টিআইবির নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ ও বাস্তবতা by আলী ইমাম মজুমদার
জাতীয়
সংসদকে ‘পুতুলনাচের নাট্যশালা’ উল্লেখ করে ‘বিরূপ ও অবমাননাকর’ মন্তব্য
করার অভিযোগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নামক
প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক
মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। স্থায়ী কমিটির সভাপতির মতে, এ
বক্তব্য অশালীন। তদুপরি তিনি এ–ও বলেছেন, ক্ষমা চাওয়ার জন্য টিআইবিকে তিন
দিনের সময় দেওয়া হলেও তারা তা করেনি। তারা সংসদকে জনগণের কাছে হেয়প্রতিপন্ন
করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
টিআইবি বাংলাদেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে একটি সুপরিচিত নাম। তারা মূলত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ করে। দুর্নীতির সঙ্গে সুশাসন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম নিয়ে তারা গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রধানত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রম তাদের গবেষণার আওতায় আসে। তবে এর বাইরেও রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ বিচার বিভাগ ও সংসদ নিয়েও মাঝেমধ্যে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিদেশি অনুদাননির্ভর এবং বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক স্বীকৃত। প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশিত তথ্যমতে, এটি বেসরকারি, নির্দলীয় ও অমুনাফাভিত্তিক একটি সংগঠন। বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতি, ব্যবসা, সুশীল সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালানো তাদের রূপকল্প। আর অভিলক্ষ্য হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ এবং আইনকানুন সংস্কার করে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা, রাজনীতি ও ব্যবসাক্ষেত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করা। এ রূপকল্প সামনে রেখে অভিলক্ষ্য অর্জনের কিছু প্রচেষ্টাও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। টিআইবি এনজিওবিষয়ক ব্যুরো কর্তৃক নিবন্ধিত। নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ তাদের বাজেট অনুমোদন করে এবং কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না, তা–ও দেখে থাকে। নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতাও তাদের।
টিআইবির গত কয়েক বছরে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা একইভাবে সমাদৃত হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তবে এগুলোতে সমাজে চলমান দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও সুশাসনের ঘাটতির দিকটি খণ্ডিতভাবে হলেও উঠে আসছে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ক্ষেত্রবিশেষে তথ্যের ঘাটতি থাকতে পারে। এতে প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্কও হয়। এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের একটি সক্রিয় প্রতিষ্ঠান থাকার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা যায় না। প্রতিবেদন বিভিন্ন সময়ে এসেছে পুলিশ, ভূমি, বিচার বিভাগসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে। এটা যাদের বিরুদ্ধে যায়, তারা স্বাভাবিকভাবে খুশি হওয়ার কথা নয়। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ তথ্যের জন্যও টিআইবি সমালোচিত হয়েছে। প্রতিবেদন যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে, তেমনি প্রতিবেদন নিয়েও সমালোচনা হয়। এ রকম পাল্টাপাল্টি সমালোচনা এক দিকে সমাজকে সচেতন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ লাভে সহায়তা আর টিআইবিকেও সমৃদ্ধ করতে পারে। তা হচ্ছেও। তবে এর নিবন্ধন বাতিলের মতো সুপারিশ কোনো গুরুত্বপূর্ণ মহল থেকে এর আগে আসেনি।
‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামক প্রতিবেদনটি তারা প্রায় নিয়মিতই প্রকাশ করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সর্বশেষ প্রতিবেদনটি দশম জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের ওপর দ্বিতীয়। প্রকাশিত হয় চলতি ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর। প্রতিবেদনের সূচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংসদকে মৌলিক স্তম্ভের একটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন, সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সংসদের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ বলেও এতে উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবেদনে সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের উপস্থিতি, কোরাম-সংকট, বিভিন্ন বিষয়ে কতটা সময় ব্যয় হয়, কমিটিগুলোর কার্যক্রম, বিরোধী দলের ভূমিকাসহ অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্য নেওয়া হয়েছে সংসদের কার্যবিবরণী, সংসদ অধিবেশন পর্যবেক্ষণসহ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরাদি থেকে।
প্রতিবেদনে ইতিবাচক তথ্যও বেশ কিছু এসেছে। সংসদের অধিবেশনে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ৬৮ শতাংশ আর ৪২ শতাংশ সাংসদ ৭৫ শতাংশের অধিক কার্যদিবসে সংসদে উপস্থিত থাকেন। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। আর মোট সময়ের ৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় আইন প্রণয়নে। এটাকে হতাশাজনক বললে অসত্য হবে না। বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা–ও অবাস্তব বলার সুযোগ নেই। সংসদের বিরোধী দলটির তিনজন সদস্য মন্ত্রিসভায় আছেন। দলের সভাপতি মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। আর যে কজন আছেন, তাঁরা মাঝেমধ্যে কিছু সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন না, এমন নয়। তবে তা অত্যন্ত ক্ষীণকণ্ঠে। সরকারের সবকিছুতেই বিরোধী দল বিরোধিতা করবে এমনটা নয়। তবে দেশের শাসনব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতে তারা সচেষ্ট বা সফল হয়েছে এমন মনে হয় না। অবশ্য এর আগে চারটি সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলেও তারা সংসদীয় ভূমিকা পালন করেছে খুব কম। সংসদ বর্জন করেছে দিনের পর দিন। এখন কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে এমনটাই ধরে নেওয়া যায়।
সংসদে অনুষ্ঠিত বিতর্কের দিকে টিআইবিও দৃষ্টি দিতে পারে। আর সংসদের জন্য টিআইবিকে বার্তাবাহক হিসেবে ধরে নেওয়া সংগত। বার্তায় পরিবেশিত ভাষার কিছু অংশ সম্পর্কে আপত্তি থাকলেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বার্তাগুলোর ওপর একানব্বইয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর কিছুটা সময় সংসদে বিরোধী দল উপস্থিত থাকলেও পরের সংসদগুলোতে তারা অনুপস্থিত থেকেছে যতটা সম্ভব। সদস্য পদ ধরে রাখতে একসময় এসে আবার কোনো অজুহাতে চলে গেছেন। সেই সংসদগুলোর বিরোধী দলের সাংসদেরা সংসদীয় দায়িত্ব তেমন পালন করেছেন এমনটাও নয়। আর এখন বিরোধী দল সংসদে থাকে বটে, কিন্তু তাদের উপস্থিতি অনুভব করার মতো নয়। সংসদীয় কমিটির মাননীয় সভাপতি ১৯৭২-এর গণপরিষদে নগণ্যসংখ্যক সদস্যসংবলিত বিরোধী দলের একজন তরুণ সদস্য ছিলেন। তিনি সেই গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর কত দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, কত সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন, প্রতিটি প্রস্তাবের সপক্ষে কী ক্ষুরধার যুক্তি দিয়েছেন, তা কিন্তু আমরা ভুলিনি। আর তখন থেকেই তিনি তাঁর অবস্থান জানান দিয়েছেন সংসদীয় গণতন্ত্রে। এটার সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমান বিরোধী দল সম্পর্কে মন্তব্যগুলো কি যথার্থ নয়? তবে এ প্রতিবেদনে তাদের ভূমিকা আর সংসদের হাল অবস্থা সম্পর্কে উল্লেখিত কিছু ভাষা যথোচিত হয়নি এমনটি মনে করা অসংগত হবে না। জাতীয় সংসদের মতো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশে এ বিষয়ে যে সতর্কতা নেওয়ার আবশ্যকতা ছিল, প্রতিবেদন প্রণেতারা তা নেননি।
তবে এটা নিয়ে তো সংসদে দুই দিন ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সমালোচিত হয়েছে টিআইবি। তিরস্কারও করা হয়েছে। এভাবে বিষয়টা মিটে যেতে পারত। কিন্তু বলা হচ্ছে, কোনো এনজিও যদি রাষ্ট্র বা সংবিধান সম্পর্কে এমন কিছু বলে, তবে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল, ২০১৫–তে এ রকম বিধান সংযোজন করা হয়েছে বা হবে। মনে হয়, সংসদীয় কমিটি কোনো এনজিও কর্তৃক সংসদের কার্যক্রম নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন না বলে বিবেচনা করে। এমনটাও হওয়ার কথা নয়। এ এনজিওটি যাঁরা করেন, তাঁরা এ দেশের নাগরিক। সুশীল সমাজের অংশ। সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। সে ক্ষেত্রে জনগণের কোনো অংশ বা এককভাবে যে কেউ তাঁদের কার্যক্রমের সমালোচনা করার অধিকার রাখেন। এটা তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা। সাংসদেরা রাজনীতি করেন। তাঁরা অন্য পক্ষ কর্তৃক সমালোচিত হন নিত্য। নিজ দলেও একে অপরের সমালোচনা করেন। গণমাধ্যম তো তা করেই থাকে। টিআইবি কিছু তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সংসদকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ পাওয়ার কথা। ত্রুটি-বিচ্যুতি শোধরানো যায়। আর সেখানে পরিবেশনার ভাষায় অশোভন এমনকি তথ্যের অসংগতি থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া চলে। তবে একেবারেই রেজিস্ট্রেশন বাতিল!
এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিলে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বে সরকার। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের একটি সহায়ক শক্তিকে এভাবে কোণঠাসা করার উদ্যোগ কতটা সংগত হবে, তা নতুনভাবে ভাবা দরকার। বিএনপি সরকারের শাসনামলে টিআইবি প্রকাশিত দুর্নীতির তথ্য বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থে। সংসদের কাজের মূল্যায়ন ও সমালোচনা কোনো এনজিও করতে পারবে না—এ ধরনের ধারণা পোষণ করাও তো অসংগত। সমাজে বা রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। এগুলো যাঁরা তুলে ধরেন, তাঁদের শত্রু ভাবা তো ঠিক নয়। সংসদে অনুষ্ঠিত বিতর্কের দিকে টিআইবিও দৃষ্টি দিতে পারে। আর সংসদের জন্য টিআইবিকে বার্তাবাহক হিসেবে ধরে নেওয়া সংগত। বার্তায় পরিবেশিত ভাষার কিছু অংশ সম্পর্কে আপত্তি থাকলেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বার্তাগুলোর ওপর।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
টিআইবি বাংলাদেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে একটি সুপরিচিত নাম। তারা মূলত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ করে। দুর্নীতির সঙ্গে সুশাসন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম নিয়ে তারা গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রধানত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রম তাদের গবেষণার আওতায় আসে। তবে এর বাইরেও রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ বিচার বিভাগ ও সংসদ নিয়েও মাঝেমধ্যে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিদেশি অনুদাননির্ভর এবং বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক স্বীকৃত। প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশিত তথ্যমতে, এটি বেসরকারি, নির্দলীয় ও অমুনাফাভিত্তিক একটি সংগঠন। বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতি, ব্যবসা, সুশীল সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালানো তাদের রূপকল্প। আর অভিলক্ষ্য হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ এবং আইনকানুন সংস্কার করে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা, রাজনীতি ও ব্যবসাক্ষেত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করা। এ রূপকল্প সামনে রেখে অভিলক্ষ্য অর্জনের কিছু প্রচেষ্টাও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। টিআইবি এনজিওবিষয়ক ব্যুরো কর্তৃক নিবন্ধিত। নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ তাদের বাজেট অনুমোদন করে এবং কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না, তা–ও দেখে থাকে। নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতাও তাদের।
টিআইবির গত কয়েক বছরে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা একইভাবে সমাদৃত হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তবে এগুলোতে সমাজে চলমান দুর্নীতি, অব্যবস্থা ও সুশাসনের ঘাটতির দিকটি খণ্ডিতভাবে হলেও উঠে আসছে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ক্ষেত্রবিশেষে তথ্যের ঘাটতি থাকতে পারে। এতে প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্কও হয়। এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের একটি সক্রিয় প্রতিষ্ঠান থাকার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা যায় না। প্রতিবেদন বিভিন্ন সময়ে এসেছে পুলিশ, ভূমি, বিচার বিভাগসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে। এটা যাদের বিরুদ্ধে যায়, তারা স্বাভাবিকভাবে খুশি হওয়ার কথা নয়। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ তথ্যের জন্যও টিআইবি সমালোচিত হয়েছে। প্রতিবেদন যেমন কোনো প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে, তেমনি প্রতিবেদন নিয়েও সমালোচনা হয়। এ রকম পাল্টাপাল্টি সমালোচনা এক দিকে সমাজকে সচেতন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ লাভে সহায়তা আর টিআইবিকেও সমৃদ্ধ করতে পারে। তা হচ্ছেও। তবে এর নিবন্ধন বাতিলের মতো সুপারিশ কোনো গুরুত্বপূর্ণ মহল থেকে এর আগে আসেনি।
‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামক প্রতিবেদনটি তারা প্রায় নিয়মিতই প্রকাশ করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সর্বশেষ প্রতিবেদনটি দশম জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের ওপর দ্বিতীয়। প্রকাশিত হয় চলতি ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর। প্রতিবেদনের সূচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংসদকে মৌলিক স্তম্ভের একটি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন, সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সংসদের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ বলেও এতে উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবেদনে সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের উপস্থিতি, কোরাম-সংকট, বিভিন্ন বিষয়ে কতটা সময় ব্যয় হয়, কমিটিগুলোর কার্যক্রম, বিরোধী দলের ভূমিকাসহ অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্য নেওয়া হয়েছে সংসদের কার্যবিবরণী, সংসদ অধিবেশন পর্যবেক্ষণসহ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরাদি থেকে।
প্রতিবেদনে ইতিবাচক তথ্যও বেশ কিছু এসেছে। সংসদের অধিবেশনে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ৬৮ শতাংশ আর ৪২ শতাংশ সাংসদ ৭৫ শতাংশের অধিক কার্যদিবসে সংসদে উপস্থিত থাকেন। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। আর মোট সময়ের ৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় আইন প্রণয়নে। এটাকে হতাশাজনক বললে অসত্য হবে না। বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা–ও অবাস্তব বলার সুযোগ নেই। সংসদের বিরোধী দলটির তিনজন সদস্য মন্ত্রিসভায় আছেন। দলের সভাপতি মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। আর যে কজন আছেন, তাঁরা মাঝেমধ্যে কিছু সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন না, এমন নয়। তবে তা অত্যন্ত ক্ষীণকণ্ঠে। সরকারের সবকিছুতেই বিরোধী দল বিরোধিতা করবে এমনটা নয়। তবে দেশের শাসনব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরতে তারা সচেষ্ট বা সফল হয়েছে এমন মনে হয় না। অবশ্য এর আগে চারটি সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলেও তারা সংসদীয় ভূমিকা পালন করেছে খুব কম। সংসদ বর্জন করেছে দিনের পর দিন। এখন কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে এমনটাই ধরে নেওয়া যায়।
সংসদে অনুষ্ঠিত বিতর্কের দিকে টিআইবিও দৃষ্টি দিতে পারে। আর সংসদের জন্য টিআইবিকে বার্তাবাহক হিসেবে ধরে নেওয়া সংগত। বার্তায় পরিবেশিত ভাষার কিছু অংশ সম্পর্কে আপত্তি থাকলেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বার্তাগুলোর ওপর একানব্বইয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর কিছুটা সময় সংসদে বিরোধী দল উপস্থিত থাকলেও পরের সংসদগুলোতে তারা অনুপস্থিত থেকেছে যতটা সম্ভব। সদস্য পদ ধরে রাখতে একসময় এসে আবার কোনো অজুহাতে চলে গেছেন। সেই সংসদগুলোর বিরোধী দলের সাংসদেরা সংসদীয় দায়িত্ব তেমন পালন করেছেন এমনটাও নয়। আর এখন বিরোধী দল সংসদে থাকে বটে, কিন্তু তাদের উপস্থিতি অনুভব করার মতো নয়। সংসদীয় কমিটির মাননীয় সভাপতি ১৯৭২-এর গণপরিষদে নগণ্যসংখ্যক সদস্যসংবলিত বিরোধী দলের একজন তরুণ সদস্য ছিলেন। তিনি সেই গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর কত দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, কত সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন, প্রতিটি প্রস্তাবের সপক্ষে কী ক্ষুরধার যুক্তি দিয়েছেন, তা কিন্তু আমরা ভুলিনি। আর তখন থেকেই তিনি তাঁর অবস্থান জানান দিয়েছেন সংসদীয় গণতন্ত্রে। এটার সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমান বিরোধী দল সম্পর্কে মন্তব্যগুলো কি যথার্থ নয়? তবে এ প্রতিবেদনে তাদের ভূমিকা আর সংসদের হাল অবস্থা সম্পর্কে উল্লেখিত কিছু ভাষা যথোচিত হয়নি এমনটি মনে করা অসংগত হবে না। জাতীয় সংসদের মতো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশে এ বিষয়ে যে সতর্কতা নেওয়ার আবশ্যকতা ছিল, প্রতিবেদন প্রণেতারা তা নেননি।
তবে এটা নিয়ে তো সংসদে দুই দিন ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সমালোচিত হয়েছে টিআইবি। তিরস্কারও করা হয়েছে। এভাবে বিষয়টা মিটে যেতে পারত। কিন্তু বলা হচ্ছে, কোনো এনজিও যদি রাষ্ট্র বা সংবিধান সম্পর্কে এমন কিছু বলে, তবে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন বিল, ২০১৫–তে এ রকম বিধান সংযোজন করা হয়েছে বা হবে। মনে হয়, সংসদীয় কমিটি কোনো এনজিও কর্তৃক সংসদের কার্যক্রম নিয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন না বলে বিবেচনা করে। এমনটাও হওয়ার কথা নয়। এ এনজিওটি যাঁরা করেন, তাঁরা এ দেশের নাগরিক। সুশীল সমাজের অংশ। সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। সে ক্ষেত্রে জনগণের কোনো অংশ বা এককভাবে যে কেউ তাঁদের কার্যক্রমের সমালোচনা করার অধিকার রাখেন। এটা তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা। সাংসদেরা রাজনীতি করেন। তাঁরা অন্য পক্ষ কর্তৃক সমালোচিত হন নিত্য। নিজ দলেও একে অপরের সমালোচনা করেন। গণমাধ্যম তো তা করেই থাকে। টিআইবি কিছু তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সংসদকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ পাওয়ার কথা। ত্রুটি-বিচ্যুতি শোধরানো যায়। আর সেখানে পরিবেশনার ভাষায় অশোভন এমনকি তথ্যের অসংগতি থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া চলে। তবে একেবারেই রেজিস্ট্রেশন বাতিল!
এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিলে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বে সরকার। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের একটি সহায়ক শক্তিকে এভাবে কোণঠাসা করার উদ্যোগ কতটা সংগত হবে, তা নতুনভাবে ভাবা দরকার। বিএনপি সরকারের শাসনামলে টিআইবি প্রকাশিত দুর্নীতির তথ্য বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থে। সংসদের কাজের মূল্যায়ন ও সমালোচনা কোনো এনজিও করতে পারবে না—এ ধরনের ধারণা পোষণ করাও তো অসংগত। সমাজে বা রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। এগুলো যাঁরা তুলে ধরেন, তাঁদের শত্রু ভাবা তো ঠিক নয়। সংসদে অনুষ্ঠিত বিতর্কের দিকে টিআইবিও দৃষ্টি দিতে পারে। আর সংসদের জন্য টিআইবিকে বার্তাবাহক হিসেবে ধরে নেওয়া সংগত। বার্তায় পরিবেশিত ভাষার কিছু অংশ সম্পর্কে আপত্তি থাকলেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বার্তাগুলোর ওপর।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments