তিন বন্ধুর দুঃসময় by নূর ইসলাম
যশোর
তথা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র তিন
বন্ধু তরিকুল, টিটো আর রাজু। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল। স্থানীয়
সরকারের মাঠ পর্যায়ের প্রতিনিধি থেকে সবাই হয়েছেন জাতীয় নেতা। মন্ত্রী আর
এমপি। তিনজনই বৃটিশ ভারতের প্রথম পৌরসভা যশোরের কখনো কাউন্সিলর বা
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে। যশোরের
উন্নয়নে তিন বন্ধুর রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। এদের কেউ যশোর উন্নয়নের
কারিগর হিসেবে, কেউ সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের নেতা হিসেবে, আবার কেউ যশোরের
নেতাকর্মীদের কাছে দাদা হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
থেকে শুরু করে সর্বশেষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এদের অনেকের রয়েছে
গৌরবোজ্জ্বল সোনালি অতীত। শুরুতে তিন বন্ধু রাজনীতির এক পতাকাতলে থাকলেও
সময়ের ব্যবধানে তারা কখনও যোজন যোজন মাইল দূরে থেকেছেন। আবার সময়ের
প্রয়োজনে হয়েছেন একত্রিত। কিন্তু এসবই তাদের রাজনীতি আর মানুষের কল্যাণে।
শুধু নিজেদের প্রয়োজনে কখনও তারা মধুর হোটেলের বাইরে বের হননি। তিনজনই
হরিহর আত্মা হিসেবে এখনও পরিচিত। সময় সুযোগ পেলেই তারা একত্রিত হন, মিলিত
হন আড্ডায়। মেতে ওঠেন নস্টালজিয়ায়। নিজেদের বিপদ আপদে তারা এখনও একে অপরের
পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও বন্ধুত্বের
খাতিরে তারা এক ও অভিন্ন। রয়েছে পারিবারিক সম্প্রীতিও। বিভিন্ন
অনুষ্ঠানাদিতে যার প্রমাণ পান যশোরের মানুষ।
ষাটের দশকে সোভিয়েতপন্থি ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে অভিষেক হয় তরিকুল ইসলামের। সঙ্গে ছিলেন বাল্যবন্ধু খালেদুর রহমান টিটো আর আলী রেজা রাজু। নেতৃত্বের দিক থেকে তরিকুল ইসলাম শুরুতেই কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে তিনি অন্য দুই বন্ধুর তুলনায় কিছুটা সুনজর কাড়েন পূর্বসূরিদের। কিন্তু তাহলে কি হবে, তিনি সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে শুরু করেন বাল্যবন্ধু টিটো আর রাজুকে। যশোর কলেজের ছাত্র হিসেবে তরিকুল আর টিটো ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ শুরু করেন। আর লেখাপড়ায় কিছুটা পিছিয়ে থেকে পেছন থেকে দুই বন্ধুকে উৎসাহ জোগাতে কলেজে উপস্থিত থাকতেন রাজু। কলেজ সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, সর্বত্রই টিটো আর তরিকুলের অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। আর রাজু যশোর শহরে দাদাগিরি করতেন। আর ওপর থেকে তাকে সাপোর্ট জোগাতেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই বাল্যবন্ধু। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই তিন বন্ধুর রয়েছে অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর তিন বন্ধু মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দেশ গড়ার রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চাকরির ভূরি ভূরি সুযোগ এলেও কেউ তা করেননি। তাদের মস্তিস্কে তখন দেশসেবার ভূত ভর করে। মার্কসবাদ লেলিনবাদের রাজনীতি নিয়ে দেশ স্বাধীনের পর তিন বন্ধু জেলও খেটেছেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলে যেমন তারা জেল খেটেছেন তেমনি দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হিসেবেও তাদের জেল খাটতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালে দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে তিন বন্ধু আবারও সক্রিয় হন রাজনীতির ময়দানে। তারই ধারাবাহিকতায় তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখান। তারও আগে রাজু সদরের কাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যান হিসেবে জনপ্রতিনিধির খেতাব লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া জাগদল গঠন করলে তরিকুল ইসলাম তার রাজনৈতিক গুরু আলমগীর সিদ্দিকীর হাত ধরে নাম লেখান সেই দলে। তার সঙ্গে হাত মেলান বন্ধু রাজু। আর টিটো থেকে যান পুরনো ব্যানার নিয়ে। বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলে তরিকুল ইসলাম যশোরের এমপি হিসেবে প্রতিমন্ত্রী হন। শুরু করেন জাতীয় রাজনীতির পাঠচক্র। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করলে টিটো সেই দলে নাম লেখান। তিন বন্ধুর দুই প্লাটফর্মে অবস্থান যশোরের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। টিটো এরশাদ সরকারের ক্যাবিনেটে ঠাঁই নিয়ে নাম লেখান নতুন ইতিহাসে। ১৯৮৫ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে সে সময় যশোর স্টেডিয়ামে এরশাদের প্রাণনাশের চেষ্টা নামক এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তরিকুল ইসলাম আবার জেলে যান। আর রাজু কিছুটা আত্মগোপনে নিজেকে রক্ষা করেন। শুরু হয় বন্ধুত্বের ফাটল। তবে তা রাজনীতির মাঠে, বিবৃতি আর বক্তৃতায়; ব্যক্তিপর্যায়ে নয়। ১৯৮৯ সালে আলী রেজা রাজু যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তরিকুল ইসলাম বিএনপির টিকিটে মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা রওশন আলীর বিপক্ষে মাঠে নামেন। এ লড়াইয়ে তরিকুল ইসলাম পরাজিত হন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে নির্বাচনে পরাজিত হয়েও টেকনোক্র্যাট কোটায় বেগম জিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য মনোনীত হন তরিকুল ইসলাম। কিছুদিন পরেই যশোর পৌরসভা নির্বাচনে বন্ধু আলী রেজা রাজু বিএনপির টিকিটে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দুই বন্ধু মিলে সে সময় যশোরের উন্নয়নে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাজ করেন। এ সময় জাতীয় পার্টির দুর্দিনে দলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন সাবেক মন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো। এর পরের ইতিহাস আরো রোমাঞ্চকর।
১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে দলত্যাগ করেন আলী রেজা রাজু। তিনি বাল্যবন্ধু তরিকুলের ওপর অভিমান করে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পেয়ে যান দলীয় মনোনয়ন। আর অপর বন্ধু টিটো হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। ফলে যশোর-৩ সদর আসনে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তরিকুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আলী রেজা রাজু আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে খালেদুর রহমান টিটো নির্বাচনী মাঠে লড়াই করতে নামেন। তিন বাল্যবন্ধুর লড়াইয়ে পরাজিত হন তরিকুল ইসলাম ও টিটো। জয়ের মালা গলায় পরে মুজিব কোর্ট গায়ে জড়িয়ে জাতীয় সংসদে যান আলী রেজা রাজু। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার থেকে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান আর সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে এমপি হয়ে যশোরবাসীকে তাক লাগিয়ে দেন সদালাপী ও সদাহাস্যোজ্জ্বল আলী রেজা রাজু। যিনি যশোরবাসীর কাছে দাদা নামে পরিচিত। এমপি হিসেবে রাজু নির্বাচনী এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাদের পরাজিত করে তিনি যেমন দলীয় মনোনয়ন ছিনিয়ে নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়লাভ করে দলীয় সভানেত্রীর সুনজর কাড়েন তেমনি তিনি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যান। রাতারাতি তিনি দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আর তরিকুল ইসলাম বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরপর রাজনীতির ঘোরটোপে টিটো যোগ দেন বিএনপিতে। বন্ধু তরিকুলের হাত ধরে তিনি জেলা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিএনপির পতাকাতলে দুই বাল্যবন্ধুকে পেয়ে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা যারপরনাই উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে টিটো যশোর-৩ সদর আসন থেকে বিএনপির টিকিটে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। কিন্তু দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু দলের ভাইস চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়ার চিন্তাও করেননি দলের চেয়ারপার্সন। টিটোকে যশোর-২ চৌগাছা ঝিকরগাছা অথবা যশোর-৪ বাঘারপাড়া আসন থেকে মনোনয়ন নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু টিটো নাখোশ হয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। নৌকা প্রতীক নিয়ে মাঠে নামেন আলী রেজা রাজু। জমে ওঠে নির্বাচনী লড়াই। বিপুল ভোটের ব্যবধানে রাজুকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন তরিকুল ইসলাম। দলের দুর্দিনের কাণ্ডারি হিসেবে খ্যাত তরিকুল ইসলাম ঠাঁই পান বেগম জিয়ার তৃতীয় ক্যাবিনেটে। ৫ বছরে তরিকুল ইসলাম মন্ত্রী পরিষদের একাধিক দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেন। বন্ধু টিটোকে পাশে রেখে তিনি যশোর বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর মেডিকেল কলেজ, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, আঞ্চলিক পাঠাগার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, যশোর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ অসংখ্য স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এমপি মন্ত্রী কোনটাই ভাগ্যে না জোটায় টিটো ডিগবাজি দিয়ে নৌকায় ওঠেন। মঈনউদ্দিন ফখরুদ্দীন সরকারের শাসন শেষে ২০০৮ সালের নির্বাচনে টিটো সদর আসন থেকে বন্ধু রাজুকে টপকে নৌকা প্রতীক জিতে নেন। লড়াইতে নামেন বন্ধু তরিকুলের বিরুদ্ধে। এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত তরিকুল ইসলাম পরাজিত হন। জিতে যান টিটো। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করলে টিটো স্বপ্ন দেখেন হয়তো ক্যাবিনেটে ডাক পাবেন। কিন্তু বাদ সাধে স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতি। তিনি দলের এমপি হন কিন্তু দলের নেতা হতে পারেননি। দলের মনোনয়ন না পেয়ে আলী রেজা রাজু ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার টিটোকে কোণঠাসা করে ফেলেন। দীর্ঘ ৫ বছর সরকারে থাকলেও টিটোকে দলীয় কোন কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। পাওয়া যায়নি দলীয় অফিসেও। অভিযোগ রয়েছে, রাজনীতিতে বিসর্জন খাটলেও এমপির প্রভাব আর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এমপি ও তার পুত্রত্রয় কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। নানা কারণে এমপির প্রতি দলীয় নেতৃত্বের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটবিহীন এ নির্বাচনে আলী রেজা রাজু ও টিটোকে টপকে নৌকার মনোনয়ন লাভ করেন রাজনীতিতে নবীন কাজী নাবিল আহমেদ। ফলে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন টিটো। এখন অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন শহরের ষষ্টিতলার বাসায়। বিপত্নীক এ রাজনীতিকের দিন কাটছে পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প গুজব করে। অপরদিকে বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন তরিকুল ইসলাম। ফলে রাজনীতির সব পদ অলংকৃত করে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। অন্যদিকে রাজু ছিটকে পড়েন জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে। সর্বশেষ দলের জেলা সম্মেলনে তিনি তার পদ হারিয়ে রিক্ত-সিক্ত জীবনযাপন করছেন। মরণব্যাধি ক্যান্সার ও কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রাজু এখন অনেকটা রাজনীতিবিমুখ। করছেন ঢাকা আর যশোর।
অপরদিকে বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে একের পর এক মামলায় জর্জরিত তরিকুল ইসলাম। নানা রোগেও কাবু হয়ে পড়েছেন প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ। সময় তিন বন্ধুকে প্রায় একই বিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তিনজনেরই এখন দুঃসময়।
ষাটের দশকে সোভিয়েতপন্থি ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে অভিষেক হয় তরিকুল ইসলামের। সঙ্গে ছিলেন বাল্যবন্ধু খালেদুর রহমান টিটো আর আলী রেজা রাজু। নেতৃত্বের দিক থেকে তরিকুল ইসলাম শুরুতেই কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে তিনি অন্য দুই বন্ধুর তুলনায় কিছুটা সুনজর কাড়েন পূর্বসূরিদের। কিন্তু তাহলে কি হবে, তিনি সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে শুরু করেন বাল্যবন্ধু টিটো আর রাজুকে। যশোর কলেজের ছাত্র হিসেবে তরিকুল আর টিটো ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ শুরু করেন। আর লেখাপড়ায় কিছুটা পিছিয়ে থেকে পেছন থেকে দুই বন্ধুকে উৎসাহ জোগাতে কলেজে উপস্থিত থাকতেন রাজু। কলেজ সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, সর্বত্রই টিটো আর তরিকুলের অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। আর রাজু যশোর শহরে দাদাগিরি করতেন। আর ওপর থেকে তাকে সাপোর্ট জোগাতেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই বাল্যবন্ধু। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই তিন বন্ধুর রয়েছে অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর তিন বন্ধু মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দেশ গড়ার রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চাকরির ভূরি ভূরি সুযোগ এলেও কেউ তা করেননি। তাদের মস্তিস্কে তখন দেশসেবার ভূত ভর করে। মার্কসবাদ লেলিনবাদের রাজনীতি নিয়ে দেশ স্বাধীনের পর তিন বন্ধু জেলও খেটেছেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলে যেমন তারা জেল খেটেছেন তেমনি দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হিসেবেও তাদের জেল খাটতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালে দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে তিন বন্ধু আবারও সক্রিয় হন রাজনীতির ময়দানে। তারই ধারাবাহিকতায় তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখান। তারও আগে রাজু সদরের কাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যান হিসেবে জনপ্রতিনিধির খেতাব লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া জাগদল গঠন করলে তরিকুল ইসলাম তার রাজনৈতিক গুরু আলমগীর সিদ্দিকীর হাত ধরে নাম লেখান সেই দলে। তার সঙ্গে হাত মেলান বন্ধু রাজু। আর টিটো থেকে যান পুরনো ব্যানার নিয়ে। বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলে তরিকুল ইসলাম যশোরের এমপি হিসেবে প্রতিমন্ত্রী হন। শুরু করেন জাতীয় রাজনীতির পাঠচক্র। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করলে টিটো সেই দলে নাম লেখান। তিন বন্ধুর দুই প্লাটফর্মে অবস্থান যশোরের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। টিটো এরশাদ সরকারের ক্যাবিনেটে ঠাঁই নিয়ে নাম লেখান নতুন ইতিহাসে। ১৯৮৫ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে সে সময় যশোর স্টেডিয়ামে এরশাদের প্রাণনাশের চেষ্টা নামক এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তরিকুল ইসলাম আবার জেলে যান। আর রাজু কিছুটা আত্মগোপনে নিজেকে রক্ষা করেন। শুরু হয় বন্ধুত্বের ফাটল। তবে তা রাজনীতির মাঠে, বিবৃতি আর বক্তৃতায়; ব্যক্তিপর্যায়ে নয়। ১৯৮৯ সালে আলী রেজা রাজু যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তরিকুল ইসলাম বিএনপির টিকিটে মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা রওশন আলীর বিপক্ষে মাঠে নামেন। এ লড়াইয়ে তরিকুল ইসলাম পরাজিত হন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে নির্বাচনে পরাজিত হয়েও টেকনোক্র্যাট কোটায় বেগম জিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য মনোনীত হন তরিকুল ইসলাম। কিছুদিন পরেই যশোর পৌরসভা নির্বাচনে বন্ধু আলী রেজা রাজু বিএনপির টিকিটে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দুই বন্ধু মিলে সে সময় যশোরের উন্নয়নে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাজ করেন। এ সময় জাতীয় পার্টির দুর্দিনে দলের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন সাবেক মন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো। এর পরের ইতিহাস আরো রোমাঞ্চকর।
১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে দলত্যাগ করেন আলী রেজা রাজু। তিনি বাল্যবন্ধু তরিকুলের ওপর অভিমান করে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পেয়ে যান দলীয় মনোনয়ন। আর অপর বন্ধু টিটো হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। ফলে যশোর-৩ সদর আসনে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তরিকুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আলী রেজা রাজু আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে খালেদুর রহমান টিটো নির্বাচনী মাঠে লড়াই করতে নামেন। তিন বাল্যবন্ধুর লড়াইয়ে পরাজিত হন তরিকুল ইসলাম ও টিটো। জয়ের মালা গলায় পরে মুজিব কোর্ট গায়ে জড়িয়ে জাতীয় সংসদে যান আলী রেজা রাজু। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার থেকে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান আর সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে এমপি হয়ে যশোরবাসীকে তাক লাগিয়ে দেন সদালাপী ও সদাহাস্যোজ্জ্বল আলী রেজা রাজু। যিনি যশোরবাসীর কাছে দাদা নামে পরিচিত। এমপি হিসেবে রাজু নির্বাচনী এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাদের পরাজিত করে তিনি যেমন দলীয় মনোনয়ন ছিনিয়ে নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়লাভ করে দলীয় সভানেত্রীর সুনজর কাড়েন তেমনি তিনি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যান। রাতারাতি তিনি দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আর তরিকুল ইসলাম বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরপর রাজনীতির ঘোরটোপে টিটো যোগ দেন বিএনপিতে। বন্ধু তরিকুলের হাত ধরে তিনি জেলা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিএনপির পতাকাতলে দুই বাল্যবন্ধুকে পেয়ে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা যারপরনাই উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে টিটো যশোর-৩ সদর আসন থেকে বিএনপির টিকিটে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। কিন্তু দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু দলের ভাইস চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়ার চিন্তাও করেননি দলের চেয়ারপার্সন। টিটোকে যশোর-২ চৌগাছা ঝিকরগাছা অথবা যশোর-৪ বাঘারপাড়া আসন থেকে মনোনয়ন নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু টিটো নাখোশ হয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। নৌকা প্রতীক নিয়ে মাঠে নামেন আলী রেজা রাজু। জমে ওঠে নির্বাচনী লড়াই। বিপুল ভোটের ব্যবধানে রাজুকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন তরিকুল ইসলাম। দলের দুর্দিনের কাণ্ডারি হিসেবে খ্যাত তরিকুল ইসলাম ঠাঁই পান বেগম জিয়ার তৃতীয় ক্যাবিনেটে। ৫ বছরে তরিকুল ইসলাম মন্ত্রী পরিষদের একাধিক দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেন। বন্ধু টিটোকে পাশে রেখে তিনি যশোর বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর মেডিকেল কলেজ, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, আঞ্চলিক পাঠাগার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, যশোর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ অসংখ্য স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এমপি মন্ত্রী কোনটাই ভাগ্যে না জোটায় টিটো ডিগবাজি দিয়ে নৌকায় ওঠেন। মঈনউদ্দিন ফখরুদ্দীন সরকারের শাসন শেষে ২০০৮ সালের নির্বাচনে টিটো সদর আসন থেকে বন্ধু রাজুকে টপকে নৌকা প্রতীক জিতে নেন। লড়াইতে নামেন বন্ধু তরিকুলের বিরুদ্ধে। এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত তরিকুল ইসলাম পরাজিত হন। জিতে যান টিটো। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করলে টিটো স্বপ্ন দেখেন হয়তো ক্যাবিনেটে ডাক পাবেন। কিন্তু বাদ সাধে স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতি। তিনি দলের এমপি হন কিন্তু দলের নেতা হতে পারেননি। দলের মনোনয়ন না পেয়ে আলী রেজা রাজু ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার টিটোকে কোণঠাসা করে ফেলেন। দীর্ঘ ৫ বছর সরকারে থাকলেও টিটোকে দলীয় কোন কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। পাওয়া যায়নি দলীয় অফিসেও। অভিযোগ রয়েছে, রাজনীতিতে বিসর্জন খাটলেও এমপির প্রভাব আর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এমপি ও তার পুত্রত্রয় কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। নানা কারণে এমপির প্রতি দলীয় নেতৃত্বের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটবিহীন এ নির্বাচনে আলী রেজা রাজু ও টিটোকে টপকে নৌকার মনোনয়ন লাভ করেন রাজনীতিতে নবীন কাজী নাবিল আহমেদ। ফলে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন টিটো। এখন অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন শহরের ষষ্টিতলার বাসায়। বিপত্নীক এ রাজনীতিকের দিন কাটছে পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প গুজব করে। অপরদিকে বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন তরিকুল ইসলাম। ফলে রাজনীতির সব পদ অলংকৃত করে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। অন্যদিকে রাজু ছিটকে পড়েন জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে। সর্বশেষ দলের জেলা সম্মেলনে তিনি তার পদ হারিয়ে রিক্ত-সিক্ত জীবনযাপন করছেন। মরণব্যাধি ক্যান্সার ও কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রাজু এখন অনেকটা রাজনীতিবিমুখ। করছেন ঢাকা আর যশোর।
অপরদিকে বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে একের পর এক মামলায় জর্জরিত তরিকুল ইসলাম। নানা রোগেও কাবু হয়ে পড়েছেন প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ। সময় তিন বন্ধুকে প্রায় একই বিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তিনজনেরই এখন দুঃসময়।
No comments