দালালদের ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ -সরজমিন মাদরাসা বোর্ড by নূর মোহাম্মদ

শফিক উল্লাহ। শরীয়তপুর সদর উপজেলার একটি দাখিল মাদরাসার শিক্ষক। দাখিল থেকে আলিম শ্রেণীর পাঠদান অনুমতির জন্য সকল মানদণ্ড মেনে আবেদন করেছেন ৩ বছর আগে। প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র জমা দেয়ার পরও কাজ হয়নি। খোঁড়া অজুহাতে বারবার তার আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়। বাধ্য হয়ে ভিন্ন পথে যান তিনি। বোর্ডের মঞ্জুরি শাখার এক কর্মকর্তার দেয়া পরামর্শে তিনি আলিয়া মাদরাসা পাশে একটি কম্পিউটার দোকানে যোগাযোগ করেন। গিয়ে দেখেন কম্পিউটার দোকানের আড়ালে চলে বোর্ডে বিভিন্ন কাজ করে দেয়ার দালালি। সেখানে পেলেন আলা উদ্দিনের চেরাগ। তিনি জানান, তিন বছরে যে কাজ হয়নি মাত্র দেড় মাসে সেটি করে দিয়েছেন তারা। নতুন পাঠদান অনুমতি, হারানো কাগজপত্র উঠানো, নাম, বয়স সংশোধনসহ যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক করা হয় এখান থেকে। মানে আপনাকে অন্য কোথাও যেতে হবে না। এক দোকানে বসে সব কাজ। এজন্য দালালরা এটাকে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ নাম দিয়েছেন। কাস্টমার সংগ্রহের পাশাপাশি বোর্ডের সব টেবিল ম্যানেজ করাই এই সার্ভিসের কাজ। আর এই দালাল চত্রেুর সঙ্গে আলিয়া মাদরাসা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, বোর্ডের একশ্রেণীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে গেইটের আনসার পর্যন্ত জড়িত।
ওয়ান স্টপ সার্ভিসের রাসেল জানান, আমরা হারানো মার্কশিট, সার্টিফিকেট একদিনের মধ্যে উঠিয়ে দিই। কেউ নরমাল প্রক্রিয়ায় উঠাতে গিলে এক সপ্তাহেও পারবেন না। তাছাড়া থানায় ডায়রি, পত্রিকা বিজ্ঞপ্তি দেয়াসহ সকল কাজও আমরা করে দিই। আপনার যদি জরুরি হয় তবে সকালে জমা দিয়ে বিকালে কাগজপত্র পাবেন। এজন্য এটার নাম দিয়েছি ওয়ান স্টপ সার্ভিস। মঙ্গলবার রাজধানীর বকশীবাজারে বাংলাদেশে মাদরাসা বোর্ডে সরজমিনে গিয়ে এই ওয়ান স্টপ সার্ভিসসহ আরও নানা অনিয়মের দেখা মিলে।
এ বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম ছায়েফ উল্যা মানবজমিনকে বলেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস নামে কেউ এ ধরনের সার্ভিস দিচ্ছে তা আমার জানা নেই। যদি এ ধরনের অভিযোগ পাই তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দিবো। এবং এর সঙ্গে বোর্ডের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পাঠদানের অনুমতি মন্ত্রণালয় দেয়, বোর্ড নয়। আমরা কেবল সরজমিন প্রতিবেদন করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিই। চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। গত দুই বছর ধরে কোন মাদরাসা পাঠদানের অনুমিত দেয়া হয়নি। ওই সার্ভিসের নামে কেউ যদি এ ধরনের অনুমোদন দিয়ে থাকে তবে সেটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না বলে জানান চেয়ারম্যান।
দুই বছর ধরে এক ছাত্রের বয়স ঠিক করাতে বোর্ডের বিভিন্ন টেবিলে ধরনা দিচ্ছেন মনজিল মিয়া নামে এক শিক্ষক। তিনি জানান, নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন করার সময় ভুল করে এক ছাত্রের বয়স দুই বছর কম দেখাই। বোর্ড সেটি গ্রহণ করে নেয়। পরে ওই ছাত্র আমাকে ধরে। আমি যেহেতু কাজটি করেছি তাই আমাকে করে দিতে হবে। আর এই কাজ করতে গিয়ে ২ বছর ধরে বোর্ডে আসছি। এখন পর্যন্ত তিন বার ব্যাংকে ৫০০ টাকা করে ড্রাপট করেছি। গতকাল দুই নাম্বার বিল্ডিং এর নিচতলা ইনফরমেশন সেন্টার থেকে আমাকে জানায়, আবার ব্যাংকে ৫০০ টাকা ড্রাফট করতে হবে। এতে আমি রেগে গেলে তথ্য কেন্দ্র কর্মকর্তা বলেন, আপনার তো ম্যানেজ বুঝেন না। দুই বছর ধরে ফাইল নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন। কাজ হচ্ছে না। ফাইলের ভিতরে ৫০০ টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে বলবেন স্যার আমি বিকালে আসছি। দেখবেন হয়ে যাবে। ওই শিক্ষক প্রতিবেদককে জানান, ভাই কী কাজ নিয়ে এসেছেন? এখানে নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে। মামা ধরেন দেখবেন দ্রুত হয়ে গেছে।
মার্কশিট, সার্টিফিকেট উঠাতে গিয়েও বিড়ম্বনায় পড়েন অনেকেই। কিশোরগঞ্জ হয়বত নগর কামিল মাদরাসা ছাত্র গালিব তার দাখিল, আলিমের মার্কশিট হারিয়েছেন। থানায় সাধারণ ডায়রি, পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি সব প্রত্রিুয়া শেষ করে এক সপ্তাহ ধরে কাগজপত্র পাচ্ছেন না। অথচ তার একদিন পর জমা দিয়ে গতকাল কাগজ পেয়ে গেছেন এমন ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি জানান। কিভাবে সেটা জানতে চাইলে গালিব বলেন, ভাই এখানে অনেককিছু আন্ডার টেবিলে হয়। মামা (দালাল) ধরতে পারলে সকালে জমা দিয়ে বিকালে কাগজ পাওয়া যায়। এজন্য তিনি বোর্ডের পাশে দিগন্ত ইনফরমেন সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দেখিয়ে দেন। বলেন, আমি সেখানে না গিয়ে ভুল করেছি। আমি বিদেশে যাওয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কাগজপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু পারছি না। এ ছাড়াও মাদরাসার দাখিল ও আলিম স্তরে পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতিদানে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়মে দাঁড়িয়েছে। এজন্য শিক্ষা বোর্ডের মঞ্জুরি শাখার কদর সবচেয়ে বেশি। নির্দিষ্ট ফরমে মাদরাসার পাঠদান, স্বীকৃতি ও অধিভুক্তির জন্য আবেদন করতে হয়। এরপর নিয়মানুযায়ী সরজমিন পরিদর্শন শেষে অনুমোদন দেয়া হয়। তবে ভুক্তভোগী একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রধান অভিযোগ করেন, সব ধরনের মানদণ্ড মেনে আবেদন করলেও ঘুষ ছাড়া পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতি পাওয়া যায় না।

No comments

Powered by Blogger.