কবি ও লেখিকার গল্প by ফারুক আহমেদ
জানালার পাশ ঘেঁষে একদঙ্গল বাতাস গান গেয়ে চলে গেল। আরেক দঙ্গল বাতাস আগের চেয়ে একটু নিচু স্বরে গান গেয়ে চলে গেল। এ রকমভাবে বাতাসের একে একে চলে যাওয়ার ভেতর বসে কবি গল্প লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বাইরে জোছনা মৃত ঘাসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে চারদিক ছড়িয়ে আছে। একের পর এক দলবেঁধে আসা বাতাসসংগীত কবিকে গল্প লেখায় একপ্রকার ত্রাণ বিতরণ করছে। আর কবি গল্প লেখার প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে ঢুকে যাচ্ছেন এক নির্জন গ্রামের ভেতর। চারদিক থেকে তাঁকে হেরেমের নারীর মতো ঘিরে রেখেছে সবুজ গাছপালা। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এমন একটা সৌন্দর্যমণ্ডিত সৌধ নির্মাণের ভেতর কয়েকটা কাক হৃদয়বিদারক চিৎকার ফেলে রাজধানীর কোলাহল তুলে আনে। ফলে, এ রকম নিপাট (কাল্পনিক) আয়োজন এবং নিপুণ (বাস্তবিক) বিশৃঙ্খলা মাথায় নিয়ে কবি তাঁর গল্পকে যাত্রা করান। গল্পটা নিটোল প্রেমের। কবি পনেরো দিন ধরে একটু একটু ভেবে গল্পের অবয়ব নির্মাণ করেছেন। এখন ওঝার মতো মাথা থেকে কাহিনিটা নামিয়ে দিলেই হলো। তিনি গল্প শুরু করলেন—
শ্রাবণ মাস। ঘোর বর্ষা। পাহাড় থেকে মেঘ এসে শহরের আকাশ দখল করে নিচ্ছে। এ ঋতু ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দেয়, মেঘ যত্রতত্র ঘোরাফেরা করতে পারবে না। তাদের অবস্থান করতে হবে শহরের নির্দিষ্ট জায়গায়। তাই গভীর রাত থেকেই জায়গা দখল নিয়ে মেঘেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। এতে কিছু মেঘ নিহত হয়। নিহত মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে যখন শহরের কোনো এক গলির কয়েকটি বাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছিল, সে সময় বৃষ্টির এমন আমেজে সংঘঠিত হচ্ছিল নানা কিছিমের ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে দু-একটি উল্লেখ করা হলো। যেমন: সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি পরস্পর জড়াজড়ি করে অনির্ণেয় সুখ খোঁজার চেষ্টায় তৎপর হয়ে ওঠে, তবে পরমুহূর্তে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় নবীন দম্পতি যারপরনাই হতাশ। ফুটপাতে শুয়ে থাকা উদ্বাস্তুরা বৃষ্টি দেখে প্রথমে কোথাও আশ্রয় নিতে ছুটে যায়, কিন্তু পলকে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় ফিরে আসে আগের জায়গায়। একটা ল্যাংড়া কুকুর বৃষ্টির ভয়ে ফুটপাত থেকে লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তাকে বেশিক্ষণ ছোটাছুটি করতে হয় না—তার আগেই বৃষ্টি থেমে যায়।
বৃষ্টি আবার শুরু হয়—আর তা হয় পরদিন বিকেল থেকে।
বৃষ্টি যখন শুরু হলো, তার আগেই অফিসগুলো তার কর্মীদের ছেড়ে দিয়েছে। সারা দিনের ক্লান্তি, ঘাম ও রেষারেষির সমাপ্তি টেনে সবাই তখন ঠিকানামুখী। এমন সময় আকাশ ভেঙে (আকাশ নয়, হবে মেঘ ভেঙে) বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে। এরই মধ্যে অবশ্য অনেকে বাসে চেপে বসেছে, অনেকে পৌঁছেও গেছে বাসায়, তবু পৃথিবীর প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দুর্ভাগ্যবানেরা সংখ্যায় সব সময় বেশিই থাকে। তা না হলে বৃষ্টি শুরুর পর রাস্তার পাশের দোকান, অফিসের বারান্দা, গ্যারেজের ফাঁকা অংশ—যেখানেই সামান্য আশ্রয় আছে, সেখানে কেন লোকের এমন গিজগিজে উপস্থিতি নজরে আসবে?
বৃষ্টি শুরু হয়ে আর থামছে না। চারদিক ফাঁকা হয়ে গেছে। এর ভেতর রাস্তায় হঠাৎ দু-একটা সিএনজির হন্তদন্ত ছুটে যাওয়া দেখে মনে হয়, বৃষ্টি ওদের তাড়িয়ে নিচ্ছে। অন্য সময় রাস্তায় অজস্র বাস গিজগিজ করলেও বৃষ্টিতে সব উধাও।
একটা অফিসের বারান্দায় বৃষ্টি সামনে নিয়ে শ-পঞ্চাশেক লোক দাঁড়িয়ে। শ-পঞ্চাশেক লোক মানে শ-পঞ্চাশেক মুখ। শ-পঞ্চাশেক মুখ মানে শ খানেক চোখ। এই পঞ্চাশটা মুখ থেকে প্রাথমিকভাবে আমরা দুটি মুখ বেছে নেব। এই দুজনের একজন যুবক, বয়স আটাশ থেকে ত্রিশ, আরেকজন যুবতী—পঁচিশ থেকে সাতাশ। অবশ্য মেয়েটির বয়স ত্রিশ থেকে বত্রিশ হলেও সমস্যা নেই।
বৃষ্টির ঝাপটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় আটকে পড়া লোকগুলো আরও একটু অন্তরঙ্গ হয়ে যায়। এ অন্তরঙ্গতায় কেউ কারও সঙ্গে গল্প বা আড্ডায় মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছে—তা নয়, বরং অনেক দূর থেকে ভেসে আসা সংসারের নানা কাসুন্দি কমবেশি নাড়াচাড়া শুরু হয়ে গেল আরকি। এটা সম্ভব হলো মুঠোফোনের বদৌলতে। আর পরস্পর অন্তরঙ্গ ভাবছে বলেই এমন সব কথা রাখঢাক না করেই চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। যা হোক, এর মধ্যে যে দুটি মুখের কথা বলা হলো, তাদের ভেতর তৈরি হয়েছে একটা যোগসূত্র। দুজন বারান্দার দুদিকে অবস্থান করেও এ যোগসূত্র তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের ভিড়ের ফাঁকফোকর ঘুরে দুজনের দৃষ্টি মিলিত হচ্ছে একসঙ্গে। বৃষ্টি একটু থেমে পরমুহূর্তে ঝাপটা দেয়, দৃষ্টি একটু ঘুরে পরমুহূর্তে আবার মিলিত হয়—এভাবে চলতেই থাকে। বৃষ্টি কিন্তু থামে না। বৃষ্টির ভেতর দু-একজন অস্থির হয়ে ওঠে, তারা বেরিয়ে পড়ে প্যান্ট গুটিয়ে। দৌড়ে এগোনোর চেষ্টা করে। দৃশ্যটি দেখে অন্যরা চাহনি ফেলে পরস্পর। তারপর কেউ একজন প্যান্ট গুটিয়ে লাফিয়ে পড়ে বৃষ্টিতে। এভাবে বেরোতে বেরোতে লোকজন প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেকে। শেষ পর্যন্ত যুবক-যুবতীসহ টিকে থাকে সাকল্যে জনা পাঁচেক। ঘণ্টা পেরোনো এই বৃষ্টিসন্ধ্যায় তারা পরস্পর বার পঞ্চাশেক দৃষ্টি ফেলেছে। এই দৃষ্টিপাত প্রথমে গম্ভীর, পরে হালকা এবং শেষে ঘটে মৃদু হাসি সহযোগে।
এ অবস্থায় কবি এই যুবক-যুবতীর ভেতর কথা ফেলতে চান। বরিষনময় সন্ধ্যায় এবার ওদের ভেতর হালকা কথার বৃষ্টি শুরু হোক—এমন বাসনা নিয়ে নিমগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে তাদের ভেতর একটা সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব—এ ভাবনায় মশগুল হওয়ার আগেই কেঁদে ওঠে কবির ছয় মাস বয়সী বাচ্চাটা। কান্নার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার মা জেগে উঠলে প্রথমেই তার চোখ পড়ে স্বামীর ওপর। ফলে, ছোট খোকা রেখে সে নজর দেয় বড় খোকার দিকে।
: এখনো তুমি লাইট জ্বালাইয়া রাখছ?
তার কণ্ঠ ঘুমজড়ানো হলেও কথাগুলো নির্দেশের মতো শোনায়। এরপর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে লাইট নিভিয়ে দেন কবি। এবং ভাবনা ফেলে বাচ্চার কান্না কীভাবে, কোন উপায় থামানো যায়, সে কাজে তৎপর হয়ে ওঠেন।
২. এক গল্পকার একটা গল্প লিখতে বসেছেন। গল্প স্থির করা আছে। তিনি আপাদমস্তক বিরহে মোড়ানো একটা গল্প লিখবেন। তবে তাঁর ভাবনার সামনে অনেক বিশৃঙ্খলা খেলা করে যায়। এর মধ্যে আছে মাস খানেক আগে বিচ্ছেদ হওয়া স্বামীর স্মৃতি। এটাকে তিনি অবশ্য পাত্তা দিতে রাজি নন। যে অনবরত প্রতারণা করেছে, তার চলে যাওয়াকে কোনোমতেই ক্ষত বলা যাবে না। তবু বারবার মনে হয়, লোকটা এমন করতে পারল? এত দিনের প্রেম, তারপর বিয়ে। তারপর একসঙ্গে যাপন, তারপর...। তিনি লিখতে শুরু করেন—
গল্পকার যে গল্পটা লিখতে শুরু করলেন, সেটি কবির লেখা গল্পের প্রায় হুবহু। তফাত যেটুকু, তা যৎসামান্য। তফাতটা গল্পের শুরুর অংশে। গল্পের শুরুর দিকে তিনি যে বিবরণ দেন, তা এখানে তুলে দিচ্ছি—
দাম্পত্য জীবনের দুই বছরের মাথায় জুঁই টের পায় ঘটনাটা। তার স্বামী রেদওয়ান ঝুঁকে পড়েছে অন্য এক নারীর দিকে। এই নিয়ে তাদের ভেতর কিছু দিন ধরে অস্থিরতা চলছে। তারই চূড়ান্ত ঝগড়াটা যখন সংঘঠিত হচ্ছে, বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। ঝগড়ার একপর্যায়ে জুঁই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। পেছন পেছন রেদওয়ান। জুঁই বাসা থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি একটা অফিসের বারান্দায় আশ্রয় নেয়। সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়ায় রেদওয়ান। অফিসের বারান্দায় বৃষ্টি সামনে নিয়ে শ-পঞ্চাশেক লোক দাঁড়িয়ে আছে।... তারপর গল্পকার দুজনের ভেতর চাহনি বিনিময় এবং প্রতীক্ষার বিবরণ কবির মতোই দিয়ে যান। শেষে যখন অফিসের বারান্দা প্রায় খালি হয়ে যায়, তখন দুজনের ভেতর কথা ফেলতে চান তিনি। ভাবেন, হাতজোড় করা রেদওয়ানকে জুঁইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন, বা চোখে চোখেই একটা সমঝোতা করিয়ে দেবেন। আর কী কী বিকল্প হতে পারে, সেসব নিয়ে ভাবছিলেন গল্পকার। তখন তাঁর মুঠোফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ‘মাম’ দেখে ফোনটা কানে নিয়ে বলেন, ‘হালো মা, বলো।’ কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে বাবার কণ্ঠ শোনা যায়। বাবা বলেন, ‘মা, তোর মা হাসপাতালে।’ ফলে লেখিকা গল্পটিকে আর টানতে পারেন না।
৩. মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে লেখিকা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গে নিয়ে যান গল্পটা। এদিকে কবিও বের হওয়ার সময় নিজের ঝোলা টাইপের ব্যাগটায় গল্পটা গুঁজে রাখেন। দুজনের ভেতর খেলা করছে প্রায় একই রকম উত্তেজনা। কবি ভাবছেন, কোথাও থেকে যেন প্রেমের গল্পের তাড়নাটা আসছে। সেই কোথাওটা অচিরেই অবয়ব নিয়ে হাজির হবে। হাজির যে হবে, এ নিয়ে কবির মনে কোনো সংশয় নেই। অন্যদিকে লেখিকা ভাবছিলেন, গল্পটা লেখার পর তিনি শান্তি বা সান্ত্বনা পাবেন—তাঁকে ঘিরে আছে যে বেদনার গোলক, তা অনেকাংশেই কমে আসবে। এমনই নিজস্ব স্বপ্নে ঘোরগ্রস্ত হয়ে কবি ও লেখিকা—দুজনই শাহবাগের ফুটপাত পার হচ্ছিলেন। কবি যাচ্ছেন আজিজ মার্কেট, লেখিকা বারডেম হাসপাতালে। এই যাতায়াতের পথে সাক্ষাৎ ঘটে তাঁদের দুজনের। সাক্ষাৎ বলতে পরস্পর পরস্পরকে অতিক্রম করেন। কেউ কারও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই সম্পন্ন হয় অতিক্রমপালা। কিন্তু এর ভেতরেই নাটক যা ঘটার ঘটে। কবির গল্পটা ঝোলা থেকে এক লাফে লেখিকার ব্যাগে এবং লেখিকার গল্পটা ব্যাগ থেকে এক লাফে কবির ঝোলায় চলে আসে। পাঠক যতই অবাক হোন না কেন, ঘটনা এই—এ-ই সত্যি। কেউ যদি বলে, উহ্, কী চাপা? এটা কোনোমতেই সম্ভব না, তারপরেও এটা আসলে সম্ভব। প্রতিদিন আমাদের চারপাশে যা যা ঘটছে, সেসবের তুলনায় দুটি গল্পের দুদিকে লাফ দেওয়া অতি সাধারণ ঘটনা। সুতরাং, এটা বিশ্বাসযোগ্য। এটাই ঘটেছে—কবির গল্প লেখিকার দখলে এবং লেখিকার গল্প কবির দখলে চলে আসে।
৪. দ্বিতীয়বার কবি যখন লিখতে শুরু করেন, তখনো গভীর রাত। ঝোলা থেকে কাগজ বের করে প্রথমেই তাঁর খটকা লাগে। তাঁর হাতের লেখা কি একটু বেঁকে গেল?—ভেবেও বিষয়টা নিয়ে আর এগোন না। কারণ, গল্পের পরবর্তী দৃশ্য তাঁর মাথায় খেলছে। ফলে, এক্ষুনি সেটি নামিয়ে দিতে হবে। কিন্তু লিখতে শুরু করেই আটকাতে হয় তাঁকে। কী এক ব্যাপার ঘটে গেছে খাতাজুড়ে। গল্পটা তাঁরই, তারপরও বলতে হবে, তাঁর না—এমন একটা সংশয় থেকে গল্পটা বেশ কয়েকবার পড়ে ফেলেন কবি। প্রতিবার পড়া শেষে এলিয়ে পড়েন তিনি। মুহূর্তেই তাঁর চোখ যায় ঘুমিয়ে থাকা নারীর দিকে। নারীটির পাশে তাঁর ছয় মাসের আত্মজা, সেও ঘুমিয়ে। এসবের মধ্যে ওই নারীমুখ তাঁকে একটা বিপুল বিরক্তির ভেতর ডুবিয়ে দেয়। তাঁর মনে হয়, এই নারী তাঁর জীবনটা বিষিয়ে তুলছে; শীতের সকালের মতো একটা হাসি তাঁকে সে বরাদ্দ দেয় না বহুদিন, বা ভাপাপিঠার মতো উষ্ণ স্পর্শ—কিচ্ছু না। নারীটি এসবে না গিয়ে বারবার যায় বিরক্তি-সহায়ক ঘটনায়, যায় চোখ রাঙানোয়। এ কারণেই তাঁর একটা নিটোল প্রেমের গল্প নিজের অজান্তেই পরিণত হয়েছে বিরহের গল্পে। কবি নিজের ভেতরই—না না এ হতে পারে না আওয়াজ দিয়ে উঠে পড়েন চেয়ার থেকে। তারপর খোলা বারান্দায় এসে পায়চারি করতে থাকেন। এদিকে লেখিকা গল্প লিখতে গিয়ে একই ঘটনার মুখোমুখি। তিনি ভেবেছিলেন, নিজের কষ্টগুলো নানা কায়দায় গল্পে ঢেলে দেবেন। এতে গল্প শেষে একটা বৃষ্টিভেজা বাতাসের আমেজ টের পাবেন। কিন্তু তা তিনি পেলেন না। তবে তাঁর মনে হতে লাগল, কোথায় যেন প্রেম লুকিয়ে আছে, ধরা দিতে গিয়েও দিচ্ছে না। লেখিকার ভাবনায় তখন তাঁর স্বামী লোকটার চেহারা এসে হাজির হয়। তাঁর সামনে বেদনার স্মৃতিগুলো ফিকে হয়ে ভিড় করে আনন্দের স্মৃতিই। সুতরাং, লেখিকা নিশ্চিত, ওই লোকটা তাঁর কাছে আবার ফিরে আসবে। আসবে! অথবা তাঁর মন কোনো বেদনায় নয়, যেতে চায় আনন্দগঞ্জে।
৫. এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে। কবির ভেতর একটা অবিশ্বাস ছক্কাপাঞ্জা খেলতে শুরু করে। কেন যেন তাঁর মনে হতে থাকে, তাঁর স্ত্রীর হৃদয় অন্যদিকে ঝুঁকে আছে। এই মানুষটিকে, এই চিত্রকল্প জন্মদাতা কবিকে সে কোনোমতেই ভালোবাসে না—এ ধারণা কবিকে সকাল-সন্ধ্যা গুঁত্তা দিয়ে বেড়ায়। ফলে, যখনই তাঁর মনে হয়, ওই নারী তাঁকে ভালোবাসে না, তখনই তিনি লাফিয়ে ওঠেন—অফিসে থাকলে এক লাফে নিচের চায়ের দোকানে পৌঁছে যান, আর বাসায় থাকলে বারান্দায়। নারীটি অবশ্য কবির এমন কর্মকাণ্ডে ভেংচিই কাটে। বলে, ‘ইদানীং দেখছি তুমি আর কবি নাই, কবি থেকে দার্শনিক হয়ে গ্যাছ।’
এমন দিনযাপনের ভেতর একদিন ‘ওই নারী আমারে ভালোবাসে না, বাসে অন্য কাউকে’—এই আপ্তবাক্য স্মরণে আসামাত্র অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েন কবি। ভরদুপুরে হাজির হন বাসায়। কড়া নেড়ে অপেক্ষা করেন। দরজা খুলে চোখ কপালে তোলে বউ, ‘তুমি?’
কবি কোনো কথা বলেন না, বউকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে বাসায় ঢুকে পড়েন। ড্রয়িংরুমে এসে প্রথমে তাঁর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলেও তা পুরোমাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। কবির পেছন পেছন তাঁর স্ত্রীও চলে আসে। একটা স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে সে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘এ আমার বন্ধু কাওসার, যে কাওসারের কথা তোমাকে বলি।’ পরিচয় করানোমাত্র একটা মোলায়েম হাসি ছড়িয়ে হাত বাড়ান কবি, যুবকও হাত বাড়ায়। কবি বলেন, ‘কী করছিলেন?’
যুবক অন্য হাতের ছুরিটা দেখিয়ে বলে, ‘পুডিং কাটছিলাম।’ ‘পুডিং অনেক নরম এবং সুস্বাদু, কাটতেও ভালো লাগে। আমিও কাটি, হে হে হে।’—কবি আওড়ালেন। এ পর্যন্ত বলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। ওদিকে লেখিকার মনে প্রেম তুমুলভাবে জেগে ওঠে। প্রেমের ধাক্কায় তিনি বেরিয়ে পড়েন বাসা থেকে। গন্তব্য সদ্য সাবেক হওয়া স্বামীর অফিস। লেখিকা ঠিক করেন, অফিসে পৌঁছে সবার সামনে স্বামীর হাত ধরে বলবেন, ‘অনেক হয়েছে, এবার চলো।’ কিন্তু তখনই তাঁর মাথায় আসে ওই মেয়ের কথা, যাকে নিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁর স্বামী। তবে পরমুহূর্তেই মাথা থেকে এটি ঝেড়ে ফেলেন তিনি। সাবেক স্বামীর অফিসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গন্তব্যের কথা লেখিকা ভাবতে পারেন না। অবশ্য স্বামীর অফিসের কাছাকাছি পৌঁছালে তাঁর ফোন বেজে ওঠে। স্কিনে নাম দেখে প্রথমে কাঁপতে থাকে তাঁর হাত। কোনোমতে নিজেকে থামান। স্বর স্বাভাবিক রেখে রিসিভ করেন ফোন—
: হ্যালো কায়েস, কী খবর?
: ভালো, তুমি কই?
: কেন?
: তুমি কোথায় তা-ই বলো। আমি আসছি। লেখিকা তাঁর অবস্থান জানিয়ে দেন। কায়েস আসে এবং লেখিকাকে নিয়ে রওনা হয় আনন্দগঞ্জের দিকে।
শ্রাবণ মাস। ঘোর বর্ষা। পাহাড় থেকে মেঘ এসে শহরের আকাশ দখল করে নিচ্ছে। এ ঋতু ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দেয়, মেঘ যত্রতত্র ঘোরাফেরা করতে পারবে না। তাদের অবস্থান করতে হবে শহরের নির্দিষ্ট জায়গায়। তাই গভীর রাত থেকেই জায়গা দখল নিয়ে মেঘেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। এতে কিছু মেঘ নিহত হয়। নিহত মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে যখন শহরের কোনো এক গলির কয়েকটি বাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছিল, সে সময় বৃষ্টির এমন আমেজে সংঘঠিত হচ্ছিল নানা কিছিমের ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে দু-একটি উল্লেখ করা হলো। যেমন: সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি পরস্পর জড়াজড়ি করে অনির্ণেয় সুখ খোঁজার চেষ্টায় তৎপর হয়ে ওঠে, তবে পরমুহূর্তে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় নবীন দম্পতি যারপরনাই হতাশ। ফুটপাতে শুয়ে থাকা উদ্বাস্তুরা বৃষ্টি দেখে প্রথমে কোথাও আশ্রয় নিতে ছুটে যায়, কিন্তু পলকে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় ফিরে আসে আগের জায়গায়। একটা ল্যাংড়া কুকুর বৃষ্টির ভয়ে ফুটপাত থেকে লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তাকে বেশিক্ষণ ছোটাছুটি করতে হয় না—তার আগেই বৃষ্টি থেমে যায়।
বৃষ্টি আবার শুরু হয়—আর তা হয় পরদিন বিকেল থেকে।
বৃষ্টি যখন শুরু হলো, তার আগেই অফিসগুলো তার কর্মীদের ছেড়ে দিয়েছে। সারা দিনের ক্লান্তি, ঘাম ও রেষারেষির সমাপ্তি টেনে সবাই তখন ঠিকানামুখী। এমন সময় আকাশ ভেঙে (আকাশ নয়, হবে মেঘ ভেঙে) বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে। এরই মধ্যে অবশ্য অনেকে বাসে চেপে বসেছে, অনেকে পৌঁছেও গেছে বাসায়, তবু পৃথিবীর প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দুর্ভাগ্যবানেরা সংখ্যায় সব সময় বেশিই থাকে। তা না হলে বৃষ্টি শুরুর পর রাস্তার পাশের দোকান, অফিসের বারান্দা, গ্যারেজের ফাঁকা অংশ—যেখানেই সামান্য আশ্রয় আছে, সেখানে কেন লোকের এমন গিজগিজে উপস্থিতি নজরে আসবে?
বৃষ্টি শুরু হয়ে আর থামছে না। চারদিক ফাঁকা হয়ে গেছে। এর ভেতর রাস্তায় হঠাৎ দু-একটা সিএনজির হন্তদন্ত ছুটে যাওয়া দেখে মনে হয়, বৃষ্টি ওদের তাড়িয়ে নিচ্ছে। অন্য সময় রাস্তায় অজস্র বাস গিজগিজ করলেও বৃষ্টিতে সব উধাও।
একটা অফিসের বারান্দায় বৃষ্টি সামনে নিয়ে শ-পঞ্চাশেক লোক দাঁড়িয়ে। শ-পঞ্চাশেক লোক মানে শ-পঞ্চাশেক মুখ। শ-পঞ্চাশেক মুখ মানে শ খানেক চোখ। এই পঞ্চাশটা মুখ থেকে প্রাথমিকভাবে আমরা দুটি মুখ বেছে নেব। এই দুজনের একজন যুবক, বয়স আটাশ থেকে ত্রিশ, আরেকজন যুবতী—পঁচিশ থেকে সাতাশ। অবশ্য মেয়েটির বয়স ত্রিশ থেকে বত্রিশ হলেও সমস্যা নেই।
বৃষ্টির ঝাপটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় আটকে পড়া লোকগুলো আরও একটু অন্তরঙ্গ হয়ে যায়। এ অন্তরঙ্গতায় কেউ কারও সঙ্গে গল্প বা আড্ডায় মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছে—তা নয়, বরং অনেক দূর থেকে ভেসে আসা সংসারের নানা কাসুন্দি কমবেশি নাড়াচাড়া শুরু হয়ে গেল আরকি। এটা সম্ভব হলো মুঠোফোনের বদৌলতে। আর পরস্পর অন্তরঙ্গ ভাবছে বলেই এমন সব কথা রাখঢাক না করেই চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। যা হোক, এর মধ্যে যে দুটি মুখের কথা বলা হলো, তাদের ভেতর তৈরি হয়েছে একটা যোগসূত্র। দুজন বারান্দার দুদিকে অবস্থান করেও এ যোগসূত্র তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের ভিড়ের ফাঁকফোকর ঘুরে দুজনের দৃষ্টি মিলিত হচ্ছে একসঙ্গে। বৃষ্টি একটু থেমে পরমুহূর্তে ঝাপটা দেয়, দৃষ্টি একটু ঘুরে পরমুহূর্তে আবার মিলিত হয়—এভাবে চলতেই থাকে। বৃষ্টি কিন্তু থামে না। বৃষ্টির ভেতর দু-একজন অস্থির হয়ে ওঠে, তারা বেরিয়ে পড়ে প্যান্ট গুটিয়ে। দৌড়ে এগোনোর চেষ্টা করে। দৃশ্যটি দেখে অন্যরা চাহনি ফেলে পরস্পর। তারপর কেউ একজন প্যান্ট গুটিয়ে লাফিয়ে পড়ে বৃষ্টিতে। এভাবে বেরোতে বেরোতে লোকজন প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেকে। শেষ পর্যন্ত যুবক-যুবতীসহ টিকে থাকে সাকল্যে জনা পাঁচেক। ঘণ্টা পেরোনো এই বৃষ্টিসন্ধ্যায় তারা পরস্পর বার পঞ্চাশেক দৃষ্টি ফেলেছে। এই দৃষ্টিপাত প্রথমে গম্ভীর, পরে হালকা এবং শেষে ঘটে মৃদু হাসি সহযোগে।
এ অবস্থায় কবি এই যুবক-যুবতীর ভেতর কথা ফেলতে চান। বরিষনময় সন্ধ্যায় এবার ওদের ভেতর হালকা কথার বৃষ্টি শুরু হোক—এমন বাসনা নিয়ে নিমগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে তাদের ভেতর একটা সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব—এ ভাবনায় মশগুল হওয়ার আগেই কেঁদে ওঠে কবির ছয় মাস বয়সী বাচ্চাটা। কান্নার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার মা জেগে উঠলে প্রথমেই তার চোখ পড়ে স্বামীর ওপর। ফলে, ছোট খোকা রেখে সে নজর দেয় বড় খোকার দিকে।
: এখনো তুমি লাইট জ্বালাইয়া রাখছ?
তার কণ্ঠ ঘুমজড়ানো হলেও কথাগুলো নির্দেশের মতো শোনায়। এরপর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে লাইট নিভিয়ে দেন কবি। এবং ভাবনা ফেলে বাচ্চার কান্না কীভাবে, কোন উপায় থামানো যায়, সে কাজে তৎপর হয়ে ওঠেন।
২. এক গল্পকার একটা গল্প লিখতে বসেছেন। গল্প স্থির করা আছে। তিনি আপাদমস্তক বিরহে মোড়ানো একটা গল্প লিখবেন। তবে তাঁর ভাবনার সামনে অনেক বিশৃঙ্খলা খেলা করে যায়। এর মধ্যে আছে মাস খানেক আগে বিচ্ছেদ হওয়া স্বামীর স্মৃতি। এটাকে তিনি অবশ্য পাত্তা দিতে রাজি নন। যে অনবরত প্রতারণা করেছে, তার চলে যাওয়াকে কোনোমতেই ক্ষত বলা যাবে না। তবু বারবার মনে হয়, লোকটা এমন করতে পারল? এত দিনের প্রেম, তারপর বিয়ে। তারপর একসঙ্গে যাপন, তারপর...। তিনি লিখতে শুরু করেন—
গল্পকার যে গল্পটা লিখতে শুরু করলেন, সেটি কবির লেখা গল্পের প্রায় হুবহু। তফাত যেটুকু, তা যৎসামান্য। তফাতটা গল্পের শুরুর অংশে। গল্পের শুরুর দিকে তিনি যে বিবরণ দেন, তা এখানে তুলে দিচ্ছি—
দাম্পত্য জীবনের দুই বছরের মাথায় জুঁই টের পায় ঘটনাটা। তার স্বামী রেদওয়ান ঝুঁকে পড়েছে অন্য এক নারীর দিকে। এই নিয়ে তাদের ভেতর কিছু দিন ধরে অস্থিরতা চলছে। তারই চূড়ান্ত ঝগড়াটা যখন সংঘঠিত হচ্ছে, বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। ঝগড়ার একপর্যায়ে জুঁই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। পেছন পেছন রেদওয়ান। জুঁই বাসা থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি একটা অফিসের বারান্দায় আশ্রয় নেয়। সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়ায় রেদওয়ান। অফিসের বারান্দায় বৃষ্টি সামনে নিয়ে শ-পঞ্চাশেক লোক দাঁড়িয়ে আছে।... তারপর গল্পকার দুজনের ভেতর চাহনি বিনিময় এবং প্রতীক্ষার বিবরণ কবির মতোই দিয়ে যান। শেষে যখন অফিসের বারান্দা প্রায় খালি হয়ে যায়, তখন দুজনের ভেতর কথা ফেলতে চান তিনি। ভাবেন, হাতজোড় করা রেদওয়ানকে জুঁইয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন, বা চোখে চোখেই একটা সমঝোতা করিয়ে দেবেন। আর কী কী বিকল্প হতে পারে, সেসব নিয়ে ভাবছিলেন গল্পকার। তখন তাঁর মুঠোফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ‘মাম’ দেখে ফোনটা কানে নিয়ে বলেন, ‘হালো মা, বলো।’ কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে বাবার কণ্ঠ শোনা যায়। বাবা বলেন, ‘মা, তোর মা হাসপাতালে।’ ফলে লেখিকা গল্পটিকে আর টানতে পারেন না।
৩. মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে লেখিকা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গে নিয়ে যান গল্পটা। এদিকে কবিও বের হওয়ার সময় নিজের ঝোলা টাইপের ব্যাগটায় গল্পটা গুঁজে রাখেন। দুজনের ভেতর খেলা করছে প্রায় একই রকম উত্তেজনা। কবি ভাবছেন, কোথাও থেকে যেন প্রেমের গল্পের তাড়নাটা আসছে। সেই কোথাওটা অচিরেই অবয়ব নিয়ে হাজির হবে। হাজির যে হবে, এ নিয়ে কবির মনে কোনো সংশয় নেই। অন্যদিকে লেখিকা ভাবছিলেন, গল্পটা লেখার পর তিনি শান্তি বা সান্ত্বনা পাবেন—তাঁকে ঘিরে আছে যে বেদনার গোলক, তা অনেকাংশেই কমে আসবে। এমনই নিজস্ব স্বপ্নে ঘোরগ্রস্ত হয়ে কবি ও লেখিকা—দুজনই শাহবাগের ফুটপাত পার হচ্ছিলেন। কবি যাচ্ছেন আজিজ মার্কেট, লেখিকা বারডেম হাসপাতালে। এই যাতায়াতের পথে সাক্ষাৎ ঘটে তাঁদের দুজনের। সাক্ষাৎ বলতে পরস্পর পরস্পরকে অতিক্রম করেন। কেউ কারও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই সম্পন্ন হয় অতিক্রমপালা। কিন্তু এর ভেতরেই নাটক যা ঘটার ঘটে। কবির গল্পটা ঝোলা থেকে এক লাফে লেখিকার ব্যাগে এবং লেখিকার গল্পটা ব্যাগ থেকে এক লাফে কবির ঝোলায় চলে আসে। পাঠক যতই অবাক হোন না কেন, ঘটনা এই—এ-ই সত্যি। কেউ যদি বলে, উহ্, কী চাপা? এটা কোনোমতেই সম্ভব না, তারপরেও এটা আসলে সম্ভব। প্রতিদিন আমাদের চারপাশে যা যা ঘটছে, সেসবের তুলনায় দুটি গল্পের দুদিকে লাফ দেওয়া অতি সাধারণ ঘটনা। সুতরাং, এটা বিশ্বাসযোগ্য। এটাই ঘটেছে—কবির গল্প লেখিকার দখলে এবং লেখিকার গল্প কবির দখলে চলে আসে।
৪. দ্বিতীয়বার কবি যখন লিখতে শুরু করেন, তখনো গভীর রাত। ঝোলা থেকে কাগজ বের করে প্রথমেই তাঁর খটকা লাগে। তাঁর হাতের লেখা কি একটু বেঁকে গেল?—ভেবেও বিষয়টা নিয়ে আর এগোন না। কারণ, গল্পের পরবর্তী দৃশ্য তাঁর মাথায় খেলছে। ফলে, এক্ষুনি সেটি নামিয়ে দিতে হবে। কিন্তু লিখতে শুরু করেই আটকাতে হয় তাঁকে। কী এক ব্যাপার ঘটে গেছে খাতাজুড়ে। গল্পটা তাঁরই, তারপরও বলতে হবে, তাঁর না—এমন একটা সংশয় থেকে গল্পটা বেশ কয়েকবার পড়ে ফেলেন কবি। প্রতিবার পড়া শেষে এলিয়ে পড়েন তিনি। মুহূর্তেই তাঁর চোখ যায় ঘুমিয়ে থাকা নারীর দিকে। নারীটির পাশে তাঁর ছয় মাসের আত্মজা, সেও ঘুমিয়ে। এসবের মধ্যে ওই নারীমুখ তাঁকে একটা বিপুল বিরক্তির ভেতর ডুবিয়ে দেয়। তাঁর মনে হয়, এই নারী তাঁর জীবনটা বিষিয়ে তুলছে; শীতের সকালের মতো একটা হাসি তাঁকে সে বরাদ্দ দেয় না বহুদিন, বা ভাপাপিঠার মতো উষ্ণ স্পর্শ—কিচ্ছু না। নারীটি এসবে না গিয়ে বারবার যায় বিরক্তি-সহায়ক ঘটনায়, যায় চোখ রাঙানোয়। এ কারণেই তাঁর একটা নিটোল প্রেমের গল্প নিজের অজান্তেই পরিণত হয়েছে বিরহের গল্পে। কবি নিজের ভেতরই—না না এ হতে পারে না আওয়াজ দিয়ে উঠে পড়েন চেয়ার থেকে। তারপর খোলা বারান্দায় এসে পায়চারি করতে থাকেন। এদিকে লেখিকা গল্প লিখতে গিয়ে একই ঘটনার মুখোমুখি। তিনি ভেবেছিলেন, নিজের কষ্টগুলো নানা কায়দায় গল্পে ঢেলে দেবেন। এতে গল্প শেষে একটা বৃষ্টিভেজা বাতাসের আমেজ টের পাবেন। কিন্তু তা তিনি পেলেন না। তবে তাঁর মনে হতে লাগল, কোথায় যেন প্রেম লুকিয়ে আছে, ধরা দিতে গিয়েও দিচ্ছে না। লেখিকার ভাবনায় তখন তাঁর স্বামী লোকটার চেহারা এসে হাজির হয়। তাঁর সামনে বেদনার স্মৃতিগুলো ফিকে হয়ে ভিড় করে আনন্দের স্মৃতিই। সুতরাং, লেখিকা নিশ্চিত, ওই লোকটা তাঁর কাছে আবার ফিরে আসবে। আসবে! অথবা তাঁর মন কোনো বেদনায় নয়, যেতে চায় আনন্দগঞ্জে।
৫. এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে। কবির ভেতর একটা অবিশ্বাস ছক্কাপাঞ্জা খেলতে শুরু করে। কেন যেন তাঁর মনে হতে থাকে, তাঁর স্ত্রীর হৃদয় অন্যদিকে ঝুঁকে আছে। এই মানুষটিকে, এই চিত্রকল্প জন্মদাতা কবিকে সে কোনোমতেই ভালোবাসে না—এ ধারণা কবিকে সকাল-সন্ধ্যা গুঁত্তা দিয়ে বেড়ায়। ফলে, যখনই তাঁর মনে হয়, ওই নারী তাঁকে ভালোবাসে না, তখনই তিনি লাফিয়ে ওঠেন—অফিসে থাকলে এক লাফে নিচের চায়ের দোকানে পৌঁছে যান, আর বাসায় থাকলে বারান্দায়। নারীটি অবশ্য কবির এমন কর্মকাণ্ডে ভেংচিই কাটে। বলে, ‘ইদানীং দেখছি তুমি আর কবি নাই, কবি থেকে দার্শনিক হয়ে গ্যাছ।’
এমন দিনযাপনের ভেতর একদিন ‘ওই নারী আমারে ভালোবাসে না, বাসে অন্য কাউকে’—এই আপ্তবাক্য স্মরণে আসামাত্র অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েন কবি। ভরদুপুরে হাজির হন বাসায়। কড়া নেড়ে অপেক্ষা করেন। দরজা খুলে চোখ কপালে তোলে বউ, ‘তুমি?’
কবি কোনো কথা বলেন না, বউকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে বাসায় ঢুকে পড়েন। ড্রয়িংরুমে এসে প্রথমে তাঁর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলেও তা পুরোমাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। কবির পেছন পেছন তাঁর স্ত্রীও চলে আসে। একটা স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে সে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘এ আমার বন্ধু কাওসার, যে কাওসারের কথা তোমাকে বলি।’ পরিচয় করানোমাত্র একটা মোলায়েম হাসি ছড়িয়ে হাত বাড়ান কবি, যুবকও হাত বাড়ায়। কবি বলেন, ‘কী করছিলেন?’
যুবক অন্য হাতের ছুরিটা দেখিয়ে বলে, ‘পুডিং কাটছিলাম।’ ‘পুডিং অনেক নরম এবং সুস্বাদু, কাটতেও ভালো লাগে। আমিও কাটি, হে হে হে।’—কবি আওড়ালেন। এ পর্যন্ত বলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। ওদিকে লেখিকার মনে প্রেম তুমুলভাবে জেগে ওঠে। প্রেমের ধাক্কায় তিনি বেরিয়ে পড়েন বাসা থেকে। গন্তব্য সদ্য সাবেক হওয়া স্বামীর অফিস। লেখিকা ঠিক করেন, অফিসে পৌঁছে সবার সামনে স্বামীর হাত ধরে বলবেন, ‘অনেক হয়েছে, এবার চলো।’ কিন্তু তখনই তাঁর মাথায় আসে ওই মেয়ের কথা, যাকে নিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁর স্বামী। তবে পরমুহূর্তেই মাথা থেকে এটি ঝেড়ে ফেলেন তিনি। সাবেক স্বামীর অফিসে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গন্তব্যের কথা লেখিকা ভাবতে পারেন না। অবশ্য স্বামীর অফিসের কাছাকাছি পৌঁছালে তাঁর ফোন বেজে ওঠে। স্কিনে নাম দেখে প্রথমে কাঁপতে থাকে তাঁর হাত। কোনোমতে নিজেকে থামান। স্বর স্বাভাবিক রেখে রিসিভ করেন ফোন—
: হ্যালো কায়েস, কী খবর?
: ভালো, তুমি কই?
: কেন?
: তুমি কোথায় তা-ই বলো। আমি আসছি। লেখিকা তাঁর অবস্থান জানিয়ে দেন। কায়েস আসে এবং লেখিকাকে নিয়ে রওনা হয় আনন্দগঞ্জের দিকে।
No comments