মাশুল নির্ধারণে ট্রানজিটের খরচ বিবেচনায় নিতে হবে -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : মো. মজিবুর রহমান by এ কে এম জাকারিয়া
মো. মজিবুর রহমান |
প্রশাসন
ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা ড. মজিবুর রহমান ২০০৯ সালের
জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের
চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালে সরকার ট্রানজিট বিষয়ে একটি
কোর কমিটি গঠন করলে তিনি এর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটির পক্ষ
থেকে সমন্বিত ট্রানজিটের জন্য ১৫ ধরনের মাশুল আরোপের সুপারিশসহ ট্রানজিট
কার্যকর করতে বিভিন্ন প্রস্তাব রেখেছিলেন। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে
কথা বলেছেন ট্রানজিটের নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো : আপনি একসময় ট্রানজিট নিয়ে গঠিত সরকারের কোর কমিটির প্রধান ছিলেন। সেই কমিটির পক্ষ থেকে ট্রানজিটের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার সঙ্গে গত সোমবার ভারতের জন্য চূড়ান্ত হওয়া নৌ–ট্রানজিট মাশুলের মিল নেই। সরকার কোন বিবেচনায় আপনাদের প্রস্তাবের চেয়ে কম ট্রানজিট মাশুল নির্ধারণ করেছে বলে মনে করেন?
মজিবুর রহমান : সরকার কী বিবেচনা থেকে করেছে, তা বলা কঠিন। তবে আমরা যে শুল্ক প্রস্তাব করেছিলাম, তা বেশি ছিল। ট্রানজিটের শুল্কের বিষয়টি পরিবর্তন হতে পারে। এখানে বিবেচনায় নেওয়ার অনেক বিষয় থাকে। ট্রানজিট শুল্ক নির্ধারণের জন্য নিজেদের খরচের খাতগুলো নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী খরচ ওঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই শুল্ক নির্ধারণের জন্য সরকার কোন কোন খরচকে বিবেচনায় নিয়েছে, সেটাই হচ্ছে আসল বিষয়।
প্রথম আলো : কোর কমিটির পক্ষ থেকে আপনারা কী কী বিষয় বিবেচনায় নিয়েছিলেন?
মজিবুর রহমান : আমরা শুল্ক হার নির্ধারণ ও সুপারিশ করার ক্ষেত্রে সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছি। যেমন নৌ–ট্রানজিটের ক্ষেত্রে নৌপথের নাব্যতা থেকে শুরু করে বন্দর সুবিধা, প্রশাসনিক খরচ ও নৌযানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার খরচসহ এ ধরনের বিষয়গুলো। আমাদের খরচের হিসাবের মধ্যে ট্রানজিট-সংক্রান্ত সব অবকাঠামো নির্মাণ ও এর ব্যবস্থাপনা খরচও রয়েছে। নৌ চলাচলে পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, তার একটি আর্থিক দিক রয়েছে। ট্রানজিটের নৌযানের কারণে বালু সরে গিয়ে নদীর পাড়ের মানুষের যে ক্ষতির আশঙ্কা, মাছের ক্ষতি বা শব্দদূষণ—এগুলোও বিবেচনায় নিয়েছি। এগুলো সবই কস্ট অব ট্রানজিট। মাশুল নির্ধারণে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো : তাহলে বলা যায় ট্রানজিটের খরচ বা কস্ট অব ট্রানজিটের অনেক দিক বিবেচনায় না নিয়েই বর্তমান শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে?
মজিবুর রহমান : দেখুন, নৌ–ট্রানজিটের শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে অথচ নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ হয়নি। আমার মনে হয়, বর্তমানে যে শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অস্থায়ী ভিত্তিতে হয়েছে। আমি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। একসময় তো এমন কথাও আমরা শুনেছি যে ট্রানজিটের জন্য আবার পয়সা নিতে হবে কেন! এখন অন্তত নীতিগতভাবে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে যে ট্রানজিটের খরচ রয়েছে এবং এ জন্য শুল্ক নিতে হবে এবং কী কী ক্ষেত্রে তা নিতে হবে ও কীভাবে নিতে হবে, সেটা মেনেই তা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিশ্চয়ই টেকনিক্যাল কমিটি হবে। তারা যখন দেখবে যে নদীতে নাব্যতা নেই, ড্রেজিং করতে হবে, তখন এসব খরচ বিবেচনার মধ্যে আসবে এবং সে কারণে শুল্ক বাড়বে কি না, তা ঠিক করা হবে।
প্রথম আলো : ট্রানজিট শুল্ক কি নির্ধারিত হয় শুধু খরচ বিবেচনা করে। এখানে মার্জিন রাখার সুযোগ নেই?
মজিবুর রহমান : আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ মার্জিন রাখা যায়। তবে সেই অর্থ ব্যয় করতে হবে ট্রানজিট ব্যবস্থা ও এর অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে। এর বাইরে এই অর্থ ব্যবহার করার সুযোগ নেই। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এটা হতে হবে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করায় ভারতের অনেক সময় বাঁচবে ও পরিবহন খরচ কমবে। যদি ধরে নিই যে এক ট্রাক পণ্য পরিবহনে ভারতের আগের তুলনায় ১০০ টাকা সাশ্রয় হলো। এই টাকার একটা অংশ বাংলাদেশ দাবি করতে পারে না?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধানে এ ধরনের তেমন কিছু পরিষ্কারভাবে নেই। দুই দেশ নিজেদের মধ্যে এ ধরনের কিছু করতে পারে। তবে এটা নির্ভর করে দুটি দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার ওপর।
প্রথম আলো : বর্তমান নৌ–ট্রানজিটের শুল্ক নির্ধারণ, এই প্রক্রিয়াকে আপনি অস্থায়ী উদ্যোগ বলেছেন। স্থায়ী বা পূর্ণাঙ্গ উদ্যোগের বিষয়টি তবে কীভাবে শুরু হবে?
মজিবুর রহমান : দেখুন, নৌ–ট্রানজিট আগে থেকেই কার্যকর। এখন সেটাকে একটা কার্যকর ট্রানজিট প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হচ্ছে। ট্রানজিটের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় এখন বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এটা একটা বড় অগ্রগতি। সরকার ট্রানজিটের বিষয়াদি নিয়ে কোর কমিটি গঠন করেছিল। এখন এ নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে সেখানে কিন্তু এই রিপোর্টের নানা দিক বিবেচনায় নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। আগেই বলেছি যে আমরা যে প্রতিবেদন তৈরি করেছি, তা হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট ব্যবস্থার সুপারিশ। এখন যেভাবে শুরু হচ্ছে সেটা আস্তে আস্তে সেদিকে যেতে পারে।
প্রথম আলো : একটি সামগ্রিক ট্রানজিট ব্যবস্থা শুরুর ক্ষেত্রে কী কী বিষয় এখন বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিটের সঙ্গে অনেক বিষয় ও অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। আমরা চেয়েছি যে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি ন্যাশনাল কাউন্সিল বা কমিটি ধরনের কিছু একটা করা। বাণিজ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, রেল, সড়ক—এসব মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে এনবিআর বা এফবিসিসিআই সবাই থাকবে। ট্রানজিটের কাজ শুরু করার জন্য এ ধরনের একটি কাঠামো জরুরি। কারণ, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট প্রক্রিয়া শুরু করতে গেলে অসংখ্য বিষয় বিবেচনায় নেওয়া ও বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। যদি নৌ–ট্রানজিটের বিষয়টিই বলি, এর নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। চোরাচালান কীভাবে ঠেকানো হবে, এটাও তো ঠিক করতে হবে। ট্রানজিটের একটি ট্রাকের নিচে যদি বাংলাদেশের কেউ চাপা পড়ে মারা যায়, তবে কীভাবে তার সুরাহা হবে, ক্ষতিপূরণের ব্যাপার বা বিমার দিকটি কীভাবে হবে—এসব অসংখ্য খুঁটিনাটি দিক রয়েছে। একটি জাতীয় কমিটি গঠনের পাশাপাশি এর অধীনে সচিব কমিটি, বিশেষজ্ঞ কমিটি ও টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা দরকার। আর ট্রানজিটের যে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, তা শুধু ভারতের ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে নেপাল ও ভুটানও রয়েছে। সবগুলো দেশ মিলিয়ে ট্রানজিট কার্যকর করার জন্য দরকার পড়বে রিজিওনাল ট্রানজিট সচিবালয়। ট্রানজিটে অন্তর্ভুক্ত সদস্যদেশগুলো নিয়ে এই সচিবালয় হবে। সদস্যদেশগুলো এই সচিবালয়ের খরচ বহন করবে।
প্রথম আলো : আপনাদের কোর কমিটির পক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে ট্রানজিট দিতে হলে বাংলাদেশকে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে হবে অন্তত ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এত অর্থ কোথা থেকে মিলবে?
মজিবুর রহমান : নানাভাবেই এই অর্থ জোগাড় করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া যেতে পারে। যেসব দেশ ট্রানজিটের সুবিধা ভোগ করবে, তারা বিনিয়োগ করতে পারে। তা ছাড়া, ট্রানজিটের জন্য তৈরি হওয়া সড়ক ও রেলপথ দেশের অভ্যন্তরীণ কাজেও লাগবে। ফলে কিছু এ ধরনের কাজ নিজেদের অর্থায়নেও হতে পারে। তবে এগুলো এমনভাবে করতে হবে যাতে ট্রানজিটের যানবাহন থেকে অর্থ নিয়ে পুরো খরচ তুলে ফেলা যায়।
প্রথম আলো : নৌ–ট্রানজিটের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে যান চলাচল চুক্তি বা কার্যত সড়কপথে ট্রানজিটের মাশুলের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এ ধরনের ট্রানজিট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
মজিবুর রহমান : পাঁচ বছর আগে আমরা যখন এ নিয়ে কাজ করেছিলাম, তখনকার চেয়ে পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। তবে ট্রানজিটের রুটগুলো এখনো পুরো প্রস্তুত নয়। এখন অস্থায়ীভাবে ও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ট্রানজিট দেওয়া যাবে। কারণ, আমাদের রাস্তা দিয়ে ৪০ ফুটের কনটেইনার তো এখন চলছে। কিন্তু যদি প্রতিদিন এক-দুই শ যানবাহন প্রবেশ করে, তবে আমরা তা এখন সামাল দিতে পারব না। পদ্মা সেতু তৈরি হলে ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার কাজ শেষ হলে তা সম্ভব। রেলের ক্ষেত্রে অনেক ব্রিজ ঠিক না করে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়া সম্ভব নয়। নদীর ক্ষেত্রে আশুগঞ্জ পর্যন্ত দেওয়া যাবে, এর পরে নয়। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা না হলে এটা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো : এ তো অবকাঠামোর বিষয়। প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি?
মজিবুর রহমান : ব্যবস্থাপনার জন্য যথাযথ প্রশাসনিক কাঠামোর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাস্টমসের একটি কাঠামো রয়েছে। জনবল কম থাকলে বাড়িয়ে কাজ শুরু করা যাবে। কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের হাইওয়ে পুলিশ ততটা কার্যকর নয়। ট্রানজিট যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব ধরনের চোরাচালান ও অনিয়ম ঠেকানোর কাজটিও বেশ জটিল ও কঠিন। একটি যান হয়তো নির্দিষ্ট সীমান্তে গেলই না, গাড়ির নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করে দিল বা মালামাল বিক্রি করে দিল। এসব দেখা ও মনিটর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও লোকবলের দরকার হবে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ কীভাবে বা কোথা থেকে এই কাজটি শুরু করতে পারে?
মজিবুর রহমান : প্রথমে নৌ–ট্রানজিটকে কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গভাবে শুরুর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। ফলে সহজেই আমরা ভুটানে পণ্য পরিবহন করতে পারব। ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই এই ড্রেজিংয়ের কাজ করা সম্ভব। আর স্থলপথে ট্রানজিটের জন্য বহুপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর রেল ও সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আগেই বলেছি, ট্রানজিটের নানা দিক দেখাশোনার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। এই বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞ বা জানাশোনা লোকজন তেমন নেই। ফলে যাঁরা আছেন, তাঁদের যদি জড়ো করা যায়, তবে তা কাজে দেবে। এই যে ট্রানজিট মাশুলের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের আসল সমস্যা হচ্ছে অজ্ঞতা। আমরা যদি জেনেশুনে ছাড় দিয়ে থাকি, তাতেআপত্তি নেই।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কী জেনেশুনে ছাড় দিচ্ছি?
প্রথম আলো : ট্রানজিট বাংলাদেশের জন্য কী সুফল নিয়ে আসবে বলে আপনি মনে করেন?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিট শুরু হলে বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটবে। রাস্তাঘাট, রেল—এসব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাবে। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর হবে। এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করবে পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশার কিছু অংশ, ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এমনকি চীনের কুনমিং। বাংলাদেশের বন্দরের আয় বাড়বে। পরিবহন ব্যবসা, হোটেল, মোটেল বা রিসোর্ট ব্যবসা বাড়বে। আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে জটিলতা কমবে। ব্যাংকিং ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়বে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। ভারত ও চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন। দেশে কর্মসংস্থান হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর বা ইউরোপ সমপর্যায়ের যেকোনো দেশে পরিণত হতে পারবে।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মজিবুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : আপনি একসময় ট্রানজিট নিয়ে গঠিত সরকারের কোর কমিটির প্রধান ছিলেন। সেই কমিটির পক্ষ থেকে ট্রানজিটের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার সঙ্গে গত সোমবার ভারতের জন্য চূড়ান্ত হওয়া নৌ–ট্রানজিট মাশুলের মিল নেই। সরকার কোন বিবেচনায় আপনাদের প্রস্তাবের চেয়ে কম ট্রানজিট মাশুল নির্ধারণ করেছে বলে মনে করেন?
মজিবুর রহমান : সরকার কী বিবেচনা থেকে করেছে, তা বলা কঠিন। তবে আমরা যে শুল্ক প্রস্তাব করেছিলাম, তা বেশি ছিল। ট্রানজিটের শুল্কের বিষয়টি পরিবর্তন হতে পারে। এখানে বিবেচনায় নেওয়ার অনেক বিষয় থাকে। ট্রানজিট শুল্ক নির্ধারণের জন্য নিজেদের খরচের খাতগুলো নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী খরচ ওঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই শুল্ক নির্ধারণের জন্য সরকার কোন কোন খরচকে বিবেচনায় নিয়েছে, সেটাই হচ্ছে আসল বিষয়।
প্রথম আলো : কোর কমিটির পক্ষ থেকে আপনারা কী কী বিষয় বিবেচনায় নিয়েছিলেন?
মজিবুর রহমান : আমরা শুল্ক হার নির্ধারণ ও সুপারিশ করার ক্ষেত্রে সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছি। যেমন নৌ–ট্রানজিটের ক্ষেত্রে নৌপথের নাব্যতা থেকে শুরু করে বন্দর সুবিধা, প্রশাসনিক খরচ ও নৌযানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার খরচসহ এ ধরনের বিষয়গুলো। আমাদের খরচের হিসাবের মধ্যে ট্রানজিট-সংক্রান্ত সব অবকাঠামো নির্মাণ ও এর ব্যবস্থাপনা খরচও রয়েছে। নৌ চলাচলে পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, তার একটি আর্থিক দিক রয়েছে। ট্রানজিটের নৌযানের কারণে বালু সরে গিয়ে নদীর পাড়ের মানুষের যে ক্ষতির আশঙ্কা, মাছের ক্ষতি বা শব্দদূষণ—এগুলোও বিবেচনায় নিয়েছি। এগুলো সবই কস্ট অব ট্রানজিট। মাশুল নির্ধারণে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো : তাহলে বলা যায় ট্রানজিটের খরচ বা কস্ট অব ট্রানজিটের অনেক দিক বিবেচনায় না নিয়েই বর্তমান শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে?
মজিবুর রহমান : দেখুন, নৌ–ট্রানজিটের শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে অথচ নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ হয়নি। আমার মনে হয়, বর্তমানে যে শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অস্থায়ী ভিত্তিতে হয়েছে। আমি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। একসময় তো এমন কথাও আমরা শুনেছি যে ট্রানজিটের জন্য আবার পয়সা নিতে হবে কেন! এখন অন্তত নীতিগতভাবে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে যে ট্রানজিটের খরচ রয়েছে এবং এ জন্য শুল্ক নিতে হবে এবং কী কী ক্ষেত্রে তা নিতে হবে ও কীভাবে নিতে হবে, সেটা মেনেই তা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিশ্চয়ই টেকনিক্যাল কমিটি হবে। তারা যখন দেখবে যে নদীতে নাব্যতা নেই, ড্রেজিং করতে হবে, তখন এসব খরচ বিবেচনার মধ্যে আসবে এবং সে কারণে শুল্ক বাড়বে কি না, তা ঠিক করা হবে।
প্রথম আলো : ট্রানজিট শুল্ক কি নির্ধারিত হয় শুধু খরচ বিবেচনা করে। এখানে মার্জিন রাখার সুযোগ নেই?
মজিবুর রহমান : আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ মার্জিন রাখা যায়। তবে সেই অর্থ ব্যয় করতে হবে ট্রানজিট ব্যবস্থা ও এর অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে। এর বাইরে এই অর্থ ব্যবহার করার সুযোগ নেই। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এটা হতে হবে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করায় ভারতের অনেক সময় বাঁচবে ও পরিবহন খরচ কমবে। যদি ধরে নিই যে এক ট্রাক পণ্য পরিবহনে ভারতের আগের তুলনায় ১০০ টাকা সাশ্রয় হলো। এই টাকার একটা অংশ বাংলাদেশ দাবি করতে পারে না?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধানে এ ধরনের তেমন কিছু পরিষ্কারভাবে নেই। দুই দেশ নিজেদের মধ্যে এ ধরনের কিছু করতে পারে। তবে এটা নির্ভর করে দুটি দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার ওপর।
প্রথম আলো : বর্তমান নৌ–ট্রানজিটের শুল্ক নির্ধারণ, এই প্রক্রিয়াকে আপনি অস্থায়ী উদ্যোগ বলেছেন। স্থায়ী বা পূর্ণাঙ্গ উদ্যোগের বিষয়টি তবে কীভাবে শুরু হবে?
মজিবুর রহমান : দেখুন, নৌ–ট্রানজিট আগে থেকেই কার্যকর। এখন সেটাকে একটা কার্যকর ট্রানজিট প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হচ্ছে। ট্রানজিটের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় এখন বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এটা একটা বড় অগ্রগতি। সরকার ট্রানজিটের বিষয়াদি নিয়ে কোর কমিটি গঠন করেছিল। এখন এ নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে সেখানে কিন্তু এই রিপোর্টের নানা দিক বিবেচনায় নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। আগেই বলেছি যে আমরা যে প্রতিবেদন তৈরি করেছি, তা হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট ব্যবস্থার সুপারিশ। এখন যেভাবে শুরু হচ্ছে সেটা আস্তে আস্তে সেদিকে যেতে পারে।
প্রথম আলো : একটি সামগ্রিক ট্রানজিট ব্যবস্থা শুরুর ক্ষেত্রে কী কী বিষয় এখন বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিটের সঙ্গে অনেক বিষয় ও অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। আমরা চেয়েছি যে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি ন্যাশনাল কাউন্সিল বা কমিটি ধরনের কিছু একটা করা। বাণিজ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, রেল, সড়ক—এসব মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে এনবিআর বা এফবিসিসিআই সবাই থাকবে। ট্রানজিটের কাজ শুরু করার জন্য এ ধরনের একটি কাঠামো জরুরি। কারণ, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট প্রক্রিয়া শুরু করতে গেলে অসংখ্য বিষয় বিবেচনায় নেওয়া ও বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। যদি নৌ–ট্রানজিটের বিষয়টিই বলি, এর নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। চোরাচালান কীভাবে ঠেকানো হবে, এটাও তো ঠিক করতে হবে। ট্রানজিটের একটি ট্রাকের নিচে যদি বাংলাদেশের কেউ চাপা পড়ে মারা যায়, তবে কীভাবে তার সুরাহা হবে, ক্ষতিপূরণের ব্যাপার বা বিমার দিকটি কীভাবে হবে—এসব অসংখ্য খুঁটিনাটি দিক রয়েছে। একটি জাতীয় কমিটি গঠনের পাশাপাশি এর অধীনে সচিব কমিটি, বিশেষজ্ঞ কমিটি ও টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা দরকার। আর ট্রানজিটের যে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, তা শুধু ভারতের ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে নেপাল ও ভুটানও রয়েছে। সবগুলো দেশ মিলিয়ে ট্রানজিট কার্যকর করার জন্য দরকার পড়বে রিজিওনাল ট্রানজিট সচিবালয়। ট্রানজিটে অন্তর্ভুক্ত সদস্যদেশগুলো নিয়ে এই সচিবালয় হবে। সদস্যদেশগুলো এই সচিবালয়ের খরচ বহন করবে।
প্রথম আলো : আপনাদের কোর কমিটির পক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে ট্রানজিট দিতে হলে বাংলাদেশকে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে হবে অন্তত ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এত অর্থ কোথা থেকে মিলবে?
মজিবুর রহমান : নানাভাবেই এই অর্থ জোগাড় করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া যেতে পারে। যেসব দেশ ট্রানজিটের সুবিধা ভোগ করবে, তারা বিনিয়োগ করতে পারে। তা ছাড়া, ট্রানজিটের জন্য তৈরি হওয়া সড়ক ও রেলপথ দেশের অভ্যন্তরীণ কাজেও লাগবে। ফলে কিছু এ ধরনের কাজ নিজেদের অর্থায়নেও হতে পারে। তবে এগুলো এমনভাবে করতে হবে যাতে ট্রানজিটের যানবাহন থেকে অর্থ নিয়ে পুরো খরচ তুলে ফেলা যায়।
প্রথম আলো : নৌ–ট্রানজিটের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে যান চলাচল চুক্তি বা কার্যত সড়কপথে ট্রানজিটের মাশুলের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এ ধরনের ট্রানজিট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
মজিবুর রহমান : পাঁচ বছর আগে আমরা যখন এ নিয়ে কাজ করেছিলাম, তখনকার চেয়ে পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। তবে ট্রানজিটের রুটগুলো এখনো পুরো প্রস্তুত নয়। এখন অস্থায়ীভাবে ও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ট্রানজিট দেওয়া যাবে। কারণ, আমাদের রাস্তা দিয়ে ৪০ ফুটের কনটেইনার তো এখন চলছে। কিন্তু যদি প্রতিদিন এক-দুই শ যানবাহন প্রবেশ করে, তবে আমরা তা এখন সামাল দিতে পারব না। পদ্মা সেতু তৈরি হলে ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার কাজ শেষ হলে তা সম্ভব। রেলের ক্ষেত্রে অনেক ব্রিজ ঠিক না করে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়া সম্ভব নয়। নদীর ক্ষেত্রে আশুগঞ্জ পর্যন্ত দেওয়া যাবে, এর পরে নয়। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা না হলে এটা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো : এ তো অবকাঠামোর বিষয়। প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি?
মজিবুর রহমান : ব্যবস্থাপনার জন্য যথাযথ প্রশাসনিক কাঠামোর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাস্টমসের একটি কাঠামো রয়েছে। জনবল কম থাকলে বাড়িয়ে কাজ শুরু করা যাবে। কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের হাইওয়ে পুলিশ ততটা কার্যকর নয়। ট্রানজিট যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব ধরনের চোরাচালান ও অনিয়ম ঠেকানোর কাজটিও বেশ জটিল ও কঠিন। একটি যান হয়তো নির্দিষ্ট সীমান্তে গেলই না, গাড়ির নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করে দিল বা মালামাল বিক্রি করে দিল। এসব দেখা ও মনিটর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও লোকবলের দরকার হবে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ কীভাবে বা কোথা থেকে এই কাজটি শুরু করতে পারে?
মজিবুর রহমান : প্রথমে নৌ–ট্রানজিটকে কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গভাবে শুরুর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। ফলে সহজেই আমরা ভুটানে পণ্য পরিবহন করতে পারব। ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই এই ড্রেজিংয়ের কাজ করা সম্ভব। আর স্থলপথে ট্রানজিটের জন্য বহুপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর রেল ও সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরুর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আগেই বলেছি, ট্রানজিটের নানা দিক দেখাশোনার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। এই বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞ বা জানাশোনা লোকজন তেমন নেই। ফলে যাঁরা আছেন, তাঁদের যদি জড়ো করা যায়, তবে তা কাজে দেবে। এই যে ট্রানজিট মাশুলের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের আসল সমস্যা হচ্ছে অজ্ঞতা। আমরা যদি জেনেশুনে ছাড় দিয়ে থাকি, তাতেআপত্তি নেই।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কী জেনেশুনে ছাড় দিচ্ছি?
প্রথম আলো : ট্রানজিট বাংলাদেশের জন্য কী সুফল নিয়ে আসবে বলে আপনি মনে করেন?
মজিবুর রহমান : ট্রানজিট শুরু হলে বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটবে। রাস্তাঘাট, রেল—এসব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাবে। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর হবে। এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করবে পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশার কিছু অংশ, ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এমনকি চীনের কুনমিং। বাংলাদেশের বন্দরের আয় বাড়বে। পরিবহন ব্যবসা, হোটেল, মোটেল বা রিসোর্ট ব্যবসা বাড়বে। আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে জটিলতা কমবে। ব্যাংকিং ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়বে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। ভারত ও চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন। দেশে কর্মসংস্থান হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর বা ইউরোপ সমপর্যায়ের যেকোনো দেশে পরিণত হতে পারবে।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মজিবুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments