টিআইবিকে তুলাধোনা নয়, মূল সংকটে হাত দিন by মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি
সংসদের ওপর প্রণীত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)
একটি গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে সংসদ অধিবেশনে তুলকালাম ঘটেছে। পত্রপত্রিকায়
প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে
মন্তব্য করা হয়েছে, সংসদে প্রকৃত বিরোধী দল নেই বিধায় সংসদের
অধিবেশনগুলোতে ‘পুতুল নাচের প্রদর্শনী’ চলছে। বোধগম্য কারণে এহেন
মন্তব্যে আঁতে ঘা লেগেছে সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের। এই
পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর একটি মনোযোগ আকর্ষণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে
সংসদের সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদ টিআইবিকে
তুলাধোনা করে ছেড়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া
চৌধুরী এবং ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য অনুযায়ী,
টিআইবি সীমা লঙ্ঘন করে এখতিয়ার-বহির্ভূতভাবে ‘রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট
অবস্থান’ নিয়ে ফেলেছে।
সাংসদদের মধ্যে এই বিষয়ে যাঁরাই বক্তব্য দিয়েছেন তাঁরা সবাই টিআইবির ওপর খড়্গহস্ত হয়েছেন। পুতুল নাচের ইঙ্গিতটা খুবই স্পর্শকাতর। এটা যে ব্যক্তিগতভাবে সব সাংসদকেই আঘাত করবে, সেটা টিআইবি কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত ছিল! এরই প্রতিক্রিয়ায় টিআইবিকে বিএনপির দালাল বলে গালাগাল করা হয়েছে। একজন তো সরাসরি এটাকে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের তকমা দিয়ে দিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মবেশে গেঁড়ে বসা সামরিক শাসকদের ব্যাপারে টিআইবির নীরবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অভিযোগ তুলেছেন, ‘তখন টিআইবির গণতন্ত্রপ্রীতি কোথায় লুকিয়েছিল? তারা তো বরং ওই সরকারের প্রশংসাই করেছিলেন!’ আরও অভিযোগ উঠেছে যে টিআইবি সংসদকে জনগণের কাছে, সর্বোপরি দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় হেয়প্রতিপন্ন করেছে। অতএব, টিআইবিকে তাদের এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য প্রত্যাহার করে সংসদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। নচেৎ, টিআইবি কর্তৃপক্ষকে সংসদে ডেকে পাঠিয়ে কৈফিয়ত তলব করা হোক। প্রয়োজনে টিআইবির দেশীয় কার্যক্রম বন্ধ করারও হুমকি দিয়েছেন কেউ কেউ। আইন ও সংসদবিষয়ক কমিটি টিআইবির সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছে। তবে ধারণা করি, ক্ষমতাসীন জোট বা সংসদ সেই ধরনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে না। কারণ তাতে ক্ষমতাসীনদেরই বেশি ক্ষতি হবে।
সংসদের অকার্যকারিতা ও অপচয় নিয়ে টিআইবি আগেও বেশ কয়েকটা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবারের প্রতিবেদনেও আপত্তিকর কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে সংবাদ সম্মেলনের কোনো কোনো মন্তব্য একটু বেশি কড়া বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বিশেষত, সংসদের ‘লেজিটিমেসি’ বিতর্কটা যেহেতু এখন জাতীয় রাজনীতির মূল ফোকাসে রয়েছে, তাই এই স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্তব্য করার সময় টিআইবি আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করলে ভালো হতো। টিআইবি যেহেতু সরকারি দুর্নীতি, অনিয়ম ও অবৈধ কার্যক্রম তাদের গবেষণা, সভা-সেমিনার, জনসচেতনতা সৃষ্টিধর্মী কর্মকাণ্ড এবং প্রকাশনাসমূহের মাধ্যমে ফোকাস করার উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান, তাই এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীন সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়াই স্বাভাবিক।
কারণ, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন দল বা জোটগুলো ৪৪ বছর ধরে জনগণকে সুশাসন কিংবা দুর্নীতিবিরোধী শাসন উপহার দেওয়া দূরে থাক, বরং প্রতিটি সরকারই যেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে দুর্নীতি, লুটপাট ও কায়েমের প্রতিযোগিতায় মজে রয়েছে। এর ফলে, এ দেশের রাষ্ট্রচরিত্রই এখন দেশের উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর বাধা’ হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। বার্লিনে অবস্থিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিবেচনায় যখন ২০০১ সালে বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচক বা ‘করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স’-এর কান্ট্রি র্যা ঙ্কিং মোতাবেক ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ ঘোষিত হয়েছিল, তখন ওই চ্যাম্পিয়নশিপ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ভরাডুবি ঘটানোর পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল বলে অনেকে মত দিয়েছিলেন।
অস্বীকার করার জো নেই যে ওই নির্বাচনের প্রচারণায় দুর্নীতির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপকে বিএনপি-জামায়াত অত্যন্ত সফলভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিল, যা মোকাবিলা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। যেমন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তাঁর এক টেলিভিশন প্রোগ্রামের সিরিজে যে নাটকীয় ভঙ্গিতে রসিয়ে রসিয়ে দুর্নীতির কাহিনিগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করতেন, সেগুলো ওই প্রোগ্রামগুলোকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল, যার সুফল ঘরে উঠেছিল বিএনপি-জামায়াতের। অতএব, বোধগম্য কারণেই আওয়ামী লীগ খাপ্পা হয়ে আক্রমণ শানিয়েছিল টিআইবির ওই সময়ের চেয়ারম্যান দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ প্রয়াত প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদের বিরুদ্ধে, যদিও ওয়াকিবহাল মহলের জানার কথা যে ওই র্যা ঙ্কিং প্রণয়নের কাজটি করে বার্লিনের মূল প্রতিষ্ঠানটি, বাংলাদেশের চ্যাপ্টার নয়।
এরপর যখন ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫—এই চার বছর পরপর আরও চারবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ঘোষিত হলো তখন তার দায়ভার এসে পড়ল তদানীন্তন ক্ষমতাসীন জোট বিএনপি-জামায়াতের ওপর। অতএব, ওই চার বছর টিআইবির বিরুদ্ধে আক্রমণের ও গালাগালির জোয়ার বইয়ে দিত বিএনপি। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত সরকারকে ওই চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য তুলাধোনা করতে ছাড়েনি, বলা বাহুল্য। ঘটনাক্রমে, রোটেশন অনুযায়ী ওই সময়ে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ। অতএব, তাঁর নেতৃত্বাধীন টিআইবিকে সরাসরি আওয়ামী লীগের দালাল বানিয়ে দিয়েছিলেন বিএনপির নেতারা। একবার বিএনপির তদানীন্তন সেক্রেটারি জেনারেল মান্নান ভূঁইয়াকে এক সভায় টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে নিজ চেয়ার ছেড়ে এসে টিআইবির তখনকার গবেষণা পরিচালক (বিআইডিএস থেকে ডেপুটেশনে কর্মরত) প্রয়াত বন্ধু এস আই লস্করকে শাসাতেও দেখা গিয়েছিল। মান্নান ভূঁইয়ার মতো একজন জননেতাকে টেলিভিশনের খবরে ওই ভূমিকায় দেখে আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে আমাকেও ওই পর্যায়ে কলম ধরতে হয়েছিল দৈনিক সংবাদ-এ।
পরপর পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের সে দুর্ভাগ্য গত এক দশকে বাংলাদেশের আর হয়নি। কিন্তু, এখনো কান্ট্রি র্যা ঙ্কিং অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্তের বিচারে নিচের দিক, মানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের দশ-বারোটি দেশের কাতারেই রয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। এই লজ্জা থেকে আমরা সহজে নিষ্কৃতি পাব বলে মনে হচ্ছে না। গত এক দশকে কিন্তু যতবারই টিআইবির কোনো গবেষণা ফলাফল প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে, প্রতিবারই ক্ষমতাসীন দল বা জোট তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, দুর্নীতি ও দুঃশাসন যেহেতু প্রধানত সরকারি দল বা জোটেরই কাজ, তাই ওগুলো উদ্ঘাটিত হলে ক্ষমতাসীন দল বা জোটই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। আর, বিরোধী দলগুলো এই প্রচারের সুবিধেটুকু ঘরে তুলছে, জনগণের কাছে তারা সাধু-সজ্জন বনে যাচ্ছে। এবারও আওয়ামী লীগ নেতারা টিআইবিকে ‘দেশদ্রোহিতার অপরাধে’ অভিযুক্ত করেছেন এবং বিএনপির দালাল বানিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, টিআইবি প্রতিবেদনের ‘গায়ে জ্বালা ধরানো’ সমালোচনার সুফল বিএনপি-জামায়াতের বাক্সে জমা হয়ে তাদের সংকটাপন্ন রাজনীতিকে সঞ্জীবনী টনিকে চাঙা করে তুলতে পারে। টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সম্মানিত চেয়ারপারসন দেশের মানবাধিকার সংগ্রামের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, যিনি আমার সহপাঠী। তাঁকে বা তাঁর নেতৃত্বাধীন টিআইবিকে বিএনপির দালাল বললে সেটা খুবই হাস্যকর ঠেকছে, কিন্তু রাজনৈতিক স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে তাঁদের আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করি।
এটুকু মেনে নিতে হবে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ না হলেও ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদেরও ‘পপুলার লেজিটিমেসি’ নেই। কিন্তু, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট যেভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গোঁ ধরে পুরো সংলাপকে ভন্ডুল করে দিয়েছিল, তাও কোনো গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক অবস্থান হতে পারে না। বিএনপিকে মেনে নিতে হবে যে অদূর ভবিষ্যতে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তারপরও বিলেতে বসে হুকুমদারির মাধ্যমে ২০-দলীয় জোটের রাজনৈতিক অধিপতি ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানকারী তারেক রহমানের অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছেন জোটের ঝানু নেতারা। তাঁরা না পারছেন তারেক জিয়াকে থামাতে, না পারছেন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ, বেগম জিয়া তাঁর পুত্রকে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীর আসনে অধিষ্ঠিত করার মিশনে আজও মরিয়া। আর তারেক রহমানের একের পর এক বালখিল্য পদক্ষেপে, উচ্চারণে ও আচরণে দেশের রাজনীতিতে উত্তাপ সঞ্চারিত হচ্ছে এবং সংঘাত ও সন্ত্রাসের তাণ্ডব সৃষ্টির মওকা পেয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। এমতাবস্থায়, দেশের দুই প্রধান দল বা নেত্রীর মধ্যে সংলাপ সৃষ্টির কোনো সুযোগ কি এখন রয়েছে? মহাজোট তারেক রহমানের এহেন অবিমৃশ্যকারী কর্মকাণ্ডের ফায়দা নিচ্ছে এবং তাদের এ জন্য দোষ দেওয়া যাবে না।
আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, জামায়াত-শিবিরের নানা পকেট সংগঠনের মাধ্যমে ‘কিলিং অপারেশন’ চালিয়ে দেশটাতে সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের’ দাবি আদায়ের খায়েশ কারও থাকলে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে। ধারাবাহিকভাবে গুপ্তহত্যার জন্য যে ঘাতক গোষ্ঠী তাদের একাত্তরের চেহারাটা আরও একবার জাতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, বেগম জিয়া একটিবারও
কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন? গণতন্ত্র না থাকায় সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে বিএনপি নেতাদের বারবার উচ্চারিত বুলি কি সন্ত্রাসী বাহিনীকে আশকারা দেওয়ার শামিল নয়?
গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম তো নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ হতে পারে না! আবার, ২০১৯ সালের আগে কোনো সংলাপ হবে
না বলে ক্ষমতাসীন মহাজোটের পক্ষ থেকে যে একগুঁয়েমি প্রদর্শন করা হচ্ছে, তা-ও সমর্থনযোগ্য নয়। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই এক নদী রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম আমরা, এ কথা আমরা কখনোই ভুলব না।
মইনুল ইসলাম: প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সাংসদদের মধ্যে এই বিষয়ে যাঁরাই বক্তব্য দিয়েছেন তাঁরা সবাই টিআইবির ওপর খড়্গহস্ত হয়েছেন। পুতুল নাচের ইঙ্গিতটা খুবই স্পর্শকাতর। এটা যে ব্যক্তিগতভাবে সব সাংসদকেই আঘাত করবে, সেটা টিআইবি কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত ছিল! এরই প্রতিক্রিয়ায় টিআইবিকে বিএনপির দালাল বলে গালাগাল করা হয়েছে। একজন তো সরাসরি এটাকে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের তকমা দিয়ে দিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মবেশে গেঁড়ে বসা সামরিক শাসকদের ব্যাপারে টিআইবির নীরবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অভিযোগ তুলেছেন, ‘তখন টিআইবির গণতন্ত্রপ্রীতি কোথায় লুকিয়েছিল? তারা তো বরং ওই সরকারের প্রশংসাই করেছিলেন!’ আরও অভিযোগ উঠেছে যে টিআইবি সংসদকে জনগণের কাছে, সর্বোপরি দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় হেয়প্রতিপন্ন করেছে। অতএব, টিআইবিকে তাদের এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য প্রত্যাহার করে সংসদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। নচেৎ, টিআইবি কর্তৃপক্ষকে সংসদে ডেকে পাঠিয়ে কৈফিয়ত তলব করা হোক। প্রয়োজনে টিআইবির দেশীয় কার্যক্রম বন্ধ করারও হুমকি দিয়েছেন কেউ কেউ। আইন ও সংসদবিষয়ক কমিটি টিআইবির সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছে। তবে ধারণা করি, ক্ষমতাসীন জোট বা সংসদ সেই ধরনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে না। কারণ তাতে ক্ষমতাসীনদেরই বেশি ক্ষতি হবে।
সংসদের অকার্যকারিতা ও অপচয় নিয়ে টিআইবি আগেও বেশ কয়েকটা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবারের প্রতিবেদনেও আপত্তিকর কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে সংবাদ সম্মেলনের কোনো কোনো মন্তব্য একটু বেশি কড়া বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বিশেষত, সংসদের ‘লেজিটিমেসি’ বিতর্কটা যেহেতু এখন জাতীয় রাজনীতির মূল ফোকাসে রয়েছে, তাই এই স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্তব্য করার সময় টিআইবি আরেকটু সাবধানতা অবলম্বন করলে ভালো হতো। টিআইবি যেহেতু সরকারি দুর্নীতি, অনিয়ম ও অবৈধ কার্যক্রম তাদের গবেষণা, সভা-সেমিনার, জনসচেতনতা সৃষ্টিধর্মী কর্মকাণ্ড এবং প্রকাশনাসমূহের মাধ্যমে ফোকাস করার উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান, তাই এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীন সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়াই স্বাভাবিক।
কারণ, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন দল বা জোটগুলো ৪৪ বছর ধরে জনগণকে সুশাসন কিংবা দুর্নীতিবিরোধী শাসন উপহার দেওয়া দূরে থাক, বরং প্রতিটি সরকারই যেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে দুর্নীতি, লুটপাট ও কায়েমের প্রতিযোগিতায় মজে রয়েছে। এর ফলে, এ দেশের রাষ্ট্রচরিত্রই এখন দেশের উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর বাধা’ হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। বার্লিনে অবস্থিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিবেচনায় যখন ২০০১ সালে বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচক বা ‘করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স’-এর কান্ট্রি র্যা ঙ্কিং মোতাবেক ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ ঘোষিত হয়েছিল, তখন ওই চ্যাম্পিয়নশিপ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ভরাডুবি ঘটানোর পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল বলে অনেকে মত দিয়েছিলেন।
অস্বীকার করার জো নেই যে ওই নির্বাচনের প্রচারণায় দুর্নীতির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপকে বিএনপি-জামায়াত অত্যন্ত সফলভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিল, যা মোকাবিলা করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। যেমন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তাঁর এক টেলিভিশন প্রোগ্রামের সিরিজে যে নাটকীয় ভঙ্গিতে রসিয়ে রসিয়ে দুর্নীতির কাহিনিগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করতেন, সেগুলো ওই প্রোগ্রামগুলোকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল, যার সুফল ঘরে উঠেছিল বিএনপি-জামায়াতের। অতএব, বোধগম্য কারণেই আওয়ামী লীগ খাপ্পা হয়ে আক্রমণ শানিয়েছিল টিআইবির ওই সময়ের চেয়ারম্যান দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ প্রয়াত প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদের বিরুদ্ধে, যদিও ওয়াকিবহাল মহলের জানার কথা যে ওই র্যা ঙ্কিং প্রণয়নের কাজটি করে বার্লিনের মূল প্রতিষ্ঠানটি, বাংলাদেশের চ্যাপ্টার নয়।
এরপর যখন ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫—এই চার বছর পরপর আরও চারবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ঘোষিত হলো তখন তার দায়ভার এসে পড়ল তদানীন্তন ক্ষমতাসীন জোট বিএনপি-জামায়াতের ওপর। অতএব, ওই চার বছর টিআইবির বিরুদ্ধে আক্রমণের ও গালাগালির জোয়ার বইয়ে দিত বিএনপি। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত সরকারকে ওই চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য তুলাধোনা করতে ছাড়েনি, বলা বাহুল্য। ঘটনাক্রমে, রোটেশন অনুযায়ী ওই সময়ে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ। অতএব, তাঁর নেতৃত্বাধীন টিআইবিকে সরাসরি আওয়ামী লীগের দালাল বানিয়ে দিয়েছিলেন বিএনপির নেতারা। একবার বিএনপির তদানীন্তন সেক্রেটারি জেনারেল মান্নান ভূঁইয়াকে এক সভায় টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে নিজ চেয়ার ছেড়ে এসে টিআইবির তখনকার গবেষণা পরিচালক (বিআইডিএস থেকে ডেপুটেশনে কর্মরত) প্রয়াত বন্ধু এস আই লস্করকে শাসাতেও দেখা গিয়েছিল। মান্নান ভূঁইয়ার মতো একজন জননেতাকে টেলিভিশনের খবরে ওই ভূমিকায় দেখে আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে আমাকেও ওই পর্যায়ে কলম ধরতে হয়েছিল দৈনিক সংবাদ-এ।
পরপর পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের সে দুর্ভাগ্য গত এক দশকে বাংলাদেশের আর হয়নি। কিন্তু, এখনো কান্ট্রি র্যা ঙ্কিং অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্তের বিচারে নিচের দিক, মানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের দশ-বারোটি দেশের কাতারেই রয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। এই লজ্জা থেকে আমরা সহজে নিষ্কৃতি পাব বলে মনে হচ্ছে না। গত এক দশকে কিন্তু যতবারই টিআইবির কোনো গবেষণা ফলাফল প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে, প্রতিবারই ক্ষমতাসীন দল বা জোট তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, দুর্নীতি ও দুঃশাসন যেহেতু প্রধানত সরকারি দল বা জোটেরই কাজ, তাই ওগুলো উদ্ঘাটিত হলে ক্ষমতাসীন দল বা জোটই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। আর, বিরোধী দলগুলো এই প্রচারের সুবিধেটুকু ঘরে তুলছে, জনগণের কাছে তারা সাধু-সজ্জন বনে যাচ্ছে। এবারও আওয়ামী লীগ নেতারা টিআইবিকে ‘দেশদ্রোহিতার অপরাধে’ অভিযুক্ত করেছেন এবং বিএনপির দালাল বানিয়ে দিচ্ছেন। কারণ, টিআইবি প্রতিবেদনের ‘গায়ে জ্বালা ধরানো’ সমালোচনার সুফল বিএনপি-জামায়াতের বাক্সে জমা হয়ে তাদের সংকটাপন্ন রাজনীতিকে সঞ্জীবনী টনিকে চাঙা করে তুলতে পারে। টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সম্মানিত চেয়ারপারসন দেশের মানবাধিকার সংগ্রামের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, যিনি আমার সহপাঠী। তাঁকে বা তাঁর নেতৃত্বাধীন টিআইবিকে বিএনপির দালাল বললে সেটা খুবই হাস্যকর ঠেকছে, কিন্তু রাজনৈতিক স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে তাঁদের আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করি।
এটুকু মেনে নিতে হবে যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ না হলেও ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদেরও ‘পপুলার লেজিটিমেসি’ নেই। কিন্তু, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট যেভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গোঁ ধরে পুরো সংলাপকে ভন্ডুল করে দিয়েছিল, তাও কোনো গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক অবস্থান হতে পারে না। বিএনপিকে মেনে নিতে হবে যে অদূর ভবিষ্যতে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তারপরও বিলেতে বসে হুকুমদারির মাধ্যমে ২০-দলীয় জোটের রাজনৈতিক অধিপতি ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানকারী তারেক রহমানের অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছেন জোটের ঝানু নেতারা। তাঁরা না পারছেন তারেক জিয়াকে থামাতে, না পারছেন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ, বেগম জিয়া তাঁর পুত্রকে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীর আসনে অধিষ্ঠিত করার মিশনে আজও মরিয়া। আর তারেক রহমানের একের পর এক বালখিল্য পদক্ষেপে, উচ্চারণে ও আচরণে দেশের রাজনীতিতে উত্তাপ সঞ্চারিত হচ্ছে এবং সংঘাত ও সন্ত্রাসের তাণ্ডব সৃষ্টির মওকা পেয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। এমতাবস্থায়, দেশের দুই প্রধান দল বা নেত্রীর মধ্যে সংলাপ সৃষ্টির কোনো সুযোগ কি এখন রয়েছে? মহাজোট তারেক রহমানের এহেন অবিমৃশ্যকারী কর্মকাণ্ডের ফায়দা নিচ্ছে এবং তাদের এ জন্য দোষ দেওয়া যাবে না।
আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, জামায়াত-শিবিরের নানা পকেট সংগঠনের মাধ্যমে ‘কিলিং অপারেশন’ চালিয়ে দেশটাতে সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের’ দাবি আদায়ের খায়েশ কারও থাকলে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে। ধারাবাহিকভাবে গুপ্তহত্যার জন্য যে ঘাতক গোষ্ঠী তাদের একাত্তরের চেহারাটা আরও একবার জাতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, বেগম জিয়া একটিবারও
কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন? গণতন্ত্র না থাকায় সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে বিএনপি নেতাদের বারবার উচ্চারিত বুলি কি সন্ত্রাসী বাহিনীকে আশকারা দেওয়ার শামিল নয়?
গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম তো নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ হতে পারে না! আবার, ২০১৯ সালের আগে কোনো সংলাপ হবে
না বলে ক্ষমতাসীন মহাজোটের পক্ষ থেকে যে একগুঁয়েমি প্রদর্শন করা হচ্ছে, তা-ও সমর্থনযোগ্য নয়। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই এক নদী রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম আমরা, এ কথা আমরা কখনোই ভুলব না।
মইনুল ইসলাম: প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments