বাঁশিওয়ালা মজ্জেল by মোজাফ্ফর হোসেন
আজ এতকাল পর মজ্জেলের সঙ্গে দেখা। যত দূর মনে পড়ে, ও মারা গিয়েছিল বছর পনেরো আগে, মে কি জুন মাসে। দিনটি ছিল ওই বছর সবচেয়ে গরম পড়া দিনগুলোর একটি। অবশ্য ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ওর মৃত্যুরও বছর দুয়েক আগে। দুই বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর আমাদের ব্যাঙগাড়ির মাঠে এক শ্যালো মেশিনের পাশে লাশটা মেলে। শরীরের কোনো অংশে কাটাছেঁড়ার দাগ ছিল না। লোকমুখে মৃত্যুর কত কারণ শুনেছি—কোনো একটা ঠিক ছিল হয়তো, কিংবা কোনোটাই না। এ নিয়ে পরে কোনো উচ্চবাচ্য না হওয়ায় এসব কথার কোনো একটা ভার্সন আমাদের মেনে নিতে হয়েছে। যেমন আমাদের এক বাড়িতেই চারটা ভার্সন তৈরি হলো। বাবা বললেন, ‘সব সময় মৃত্যুর কারণ থাকবে, এমনটি আশা করা ভুল।’ মা বললেন, ‘মৃগিব্যারাম, গরমে ওর সমস্যাটা আরু বাড়তুক।’ মুশির মা বলল, ‘জিনের দোষে মরছে। ওমন ধু ধু ফাঁকা মাঠে একা মানুষ বাঁচে নাকি! দেখো গে তিয়াস মিটাতি গিছিলু, অমনি গলা মটকি দিছে।’ আমি মেনে নিয়েছি দাদির ভার্সনটা। দাদির ধারণা, মজ্জেল বাঁশিতে ফুঁ দিতে না পেরে দম আটকে মারা গেছে! মৃত মজ্জেলকে দেখতে যেতে আমার মন সায় দেয়নি। ওর লুঙ্গির কোঁচে বাঁশিটা গোঁজা ছিল, আর কিছু ছিল না সঙ্গে। যারা দেখতে গিয়েছিল তাদের মুখে শোনা।
এভাবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। প্রথেম আমি ওকে চিনতে পারিনি। ওর বাঁশির সুর শুনে চেনা চেনা বলে আন্দাজ করেছিলাম মাত্র। মজ্জেলই আমাকে প্রথম চিনল, তা-ও চাঁদনি রাতে এক সমুদ্র আলোয় আমার কাঁপা কাঁপা অবয়ব দেখে; অথবা হতে পারে, আগে থেকেই ও আমাকে চিনতে পেরে অনুসরণ করছিল।
‘কী দাদাভাই, মিঠুন-কাট লাগবি নাকি?’—মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে ওর সেই গাল–টানা হাসিটা হেসে বলল।
‘এখন আর তোমার মিঠুনের যুগ না। এটা হলো রণবীরদের যুগ—এক রণবীর সিং আরেক রণবীর কাপুর! ওদের অবশ্য তুমি চিনবে না।’—আমিও যথারীতি হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম। আমরা পাশেই একটি কাঠের গুঁড়ির ওপর দুজন দুদিকে মুখ করে বসলাম। ২০০৯ সালে আইলাতে সমুদ্রের শরীরের এদিকটাতে আরও কিছুটা জল ধরে, বেদখল হয় লোকালয়ের অংশবিশেষ, দু-একটা গাছের গুঁড়ি এখনো ভাটার সময় জেগে ওঠে।
‘তুমি এখানে যে?’—আমি জানতে চাইলাম।
‘গাঙয়ের ধারে বসে বাপজানের কাছ সাগরের মেলা গল্প শুনছি। বাপজান শুনছে তাঁর বাপজানের কাছে। সে শুনছে আবার তাঁর বাপজানের কাছে। চৌদ্দপুরুষে মিলে কেউ সমুদ্র দেকিনি। গাঙ শুকি খাল হলু, খাল শুকি খটখটে মাঠ। মরার আগে বাপজান আমার হাতখান ধরি বুলিছিল, তুই দেখিস বাবা। তোর কাছে আর কিছুই আমার চাওয়ার নেই। মানষে তার পুলার কাছে কত কিছু চায়—ছেলি ডাক্তার হবি, ব্যারিস্টার হবি, মাতব্বর হবি, দশ গাঁয়ের মানুষ তাকে মান্য করি চলবি। আমার বাজান চে’ছিল, আমি সাগর দেখবু। গেল বছর একিনে আসছি। তার আগে কয়েক বছর কক্সবাজারে ছিলাম।’
‘সমুদ্র তোমার ভালো লাগে?’—আমি আনমনা হয়ে জানতে চাই।
‘কী জানি! তয় ডাঙায় আর মন টেকে না। মনটা খালি তড়পায়। জল বড় মায়া ডাক ডাকে রে ভাই।’
‘বাঁশিতে একটু ফুঁ দাও না মজ্জেল। কত দিন পানির পাশে বসে তোমার বাঁশি শোনা হয়নি। তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের শানবাঁধানো পুকুরপাড়ে বসে বাঁশি বাজাতে, আর আমরা তোমার পাশে গোল করে বসে তন্ময় হয়ে সেই বাঁশি শুনতাম—মনে পড়ে?’
মজ্জেল কোনো কথা বলে না। সমুদ্রের জলের মতো ওর চোখেও চাঁদের চিকন আলো গলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। বাঁশিটা মুখে তোলে মজ্জেল। বাঁশি বাজায় চোখ বন্ধ করে, ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো গভীর মনোযোগ দিয়ে। সেই মজ্জেল, তেমনই আছে, তেমন সুরেলা বাজায় সে।
আমার বয়স যেদিন সাত দিন হলো, সেদিনই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমার আঁতুড়ে চুল ফেলার জন্য মা ডেকেছিল। তপ্ত দুপুরে গোলাঘরের চালের তলে বসে আমার চুল কেটেছিল। আমি ছিলাম দাদির কোলে ধরা। শুধু আমি না, প্রথম চুল কাটা থেকে অনেক বড় হওয়া অবধি আমার পাঁচ ভাইয়ের চুল কেটেছে মজ্জেল। গায়ের প্রায় সকল আবালবৃদ্ধবনিতার চুল মজ্জেলই কাটত। আমার চুল কাটা শেষ হলে মজ্জেল কাঁঠালের সার দিয়ে গরম ভাতে জল ঢেলে পান্তা বানিয়ে খেয়েছিল। ছেলের প্রথম চুল কাটা, মা বাড়ির পোষা মুরগির ঝালমাংস রান্না করেছিল, মজ্জেল খায়নি। কটা টাকা বকশিশ দিতে চেয়েছিল মা, তা-ও নেয়নি। বরাবরের মতো কেজি খানেক চাল গামছায় বেঁধে হাঁটা দিয়েছিল। এসব কথা আমার মায়ের মুখে শোনা। মজ্জেল যেদিন মারা গেছে বলে সংবাদ এল, সেদিন মা আমাকে দুঃখ করে কথাগুলো বলছিল।
বুদ্ধি হওয়ার পর দেখতাম, কোনো এক শুক্রবারে জুমার আগে মজ্জেলকে বাড়িতে ডাকা হতো। আমরা পিঠাপিঠি দু-ভাই খালি গা হয়ে বসে পড়তাম। মজ্জেল বাবার চাকু-কাস্তে ধার করা বেলিটে বালু দিয়ে তার ক্ষুর ধার দিত। আমরা বসতাম, মজ্জেল তার স্বভাবজাত ঢঙে জানতে চাইত, ‘মিঠুন, না অমিতাভ?’ আমি বলতাম, মিঠুন। মেজো ভাইয়ের পছন্দ ছিল অমিতাভ। মজার ব্যাপার হলো, আমরা কেউই তখন অমিতাভ বা মিঠুনকে চিনতাম না। গাঁয়ে তখনো টেলিভিশন ঢোকেনি। আমার ধারণা, মজ্জেলও দেখেনি। তবে আমার ধারণা ভুলও হতে পারে; পাশের গাঁয়ে চুল কাটতে গিয়ে হয়তো কারও বাড়িতে দেখে থাকতে পারে। কারণ, পাশের গ্রামে তখন তিনটি টিভি আছে বলে আমাদের কাছে খবর ছিল। গাঁয়ে–গাঁয়ে কাজিয়া বাধলে ওরা এই টেলিভিশন থাকা নিয়ে বড্ড বড়াই করত। চুল কাটা হলে আয়নায় দেখতাম, দুজনের চুল কাটার স্টাইল হুবহু এক। মজ্জেলের চুল কাটার ভ্যারিয়েশনটা ছিল ওর মুখেই, কাঁচিতে নয়। সারা গাঁয়ে একভাবেই চুল কেটেছে বড়-ছোট সবার। বৈচিত্র্য ছিল না ওর বাঁশির সুরেও। সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্ত একটানা এক সুরে বাজত ওর বাঁশি। এক সুরা হলেও বেসুরা ছিল না। প্রতিদিনই মনে হতো নতুন করে শুনছি—এমনই দরদ দিয়ে বাজাত ও। ওর নাপিতগিরিতে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না বটে, কিন্তু বাঁশিওয়ালা মজ্জেলে আমাদের কারোরই কোনো অতৃপ্তি ছিল না।
‘চল, একটু হাঁটি।’—বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে বলল মজ্জেল।
আমরা হাঁটতে থাকি।
‘আচ্ছা, রাত বিশেষ হয়নি, ওদিকটাই মানুষ যা আছে একেবারে কম না। এদিকটা এমন ফাঁকা কেন?’—আমি জানতে চাই।
‘আমি থাকি বলে।’—সরলভাবে উত্তর করে মজ্জেল। ‘রাতে বাতাসে বাঁশির সুর শুনি কেউ আসবার সাহস পায় না। আমাকে তো আর কেউ দেখতি পায় না! ভয়ের দেখি বিশ্বজয়, বুঝলি দাদা?’—মজ্জেল বাঁকা হাসি হেসে বলে।
‘সেদিন তুমিও যদি কোনো ভয় ওদের দেখাতে পারতে তাহলে তো আর তোমাকে ওইভাবে নিরুদ্দেশ হতে হতো না।’—আমি বলি।
মজ্জেল কোনো কথা বলে না। আনমনা হয়ে কী যেন ভাবে।
‘বিশ্বাস করো, আমি ওদের দলে কোনো দিনই ছিলাম না। সবাই এক জোট ছিল বলে আমি বিরোধিতা করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, যদি বলো নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ, তাহলে আমার অপরাধ মেনে নিতে আপত্তি নেই।’—মজ্জেলকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি আমি।
‘সব জানি দাদাভাই। তুমি আমার বাঁশির সুর ভালোবাসতি বুলিই তো আবার আমাদের ফের দেখা হয়িছে। আবার এত দিন পর আমি কারু জন্যি বাজাচ্ছি।’
‘তাহলে মাঝে এত দিন কার জন্যে বাজিয়েছ?’
‘অভ্যেসে। অভ্যেসে বাজাই এখন।’
‘নাকি নিজের জন্যে?’
‘হতেও পারে।’—মজ্জেলের নির্বিকার উত্তর। সমুদ্রের দিকে বোবাদৃষ্টি দিয়ে বাঁশিটা আবার তুলে নেয় সে।
রাতে আমাদের সকলকে ঘুম পাড়িয়ে তবেই ঘুমাতে যেত মজ্জেল। আমার ঘুম আসত একটু দেরিতে। মজ্জেল যখন হেঁটে হেঁটে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গাঁয়ের ও প্রান্তে চলে যেত, তখন মনে হতো, অন্য কোনো জগৎ থেকে ভেসে আসছে সুরটা। একবার মনে হতো, স্বপ্নের ওপাশ থেকে, আরেকবার মনে হতো, মনের কোনো গোপন স্থান থেকে। ফজরের আজানের কিছু আগে বিশ্রামে যেত সে। প্রতিদিনই দেরিতে ওঠার জন্য মায়ের বকা শুনতে হতো আমাকে। মজ্জেলকে একবার বলেওছিলাম সে কথা। ও হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আমি তো অত রাত পর্যন্ত বাজাইনি দাদাভাই। এশার আজান হলিই আমার ফুঁ ফুরিয়ে যায় যে!’
বাতাস কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের কণ্ঠস্বরে খানিক পরিবর্তন আসে। এমন শান্ত-নীরব সমুদ্র দেখলেই আমার বেশি ভয় করত। এখন অবশ্য আর কিছুতেই ভয় করে না। এখন এই অবস্থায় একভাবে টানা কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সমুদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, যে শব্দটা আসছে, ওটা ওর নাক ডাকার শব্দ। আমি একটু একটু করে সমুদ্রকে বুঝে উঠতে শুরু করেছি।
‘গ্রামটা খুব বদলে গেছে, তাই না দাদাভাই?’—মজ্জেল বাজানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘হুম। অনেক বদলেছে। বাড়ি বাড়ি লম্বা লম্বা প্রাচীর উঠেছে, হঠাৎ হঠাৎ কারও বাড়ি যাওয়ার জো নেই। বাড়ির মেয়েরা আর যখন-তখন বের হয় না। পাড়ার ছেলেরা এখন সীমান্তে ফেনসিডিলের কারবার করে। গাঁয়ে আগে মসজিদ ছিল একটা, তা-ও যেমন-তেমন করে বাঁধানো; এখন নতুন বেশ কয়েকটা মসজিদ উঠেছে, অট্টালিকার মতো, গায়ে গায়ে বৈদ্যুতিক ফ্যান লাগানো। মোড়ে মোড়ে সেলুন হয়েছে। আধুনিক সব মেশিনে চুল কাটা হয়।’
‘বাহ্!’—এটুকু বলেই মজ্জেল থেমে গেল। কিছু একটা যোগ করতে গিয়েও করল না।
‘এখন বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন, কত গানবাজনা হয়, অথচ বাঁশি বাজানোর অপরাধে তোমাকে গ্রামছাড়া করা হলো। কোথা থেকে এসে সাফা হুজুর কী ফতোয়া দিল, আর অমনি গ্রামবাসী ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ এই গ্রামবাসীই তুমি এক রাত অসুস্থ হলে বাঁশি শুনতে পাবে না বলে বিচলিত হয়ে পড়ত। তোমার ত্বরিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করত।’
‘একবার আমার জ্বর কিছুতেই বাগে আসছিল না। মিনু কবিরাজ তার চিকিৎসা ফেল মেরি গেলো দেখি পাবনার এক বড় কবিরাজকে ধরি এনিছেল।’—আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যোগ করে মজ্জেল।
‘অথচ তোমাকে গ্রামছাড়া করার মিছিলে নেতৃত্বস্থানে ছিল সেই মিনু কবিরাজ। মনে পড়ে তোমার?’
‘সমুদ্র কত মহান দেখো দাদাভাই। একটা আস্ত জগৎ কেমন মায়ের মতন মমতা দি পেটের ভেতর বেঁধি রেখিছে।’—প্রসঙ্গ বদলায় মজ্জেল।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে আরও একটা গুঁড়ি পেয়ে যাই। দুজনেই কিছুটা ক্লান্ত, বসে পড়ি আগ-পিছ করে। মজ্জেলকে বাঁশিটা ধরতে আবারও অনুরোধ করি। মজ্জেল ফুঁ দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করি, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সুরটি। আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে চেটেপুটে সমস্ত সুর উপভোগ করার চেষ্টা করছি। এটা ছিল আমার রোজকার কাজ। মজ্জেল বাঁশি বাজাতে বাজাতেই কোনো এক গাছের গুঁড়িতে বসে কিংবা কারও বাঁশের মাচানে শুয়ে অথবা কারও বাঁধানো পুকুরে পানির ভেতর চাঁদের প্রস্থান দেখতে দেখতে রাতটা কাটিয়ে দিত। ঘরসংসারহীন মানুষ সে ছিল না। মজ্জেল তখন আট সন্তানের বাবা—পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে। একটির সঙ্গেও মজ্জেলের চেহারার মিল নেই। মাঝরাতে মজ্জেলের বউয়ের বিছানা থেকে একেক দিন একেকজনকে উঠে আসতে দেখা যেত বলে রটনা আছে। বছর বিয়াতো মজ্জেলের বউ। যদিও গাঁয়েই বাড়ি তবু বেশ কয়েক দিন পরপর নিজের বাড়ি যেত মজ্জেল। বাড়ি থেকে বের হতো দুই কাঁধে দুই মেয়েকে নিয়ে। সব সময় দুই কাঁধে দুজন থাকত, এক জোড়া বড় হলে পিঠাপিঠি অন্য জোড়া আসত। মজ্জেল গভীর মমতা দিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খানিকটা সময় বা গোটা দিন কাটিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ত বাঁশি আর চুল কাটার সরঞ্জাম নিয়ে। সংসারে তার অবদান বলতে ছিল, ছেলেমেয়েদের জন্য মাঝেমধ্যে এক প্যাকেট লজেন্স নিয়ে যাওয়া। বউ মেজাজ খিঁচিয়ে তার অর্ধেক ফেলে দিত রান্নাঘরের ঝাঁপির ওপাশে গা ঘিন ঘিন করা কাদার ভেতর। ছেলেমেয়েরা সেটাই কুড়িয়ে পুকুরের পানিতে ধুয়ে পলিথিন ছাড়িয়ে অন্য ছেলেদের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে চুষে বেড়াত। মজ্জেলের সেজো মেয়েটা আট বছর বয়সে বাগানে রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যায়। রক্তাক্ত কেন হলো, সেটি নিয়ে গাঁয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। চেয়ারম্যান চোখ রাঙিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দিল। মেয়েটিকে কোলে তুলে মজ্জেলের সেকি কান্না! ওই প্রথম এবং ওই শেষ কাঁদতে দেখি তাকে। মজ্জেলের লাশ যেদিন পাওয়া যায়, ঠিক তার দিন সাতেক পরে মজ্জেলের বউ এক পুত্রসন্তান প্রসব করে। অবিকল মজ্জেলের মতো দেখতে। শিশুটিকে দেখতে গাঁয়ের মানুষ ভেঙে পড়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এগারো দিনের মাথায় মারা যায় শিশুটি। ভাবলাম কথাগুলো মজ্জেলকে বলি। আবার মনে হলো, থাক, এত দিন বাদ সেসব কথা না তোলাই ভালো। আছি যখন, অন্য দিন আরও কথা পাড়া যাবে। মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে লুঙ্গির ভাঁজে গোঁজে। ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করো দাদাভাই।’—মজ্জেল বলে। ‘তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি আমার কাছে। ক্ষমা চাচ্ছ যে?’—আমি জিজ্ঞেস করি। ‘জলের স্রোত যখন তুমাকে টেনি নি যাচ্ছিল, তখন আমি তুমাকে অনেক বাঁচানুর চেষ্টা করিছি। পারিনি। দেহহীন ইচ্ছাশক্তি বড্ড অকেজো।’ ‘তোমাকে আর বলতে হবে না সেসব। এ কয়দিনে আমিও কিছুটা বুঝেছি।’ আর কথা না বাড়িয়ে আমার আগে আগে পা বাড়ায় মজ্জেল। আমি দেখতে পাই, মাথায় গামছা পাকিয়ে অনন্তকালের পথে হেঁটে চলেছে মজ্জেল। হাতে তেল চকচকে বাঁশের বাঁশি। নির্বিকার তার চলার গতি। মাথার ওপর দিয়ে পথ কেটে কেটে বাড়ি ফিরছে একথালা চাঁদ।
এভাবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। প্রথেম আমি ওকে চিনতে পারিনি। ওর বাঁশির সুর শুনে চেনা চেনা বলে আন্দাজ করেছিলাম মাত্র। মজ্জেলই আমাকে প্রথম চিনল, তা-ও চাঁদনি রাতে এক সমুদ্র আলোয় আমার কাঁপা কাঁপা অবয়ব দেখে; অথবা হতে পারে, আগে থেকেই ও আমাকে চিনতে পেরে অনুসরণ করছিল।
‘কী দাদাভাই, মিঠুন-কাট লাগবি নাকি?’—মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে ওর সেই গাল–টানা হাসিটা হেসে বলল।
‘এখন আর তোমার মিঠুনের যুগ না। এটা হলো রণবীরদের যুগ—এক রণবীর সিং আরেক রণবীর কাপুর! ওদের অবশ্য তুমি চিনবে না।’—আমিও যথারীতি হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম। আমরা পাশেই একটি কাঠের গুঁড়ির ওপর দুজন দুদিকে মুখ করে বসলাম। ২০০৯ সালে আইলাতে সমুদ্রের শরীরের এদিকটাতে আরও কিছুটা জল ধরে, বেদখল হয় লোকালয়ের অংশবিশেষ, দু-একটা গাছের গুঁড়ি এখনো ভাটার সময় জেগে ওঠে।
‘তুমি এখানে যে?’—আমি জানতে চাইলাম।
‘গাঙয়ের ধারে বসে বাপজানের কাছ সাগরের মেলা গল্প শুনছি। বাপজান শুনছে তাঁর বাপজানের কাছে। সে শুনছে আবার তাঁর বাপজানের কাছে। চৌদ্দপুরুষে মিলে কেউ সমুদ্র দেকিনি। গাঙ শুকি খাল হলু, খাল শুকি খটখটে মাঠ। মরার আগে বাপজান আমার হাতখান ধরি বুলিছিল, তুই দেখিস বাবা। তোর কাছে আর কিছুই আমার চাওয়ার নেই। মানষে তার পুলার কাছে কত কিছু চায়—ছেলি ডাক্তার হবি, ব্যারিস্টার হবি, মাতব্বর হবি, দশ গাঁয়ের মানুষ তাকে মান্য করি চলবি। আমার বাজান চে’ছিল, আমি সাগর দেখবু। গেল বছর একিনে আসছি। তার আগে কয়েক বছর কক্সবাজারে ছিলাম।’
‘সমুদ্র তোমার ভালো লাগে?’—আমি আনমনা হয়ে জানতে চাই।
‘কী জানি! তয় ডাঙায় আর মন টেকে না। মনটা খালি তড়পায়। জল বড় মায়া ডাক ডাকে রে ভাই।’
‘বাঁশিতে একটু ফুঁ দাও না মজ্জেল। কত দিন পানির পাশে বসে তোমার বাঁশি শোনা হয়নি। তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের শানবাঁধানো পুকুরপাড়ে বসে বাঁশি বাজাতে, আর আমরা তোমার পাশে গোল করে বসে তন্ময় হয়ে সেই বাঁশি শুনতাম—মনে পড়ে?’
মজ্জেল কোনো কথা বলে না। সমুদ্রের জলের মতো ওর চোখেও চাঁদের চিকন আলো গলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। বাঁশিটা মুখে তোলে মজ্জেল। বাঁশি বাজায় চোখ বন্ধ করে, ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো গভীর মনোযোগ দিয়ে। সেই মজ্জেল, তেমনই আছে, তেমন সুরেলা বাজায় সে।
আমার বয়স যেদিন সাত দিন হলো, সেদিনই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমার আঁতুড়ে চুল ফেলার জন্য মা ডেকেছিল। তপ্ত দুপুরে গোলাঘরের চালের তলে বসে আমার চুল কেটেছিল। আমি ছিলাম দাদির কোলে ধরা। শুধু আমি না, প্রথম চুল কাটা থেকে অনেক বড় হওয়া অবধি আমার পাঁচ ভাইয়ের চুল কেটেছে মজ্জেল। গায়ের প্রায় সকল আবালবৃদ্ধবনিতার চুল মজ্জেলই কাটত। আমার চুল কাটা শেষ হলে মজ্জেল কাঁঠালের সার দিয়ে গরম ভাতে জল ঢেলে পান্তা বানিয়ে খেয়েছিল। ছেলের প্রথম চুল কাটা, মা বাড়ির পোষা মুরগির ঝালমাংস রান্না করেছিল, মজ্জেল খায়নি। কটা টাকা বকশিশ দিতে চেয়েছিল মা, তা-ও নেয়নি। বরাবরের মতো কেজি খানেক চাল গামছায় বেঁধে হাঁটা দিয়েছিল। এসব কথা আমার মায়ের মুখে শোনা। মজ্জেল যেদিন মারা গেছে বলে সংবাদ এল, সেদিন মা আমাকে দুঃখ করে কথাগুলো বলছিল।
বুদ্ধি হওয়ার পর দেখতাম, কোনো এক শুক্রবারে জুমার আগে মজ্জেলকে বাড়িতে ডাকা হতো। আমরা পিঠাপিঠি দু-ভাই খালি গা হয়ে বসে পড়তাম। মজ্জেল বাবার চাকু-কাস্তে ধার করা বেলিটে বালু দিয়ে তার ক্ষুর ধার দিত। আমরা বসতাম, মজ্জেল তার স্বভাবজাত ঢঙে জানতে চাইত, ‘মিঠুন, না অমিতাভ?’ আমি বলতাম, মিঠুন। মেজো ভাইয়ের পছন্দ ছিল অমিতাভ। মজার ব্যাপার হলো, আমরা কেউই তখন অমিতাভ বা মিঠুনকে চিনতাম না। গাঁয়ে তখনো টেলিভিশন ঢোকেনি। আমার ধারণা, মজ্জেলও দেখেনি। তবে আমার ধারণা ভুলও হতে পারে; পাশের গাঁয়ে চুল কাটতে গিয়ে হয়তো কারও বাড়িতে দেখে থাকতে পারে। কারণ, পাশের গ্রামে তখন তিনটি টিভি আছে বলে আমাদের কাছে খবর ছিল। গাঁয়ে–গাঁয়ে কাজিয়া বাধলে ওরা এই টেলিভিশন থাকা নিয়ে বড্ড বড়াই করত। চুল কাটা হলে আয়নায় দেখতাম, দুজনের চুল কাটার স্টাইল হুবহু এক। মজ্জেলের চুল কাটার ভ্যারিয়েশনটা ছিল ওর মুখেই, কাঁচিতে নয়। সারা গাঁয়ে একভাবেই চুল কেটেছে বড়-ছোট সবার। বৈচিত্র্য ছিল না ওর বাঁশির সুরেও। সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত পর্যন্ত একটানা এক সুরে বাজত ওর বাঁশি। এক সুরা হলেও বেসুরা ছিল না। প্রতিদিনই মনে হতো নতুন করে শুনছি—এমনই দরদ দিয়ে বাজাত ও। ওর নাপিতগিরিতে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না বটে, কিন্তু বাঁশিওয়ালা মজ্জেলে আমাদের কারোরই কোনো অতৃপ্তি ছিল না।
‘চল, একটু হাঁটি।’—বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে বলল মজ্জেল।
আমরা হাঁটতে থাকি।
‘আচ্ছা, রাত বিশেষ হয়নি, ওদিকটাই মানুষ যা আছে একেবারে কম না। এদিকটা এমন ফাঁকা কেন?’—আমি জানতে চাই।
‘আমি থাকি বলে।’—সরলভাবে উত্তর করে মজ্জেল। ‘রাতে বাতাসে বাঁশির সুর শুনি কেউ আসবার সাহস পায় না। আমাকে তো আর কেউ দেখতি পায় না! ভয়ের দেখি বিশ্বজয়, বুঝলি দাদা?’—মজ্জেল বাঁকা হাসি হেসে বলে।
‘সেদিন তুমিও যদি কোনো ভয় ওদের দেখাতে পারতে তাহলে তো আর তোমাকে ওইভাবে নিরুদ্দেশ হতে হতো না।’—আমি বলি।
মজ্জেল কোনো কথা বলে না। আনমনা হয়ে কী যেন ভাবে।
‘বিশ্বাস করো, আমি ওদের দলে কোনো দিনই ছিলাম না। সবাই এক জোট ছিল বলে আমি বিরোধিতা করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, যদি বলো নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ, তাহলে আমার অপরাধ মেনে নিতে আপত্তি নেই।’—মজ্জেলকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি আমি।
‘সব জানি দাদাভাই। তুমি আমার বাঁশির সুর ভালোবাসতি বুলিই তো আবার আমাদের ফের দেখা হয়িছে। আবার এত দিন পর আমি কারু জন্যি বাজাচ্ছি।’
‘তাহলে মাঝে এত দিন কার জন্যে বাজিয়েছ?’
‘অভ্যেসে। অভ্যেসে বাজাই এখন।’
‘নাকি নিজের জন্যে?’
‘হতেও পারে।’—মজ্জেলের নির্বিকার উত্তর। সমুদ্রের দিকে বোবাদৃষ্টি দিয়ে বাঁশিটা আবার তুলে নেয় সে।
রাতে আমাদের সকলকে ঘুম পাড়িয়ে তবেই ঘুমাতে যেত মজ্জেল। আমার ঘুম আসত একটু দেরিতে। মজ্জেল যখন হেঁটে হেঁটে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গাঁয়ের ও প্রান্তে চলে যেত, তখন মনে হতো, অন্য কোনো জগৎ থেকে ভেসে আসছে সুরটা। একবার মনে হতো, স্বপ্নের ওপাশ থেকে, আরেকবার মনে হতো, মনের কোনো গোপন স্থান থেকে। ফজরের আজানের কিছু আগে বিশ্রামে যেত সে। প্রতিদিনই দেরিতে ওঠার জন্য মায়ের বকা শুনতে হতো আমাকে। মজ্জেলকে একবার বলেওছিলাম সে কথা। ও হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আমি তো অত রাত পর্যন্ত বাজাইনি দাদাভাই। এশার আজান হলিই আমার ফুঁ ফুরিয়ে যায় যে!’
বাতাস কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের কণ্ঠস্বরে খানিক পরিবর্তন আসে। এমন শান্ত-নীরব সমুদ্র দেখলেই আমার বেশি ভয় করত। এখন অবশ্য আর কিছুতেই ভয় করে না। এখন এই অবস্থায় একভাবে টানা কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সমুদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, যে শব্দটা আসছে, ওটা ওর নাক ডাকার শব্দ। আমি একটু একটু করে সমুদ্রকে বুঝে উঠতে শুরু করেছি।
‘গ্রামটা খুব বদলে গেছে, তাই না দাদাভাই?’—মজ্জেল বাজানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘হুম। অনেক বদলেছে। বাড়ি বাড়ি লম্বা লম্বা প্রাচীর উঠেছে, হঠাৎ হঠাৎ কারও বাড়ি যাওয়ার জো নেই। বাড়ির মেয়েরা আর যখন-তখন বের হয় না। পাড়ার ছেলেরা এখন সীমান্তে ফেনসিডিলের কারবার করে। গাঁয়ে আগে মসজিদ ছিল একটা, তা-ও যেমন-তেমন করে বাঁধানো; এখন নতুন বেশ কয়েকটা মসজিদ উঠেছে, অট্টালিকার মতো, গায়ে গায়ে বৈদ্যুতিক ফ্যান লাগানো। মোড়ে মোড়ে সেলুন হয়েছে। আধুনিক সব মেশিনে চুল কাটা হয়।’
‘বাহ্!’—এটুকু বলেই মজ্জেল থেমে গেল। কিছু একটা যোগ করতে গিয়েও করল না।
‘এখন বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন, কত গানবাজনা হয়, অথচ বাঁশি বাজানোর অপরাধে তোমাকে গ্রামছাড়া করা হলো। কোথা থেকে এসে সাফা হুজুর কী ফতোয়া দিল, আর অমনি গ্রামবাসী ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ এই গ্রামবাসীই তুমি এক রাত অসুস্থ হলে বাঁশি শুনতে পাবে না বলে বিচলিত হয়ে পড়ত। তোমার ত্বরিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করত।’
‘একবার আমার জ্বর কিছুতেই বাগে আসছিল না। মিনু কবিরাজ তার চিকিৎসা ফেল মেরি গেলো দেখি পাবনার এক বড় কবিরাজকে ধরি এনিছেল।’—আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যোগ করে মজ্জেল।
‘অথচ তোমাকে গ্রামছাড়া করার মিছিলে নেতৃত্বস্থানে ছিল সেই মিনু কবিরাজ। মনে পড়ে তোমার?’
‘সমুদ্র কত মহান দেখো দাদাভাই। একটা আস্ত জগৎ কেমন মায়ের মতন মমতা দি পেটের ভেতর বেঁধি রেখিছে।’—প্রসঙ্গ বদলায় মজ্জেল।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে আরও একটা গুঁড়ি পেয়ে যাই। দুজনেই কিছুটা ক্লান্ত, বসে পড়ি আগ-পিছ করে। মজ্জেলকে বাঁশিটা ধরতে আবারও অনুরোধ করি। মজ্জেল ফুঁ দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করি, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সুরটি। আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে চেটেপুটে সমস্ত সুর উপভোগ করার চেষ্টা করছি। এটা ছিল আমার রোজকার কাজ। মজ্জেল বাঁশি বাজাতে বাজাতেই কোনো এক গাছের গুঁড়িতে বসে কিংবা কারও বাঁশের মাচানে শুয়ে অথবা কারও বাঁধানো পুকুরে পানির ভেতর চাঁদের প্রস্থান দেখতে দেখতে রাতটা কাটিয়ে দিত। ঘরসংসারহীন মানুষ সে ছিল না। মজ্জেল তখন আট সন্তানের বাবা—পাঁচ মেয়ে, তিন ছেলে। একটির সঙ্গেও মজ্জেলের চেহারার মিল নেই। মাঝরাতে মজ্জেলের বউয়ের বিছানা থেকে একেক দিন একেকজনকে উঠে আসতে দেখা যেত বলে রটনা আছে। বছর বিয়াতো মজ্জেলের বউ। যদিও গাঁয়েই বাড়ি তবু বেশ কয়েক দিন পরপর নিজের বাড়ি যেত মজ্জেল। বাড়ি থেকে বের হতো দুই কাঁধে দুই মেয়েকে নিয়ে। সব সময় দুই কাঁধে দুজন থাকত, এক জোড়া বড় হলে পিঠাপিঠি অন্য জোড়া আসত। মজ্জেল গভীর মমতা দিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খানিকটা সময় বা গোটা দিন কাটিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ত বাঁশি আর চুল কাটার সরঞ্জাম নিয়ে। সংসারে তার অবদান বলতে ছিল, ছেলেমেয়েদের জন্য মাঝেমধ্যে এক প্যাকেট লজেন্স নিয়ে যাওয়া। বউ মেজাজ খিঁচিয়ে তার অর্ধেক ফেলে দিত রান্নাঘরের ঝাঁপির ওপাশে গা ঘিন ঘিন করা কাদার ভেতর। ছেলেমেয়েরা সেটাই কুড়িয়ে পুকুরের পানিতে ধুয়ে পলিথিন ছাড়িয়ে অন্য ছেলেদের লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে চুষে বেড়াত। মজ্জেলের সেজো মেয়েটা আট বছর বয়সে বাগানে রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যায়। রক্তাক্ত কেন হলো, সেটি নিয়ে গাঁয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। চেয়ারম্যান চোখ রাঙিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দিল। মেয়েটিকে কোলে তুলে মজ্জেলের সেকি কান্না! ওই প্রথম এবং ওই শেষ কাঁদতে দেখি তাকে। মজ্জেলের লাশ যেদিন পাওয়া যায়, ঠিক তার দিন সাতেক পরে মজ্জেলের বউ এক পুত্রসন্তান প্রসব করে। অবিকল মজ্জেলের মতো দেখতে। শিশুটিকে দেখতে গাঁয়ের মানুষ ভেঙে পড়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এগারো দিনের মাথায় মারা যায় শিশুটি। ভাবলাম কথাগুলো মজ্জেলকে বলি। আবার মনে হলো, থাক, এত দিন বাদ সেসব কথা না তোলাই ভালো। আছি যখন, অন্য দিন আরও কথা পাড়া যাবে। মজ্জেল বাঁশিটা মুখ থেকে নামিয়ে লুঙ্গির ভাঁজে গোঁজে। ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করো দাদাভাই।’—মজ্জেল বলে। ‘তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি আমার কাছে। ক্ষমা চাচ্ছ যে?’—আমি জিজ্ঞেস করি। ‘জলের স্রোত যখন তুমাকে টেনি নি যাচ্ছিল, তখন আমি তুমাকে অনেক বাঁচানুর চেষ্টা করিছি। পারিনি। দেহহীন ইচ্ছাশক্তি বড্ড অকেজো।’ ‘তোমাকে আর বলতে হবে না সেসব। এ কয়দিনে আমিও কিছুটা বুঝেছি।’ আর কথা না বাড়িয়ে আমার আগে আগে পা বাড়ায় মজ্জেল। আমি দেখতে পাই, মাথায় গামছা পাকিয়ে অনন্তকালের পথে হেঁটে চলেছে মজ্জেল। হাতে তেল চকচকে বাঁশের বাঁশি। নির্বিকার তার চলার গতি। মাথার ওপর দিয়ে পথ কেটে কেটে বাড়ি ফিরছে একথালা চাঁদ।
No comments