বিচিত্র জীবন আবদুল হকের by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ
‘আপনি
কি চাপাতির আঘাতে মৃত্যুর সময় হাঁসফাঁস করতে চান?’ মুঠোফোনে ভয়াবহ এমন
বার্তাই গিয়েছিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য
যিনি নিজের জীবনের পুরোটা নিংড়ে দিয়েছেন- নির্বিরোধী এ ব্যক্তির কাছে এমন
বার্তা দেয়ার মতো মানুষও যে আছে কেউই ভাবতে পারেন না। অথচ যার হাত হয়ে
হুমকিবার্তা গেছে তারই ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। তারও
ভালোবাসা(!) সাহিত্যের প্রতি। আবদুল হকের বিরুদ্ধে মোবাইল ফোনে এসএমএস
জালিয়াতির মাধ্যমে হুমকি দিয়ে অনেককে ফাঁসানোর অভিযোগ অনেক আগে থেকেই।
অভিযোগ আছে বিভিন্ন জনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়েরও। মানবজমিনেও বেশ
কয়েকবার এমন অভিযোগের খবর উঠেছে। তার বিরুদ্ধে প্রথম যখন অভিযোগ উঠেছিল
নিজের বক্তব্য জানিয়ে একটি ই-মেইল বার্তা পাঠিয়েছিলেন তিনি। কোন প্রতিবাদ
নয়, নিছক নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছিলেন সে বার্তায় ‘বারবার
হ্যাকিঙের অভিযোগ আমার দিকেই ছুটে আসে কেন, ভাবছি। মনে হয় তার কারণ এই যে,
লোকে মনে করে আমি আইটি বিশেষজ্ঞ। আসলে আমি বিশেষজ্ঞ নই। যদি হয়েও থাকি,
তাহলে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। অপরাধ হলো মানুষের ক্ষতি করা। আমি
আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় কারও ক্ষতি করেছি- এমন প্রমাণ কারও কাছে নেই। আছে
শুধু সন্দেহ।’ আবদুল হক মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেষ
পর্যন্ত যেতে পারেননি। সনদ পাওয়ার আগেই থেমে গেছে তার শিক্ষাজীবন। তবে তার
কলম থেমে থাকেনি। লেখালেখির হাত আবদুল হকের বেশ ভালোই। কলমেও ধার আছে।
সাহিত্যের ভুবনের প্রতি তার যেন আজন্মের ভালোবাসা। মাদরাসার শিক্ষক আবদুল
হক চোখ বুঝে ছেলের নাম রাখেন এক সাহিত্য পুরুষের নামে। অদ্বৈত, তার দুই বছর
বয়সী ছেলের নাম। আবদুল হক ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথকে। ভালোবাসেন জীবনানন্দ
দাশকে। যখন মাদরাসার শিক্ষক তখন মাদরাসায় তার কক্ষেও স্থান হয় এই লেখকদের।
মাদরাসার শিক্ষক হলেও আবদুল হকের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে নিজের মুখের
পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথের জায়গাও হয় অনায়াসেই। কানাঘুষা হয় মাদরাসায়। কান দেন
না আবদুল হক। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার শাহবাগ জামেয়া মাদরাসার কম্পিউটার
শিক্ষক আবদুল হক চলেন নিজের মতোই। কম্পিউটার ও প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষ দখল
তার। তাই কানাঘুষা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে সরব হয়নি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। তবে
তার বিরুদ্ধে এসএমএস জালিয়াতির অভিযোগ উঠলে কর্তৃপক্ষ তাকে ছাঁটাইয়ের
সিদ্ধান্ত নেয়। অভিযোগ উঠে তার কারসাজিতেই ফায়যুর রাহমান নামের এক কোরআনে
হাফেজের মোবাইল ফোন থেকে হত্যার হুমকি দিয়ে এসএমএস গেছে অর্থমন্ত্রী ও
শিক্ষামন্ত্রীর মোবাইল ফোনে। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর হতে হয় মাদরাসা
কর্তৃপক্ষকে। তবে আবদুল হকের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বহিষ্কারের মতো
সিদ্ধান্ত নেয় না মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। তারা আবদুল হককে নিজ থেকে অব্যাহতি
চাওয়ার সুপারিশ করে। আবদুল হক অব্যাহতি নেন ২০১৪ সালের ২৯শে অক্টোবর।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার গাঙপাড় নোয়াকোটের খলিলুর রহমানের ছেলে আবদুল হক
মাদরাসার চাকরি হারিয়ে ফিরে আসেন নিজের গ্রামে। দিনের সময়টুকু বাড়িতেই
কাটে, সন্ধ্যা হলে চলে যান স্থানীয় শারপিন বাজারস্থ জনৈক ইয়াকুবের দোকানে।
সময় কাটান সেখানেই। বাড়িতে অবস্থানরত সময়ে এসএমএসের মাধ্যমে হত্যা হুমকির
আরও দুটো ঘটনা ঘটে। একটি ঘটনায় হত্যার হুমকি বার্তা পৌঁছে আওয়ামী লীগ নেতা
শেখ ফজলুল করিম সেলিমের কাছে। অন্য ঘটনায় হুমকি পৌঁছে সুনামগঞ্জের ছাতক
উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আইনূর আক্তার পান্না ও ছাতক থানার ওসি শাহজালাল
মুন্সির মোবাইলে। যে দুটো মোবাইল থেকে এমন হুমকি গেছে দুটো মোবাইল ফোনের
মালিকের সঙ্গেই যোগসূত্র রয়েছে আবদুল হকের। শেখ সেলিমের মোবাইল ফোনে হুমকি
বার্তা নিয়ে যে নম্বর পৌঁছেছে সে নম্বরটির মালিক আবদুল হকের মাদরাসার
সহকর্মী মাওলানা সাদ উদ্দিনের। সাদ উদ্দিন আবদুল হকের ছেড়ে আসা পদে দায়িত্ব
পেয়েছিলেন। আর অপর যে মোবাইল নম্বরটি হুমকি বার্তা নিয়ে ছাতকের ইউএনও,
ওসির কাছে গেছে সে নম্বরের মালিক আবদুল হকের গ্রামের বাসিন্দা মোখলেসুর
রহমান। দুটো ঘটনাতেই সন্দেহের তীর ছুটে আবদুল হকের দিকে। আর তা অভিযোগ হয়ে
পৌঁছে মানবজমিন পর্যন্ত। অভিযোগগুলো প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হলে আবদুল
হকের আরও একটি ই-মেইল বার্তা পৌঁছে প্রতিবেদকের কাছে। আবদুল হক আবারও
অস্বীকার করেন তার সংশ্লিষ্টতা। প্রথম ই-মেইল বার্তায় আবদুল হক উল্লেখ
করেছিলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষ নই, সাধারণেরও নিচে, অবসাধারণ-খুব ছোট মানুষ।
জন্মাবধি বইয়ে ডুবে আছি। টুকটাক লিখি মাঝেমধ্যে, প্রবন্ধ আর কবিতা। সেসব
কিছু হয় কি না জানি না। শুধু জানি যে, সাহিত্যের বাইরে আমার আর কোন স্বপ্ন
নেই। শিক্ষকতা আমার বাহ্যিক জীবিকার উপায়, আগ্রহের পেশা নয়।’ ইন্টারনেটের
ভুবন ঘেঁটেও আবদুল হককে এমনই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, সাহিত্যের মাঝেই যেন
তার প্রাণ রাখা। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিপদে ফেলা, এসএমএস জালিয়াতির মাধ্যমে
কাউকে সন্ত্রাসী সাজানো তার এ পরিচয়ের সঙ্গে খুব একটা খাপ খায় না। তবে
ঘটনাগুলোর সঙ্গে আবদুল হকের সুতোর যোগ, প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান সব খাপে
খাপে মিলে গিয়ে আবদুল হকই অপরাধীর খোপে আটকে গেছেন। আবদুল হক বলছেন, তিনি
অপরাধী নন। তবে প্রমাণগুলো তার পক্ষে বলছে না। তার বিরুদ্ধে থাকা
প্রমাণগুলো বলছে, আবদুল হক এক বিচিত্র জীবনযাপন করছেন। সাহিত্যের সফেদ
শুভ্র বসন ভালোবাসেন তিনি। ভালোবাসেন অপরাধের কালিমাও।
No comments