‘দুই পাকিস্তানপ্রেমী’র জন্য পাকিস্তানের দরদ by সোহরাব হাসান
মানবতাবিরোধী
অপরাধের দায়ে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর
নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে পাকিস্তান সরকার এবং
সেই দেশের গণমাধ্যম ও একাধিক রাজনৈতিক দল যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে,
তাতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রতিই
তাঁদের অধিক আনুগত্য ছিল। আর সেটি লুকোছাপা না করে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র ও
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে জিহাদি মনোভাব দেখিয়েছে, তা
কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী
জানান, বাংলাদেশে দুই যুদ্ধাপরাধীর বিচারে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত ও
উদ্বিগ্ন। নিসার আলী ১৯৭৪ সালের চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যা বলেছেন,
তার অর্থ হলো সে সময় পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দিয়ে এখন বিচার
করছ কেন? এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও একই কথার প্রতিধ্বনি তুলে
দুই দেশের সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের স্বার্থে এ ব্যাপারে আর অগ্রসর না হওয়ার
আহ্বান জানালেন। নিজের কথায়ই পাকিস্তান ধরা খেয়েছে। ১৯৭৪ সালের ত্রিদেশীয়
চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আটক ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা
কর্মকর্তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও বিচার না করে মাফ করে দেওয়ার কথা
বলা হয়েছিল। তাই, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে চাই,
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যাঁদের মাফ করে দিতে এবং ভুলে যেতে
বলেছিলেন, সেই তালিকায় কি সম্প্রতি দণ্ড পাওয়া দুই যুদ্ধাপরাধীর নাম ছিল?
তাঁরা কি পাকিস্তানের নাগরিক?
আসলে পাকিস্তানের এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পেছনে যে বিষয়টি কাজ করেছে, তা হলো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি সামনে এলে পাকিস্তানের কৃতকর্মও মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক ও রাজনীতিকেরা সেটি হতে দিতে চান না। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিকেরা একাত্তরের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না থেকেও নিজেদের মানসিকভাবে যুক্ত করেছেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এত দিন একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পিপিপি ও তার নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওপর দায় চাপালেও এখন মনে হচ্ছে, তিনিও সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
বাংলাদেশের দুই যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জামায়াতের নেতা সিরাজুল হক। রোববার বান্নুতে আয়োজিত এক জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই নেতার একমাত্র অপরাধ ছিল, তাঁরা এই দেশ ও এর আদর্শ ও সেনাবাহিনীকে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার একের পর এক পাকিস্তানপন্থী লোকদের নির্মূল করছে এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। কিন্তু ইসলামাবাদের শাসকেরা নিশ্চুপ রয়েছেন।’ জামায়াতের এই নেতা পাশাপাশি নওয়াজ শরিফকে উদার নীতি ত্যাগ করতে বলেছেন। অন্যথায় বাংলাদেশ বা ভারতে চলে যেতে বলেছেন।
পাকিস্তানে প্রতিদিনই সন্ত্রাসী ঘটনায় মানুষ বহু মারা যাচ্ছে, তার প্রতিবাদে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি কালো দিবস পালন না করলেও বাংলাদেশের দুই নেতার বিচারের প্রতিবাদে কালো দিবস পালন করেছে। কম যায়নি ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফও। দলটি পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে এ দুজনের ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রস্তাব এনেছে।
তবে পাকিস্তান সরকার ‘ভারসাম্যহীনভাবে অতি আবেগ’ দেখিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর। তিনি অভিযোগ করেন, সামরিক আদালতে ও সৌদি আরবে পক্ষপাতদুষ্ট বিচারের মাধ্যমে পাকিস্তানের নাগরিকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও সে ব্যাপারে সরকার নীরব থাকে। তাদের এমন প্রতিক্রিয়া এই বার্তা দেয় যে দেশের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের অধিক ভালোবাসা ও আবেগ রয়েছে। পাকিস্তানের এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পাকিস্তানে ও সৌদি আরবে যেসব পাকিস্তানি নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের প্রতি আগে সরকারকে আবেগ দেখাতে হবে। সরকারের এমন আবেগ একটি ব্যাপার নিশ্চিত করেছে যে ওই দুজন (সাকা ও মুজাহিদ) রাজনৈতিক এজেন্ট ছিলেন এবং পাকিস্তানের জন্য কাজ করতেন। ওই দুজন বাংলাদেশি কি পাকিস্তানে বসবাসকারী নাগরিকদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে কেন এবং কিসের জন্য—সরকারের এটাও পরিষ্কার করা উচিত।
গত বছর ডিসেম্বরে পাকিস্তানে মৃত্যুদণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর গত ১১ মাসে ২৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, যা বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম।
পাকিস্তানের এই অকূটনৈতিক আচরণ ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত সোমবার পাকিস্তানকে দেওয়া প্রতিবাদে বলা হয়: মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে দণ্ডিত দুজনের ফাঁসি নিয়ে ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশ এটাও আশা করে যে পাকিস্তান দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবে। এতে আরও বলা হয়: ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি নিয়ে খণ্ডিত ব্যাখ্যা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবেশী ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হচ্ছে চুক্তির মূলনীতি। ওই চুক্তিতে কখনোই মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় জড়িত এবং এর পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি কিংবা বিচার থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলা হয়নি।
১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে ত্রিদেশীয় চুক্তি সই হয়, তাতে কোথাও নিজে দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না, সে কথা বলা নেই। এই চুক্তির ১৩ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে: উপমহাদেশে শান্তি এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং তিন দেশের মধ্যে আশু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিষয়টি নিয়ে তিন দেশের তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বৈঠকে বলেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব, আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যাজনিত অপরাধ বিষয়ে যত আইন আছে তার সবগুলোর বিবেচনাতেই ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য অপরাধী। ওই সব আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার সংজ্ঞায় যেসব অপরাধের নাম আছে এবং যারা ওই সব অপরাধ করবে, তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে সারা বিশ্ব সর্বসম্মতভাবে একমত। আর ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ওই সব আইনে বর্ণিত অনেক অপরাধ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার সরকার এসব ঘটনার নিন্দা জানায় এবং এ–জাতীয় অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্য পাকিস্তান গভীরভাবে অনুতপ্ত।
চুক্তির ১৪ নম্বর ধারায় আছে: তিন মন্ত্রী একমত হন যে, উপমহাদেশে শান্তি ও অগ্রগতির স্বার্থে তিন দেশের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, তার আলোকেই ১৯৫ জন সৈনিকের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রই বাংলাদেশ ভ্রমণে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং সমঝোতার স্বার্থে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে অতীতের ভুলগুলো ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। একইভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানিদের ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমা করতে জানে। তাই নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করার জন্য ১৯৭১ বাংলাদেশে যে বর্বরতা এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হয়েছে, তা তিনি তার দেশের নাগরিকদের ভুলে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। এবং ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়: ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও’ বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই আবেদন এবং মনোভাবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অতঃপর দিল্লি সমঝোতার আলোকে অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে এই ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তাদেরও ভারত হতে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।’
ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ।
এখন দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান মোটেই অনুতপ্ত হয়নি। বরং পাকিস্তান সরকার ও সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলো সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিচারের বিরোধিতা করে এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, এই দুই নেতা ছিলেন তাদের আদর্শে বিশ্বাসী, যে কথা আসমা জাহাঙ্গীর তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন।
সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের এই প্রতিক্রিয়ার আরেকটি কারণ হলো সত্যের মুখোমুখি হতে না চাওয়া। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন কর্মকর্তার বিচার না করে দেশটি আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন করেছে। তাই আমরা মনে করি, তাঁদের বিচারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা জরুরি। কেননা, গণহত্যার মতো অপরাধ কখনোই তামাদি হয় না। পাকিস্তান সরকার গঠিত হামুদুর রহমান কমিশনও বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তার বিচারের সুপারিশ করেছিল।
এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীরের ভূমিকার কথাও স্মরণ করতে চাই। তিনি দুটি বিষয়কে সামনে রেখে জনমত তৈরির পক্ষে কাজ করছেন। এক, একাত্তরের অপরাধের জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া। দুই. অপরাধে জড়িত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিচার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজও মনে করেন, ‘১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে হস্তান্তর ও বিচারের ব্যাপারে এই চুক্তিটি কোনো আইনি বাধা নয়। ১৯৭১ সালে যাঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনে করা এখনো সম্ভব।’
ইতিহাসের দায়মুক্তির জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা সব অপরাধীরই বিচার হওয়া প্রয়োজন। এই বিচারের কাজটি আমরা আগে শুরু করতে পারলে হয়তো পাকিস্তান এই ‘ভারসাম্যহীন অতি আবেগ’ দেখানোর সাহস পেত না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
আসলে পাকিস্তানের এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পেছনে যে বিষয়টি কাজ করেছে, তা হলো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি সামনে এলে পাকিস্তানের কৃতকর্মও মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক ও রাজনীতিকেরা সেটি হতে দিতে চান না। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিকেরা একাত্তরের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না থেকেও নিজেদের মানসিকভাবে যুক্ত করেছেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এত দিন একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পিপিপি ও তার নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওপর দায় চাপালেও এখন মনে হচ্ছে, তিনিও সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
বাংলাদেশের দুই যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জামায়াতের নেতা সিরাজুল হক। রোববার বান্নুতে আয়োজিত এক জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই নেতার একমাত্র অপরাধ ছিল, তাঁরা এই দেশ ও এর আদর্শ ও সেনাবাহিনীকে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার একের পর এক পাকিস্তানপন্থী লোকদের নির্মূল করছে এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। কিন্তু ইসলামাবাদের শাসকেরা নিশ্চুপ রয়েছেন।’ জামায়াতের এই নেতা পাশাপাশি নওয়াজ শরিফকে উদার নীতি ত্যাগ করতে বলেছেন। অন্যথায় বাংলাদেশ বা ভারতে চলে যেতে বলেছেন।
পাকিস্তানে প্রতিদিনই সন্ত্রাসী ঘটনায় মানুষ বহু মারা যাচ্ছে, তার প্রতিবাদে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি কালো দিবস পালন না করলেও বাংলাদেশের দুই নেতার বিচারের প্রতিবাদে কালো দিবস পালন করেছে। কম যায়নি ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফও। দলটি পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে এ দুজনের ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রস্তাব এনেছে।
তবে পাকিস্তান সরকার ‘ভারসাম্যহীনভাবে অতি আবেগ’ দেখিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর। তিনি অভিযোগ করেন, সামরিক আদালতে ও সৌদি আরবে পক্ষপাতদুষ্ট বিচারের মাধ্যমে পাকিস্তানের নাগরিকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও সে ব্যাপারে সরকার নীরব থাকে। তাদের এমন প্রতিক্রিয়া এই বার্তা দেয় যে দেশের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের অধিক ভালোবাসা ও আবেগ রয়েছে। পাকিস্তানের এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পাকিস্তানে ও সৌদি আরবে যেসব পাকিস্তানি নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের প্রতি আগে সরকারকে আবেগ দেখাতে হবে। সরকারের এমন আবেগ একটি ব্যাপার নিশ্চিত করেছে যে ওই দুজন (সাকা ও মুজাহিদ) রাজনৈতিক এজেন্ট ছিলেন এবং পাকিস্তানের জন্য কাজ করতেন। ওই দুজন বাংলাদেশি কি পাকিস্তানে বসবাসকারী নাগরিকদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে কেন এবং কিসের জন্য—সরকারের এটাও পরিষ্কার করা উচিত।
গত বছর ডিসেম্বরে পাকিস্তানে মৃত্যুদণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর গত ১১ মাসে ২৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, যা বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম।
পাকিস্তানের এই অকূটনৈতিক আচরণ ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত সোমবার পাকিস্তানকে দেওয়া প্রতিবাদে বলা হয়: মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে দণ্ডিত দুজনের ফাঁসি নিয়ে ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশ এটাও আশা করে যে পাকিস্তান দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবে। এতে আরও বলা হয়: ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি নিয়ে খণ্ডিত ব্যাখ্যা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবেশী ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হচ্ছে চুক্তির মূলনীতি। ওই চুক্তিতে কখনোই মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় জড়িত এবং এর পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি কিংবা বিচার থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলা হয়নি।
১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে ত্রিদেশীয় চুক্তি সই হয়, তাতে কোথাও নিজে দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না, সে কথা বলা নেই। এই চুক্তির ১৩ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে: উপমহাদেশে শান্তি এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং তিন দেশের মধ্যে আশু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিষয়টি নিয়ে তিন দেশের তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বৈঠকে বলেন যে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব, আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যাজনিত অপরাধ বিষয়ে যত আইন আছে তার সবগুলোর বিবেচনাতেই ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য অপরাধী। ওই সব আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার সংজ্ঞায় যেসব অপরাধের নাম আছে এবং যারা ওই সব অপরাধ করবে, তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে সারা বিশ্ব সর্বসম্মতভাবে একমত। আর ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ওই সব আইনে বর্ণিত অনেক অপরাধ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার সরকার এসব ঘটনার নিন্দা জানায় এবং এ–জাতীয় অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্য পাকিস্তান গভীরভাবে অনুতপ্ত।
চুক্তির ১৪ নম্বর ধারায় আছে: তিন মন্ত্রী একমত হন যে, উপমহাদেশে শান্তি ও অগ্রগতির স্বার্থে তিন দেশের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, তার আলোকেই ১৯৫ জন সৈনিকের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রই বাংলাদেশ ভ্রমণে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং সমঝোতার স্বার্থে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে অতীতের ভুলগুলো ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। একইভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানিদের ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমা করতে জানে। তাই নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করার জন্য ১৯৭১ বাংলাদেশে যে বর্বরতা এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হয়েছে, তা তিনি তার দেশের নাগরিকদের ভুলে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। এবং ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়: ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও’ বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই আবেদন এবং মনোভাবের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অতঃপর দিল্লি সমঝোতার আলোকে অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে এই ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তাদেরও ভারত হতে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।’
ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ।
এখন দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান মোটেই অনুতপ্ত হয়নি। বরং পাকিস্তান সরকার ও সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলো সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিচারের বিরোধিতা করে এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, এই দুই নেতা ছিলেন তাদের আদর্শে বিশ্বাসী, যে কথা আসমা জাহাঙ্গীর তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন।
সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের এই প্রতিক্রিয়ার আরেকটি কারণ হলো সত্যের মুখোমুখি হতে না চাওয়া। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন কর্মকর্তার বিচার না করে দেশটি আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন করেছে। তাই আমরা মনে করি, তাঁদের বিচারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা জরুরি। কেননা, গণহত্যার মতো অপরাধ কখনোই তামাদি হয় না। পাকিস্তান সরকার গঠিত হামুদুর রহমান কমিশনও বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তার বিচারের সুপারিশ করেছিল।
এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীরের ভূমিকার কথাও স্মরণ করতে চাই। তিনি দুটি বিষয়কে সামনে রেখে জনমত তৈরির পক্ষে কাজ করছেন। এক, একাত্তরের অপরাধের জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া। দুই. অপরাধে জড়িত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিচার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজও মনে করেন, ‘১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে হস্তান্তর ও বিচারের ব্যাপারে এই চুক্তিটি কোনো আইনি বাধা নয়। ১৯৭১ সালে যাঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনে করা এখনো সম্ভব।’
ইতিহাসের দায়মুক্তির জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা সব অপরাধীরই বিচার হওয়া প্রয়োজন। এই বিচারের কাজটি আমরা আগে শুরু করতে পারলে হয়তো পাকিস্তান এই ‘ভারসাম্যহীন অতি আবেগ’ দেখানোর সাহস পেত না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments