এবার আরেক প্রতিবেশীকে দূরে ঠেলে দিলেন মোদি by মণি শঙ্কর আইয়ার
গোয়েবলসের
চেয়ে কখনই পিছিয়ে না থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অপপ্রচার যন্ত্র
কাজে নেমে গেলো যখন ২০১৪ সালের আগস্টে মোদি নেপাল সফর করেন। তখন ওই
অপপ্রচার যন্ত্র থেকে সদর্পে ঘোষণা দেয়া হলো, মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার কয়েক
সপ্তাহের মধ্যেই নেপাল সফর করলেন। অথচ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং
১০ বছরেও একবার নেপাল সফরে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিবেকমান মানুষেরা
ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন যে, নেপাল একটি নতুন সংবিধান রচনার পথে ছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি এ সময় দেশটি সফর করেন, তবে এর ভুল অর্থ দাঁড়াতে
পারতো। একে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হতো যে, নেপালের দীর্ঘ ৭ বছরের জটিল
সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছে ভারত। কিন্তু কর্কশ কণ্ঠস্বরের
চিৎকারে বরাবরের মতোই সেসব কারো কানে গিয়ে পৌঁছায়নি। মোদির পুরো সফরটিকে
চিত্রায়িত করা হয়েছে বিশাল কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে। কিন্তু সত্য প্রকাশ পেতে
আরও ৩ মাস সময় লাগলো। ২০১৪ সালের নভেম্বরে সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে নেপাল
যাবার পথে মোদি নেপালের মাধেসির সমভূমির জনকপুরে একটি বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ
দিতে থামতে চাইলেন। তার ভাবখানা এমন ছিল যেন মাধেসি নেপালে নয়, বরং ভারতের
মাটিতে অবস্থিত!
নেপালের প্রস্তাবিত পার্লামেন্টে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিলেন মাধেসির সমভূমির মানুষ। অপরদিকে সমান নয়, বরং ন্যায়সঙ্গত প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিলেন পার্বত্য এলাকার মানুষ। মূলত, এ বিরোধের কারণেই নেপালের সংবিধান চূড়ান্ত হতে পারছিল না। জনকপুরে থেমে সমাবেশে অংশ নিয়ে মোদি চেয়েছিলেন মাধেসির প্রতি পক্ষালম্বন করতে। নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের এর চেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ কল্পনাও করা যায় না! নেপালি জনগণ বেশ বিচক্ষণভাবে খেলাটা ধরতে পারে। মোদিকে জনকপুরে জনসভায় ভাষণ দেয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় নেপাল। তবে নিরাপত্তার ইস্যু সামনে এনে ভদ্রোচিত কায়দায় ধামাচাপা দেয়া হয় বিষয়টিকে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তটি ছিল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও স্বার্বভৌম নেপালের দ্বার্থ্যহীন বার্তা: বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শকে স্বাগত জানানো হবে; তাই বলে স্বার্বভৌমত্ব ও সংবেদনশীল বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ মেনে নেয়া হবে না।
মোদি জনকপুরের ঘটনা নিয়ে পরে উচ্চবাচ্য করেননি। কিন্তু নেপালের সংবিধান রচনা প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত হর্তাকর্তা হবার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ থেকেই যান। প্রশ্ন হলো, কেন নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন আগ্রহ? দুটি কারণ- আদর্শগত ও নির্বাচন-সম্পর্কিত। আদর্শগত স্বার্থের দিকটি পরিষ্কার। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালে যখন রাজতন্ত্র ছিল, তখন দেশটি ছিল বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। আরএসএস ও বিজেপি’র জন্য সেটি ছিল আকর্ষক একটি বিষয়। কেননা, তাদের দীর্ঘমেয়াদি মূল উদ্দেশ্য হলো, ভারতকে একটি হিন্দু রাজের দেশে পরিণত করা। কিন্তু সম্প্রদায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়ার এমন ধারণা নেপাল শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং নিজেদের ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, ঠিক যেমনটি একসময় ভারতও নিজেদের দিয়েছিল। মোদির এমন দুষ্ট পরিকল্পনা তারা নস্যাৎ করে দিয়েছে। সংঘ পরিবার নিজেদের এক ধ্রুবতারা হারিয়েছে নিশ্চিতভাবে। এটাই মোদির ক্ষোভের কারণ।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, নোংরা রাজনীতি। ভারতের উত্তর বিহারের পুরো সীমান্তের পাশেই অবস্থিত মাধেস। আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিহার নির্বাচনে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে মোদি মাধেসে জনসভায় ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। তার বিশ্বাস, মাধেসির পক্ষালম্বন করা হলে নির্বাচনে বিহারীদের সমর্থন পাওয়া যাবে। কেননা, মাধেসির মূল বাসিন্দা তেরাই জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বিহারীদের গভীর জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে। একটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলতে চেয়েছেন মোদি। সস্তা ঘরোয়া রাজনৈতিক ও নির্বাচনগত ফায়দা পেতে কেউই অন্য দেশের স্বার্বভৌমত্ব নিয়ে খেলতে পারে না।
শেষ পর্যন্ত ফলাফল দাঁড়ালো, যেই মোদি এক বছর আগেও নেপালের সেরা বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হতেন, এখন তাকে সেখানে দেখা হচ্ছে হস্তক্ষেপকারী ক্ষমতাচ্ছন্ন অহঙ্কারী ব্যক্তি হিসেবে। নেপালের সবচেয়ে স্পষ্টভাষী কলামিস্ট কনক মণি দীক্ষিত সম্প্রতি দ্য হিন্দুতে একটি কলাম লিখেছেন। কনক মণি এমন এক দেশে ভারতের সেরা বন্ধুদের একজন যে দেশে ভারতের বন্ধু খুব বেশি নেই। নিজের নিবন্ধতে তিনি নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে বর্ণনা করেছেন ‘ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক হস্তক্ষেপবাদ’ হিসেবে। এমনকি নেপালে নিজেদের ‘বহিঃ গোয়েন্দা সংস্থাকে স্পষ্টতঃ কাজ’ করার অনুমতিও ভারত দিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ কনক মণির। তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ‘স্বার্বভৌমত্ব ও হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে’র মৌলিক রীতি ভঙ্গের অভিযোগও এনেছেন।
মোদি তাই নেপালে আমাদের অত্যাবশ্যক স্বার্থে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন। নেপালে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাগত স্বার্থ রয়েছে। চীন হিমালয়ের অপরপাশে নেপালের প্রতিবেশী। গত কয়েক দিন নেপালে চীনের তুলনায় ভারতের অবস্থানের এতটা ক্ষতি মোদি করেছেন, যা আমাদের পূর্বের সব ভুল একত্রিত করলেও সমান হবে না। মোদির ভারত স্বার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ নেপাল প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধাপূর্ণ ভাষায় বক্তব্য রেখেছে। ‘স্বাগত’ জানানোর বদলে ‘উল্লেখ’ এবং সংবিধানের পূর্বে ‘দ্যা’র বদলে ‘অ্যা’ উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে। এছাড়া সমতলভূমিতে তথা মাধেসে সংবিধান নিয়ে চলমান সহিংসতা নিয়ে নিজেদের ‘উদ্বেগ’ও প্রকাশ করেছে ভারত। অপরদিকে চীন আমাদের ছাপিয়ে গেছে। তারা নেপালকে একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’ হিসেবে উল্লেখ করে নতুন সংবিধান রচনা করায় শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এর ফলে চীন সংবিধানের মাধ্যমে অনুমোদিত নতুন নেপালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। আর ভারত নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছে আঞ্চলিক এক মস্তান হিসেবে। যে ঝামেলা মোদি ইসলামপন্থি পাকিস্তানের সঙ্গে করেছেন, সেই ঝামেলা হিন্দু (ধর্মনিরপেক্ষ) নেপালের সঙ্গেও করেলেন।
সাংবিধানিক পরিষদে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে নেপালের সংবিধান পাস হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার প্রাক্বালে পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্করের ১২ ঘণ্টার সফরকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন আরেক প্রভাবশালী নেপালী বুদ্ধিজীবী অমীত ধকল। জয়সঙ্করের ওই সফর পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে ছিল না; ছিল প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি গিয়েছিলেন নেপালিদের মোদির সতর্কতা সম্পর্কে জানিয়ে দিতে যে, ভারতের প্রস্তাবিত ৭টি বৃহৎ সংশোধনী মেনে নেয়ার আগে স্বার্বভৌম নেপালের উচিত সংবিধানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা স্থগিত রাখা। এমনকি প্রচ্ছন্ন হুমকিও জয়সঙ্কর দিয়েছিলেন যে, সমতলভূমির তেরাইদের মধ্যে চলমান অস্থিরতাকে ব্যবহার করে নেপালের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করা হবে। বন্ধ করে দেয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক পণ্যের চলাচল। অমিত ধকল তাই যখন বললেন, ‘জয়সঙ্কর কোনো বার্তা দিতে আসেননি, এসেছিলেন শুধু হুমকি দিতে’- তখন আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। পরে সে হুমকি ভারত বাস্তবায়নও করেছে। অমিত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধির বার্তা প্রদানের এমন বাজে ভঙ্গির নিন্দা জানান। অমিত বলেন, তার বক্তব্যে ভদ্রতা ও শালীনতার কোন নমুনা ছিল না। তার শরীরি ভাষা ও রুক্ষ কণ্ঠ বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের দম্ভের সঙ্গে মিলে যায়। সত্যি বলতে কি, এটি জয়সঙ্করের ব্যক্তিগত কর্ম ছিল না। তিনি শুধু তার বসের নির্দেশনা তামিল করছিলেন। অমিত বলেন, এ বিষয়টি কাঠমান্ডুতে তীব্র ‘ক্রোধে’র জন্ম দিয়েছে।
এ সবকিছু শুধু ভারতের পরাজয়ই ছিল না, ছিল খুব অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এটা সত্য যে, নতুন সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে সংবিধান নিজেই প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে নেপালি পার্লামেন্টকে ২ বছর সময় দিয়ে রেখেছে। এ দুই বছর সাংবিধানিক পরিষদ চাইলে কাজ চালাতে পারবে। মাধেসি বা তেরাইয়ের সমতলভূমিতে যে সমস্যা চলছে, তা সংবিধান সংশোধন করলেই হয়ে যায়। আবার তেরাই-এর ১১৬ জন প্রতিনিধির ১০৫ জনই সংবিধানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আমরা নিজেরাও ১২০ বারেরও বেশিবার আমাদের সংবিধানে সংশোধনী এনেছি। তাই নেপালের সমস্যা তাদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি না কেন আমরা? যখন মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচন্দ পরিষ্কারভাবে বলে রেখেছেন, ‘যেকোন স্থান থেকে যেকোন কাজ যা আমাদের স্বার্বভৌমত্বকে খর্ব করে, তা নেপালের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না’; তখন তাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার আমরা কে?
নেপালীদের সঙ্গে দলাদলি ও নিশ্চিতভাবে জাতিগত বিবেদের বদলে, মোদির প্রয়োজন এটি স্বীকৃতি দেয়া যে, নেপালে কেবল ভারতের সঙ্গে জাতিগত সম্পর্কযুক্ত ২-৩টি সম্প্রদায়েরই বাস তা নয়। বরং নেপাল এখন ১২৫টি স্বীকৃত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এ সংবিধানে পার্লামেন্টে ২৪০টি সরাসরি নির্বাচিত সদস্য পদ, ৩৩৫টি আনুপাতিকহারে নির্বাচিত সদস্যপদ, সমতলের মানুষদের জন্য বিশেষ বিধান, নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন বরাদ্দ ও আরও বিভিন্ন প্রগতিশীল বিধান রাখা হয়েছে। এসব দেখে ভারতের হতাশ হওয়ার বদলে আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হায়! ভাল কিছু মোদির সঙ্গে যায় না। আমরা বাকিরা সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হলো, আমাদের হর্তাকর্তাদের কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যবহারের জন্য নেপালি জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং তাদের স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা জানানো। অন্যথায়, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো নেপালও বিপাকেই থেকে যাবে এ সংবিধান নিয়ে।
নেপালের প্রস্তাবিত পার্লামেন্টে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিলেন মাধেসির সমভূমির মানুষ। অপরদিকে সমান নয়, বরং ন্যায়সঙ্গত প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিলেন পার্বত্য এলাকার মানুষ। মূলত, এ বিরোধের কারণেই নেপালের সংবিধান চূড়ান্ত হতে পারছিল না। জনকপুরে থেমে সমাবেশে অংশ নিয়ে মোদি চেয়েছিলেন মাধেসির প্রতি পক্ষালম্বন করতে। নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের এর চেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ কল্পনাও করা যায় না! নেপালি জনগণ বেশ বিচক্ষণভাবে খেলাটা ধরতে পারে। মোদিকে জনকপুরে জনসভায় ভাষণ দেয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় নেপাল। তবে নিরাপত্তার ইস্যু সামনে এনে ভদ্রোচিত কায়দায় ধামাচাপা দেয়া হয় বিষয়টিকে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তটি ছিল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও স্বার্বভৌম নেপালের দ্বার্থ্যহীন বার্তা: বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শকে স্বাগত জানানো হবে; তাই বলে স্বার্বভৌমত্ব ও সংবেদনশীল বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ মেনে নেয়া হবে না।
মোদি জনকপুরের ঘটনা নিয়ে পরে উচ্চবাচ্য করেননি। কিন্তু নেপালের সংবিধান রচনা প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত হর্তাকর্তা হবার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ থেকেই যান। প্রশ্ন হলো, কেন নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন আগ্রহ? দুটি কারণ- আদর্শগত ও নির্বাচন-সম্পর্কিত। আদর্শগত স্বার্থের দিকটি পরিষ্কার। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালে যখন রাজতন্ত্র ছিল, তখন দেশটি ছিল বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। আরএসএস ও বিজেপি’র জন্য সেটি ছিল আকর্ষক একটি বিষয়। কেননা, তাদের দীর্ঘমেয়াদি মূল উদ্দেশ্য হলো, ভারতকে একটি হিন্দু রাজের দেশে পরিণত করা। কিন্তু সম্প্রদায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়ার এমন ধারণা নেপাল শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং নিজেদের ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, ঠিক যেমনটি একসময় ভারতও নিজেদের দিয়েছিল। মোদির এমন দুষ্ট পরিকল্পনা তারা নস্যাৎ করে দিয়েছে। সংঘ পরিবার নিজেদের এক ধ্রুবতারা হারিয়েছে নিশ্চিতভাবে। এটাই মোদির ক্ষোভের কারণ।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, নোংরা রাজনীতি। ভারতের উত্তর বিহারের পুরো সীমান্তের পাশেই অবস্থিত মাধেস। আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিহার নির্বাচনে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে মোদি মাধেসে জনসভায় ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। তার বিশ্বাস, মাধেসির পক্ষালম্বন করা হলে নির্বাচনে বিহারীদের সমর্থন পাওয়া যাবে। কেননা, মাধেসির মূল বাসিন্দা তেরাই জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বিহারীদের গভীর জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে। একটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলতে চেয়েছেন মোদি। সস্তা ঘরোয়া রাজনৈতিক ও নির্বাচনগত ফায়দা পেতে কেউই অন্য দেশের স্বার্বভৌমত্ব নিয়ে খেলতে পারে না।
শেষ পর্যন্ত ফলাফল দাঁড়ালো, যেই মোদি এক বছর আগেও নেপালের সেরা বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হতেন, এখন তাকে সেখানে দেখা হচ্ছে হস্তক্ষেপকারী ক্ষমতাচ্ছন্ন অহঙ্কারী ব্যক্তি হিসেবে। নেপালের সবচেয়ে স্পষ্টভাষী কলামিস্ট কনক মণি দীক্ষিত সম্প্রতি দ্য হিন্দুতে একটি কলাম লিখেছেন। কনক মণি এমন এক দেশে ভারতের সেরা বন্ধুদের একজন যে দেশে ভারতের বন্ধু খুব বেশি নেই। নিজের নিবন্ধতে তিনি নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে বর্ণনা করেছেন ‘ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক হস্তক্ষেপবাদ’ হিসেবে। এমনকি নেপালে নিজেদের ‘বহিঃ গোয়েন্দা সংস্থাকে স্পষ্টতঃ কাজ’ করার অনুমতিও ভারত দিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ কনক মণির। তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ‘স্বার্বভৌমত্ব ও হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে’র মৌলিক রীতি ভঙ্গের অভিযোগও এনেছেন।
মোদি তাই নেপালে আমাদের অত্যাবশ্যক স্বার্থে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন। নেপালে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাগত স্বার্থ রয়েছে। চীন হিমালয়ের অপরপাশে নেপালের প্রতিবেশী। গত কয়েক দিন নেপালে চীনের তুলনায় ভারতের অবস্থানের এতটা ক্ষতি মোদি করেছেন, যা আমাদের পূর্বের সব ভুল একত্রিত করলেও সমান হবে না। মোদির ভারত স্বার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ নেপাল প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধাপূর্ণ ভাষায় বক্তব্য রেখেছে। ‘স্বাগত’ জানানোর বদলে ‘উল্লেখ’ এবং সংবিধানের পূর্বে ‘দ্যা’র বদলে ‘অ্যা’ উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে। এছাড়া সমতলভূমিতে তথা মাধেসে সংবিধান নিয়ে চলমান সহিংসতা নিয়ে নিজেদের ‘উদ্বেগ’ও প্রকাশ করেছে ভারত। অপরদিকে চীন আমাদের ছাপিয়ে গেছে। তারা নেপালকে একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’ হিসেবে উল্লেখ করে নতুন সংবিধান রচনা করায় শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এর ফলে চীন সংবিধানের মাধ্যমে অনুমোদিত নতুন নেপালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। আর ভারত নিজেকে ফুটিয়ে তুলেছে আঞ্চলিক এক মস্তান হিসেবে। যে ঝামেলা মোদি ইসলামপন্থি পাকিস্তানের সঙ্গে করেছেন, সেই ঝামেলা হিন্দু (ধর্মনিরপেক্ষ) নেপালের সঙ্গেও করেলেন।
সাংবিধানিক পরিষদে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে নেপালের সংবিধান পাস হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার প্রাক্বালে পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্করের ১২ ঘণ্টার সফরকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন আরেক প্রভাবশালী নেপালী বুদ্ধিজীবী অমীত ধকল। জয়সঙ্করের ওই সফর পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে ছিল না; ছিল প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি গিয়েছিলেন নেপালিদের মোদির সতর্কতা সম্পর্কে জানিয়ে দিতে যে, ভারতের প্রস্তাবিত ৭টি বৃহৎ সংশোধনী মেনে নেয়ার আগে স্বার্বভৌম নেপালের উচিত সংবিধানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা স্থগিত রাখা। এমনকি প্রচ্ছন্ন হুমকিও জয়সঙ্কর দিয়েছিলেন যে, সমতলভূমির তেরাইদের মধ্যে চলমান অস্থিরতাকে ব্যবহার করে নেপালের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করা হবে। বন্ধ করে দেয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক পণ্যের চলাচল। অমিত ধকল তাই যখন বললেন, ‘জয়সঙ্কর কোনো বার্তা দিতে আসেননি, এসেছিলেন শুধু হুমকি দিতে’- তখন আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। পরে সে হুমকি ভারত বাস্তবায়নও করেছে। অমিত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধির বার্তা প্রদানের এমন বাজে ভঙ্গির নিন্দা জানান। অমিত বলেন, তার বক্তব্যে ভদ্রতা ও শালীনতার কোন নমুনা ছিল না। তার শরীরি ভাষা ও রুক্ষ কণ্ঠ বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের দম্ভের সঙ্গে মিলে যায়। সত্যি বলতে কি, এটি জয়সঙ্করের ব্যক্তিগত কর্ম ছিল না। তিনি শুধু তার বসের নির্দেশনা তামিল করছিলেন। অমিত বলেন, এ বিষয়টি কাঠমান্ডুতে তীব্র ‘ক্রোধে’র জন্ম দিয়েছে।
এ সবকিছু শুধু ভারতের পরাজয়ই ছিল না, ছিল খুব অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এটা সত্য যে, নতুন সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে সংবিধান নিজেই প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে নেপালি পার্লামেন্টকে ২ বছর সময় দিয়ে রেখেছে। এ দুই বছর সাংবিধানিক পরিষদ চাইলে কাজ চালাতে পারবে। মাধেসি বা তেরাইয়ের সমতলভূমিতে যে সমস্যা চলছে, তা সংবিধান সংশোধন করলেই হয়ে যায়। আবার তেরাই-এর ১১৬ জন প্রতিনিধির ১০৫ জনই সংবিধানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আমরা নিজেরাও ১২০ বারেরও বেশিবার আমাদের সংবিধানে সংশোধনী এনেছি। তাই নেপালের সমস্যা তাদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি না কেন আমরা? যখন মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচন্দ পরিষ্কারভাবে বলে রেখেছেন, ‘যেকোন স্থান থেকে যেকোন কাজ যা আমাদের স্বার্বভৌমত্বকে খর্ব করে, তা নেপালের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না’; তখন তাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার আমরা কে?
নেপালীদের সঙ্গে দলাদলি ও নিশ্চিতভাবে জাতিগত বিবেদের বদলে, মোদির প্রয়োজন এটি স্বীকৃতি দেয়া যে, নেপালে কেবল ভারতের সঙ্গে জাতিগত সম্পর্কযুক্ত ২-৩টি সম্প্রদায়েরই বাস তা নয়। বরং নেপাল এখন ১২৫টি স্বীকৃত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এ সংবিধানে পার্লামেন্টে ২৪০টি সরাসরি নির্বাচিত সদস্য পদ, ৩৩৫টি আনুপাতিকহারে নির্বাচিত সদস্যপদ, সমতলের মানুষদের জন্য বিশেষ বিধান, নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন বরাদ্দ ও আরও বিভিন্ন প্রগতিশীল বিধান রাখা হয়েছে। এসব দেখে ভারতের হতাশ হওয়ার বদলে আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হায়! ভাল কিছু মোদির সঙ্গে যায় না। আমরা বাকিরা সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হলো, আমাদের হর্তাকর্তাদের কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যবহারের জন্য নেপালি জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং তাদের স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা জানানো। অন্যথায়, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো নেপালও বিপাকেই থেকে যাবে এ সংবিধান নিয়ে।
মণি শঙ্কর আইয়ার |
[লেখক: মণি শঙ্কর আইয়ার
ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও বর্তমানে কংগ্রেসদলীয় রাজনীতিক। তিনি রাজ্যসভায়
কংগ্রেসের এমপি। ওপরের লেখাটি এনডিটিভি’তে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ।]
No comments