চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় কেন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন?
উনিশ্শো
একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর, বিশেষ করে চাকমাদের ভূমিকা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।
চাকমাদের তৎকালীন রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষে, বাংলাদেশের
স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। পিয়জীত দেবসরকার: 'ত্রিদিব রায়
ছিলেন এমন একজন রাজা যিনি ব্যক্তি স্বার্থ-র জন্য তার রাজত্ব হারিয়েছেন'
কিন্তু ত্রিদিব রায়-এর সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ ছিল বা কী ধরণের
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সেই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল, সে বিষয়ে গবেষণা
খুব বেশি হয়নি। সম্প্রতি সেই কাজটি করেছেন লন্ডন-ভিত্তিক ভারতীয় রাজনৈতিক
বিশ্লেষক প্রিয়জীত দেবসরকার, যার বই ‘দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট
পাকিস্তান’ গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইতে লেখক উপমহাদেশের বিশাল
ক্যানভাসের মধ্যে চাকমাদের ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতার একটি জীবন্ত চিত্র
এঁকেছেন। সেই চিত্রে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন কীভাবে একের পর এক চাকমা রাজা
নিজেদের রাজত্ব এবং স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা
চাকমা জাতিগোষ্ঠীকে তাদের প্রতিবেশী বাঙ্গালীদের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত
করেছিল। রাজা ত্রিদিব রায়-এর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ব্যাখ্যা করার জন্যই
প্রিয়জীত দেবসরকার তার বই-এর নামে তাকে ‘পশ্চিম পাকিস্তানের শেষ রাজা’ বলে
আখ্যায়িত করেছেন। দেবসরকারের মতে, ১৯৫৩ সালে সিংহাসনে আরোহণ থেকে শুরু
করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ত্রিদিব রায় নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের এক
জাতিগোষ্ঠীর রাজা হিসেবে দেখেছেন। রাজা ত্রিদিব রায় খুব চিন্তা-ভাবনা করেই
বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাজা ত্রিদিব রায়: সিংহাসনে
আরোহণের দিন। দেবসরকারের গবেষণা মতে, ত্রিদিব রায়-এর সিদ্ধান্ত ছিল
আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক। নিজের রাজত্ব এবং স্বায়ত্তশাসন টিকিয়ে রাখতেই
ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। “উনি চাইছিলেন তার রাজত্ব
এবং রাজ পরিবারের শাসন যেন বজায় থাকে, যদিও অনেক সাধারণ চাকমা তার নীতির
বিপক্ষে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন”, দেবসরকার বলেন। বইটির ভিত্তি
হচ্ছে দালিলিক গবেষণা, অর্থাৎ প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত দলিল ছিল বইটির মৌলিক
উপাদান। গবেষণার কাজ হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে – বাংলাদেশের
রাঙ্গামাটি থেকে শুরু হয়ে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, তারপর শ্রীলংকা এবং
থাইল্যান্ড হয়ে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্স। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক
খেলার মাঠে চাকমা রাজাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে দেখেছেন
লেখক। বইটির মূল লক্ষ্য ছিল সেই বিশ্লেষণের আলোকে রাজা ত্রিদিব রায়-এর
কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা এবং ব্যাখ্যা করা। বই-এর শুরুতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে, বিশেষ করে আরাকান এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে
চাকমাদের আগমন এবং প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস। এর পরে এসেছে, দিল্লিতে মোগল
বাদশাহদের সাথে চাকমা রাজাদের সম্পর্ক এবং ব্রিটিশ শাসন শেষে পার্বত্য
চট্টগ্রামকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধীনস্থ করার সিদ্ধান্ত। পার্বত্য
চট্টগ্রামে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও এলাকাটি পাকিস্তানের সাথে
সংযুক্ত করা হয়। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ-এর এই সিদ্ধান্ত অনেককে অবাক
করলেও, তৎকালীন চাকমা রাজা নালিনক্সা রায় খুশিই হয়েছিলেন। ভারতীয়
কংগ্রেসের নীতি বেশ সোজা-সাপটা ছিল, বলছেন দেবসরকার। তারা স্বাধীন ভারতে
কোনো ধরনের স্থানীয় রাজা-রাজকুমার বা রাজকীয় ক্ষুদ্র রাজ্য বরদাশত করবে
না বলে জানিয়ে দিয়েছিল। কাজেই, চাকমা রাজার পক্ষে ভারতে যোগ দিয়ে রাজত্ব
টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হতো। “আপনি যদি একটু পেছনে যান, আপনি দেখবেন চাকমারা
ব্রিটিশ ভারতে সব সময় স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে আসছে। তাদের কিন্তু সব সময়
একটি আলাদা রাজত্ব, আলাদা পরিচয় ছিল,” দেবসরকার বলেন। রাজা ত্রিদিব রায়
মনে করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসনই পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের
স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করবে। শুরু থেকেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক
এবং বেসামরিক আমলাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। অন্যদিকে, পূর্ব
পাকিস্তানের উদীয়মান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা স্থানীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের
সাথে সম্পর্ক স্থাপনকে তিনি কম গুরুত্ব দেন। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা শেখ মুজিবের ব্যাপক বিজয়-এর পরেও তিনি তার
অবস্থান পুনর্বিবেচনা করেন নি। দেবসরকার বলছেন, ত্রিদিব রায় ১৯৭০-এর
নির্বাচনের আগে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করলে তিনি তাকে আওয়ামী লীগ-এর
প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবার অনুরোধ জানান। মুজিব ত্রিদিব রায়কে
আশ্বাস দেন, যে তার দল বিজয়ী হলে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে তিনি সহায়তা
করবেন। “কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়-এর মূল লক্ষ্য ছিল তার রাজত্বের
স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা রক্ষা করা এবং আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, সে
বিষয়ে হয়তো কোন সমস্যা ছিল”, দেবসরকার বলেন। তবে দেবসরকার মনে করছেন,
ত্রিদিব রায় ভেবেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান
নির্বাচনের ফলাফলকে কোনো না কোনো ভাবে নাকচ করে দিতে পারবেন। “উনি যেহেতু
পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাদের অনেক উন্নত
মানের বাহিনী মনে করতেন, তিনি ভেবেছিলেন যে তাদের বিরুদ্ধে বিদেশী কোন
হুমকি কাজ করবে না এবং তারা সব কিছু সামলে নিতে পারবে,” তিনি বলেন। লেখক
তার কাজ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই শেষ করে দেননি, কারণ ত্রিদিব রায়-এর
রাজনৈতিক জীবন ১৯৭১-এর পর থেমে থাকে নি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৩ সালে রাজা ত্রিদিব রায়কে দেশের প্রেসিডেন্ট হবার
প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হতে চাননি
বলে পদ গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু তারপরও, দেবসরকার তার উপসংহারে লিখছেন,
“ত্রিদিব রায় ছিলেন এমন একজন রাজা যিনি শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থ-র জন্য
তার রাজত্ব হারিয়েছেন”। চাকমাদের ৫০তম রাজা ত্রিদিব রায়-এর নাম ১৯৭২
সালের দালাল আইনে অভিযুক্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি সেই
অভিযোগ মোকাবেলা করার জন্য কখনো বাংলাদেশে ফিরে আসেননি এবং ৭৯ বছর বয়সে
২০১২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি নির্বাসনে ছিলেন। দ্য
লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান, ১৬১ পৃষ্ঠা। প্রকাশক: কুইনটাস।
No comments