তিনি বেঁচে আছেন, এটাই যথেষ্ট! by আসিফ নজরুল
চোখ ও হাত বেঁধে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে শিলংয়ে নেওয়া হয়েছে |
বিএনপির
নেতা সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে রহস্যের জাল কাটছে না। দীর্ঘদিন পর তিনি কীভাবে
শিলংয়ে আবির্ভূত হলেন? কারা তাঁকে নিয়ে গেছে? মাঝখানে ৬২ দিন তিনি কোথায়
ছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগ জানে, বিএনপিও হয়তো জানে। একমাত্র
জানেন না সালাহ উদ্দিন নিজে। তিনি বলেছেন, ৬২ দিনের বহু কিছু তিনি মনে করতে
পারছেন না। তিনি তাই জানেন না তাঁকে কারা কোথায় রেখেছিল। এমনকি কারা
তাঁকে এই দীর্ঘপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিয়ে গেছে, সেটাও তিনি বলতে পারেন
না!
সালাহ উদ্দিনের এই ‘স্মৃতিবিভ্রম’ ডাক্তাররা নাকি বিশ্বাস করছেন না ভারতে। তবে এটি অব্যাহত রাখাই সম্ভবত মঙ্গলজনক হবে তাঁর জন্য। এর আগে এ বি সিদ্দিকী ফিরে এসেছিলেন গুমবাহিনী থেকে। ফিরে এসে কারও কাছে অভিযোগ করেননি, কারও বিচার চাননি, কারও বিচার হয়ওনি। প্রাণ ফিরে পাওয়ার আনন্দে এ বি সিদ্দিকী মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে তাঁর স্ত্রী রিজওয়ানা হাসানের। কিন্তু তিনি নিজের জীবনে এত বড় অন্যায়ের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে পারেননি। যে দেশে গুম আর ক্রসফায়ার প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে, সেখানে এ বি সিদ্দিকীর ফিরে আসাতেই ধন্য হয়েছে তাঁর পরিবার এবং তাঁর সব শুভাকাঙ্ক্ষী।
সালাহ উদ্দিনও হয়তো তাই বাঁচার আনন্দে সবকিছু ভুলে যেতে প্রস্তুত আছেন। তাঁর পরিবারও এ নিয়ে কোনো কিছু বলতে চায় না, হয়তো বলবেও না কোনো দিন। এর কারণ আছে। চৌধুরী আলম আর ইলিয়াস আলী কয়েক বছরে ফিরে আসেননি। নাসিরউদ্দিন পিন্টুর জেল থেকে মেয়র নির্বাচন করার মতো উদ্দীপনা ছিল। কিন্তু জেলেই তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন এক সপ্তাহের মধ্যে। কোনো কিছুর বিচার হয়নি, ‘২০৪১ সাল’ পর্যন্ত হওয়ার তেমন সম্ভাবনাও নেই। এমন এক পরিস্থিতিতে সালাহ উদ্দিনের হদিস যে পাওয়া গেল, সেটিই তো অনেক তাঁর জন্য! আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে কোনো দিনও তাই আর তাঁর ৬২ দিনের স্মৃতি ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।
বরং তাঁর ‘স্মৃতিবিভ্রম’ গুমের শিকার ব্যক্তিদের প্রাণে বাঁচার জন্য এক অভিনব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এ দেশে গুমের বিচার হবে না। যত দিন আওয়ামী লীগের একাধিপত্য সুনিশ্চিত না হবে, তত দিন হয়তো গুমও বন্ধ হবে না। তবে গুম করে মেরে লাশসুদ্ধ নিশ্চিহ্ন করার চেয়ে এ বি সিদ্দিকী বা সালাহ উদ্দিন বা আরও আগের সুখরঞ্জন বালীর পদ্ধতিতে অন্তত জীবিত রাখার চেষ্টা সরকার এখন সবার ক্ষেত্রে করতে পারে।
এই বিচারহীনতার দেশে এখন তা-ই হবে পরম পাওয়া! প্রাণে না মেরে যাকে গুম করা হবে, তাকে বেশ কিছুদিন আটকে রাখা হোক! পরে গুমকৃত ব্যক্তির স্মৃতিবিভ্রম ঘটবে বা এবং তার মুখ বন্ধ থাকবে—এই নিশ্চয়তা পেলে তাকে এ বি সিদ্দিকীর মতো পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া যেতে পারে। কিংবা সালাহ উদ্দিন বা সুখরঞ্জন বালীর মতো বিপজ্জনক কেউ হলে তাঁকে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ভারতে আটক রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনে ফরেনারস অ্যাক্টে বিচার করে সেখানে কয়েক বছরের জন্য জেলেও রাখা যেতে পারে!
এসবের জন্য কোনো দায় সরকারকে নিতে হবে না। সরকার গুম করেছে এটি স্বীকার করারও প্রয়োজন নেই। এর দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হোক! তবু শুধু গুমের শিকার ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হোক। অবসান ঘটানো হোক তার পরিবারের দুঃসহ যন্ত্রণার দিনযাপনের।
সর্বোচ্চ নিপীড়ন হচ্ছে কাউকে মেরে ফেলা, তার মৃত্যুর সংবাদ এবং মৃতদেহ গুম করে ফেলা। এর অবসান হোক!
২...
এ দেশের শাসকেরা সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অতীতে বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। আইনি, রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে কোনো পদক্ষেপ অকার্যকর বা বিতর্কিত হয়ে উঠলে আরও কঠোর পদক্ষেপ এসেছে। গুম এর সর্বশেষ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ সংস্করণ।
অতীতে দীর্ঘদিন সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে প্রিভেনশন ডিটেনশন বা নিবর্তনমূলক আটকাদেশ দিয়ে। এই আটকাদেশ দেওয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়, ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করা হয় বিশেষ ক্ষমতা আইন। ডিটেনশন পাওয়া ব্যক্তিদের সাধারণভাবে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির মতো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির হওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থাকে না। তাকে কেন আটক করা হলো তা ‘জনস্বার্থে’ জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকে না। একাধারে ছয় মাস আটকাদেশের পর এটি আরও বৃদ্ধি হবে কি না, তা–ও নির্ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে সরকার কর্তৃক গঠিত অ্যাডভাইজরি বোর্ডের।
অত্যাচারী শাসকদের ডিটেনশন কৌশলে বাদ সাধে এরশাদ আমলের সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে দায়েরকৃত একের পর এক হেবিয়াস কর্পাস মামলায় প্রিভেনটিভ ডিটেনশনকে অবৈধ ঘোষণা করে এর প্রয়োগের সুযোগকে অনেকাংশে বন্ধ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমলে ভিন্নমতাবলম্বী আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য নির্যাতন পদ্ধতি হয় কঠোরতর। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি এ সময় ক্রসফায়ারের নামে নবসৃষ্ট র্যা বের হাতে খুন করা হয় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের। ক্রসফায়ারের নতুন নতুন গল্প বানানো কঠিন, প্রত্যক্ষদর্শীর ঝামেলা থাকে এবং সবচেয়ে যা সমস্যা, হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির শরীরে থাকে হত্যাকাণ্ডের নানা আলামত। এসব ঝামেলা এড়ানোর জন্যই কি না কে জানে, শেখ হাসিনার দ্বিতীয় আমল থেকে ক্রসফায়ারের পাশাপাশি শুরু হয় গুমের তাণ্ডব। গুম করে কারও জীবন-দেহ-অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার এই রক্তজল করা প্রবণতার শিকার হয়েছে গত পাঁচ বছরে বহু মানুষ!
গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার আহাজারি করলে সরকার স্রেফ কিছুই জানে বলে তার দায়িত্ব সেরেছে, কখনো এসব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছে। এই দেশে আইন-আদালত আছে, পুলিশ গোয়েন্দা আছে, সংবাদপত্র-সুশীল সমাজ আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গুমের কোনো বিচার হয়নি বা গুমের জন্য কারা দায়ী, এই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় শরীরের সঙ্গে বাঁধা ইট খুলে পরে লাশ ভেসে উঠলে এবং হাইকোর্ট একটি সাহসী সিদ্ধান্ত দিলে এতে র্যা বের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার তথ্য উদ্ভাসিত হয়। এর ঠিক পরপরই সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এনে প্রায় একদলীয় বর্তমান সংসদে উচ্চ আদালতের বিচারকদের যথেচ্ছ সমালোচনা এবং চাকরিচ্যুত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। র্যা বের ক্ষমতা, দাপট এবং রাজনৈতিক খবরদারি হয়ে ওঠে আরও প্রকাশ্য।
এখন যা পরিস্থিতি, আমার মনে হয় না গুমের বিরুদ্ধে বিচারিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো কোনো শক্তি আছে দেশে। গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার হয়তো তার প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা করে, কিন্তু এটি হবে এই বিশ্বাস সম্ভবত তাদের আর নেই। ভুক্তভোগী পরিবারদের সমাবেশে তাই বলতে শোনা যায়, গুম করা ব্যক্তিকে কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে তা অন্তত জানানো হোক। সালাহ উদ্দিনের পুনরুত্থানের চরম নাটকীয় ঘটনার পর হয়তো এখন নতুন করে আশায় বুক বাঁধবে গুমের শিকার এই পরিবারগুলো। তারা আশা করবে, কোনো একদিন মেঘালয় কিংবা অরুণাচল—কোথাও উদ্ভ্রান্ত বেশে খোঁজ পাওয়া যাবে হারিয়ে যাওয়া স্বজনের। পাওয়া গেলে তিনি বা তাঁর পরিবার কাউকে দুষবে না এ জন্য, প্রয়োজনে স্মৃতিভ্রষ্ট হবেন, নাটক সাজিয়েছেন বলে উল্টো অভিযুক্ত হবেন, তবু তাঁর প্রাণরক্ষা হোক!
৩...
বিএনপি অভিযোগ করেছিল সালাহ উদ্দিনকে সরকারি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছে। সালাহ উদ্দিনের সন্ধানের খবরের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন: প্রমাণ হলো বিএনপি মিথ্যাচার করেছে। প্রথম আলো অনলাইন পাঠক জরিপে প্রশ্ন করেছিল, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য কি যৌক্তিক? ৯ হাজার ৬৩৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ‘না’ বলেছিল ৭ হাজার ১৯২ জন। আমরা এসব উত্তরদাতাকে ‘রাবিশ’ হিসেবে উড়িয়ে দিতে প্রস্তুত আছি। সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে পুলিশ সালাহ উদ্দিনের দুজন ড্রাইভার ও একজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছিল, তাঁর খোঁজে র্যা ব বেশ কয়েক জায়গায় হানা দিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন, সরকারি বাহিনীর লোকজন সালাহ উদ্দিনকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি গাড়ি ঘটনাস্থলের কাছে ছিল বলেও জানিয়েছিলেন। আমরা এসব প্রসঙ্গ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’ হিসেবে ভুলে যেতে রাজি আছি।
আমাদের কিছু প্রশ্নও ছিল। বিএনপির নেত্রী সুনির্দিষ্টভাবে র্যা বের কাছেই সালাহ উদ্দিন আছেন বলে অভিযোগ করার দুই দিনের মধ্যে তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল কেন? নিজের ইচ্ছেয় সীমান্ত পাড়ি দিলে সালাহ উদ্দিন কেন যাবেন পাসপোর্ট, মালামাল, অর্থকড়ি, প্রস্তুতি ছাড়া? কেন এবং কীভাবে নূর হোসেন, সালাহ উদ্দিন বা সুখরঞ্জন বালীর হদিস মেলে ভারতে? এসব প্রশ্নও ‘উসকানিমূলক’ হিসেবে আমরা ভুলে যেতে রাজি আছি। তবু বেঁচে থাক সালাহ উদ্দিন এবং তাঁর মতো গুমের শিকার মানুষেরা।
এই পোড়া দেশে এখন এর চেয়ে বেশি চাওয়ার আর কিছু নেই!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সালাহ উদ্দিনের এই ‘স্মৃতিবিভ্রম’ ডাক্তাররা নাকি বিশ্বাস করছেন না ভারতে। তবে এটি অব্যাহত রাখাই সম্ভবত মঙ্গলজনক হবে তাঁর জন্য। এর আগে এ বি সিদ্দিকী ফিরে এসেছিলেন গুমবাহিনী থেকে। ফিরে এসে কারও কাছে অভিযোগ করেননি, কারও বিচার চাননি, কারও বিচার হয়ওনি। প্রাণ ফিরে পাওয়ার আনন্দে এ বি সিদ্দিকী মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে তাঁর স্ত্রী রিজওয়ানা হাসানের। কিন্তু তিনি নিজের জীবনে এত বড় অন্যায়ের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে পারেননি। যে দেশে গুম আর ক্রসফায়ার প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে, সেখানে এ বি সিদ্দিকীর ফিরে আসাতেই ধন্য হয়েছে তাঁর পরিবার এবং তাঁর সব শুভাকাঙ্ক্ষী।
সালাহ উদ্দিনও হয়তো তাই বাঁচার আনন্দে সবকিছু ভুলে যেতে প্রস্তুত আছেন। তাঁর পরিবারও এ নিয়ে কোনো কিছু বলতে চায় না, হয়তো বলবেও না কোনো দিন। এর কারণ আছে। চৌধুরী আলম আর ইলিয়াস আলী কয়েক বছরে ফিরে আসেননি। নাসিরউদ্দিন পিন্টুর জেল থেকে মেয়র নির্বাচন করার মতো উদ্দীপনা ছিল। কিন্তু জেলেই তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন এক সপ্তাহের মধ্যে। কোনো কিছুর বিচার হয়নি, ‘২০৪১ সাল’ পর্যন্ত হওয়ার তেমন সম্ভাবনাও নেই। এমন এক পরিস্থিতিতে সালাহ উদ্দিনের হদিস যে পাওয়া গেল, সেটিই তো অনেক তাঁর জন্য! আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে কোনো দিনও তাই আর তাঁর ৬২ দিনের স্মৃতি ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।
বরং তাঁর ‘স্মৃতিবিভ্রম’ গুমের শিকার ব্যক্তিদের প্রাণে বাঁচার জন্য এক অভিনব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এ দেশে গুমের বিচার হবে না। যত দিন আওয়ামী লীগের একাধিপত্য সুনিশ্চিত না হবে, তত দিন হয়তো গুমও বন্ধ হবে না। তবে গুম করে মেরে লাশসুদ্ধ নিশ্চিহ্ন করার চেয়ে এ বি সিদ্দিকী বা সালাহ উদ্দিন বা আরও আগের সুখরঞ্জন বালীর পদ্ধতিতে অন্তত জীবিত রাখার চেষ্টা সরকার এখন সবার ক্ষেত্রে করতে পারে।
এই বিচারহীনতার দেশে এখন তা-ই হবে পরম পাওয়া! প্রাণে না মেরে যাকে গুম করা হবে, তাকে বেশ কিছুদিন আটকে রাখা হোক! পরে গুমকৃত ব্যক্তির স্মৃতিবিভ্রম ঘটবে বা এবং তার মুখ বন্ধ থাকবে—এই নিশ্চয়তা পেলে তাকে এ বি সিদ্দিকীর মতো পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া যেতে পারে। কিংবা সালাহ উদ্দিন বা সুখরঞ্জন বালীর মতো বিপজ্জনক কেউ হলে তাঁকে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ভারতে আটক রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনে ফরেনারস অ্যাক্টে বিচার করে সেখানে কয়েক বছরের জন্য জেলেও রাখা যেতে পারে!
এসবের জন্য কোনো দায় সরকারকে নিতে হবে না। সরকার গুম করেছে এটি স্বীকার করারও প্রয়োজন নেই। এর দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হোক! তবু শুধু গুমের শিকার ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হোক। অবসান ঘটানো হোক তার পরিবারের দুঃসহ যন্ত্রণার দিনযাপনের।
সর্বোচ্চ নিপীড়ন হচ্ছে কাউকে মেরে ফেলা, তার মৃত্যুর সংবাদ এবং মৃতদেহ গুম করে ফেলা। এর অবসান হোক!
২...
এ দেশের শাসকেরা সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অতীতে বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। আইনি, রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে কোনো পদক্ষেপ অকার্যকর বা বিতর্কিত হয়ে উঠলে আরও কঠোর পদক্ষেপ এসেছে। গুম এর সর্বশেষ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ সংস্করণ।
অতীতে দীর্ঘদিন সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে প্রিভেনশন ডিটেনশন বা নিবর্তনমূলক আটকাদেশ দিয়ে। এই আটকাদেশ দেওয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়, ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করা হয় বিশেষ ক্ষমতা আইন। ডিটেনশন পাওয়া ব্যক্তিদের সাধারণভাবে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির মতো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির হওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থাকে না। তাকে কেন আটক করা হলো তা ‘জনস্বার্থে’ জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকে না। একাধারে ছয় মাস আটকাদেশের পর এটি আরও বৃদ্ধি হবে কি না, তা–ও নির্ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে সরকার কর্তৃক গঠিত অ্যাডভাইজরি বোর্ডের।
অত্যাচারী শাসকদের ডিটেনশন কৌশলে বাদ সাধে এরশাদ আমলের সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে দায়েরকৃত একের পর এক হেবিয়াস কর্পাস মামলায় প্রিভেনটিভ ডিটেনশনকে অবৈধ ঘোষণা করে এর প্রয়োগের সুযোগকে অনেকাংশে বন্ধ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমলে ভিন্নমতাবলম্বী আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য নির্যাতন পদ্ধতি হয় কঠোরতর। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি এ সময় ক্রসফায়ারের নামে নবসৃষ্ট র্যা বের হাতে খুন করা হয় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের। ক্রসফায়ারের নতুন নতুন গল্প বানানো কঠিন, প্রত্যক্ষদর্শীর ঝামেলা থাকে এবং সবচেয়ে যা সমস্যা, হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির শরীরে থাকে হত্যাকাণ্ডের নানা আলামত। এসব ঝামেলা এড়ানোর জন্যই কি না কে জানে, শেখ হাসিনার দ্বিতীয় আমল থেকে ক্রসফায়ারের পাশাপাশি শুরু হয় গুমের তাণ্ডব। গুম করে কারও জীবন-দেহ-অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার এই রক্তজল করা প্রবণতার শিকার হয়েছে গত পাঁচ বছরে বহু মানুষ!
গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার আহাজারি করলে সরকার স্রেফ কিছুই জানে বলে তার দায়িত্ব সেরেছে, কখনো এসব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছে। এই দেশে আইন-আদালত আছে, পুলিশ গোয়েন্দা আছে, সংবাদপত্র-সুশীল সমাজ আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গুমের কোনো বিচার হয়নি বা গুমের জন্য কারা দায়ী, এই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় শরীরের সঙ্গে বাঁধা ইট খুলে পরে লাশ ভেসে উঠলে এবং হাইকোর্ট একটি সাহসী সিদ্ধান্ত দিলে এতে র্যা বের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার তথ্য উদ্ভাসিত হয়। এর ঠিক পরপরই সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এনে প্রায় একদলীয় বর্তমান সংসদে উচ্চ আদালতের বিচারকদের যথেচ্ছ সমালোচনা এবং চাকরিচ্যুত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। র্যা বের ক্ষমতা, দাপট এবং রাজনৈতিক খবরদারি হয়ে ওঠে আরও প্রকাশ্য।
এখন যা পরিস্থিতি, আমার মনে হয় না গুমের বিরুদ্ধে বিচারিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো কোনো শক্তি আছে দেশে। গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার হয়তো তার প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা করে, কিন্তু এটি হবে এই বিশ্বাস সম্ভবত তাদের আর নেই। ভুক্তভোগী পরিবারদের সমাবেশে তাই বলতে শোনা যায়, গুম করা ব্যক্তিকে কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে তা অন্তত জানানো হোক। সালাহ উদ্দিনের পুনরুত্থানের চরম নাটকীয় ঘটনার পর হয়তো এখন নতুন করে আশায় বুক বাঁধবে গুমের শিকার এই পরিবারগুলো। তারা আশা করবে, কোনো একদিন মেঘালয় কিংবা অরুণাচল—কোথাও উদ্ভ্রান্ত বেশে খোঁজ পাওয়া যাবে হারিয়ে যাওয়া স্বজনের। পাওয়া গেলে তিনি বা তাঁর পরিবার কাউকে দুষবে না এ জন্য, প্রয়োজনে স্মৃতিভ্রষ্ট হবেন, নাটক সাজিয়েছেন বলে উল্টো অভিযুক্ত হবেন, তবু তাঁর প্রাণরক্ষা হোক!
৩...
বিএনপি অভিযোগ করেছিল সালাহ উদ্দিনকে সরকারি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছে। সালাহ উদ্দিনের সন্ধানের খবরের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন: প্রমাণ হলো বিএনপি মিথ্যাচার করেছে। প্রথম আলো অনলাইন পাঠক জরিপে প্রশ্ন করেছিল, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য কি যৌক্তিক? ৯ হাজার ৬৩৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ‘না’ বলেছিল ৭ হাজার ১৯২ জন। আমরা এসব উত্তরদাতাকে ‘রাবিশ’ হিসেবে উড়িয়ে দিতে প্রস্তুত আছি। সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে পুলিশ সালাহ উদ্দিনের দুজন ড্রাইভার ও একজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছিল, তাঁর খোঁজে র্যা ব বেশ কয়েক জায়গায় হানা দিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন, সরকারি বাহিনীর লোকজন সালাহ উদ্দিনকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি গাড়ি ঘটনাস্থলের কাছে ছিল বলেও জানিয়েছিলেন। আমরা এসব প্রসঙ্গ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’ হিসেবে ভুলে যেতে রাজি আছি।
আমাদের কিছু প্রশ্নও ছিল। বিএনপির নেত্রী সুনির্দিষ্টভাবে র্যা বের কাছেই সালাহ উদ্দিন আছেন বলে অভিযোগ করার দুই দিনের মধ্যে তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল কেন? নিজের ইচ্ছেয় সীমান্ত পাড়ি দিলে সালাহ উদ্দিন কেন যাবেন পাসপোর্ট, মালামাল, অর্থকড়ি, প্রস্তুতি ছাড়া? কেন এবং কীভাবে নূর হোসেন, সালাহ উদ্দিন বা সুখরঞ্জন বালীর হদিস মেলে ভারতে? এসব প্রশ্নও ‘উসকানিমূলক’ হিসেবে আমরা ভুলে যেতে রাজি আছি। তবু বেঁচে থাক সালাহ উদ্দিন এবং তাঁর মতো গুমের শিকার মানুষেরা।
এই পোড়া দেশে এখন এর চেয়ে বেশি চাওয়ার আর কিছু নেই!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments