রাষ্ট্রে ব্যক্তি ও বেসরকারি উদ্যোগ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
ও অন্যান্য উপলক্ষে প্রথম আলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। একেক
ক্রোড়পত্রের লেখার জন্য নির্বাচন করা হয় একেকটি থিম বা বিষয়বস্তু।
কোনোটিতে থাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা সমাজে অবদান রেখেছেন, তাঁদের কাজ
সম্পর্কে, যাতে আরও অনেকে তাঁদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। এক
ক্রোড়পত্রে বিভিন্ন সময় যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক
পদক-পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে লেখা ছিল। ফিলিপাইনের ম্যাগসাইসাই
পুরস্কার এশিয়ার নোবেল পুরস্কার বলে খ্যাত। প্রথম বাংলাদেশি, যিনি
ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত হন, তিনি তাহেরুন্নেসা আবদুল্লাহ।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তাঁর ওপর একটি লেখা ছিল। তিনি বলেছিলেন:
‘আমার মতো অজানা-অচেনা একটি মেয়ে ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেল, তা অনেকেই সহজভাবে নিতে পারেনি। ফলে একসময় কাজ করার পরিবেশটি হারিয়ে যায়। তাই অনেক কিছু করার পরিকল্পনা ছিল, তা করতে পারিনি। কুমিল্লা একাডেমির কাজ থেকেই ইস্তফা নিতে হয়।’
আজ উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে নারী রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। ৫০ বছর আগে তা সম্ভব ছিল না। কর্মক্ষেত্রে উঁচু পদে নারীর দেখা পাওয়া ছিল বিরল দৃশ্য। তাহেরুন্নেসা ১৯৬৩ সালে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত ‘পাকিস্তান একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’-এ ভারপ্রাপ্ত ইনস্ট্রাক্টর পদে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর এর নাম হয় বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট, সংক্ষেপে বার্ড। কুমিল্লা একাডেমি নামেই বেশি পরিচিত। এটি যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত এবং যিনি এর প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর নাম আখতার হামিদ খান। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অফিসার, অসামান্য কর্মী। স্বাধীনতার পর কুমিল্লা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন তাহেরুন্নেসা। সেই ষাটের দশকে নারীশিক্ষা, বাসস্থান উন্নয়ন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া, কুটিরশিল্প গড়ে তুলে গ্রামীণ দারিদ্র্যমোচন প্রভৃতি কাজ তিনি দক্ষতার সঙ্গে করেন। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কমিউনিটি লিডারশিপ’ বিভাগে ১৯৭৮ সালে তাঁকে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি আরও এগিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সমাজের সহযোগিতা তো দূরের কথা, কোনো রকম আনুকূল্যই পাননি; বরং শিকার হয়েছেন ঈর্ষার। তারপরও তিনি বলেছেন:
‘চারপাশে অনেক হতাশা। তবে অনেক আশাও আছে। দল বেঁধে মেয়েরা কারখানায় যাচ্ছে, বড় বড় জায়গায় চাকরি করছে, মায়েদের আর সাত-আটটি সন্তানের জন্ম দিতে হচ্ছে না—এ ধরনের দৃশ্য আমি জীবিত অবস্থাতেই দেখে যেতে পারছি, তা অনেক বড় পাওয়া।’
সেই বড় প্রাপ্তির পেছনে যে দীর্ঘ যাত্রা, সেই পথ যাঁরা তৈরি করেন, তাহেরুন্নেসাও তাঁদের একজন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে তাঁর পরিবারের অনেকের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁদের পরিবার অবিভক্ত বাংলার আলোকিত ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলোর একটি। তাঁরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও উদার। তাঁর নানা খান বাহাদুর তাসাদ্দুক আহমদ ছিলেন বিশের দশকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সবচেয়ে খ্যাতিমান প্রধান শিক্ষক। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, কবি-কথাশিল্পী বুদ্ধদেব বসুর মতো তাঁর বিখ্যাত ছাত্ররা তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রশংসা সব সময় করতেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে সম্মান করতেন। তাসাদ্দুক আহমদের অন্যান্য ভাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুখ্যাত ছিলেন। তাহেরুন্নেসার স্বামী ভূতত্ত্ববিদ এস কে এম আবদুল্লাহ ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ। স্ত্রীকে অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়েছেন।
শুরুতে উদ্ধৃত মিসেস আবদুল্লাহর সোজা কথাটি আমার মনে একটি ধারণার জন্ম দেয়। তাঁর বক্তব্যটি নিয়ে চিন্তা করি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল নতুন স্বাধীন দেশ। শুধু সরকারি উদ্যোগ ও তৎপরতায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব নয়। কোনো দেশের এক-তৃতীয়াংশ কাজের বেশি সরকারের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের সরকারের আর্থিক সংগতি কম। ব্যক্তি ও বেসরকারি উদ্যোগ দরকার। বাংলাদেশ আজ যে আর্থসামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার পেছনে বহু ব্যক্তি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবদানই বারো আনা।
আমাদের বাঙালি সমাজ, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজ কোনো শক্ত দার্শনিক ও নৈতিক আদর্শিক পাটাতনের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। না ধর্মীয়, না ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ সমাজের চালিকাশক্তি। এ সমাজে অতীতে উঁচু আদর্শবান ও নীতিমান মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নির্মাণ করেছিলেন—সমাজ নয়। যে সমাজের দার্শনিক ভিত্তি দুর্বল, সেখানে প্রতিষ্ঠিত কোনো রাষ্ট্রে উন্নত রাজনৈতিক আদর্শ থাকতে পারে না। তবে কিছু কিছু আদর্শ সব সমাজেই স্বীকৃত। তার মধ্যে সত্য, প্রেম, ন্যায়বিচার প্রভৃতি রয়েছে। সত্য হলো নিরপেক্ষ সত্য ইমপারশিয়াল ট্রুথ; এবং প্রেমও নর-নারীর দেহঘনিষ্ঠ প্রেম নয়—মানুষে মানুষের প্রেম। সে প্রেম অনেক বড় প্রেম। মানবপ্রেম। আমাদের সমাজে যে হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, তা দার্শনিক ভিত্তি না থাকারই ফল। সে জন্য বহু রক্তে অর্জিত রাষ্ট্রকেও মানবিক করা সম্ভব হয়নি।
সমাজে উঁচু দার্শনিক চিন্তা ও নৈতিকতার অতি বড় ব্যাপার। রাষ্ট্রে গঠনমূলক কাজে যত বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন, তত সমাজ দ্রুত এগিয়ে যায়। উপমহাদেশের দুই বড় মনীষী রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধী রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি সন্দেহের চোখে দেখেছেন। তাঁরা ব্যক্তির সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কাজের ওপর জোর দিয়েছেন। তরুণদের অনেকেই মনে করেন একটা বিপ্লবই সব সমস্যার সমাধান। বস্তুত তা ঠিক নয়। তবে প্রগতিশীল নেতৃত্বে বড় ধাক্কায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
একবার শান্তিনিকেতনে সাবেক বিপ্লববাদী এবং পরে গান্ধীবাদী ও রবীন্দ্রপ্রেমিক পান্নালাল দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেলাল মোহাম্মদ ও আমি গিয়েছিলাম দেখা করতে। দাশগুপ্ত অতি খাঁটি মানুষ। আশির ওপরে বয়স তখন। তিনি বোলপুর অঞ্চলের গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধানে অনশন করছিলেন তাঁর বন্ধুর গুরুপল্লির বাড়িতে। একবার স্বাধীনতার পরেও তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। তাঁর একটি কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। গান্ধীবাদী দাশগুপ্ত বলতেন, রাষ্ট্রের ওপর সব ব্যাপারে নির্ভর করা যায় না। তা কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—যা-ই হোক না কেন! বিকল্প কৃষিব্যবস্থা, বিকল্প শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা করতে হবে। আমার মনে হয়েছে, তা করতে হলে সমাজেরও পূর্ণ আনুকূল্য ও সহযোগিতা দরকার। ঈর্ষাবশত যেকোনো বেসরকারি ও বিকল্প উদ্যোগ থামিয়ে দিলে সামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
গত সপ্তাহে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য ড. বালচন্দ্র মুঙ্গেকার ঢাকায় এসেছিলেন এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে। তিনি ভারতের সংবিধানপ্রণেতা বি আর আম্বেদকরের অনুসারী এবং গান্ধীবাদীও। গান্ধীজিকে নিয়ে কাজও করছেন। তাঁর বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনে আলোচনা করতে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। প্রফেসর মুঙ্গেকার আগে ছিলেন মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পরে সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজের চেয়ারম্যান। তিনি রাষ্ট্রপতি মনোনীত পার্লামেন্টের মেম্বার। আম্বেদকর নিয়েও তাঁর সঙ্গে কথা হলো। আম্বেদকর বলেছেন, শুধু আইনের দ্বারা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সমাজের ভেতরের চেতনা জাগ্রত থাকতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হয় অতি অল্পসংখ্যক সচেতন ও সংক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে। একটি ভালো রাষ্ট্র তা-ই, যা ওই সংক্ষুব্ধ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের উদারভাবে সহ্য করে এবং তাঁদের উন্নত আদর্শ ও চিন্তা মেনে নেয়। মানুষের কল্যাণে অল্প কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষের আন্দোলনকে বিকশিত হতে দেওয়া উচিত। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা ক্ষতিকর। যেকোনো উন্নত চিন্তাকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত। সে চিন্তা বা মত যদি আপাতত সরকার বা রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তবু।
সরকার তার প্রশাসনযন্ত্র দিয়ে যে কাজ করে, তা নাগরিকদের প্রত্যাশার তুলনায় অতি অল্প। আধুনিক শিল্পকারখানা থেকেও মানুষের প্রত্যাশা খুব বেশি। কিন্তু শিল্পকারখানারও চাকরি দেওয়া বা কর্মসংস্থান করার ক্ষমতা সীমাহীন নয়। নতুন ডিগ্রিপ্রাপ্তরা চাকরির সন্ধানে সরকার ও শিল্পমালিকদের কাছে ছুটছেন, কিন্তু তাঁদের একটি বড় অংশের আশা পূরণ হচ্ছে না। ফলে, যুবসমাজের একটি অংশের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। সেই হতাশাকে নানাভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে উগ্রবাদীরা। জঙ্গিগোষ্ঠী পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব। যাদের সৎ পথে উপার্জনের পথ বন্ধ, তারা সমাজবিরোধী কাজে যেতে পারে। সে জন্য বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাবলম্বী হওয়ার উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করা জরুরি।
বেকারত্ব ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে যুবসমাজে সন্ত্রাসী প্রবণতা দেখা দেয়। তারা সংগতভাবেই একটি পরিবর্তন চায়। আজ গ্রামীণ জীবনে শান্তি নেই, শহরেও অশান্তি। ফলে, গোটা সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অনাচারেই মানুষ অতিষ্ঠ। বর্তমান ব্যবস্থায় সে রকম শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, যাতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা নিয়ে গ্রামেও জীবিকা উপার্জন করতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থাকে সমাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি, যে কথা রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী বলেছেন। ছেলেমেয়েদের হাতে একটা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিলেই আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। এখন ডিগ্রির সার্টিফিকেটের একটি কাগজের চোতা পনেরো আনা শিক্ষার্থীরই কাজে লাগছে না। যুগের ও সমাজের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া উগ্রবাদী প্রবণতার মোকাবিলা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের অতিরিক্ত কর্তৃত্ব একটি অস্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ই তার বিরোধিতা করেছেন। সমাজের ওপর রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী আচরণ ও নিপীড়ন নাগরিকদের সৃষ্টিশীলতাকে দুর্বল করে। একটি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীলতাও মানুষকে স্বাবলম্বী হতে দেয় না। দাতাদের অর্থনির্ভর এনজিও সমাজের সমবায়ী ও স্বেচ্ছাশ্রমের তৎপরতাকেও খর্ব করে। দলীয় রাজনীতির অন্ধ আনুগত্য মানুষের ন্যায়বিচারের প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে। এবং মানবিক সহানুভূতি, সহযোগিতা ও গঠনমূলক কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ নষ্ট করে দেয়। সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ব্যক্তির উদ্যোগকে উৎসাহিত করা এবং গঠনমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত না করে বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
‘আমার মতো অজানা-অচেনা একটি মেয়ে ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেল, তা অনেকেই সহজভাবে নিতে পারেনি। ফলে একসময় কাজ করার পরিবেশটি হারিয়ে যায়। তাই অনেক কিছু করার পরিকল্পনা ছিল, তা করতে পারিনি। কুমিল্লা একাডেমির কাজ থেকেই ইস্তফা নিতে হয়।’
আজ উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে নারী রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। ৫০ বছর আগে তা সম্ভব ছিল না। কর্মক্ষেত্রে উঁচু পদে নারীর দেখা পাওয়া ছিল বিরল দৃশ্য। তাহেরুন্নেসা ১৯৬৩ সালে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত ‘পাকিস্তান একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’-এ ভারপ্রাপ্ত ইনস্ট্রাক্টর পদে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর এর নাম হয় বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট, সংক্ষেপে বার্ড। কুমিল্লা একাডেমি নামেই বেশি পরিচিত। এটি যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত এবং যিনি এর প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর নাম আখতার হামিদ খান। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অফিসার, অসামান্য কর্মী। স্বাধীনতার পর কুমিল্লা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন তাহেরুন্নেসা। সেই ষাটের দশকে নারীশিক্ষা, বাসস্থান উন্নয়ন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া, কুটিরশিল্প গড়ে তুলে গ্রামীণ দারিদ্র্যমোচন প্রভৃতি কাজ তিনি দক্ষতার সঙ্গে করেন। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কমিউনিটি লিডারশিপ’ বিভাগে ১৯৭৮ সালে তাঁকে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি আরও এগিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সমাজের সহযোগিতা তো দূরের কথা, কোনো রকম আনুকূল্যই পাননি; বরং শিকার হয়েছেন ঈর্ষার। তারপরও তিনি বলেছেন:
‘চারপাশে অনেক হতাশা। তবে অনেক আশাও আছে। দল বেঁধে মেয়েরা কারখানায় যাচ্ছে, বড় বড় জায়গায় চাকরি করছে, মায়েদের আর সাত-আটটি সন্তানের জন্ম দিতে হচ্ছে না—এ ধরনের দৃশ্য আমি জীবিত অবস্থাতেই দেখে যেতে পারছি, তা অনেক বড় পাওয়া।’
সেই বড় প্রাপ্তির পেছনে যে দীর্ঘ যাত্রা, সেই পথ যাঁরা তৈরি করেন, তাহেরুন্নেসাও তাঁদের একজন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে তাঁর পরিবারের অনেকের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁদের পরিবার অবিভক্ত বাংলার আলোকিত ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলোর একটি। তাঁরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও উদার। তাঁর নানা খান বাহাদুর তাসাদ্দুক আহমদ ছিলেন বিশের দশকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সবচেয়ে খ্যাতিমান প্রধান শিক্ষক। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, কবি-কথাশিল্পী বুদ্ধদেব বসুর মতো তাঁর বিখ্যাত ছাত্ররা তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রশংসা সব সময় করতেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে সম্মান করতেন। তাসাদ্দুক আহমদের অন্যান্য ভাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুখ্যাত ছিলেন। তাহেরুন্নেসার স্বামী ভূতত্ত্ববিদ এস কে এম আবদুল্লাহ ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ। স্ত্রীকে অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়েছেন।
শুরুতে উদ্ধৃত মিসেস আবদুল্লাহর সোজা কথাটি আমার মনে একটি ধারণার জন্ম দেয়। তাঁর বক্তব্যটি নিয়ে চিন্তা করি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল নতুন স্বাধীন দেশ। শুধু সরকারি উদ্যোগ ও তৎপরতায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব নয়। কোনো দেশের এক-তৃতীয়াংশ কাজের বেশি সরকারের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের সরকারের আর্থিক সংগতি কম। ব্যক্তি ও বেসরকারি উদ্যোগ দরকার। বাংলাদেশ আজ যে আর্থসামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার পেছনে বহু ব্যক্তি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবদানই বারো আনা।
আমাদের বাঙালি সমাজ, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজ কোনো শক্ত দার্শনিক ও নৈতিক আদর্শিক পাটাতনের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। না ধর্মীয়, না ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ সমাজের চালিকাশক্তি। এ সমাজে অতীতে উঁচু আদর্শবান ও নীতিমান মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নির্মাণ করেছিলেন—সমাজ নয়। যে সমাজের দার্শনিক ভিত্তি দুর্বল, সেখানে প্রতিষ্ঠিত কোনো রাষ্ট্রে উন্নত রাজনৈতিক আদর্শ থাকতে পারে না। তবে কিছু কিছু আদর্শ সব সমাজেই স্বীকৃত। তার মধ্যে সত্য, প্রেম, ন্যায়বিচার প্রভৃতি রয়েছে। সত্য হলো নিরপেক্ষ সত্য ইমপারশিয়াল ট্রুথ; এবং প্রেমও নর-নারীর দেহঘনিষ্ঠ প্রেম নয়—মানুষে মানুষের প্রেম। সে প্রেম অনেক বড় প্রেম। মানবপ্রেম। আমাদের সমাজে যে হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, তা দার্শনিক ভিত্তি না থাকারই ফল। সে জন্য বহু রক্তে অর্জিত রাষ্ট্রকেও মানবিক করা সম্ভব হয়নি।
সমাজে উঁচু দার্শনিক চিন্তা ও নৈতিকতার অতি বড় ব্যাপার। রাষ্ট্রে গঠনমূলক কাজে যত বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন, তত সমাজ দ্রুত এগিয়ে যায়। উপমহাদেশের দুই বড় মনীষী রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধী রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি সন্দেহের চোখে দেখেছেন। তাঁরা ব্যক্তির সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কাজের ওপর জোর দিয়েছেন। তরুণদের অনেকেই মনে করেন একটা বিপ্লবই সব সমস্যার সমাধান। বস্তুত তা ঠিক নয়। তবে প্রগতিশীল নেতৃত্বে বড় ধাক্কায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
একবার শান্তিনিকেতনে সাবেক বিপ্লববাদী এবং পরে গান্ধীবাদী ও রবীন্দ্রপ্রেমিক পান্নালাল দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেলাল মোহাম্মদ ও আমি গিয়েছিলাম দেখা করতে। দাশগুপ্ত অতি খাঁটি মানুষ। আশির ওপরে বয়স তখন। তিনি বোলপুর অঞ্চলের গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধানে অনশন করছিলেন তাঁর বন্ধুর গুরুপল্লির বাড়িতে। একবার স্বাধীনতার পরেও তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। তাঁর একটি কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। গান্ধীবাদী দাশগুপ্ত বলতেন, রাষ্ট্রের ওপর সব ব্যাপারে নির্ভর করা যায় না। তা কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—যা-ই হোক না কেন! বিকল্প কৃষিব্যবস্থা, বিকল্প শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা করতে হবে। আমার মনে হয়েছে, তা করতে হলে সমাজেরও পূর্ণ আনুকূল্য ও সহযোগিতা দরকার। ঈর্ষাবশত যেকোনো বেসরকারি ও বিকল্প উদ্যোগ থামিয়ে দিলে সামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
গত সপ্তাহে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য ড. বালচন্দ্র মুঙ্গেকার ঢাকায় এসেছিলেন এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে। তিনি ভারতের সংবিধানপ্রণেতা বি আর আম্বেদকরের অনুসারী এবং গান্ধীবাদীও। গান্ধীজিকে নিয়ে কাজও করছেন। তাঁর বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনে আলোচনা করতে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। প্রফেসর মুঙ্গেকার আগে ছিলেন মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পরে সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজের চেয়ারম্যান। তিনি রাষ্ট্রপতি মনোনীত পার্লামেন্টের মেম্বার। আম্বেদকর নিয়েও তাঁর সঙ্গে কথা হলো। আম্বেদকর বলেছেন, শুধু আইনের দ্বারা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সমাজের ভেতরের চেতনা জাগ্রত থাকতে হবে।
সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হয় অতি অল্পসংখ্যক সচেতন ও সংক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে। একটি ভালো রাষ্ট্র তা-ই, যা ওই সংক্ষুব্ধ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের উদারভাবে সহ্য করে এবং তাঁদের উন্নত আদর্শ ও চিন্তা মেনে নেয়। মানুষের কল্যাণে অল্প কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষের আন্দোলনকে বিকশিত হতে দেওয়া উচিত। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা ক্ষতিকর। যেকোনো উন্নত চিন্তাকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত। সে চিন্তা বা মত যদি আপাতত সরকার বা রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তবু।
সরকার তার প্রশাসনযন্ত্র দিয়ে যে কাজ করে, তা নাগরিকদের প্রত্যাশার তুলনায় অতি অল্প। আধুনিক শিল্পকারখানা থেকেও মানুষের প্রত্যাশা খুব বেশি। কিন্তু শিল্পকারখানারও চাকরি দেওয়া বা কর্মসংস্থান করার ক্ষমতা সীমাহীন নয়। নতুন ডিগ্রিপ্রাপ্তরা চাকরির সন্ধানে সরকার ও শিল্পমালিকদের কাছে ছুটছেন, কিন্তু তাঁদের একটি বড় অংশের আশা পূরণ হচ্ছে না। ফলে, যুবসমাজের একটি অংশের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। সেই হতাশাকে নানাভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে উগ্রবাদীরা। জঙ্গিগোষ্ঠী পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব। যাদের সৎ পথে উপার্জনের পথ বন্ধ, তারা সমাজবিরোধী কাজে যেতে পারে। সে জন্য বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাবলম্বী হওয়ার উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করা জরুরি।
বেকারত্ব ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে যুবসমাজে সন্ত্রাসী প্রবণতা দেখা দেয়। তারা সংগতভাবেই একটি পরিবর্তন চায়। আজ গ্রামীণ জীবনে শান্তি নেই, শহরেও অশান্তি। ফলে, গোটা সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অনাচারেই মানুষ অতিষ্ঠ। বর্তমান ব্যবস্থায় সে রকম শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, যাতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা নিয়ে গ্রামেও জীবিকা উপার্জন করতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থাকে সমাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি, যে কথা রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী বলেছেন। ছেলেমেয়েদের হাতে একটা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিলেই আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। এখন ডিগ্রির সার্টিফিকেটের একটি কাগজের চোতা পনেরো আনা শিক্ষার্থীরই কাজে লাগছে না। যুগের ও সমাজের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া উগ্রবাদী প্রবণতার মোকাবিলা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের অতিরিক্ত কর্তৃত্ব একটি অস্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ই তার বিরোধিতা করেছেন। সমাজের ওপর রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী আচরণ ও নিপীড়ন নাগরিকদের সৃষ্টিশীলতাকে দুর্বল করে। একটি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীলতাও মানুষকে স্বাবলম্বী হতে দেয় না। দাতাদের অর্থনির্ভর এনজিও সমাজের সমবায়ী ও স্বেচ্ছাশ্রমের তৎপরতাকেও খর্ব করে। দলীয় রাজনীতির অন্ধ আনুগত্য মানুষের ন্যায়বিচারের প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করে। এবং মানবিক সহানুভূতি, সহযোগিতা ও গঠনমূলক কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ নষ্ট করে দেয়। সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ব্যক্তির উদ্যোগকে উৎসাহিত করা এবং গঠনমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত না করে বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments