চার ঘাটে বিক্রি বাংলাদেশিরা by টিপু সুলতান
দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে
মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশিরা ঘাটে ঘাটে চার দফা বিক্রি হন।
কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে এর শুরু। আর শেষ ঘাট হলো মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী
থাইল্যান্ডের জঙ্গল।
ভুক্তভোগীরা জানান, শেষ ধাপ হলো সবচেয়ে জঘন্য ও কষ্টের। মুক্তিপণ দিতে না পারলে এখানেই জীবনের শেষ।
‘জঙ্গল ক্যাম্প’ নামে পরিচিতি পাওয়া শেষ ধাপ থেকে বিভিন্ন সময়ে মুক্তি পাওয়া ও উদ্ধার হওয়া অনেক বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা এখন থাইল্যান্ডের বন্দিশালায় আছেন। এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী এবং পাচারকারী চক্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সংখলা প্রদেশের স্থানীয় বাসিন্দা এবং ধরা পড়া দালালদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে দোভাষীর কাজ করা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে পাচারের রুট, ঘাটে ঘাটে হাতবদল ও মানুষ বেচাকেনার চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রথম ঘাট: বাংলাদেশিদের পাচারের ক্ষেত্রে প্রথম ঘাট হলো কক্সবাজারের টেকনাফ। বিভিন্ন এলাকা থেকে মাঠপর্যায়ের দালালেরা লোকজন এনে টেকনাফের ছোট ইঞ্জিন নৌকায় তুলে দেন। জনপ্রতি দালালেরা পান ১০ হাজার টাকা। টেকনাফ উপকূল থেকে ছোট নৌকায় এসব লোকেক নেওয়া হয় সমুদ্রে থাকা বড় ইঞ্জিন নৌকায়। মাছ ধরা ট্রলার বা ট্রলারের আদলে কাঠের তৈরি এসব বড় নৌকাকে পাচারকারীরা বলে ‘শিপ’ বা জাহাজ।
এসব জাহাজ বা বড় নৌকা যদি বাংলাদেশ জলসীমার কাছাকাছি থাকে, তাহলে টেকনাফের ছোট নৌকাগুলো ৪–৬ ঘণ্টা চলার পর সেখানে পৌঁছায়। আর যদি বাংলাদেশের জলসীমার বাইরে থাকে, তাহলে এক দিন এক রাত চলতে হয়। একেকটি ছোট নৌকায় ১০–১৫ জন করে নেওয়া হয়। এ সময় মানুষগুলোকে নৌকায় শুইয়ে রেখে গায়ের ওপর মাছ ধরার জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: বড় নৌকায় তুলে দিলে ছোট নৌকার মালিকেরা জনপ্রতি পান ১০ হাজার থাই বাথের সমান ২৫ হাজার টাকা। একইভাবে মিয়ানমারের দালালেরা আরাকান উপকূল থেকে ছোট নৌকায় রোহিঙ্গাদের এনে বড় নৌকায় বিক্রি করে মিয়ানমারের মুদ্রায় দুই লাখ কিয়াত (বাংলাদেশি ১৪ হাজার টাকার সমান)।
বড় নৌকায় ৩০০ থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত লোক নেওয়া হয়। ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত বড় নৌকা ছাড়ে না। এ জন্য এক থেকে দুই মাসও অপেক্ষা করা হয়।
পাচারকারীদের-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই দীর্ঘ সময় বড় নৌকাগুলো থাকে মিয়ানমারের জলসীমায় সে দেশের নৌবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে। এ জন্য নৌকাপ্রতি মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে দিতে হয় ওই দেশি মুদ্রায় তিন লাখ কিয়াত (বাংলাদেশি ২১ হাজার টাকার সমান)। ১৫ দিন রাখার জন্য এ টাকা দেওয়া হলেও নৌকাগুলো সাধারণত দুই মাস পর্যন্ত রাখে।
একবার বড় নৌকায় উঠে গেলে আর ফেরার সুযোগ নেই। সেখানে অনেকটা বন্দিদশায় থাকেন সবাই। গাদাগাদি করে রাখা হয়। খাবার দেওয়া হয় সামান্য ভাত ও মরিচ। পানিও অপর্যাপ্ত। কেউ অসুস্থ হলে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। সংখলার ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা আরাকানের জাফর আহমদ বললেন, তাঁদের নৌকা থেকে অসুস্থ দুজনকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
নৌকায় পাহারায় থাকে সশস্ত্র পাহারাদার। সংখ্যায় পাঁচ-ছয়জন। কারও কারও হাতে অস্ত্রও থাকে। কেউ কোনো বিষয়ে বাগ্বিতণ্ডা করলে প্রহরীরা মেরে সাগরে ফেলে দেয়।
এ ধরনের চক্রের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেছেন এবং এখন সংখলার পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন—এমন একজন রোহিঙ্গা এই প্রতিবেদককে বলেন, চার-পাঁচজন লোক দিয়ে চার-পাঁচ শ লোককে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। এ জন্য প্রত্যেক নৌকায় শুরুতেই এক-দুজনকে হত্যা করে সবার মধ্যে আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়া হয়।
একেকটি নৌকায় বিভিন্ন চক্রের পাঠানো মানুষ থাকে। নৌকায় সংশ্লিষ্ট চক্রের একজন করে প্রতিনিধি থাকে। তারা নৌকায় তুলেই এক দফা নির্যাতন করে এসব মানুষকে দিয়ে দেশে স্বজনদের ফোন করায় এবং টাকা দাবি করে।
তৃতীয় ধাপ: নৌকা পূর্ণ হওয়ার পর সেটি যাত্রা শুরু করে। টানা সাত দিন, সাত রাত চলার পর থাইল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছায়। সেখানে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামে। এরপর ছোট নৌকায় করে স্থলভূমিতে তোলা হয়।
থাই উপকূলে বড় জাহাজ থেকে এসব মানুষকে বিক্রি করা হয় এখানকার চক্রের কাছে। পাচারকারীদের ভাষায় ‘এজেন্টের’ কাছে। এজেন্টরা জনপ্রতি ১৫ হাজার বাথ পরিশোধ করে বড় নৌকাকে।
এই এজেন্টদের ব্যবস্থাপনায় সবাইকে স্থলভাগে তোলা হয়। বেশির ভাগ সময় দক্ষিণ থাইল্যান্ডের সংখলার রাত্তফুম, সতুন, রেনং ও ফুকেটের পাঙ্না উপকূলের পাহাড় বা জঙ্গল এলাকা দিয়ে পাচার করা মানুষদের তোলা হয়। এর বাইরে রেইয়ং উপকূলও পাচারকারী চক্র রুট হিসেবে ব্যবহার করেছে, তবে সেটা অনেক কম।
এর মধ্যে ছোট নৌকায় যদি সতুন উপকূলে তোলা হয়, তারপর দুই ঘণ্টা হেঁটে রাস্তা পাওয়া যায়। সেখানে পিকআপ ভ্যান থাকে। তাতে করে মানুষগুলোকে নেওয়া হয় কোয়ানডন নামক সংখলা প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায়। এটা দুই ঘণ্টার যাত্রা। এরপর এক দিন এক রাত হাঁটিয়ে নেওয়া হয় মালয়েশিয়ার সীমান্তের খুব কাছে বাদাম বেসার জঙ্গলে পাচারকারীদের ক্যাম্পে।
রাত্তাফুম দিয়ে তুললে গাড়িতে প্রায় চার ঘণ্টার যাত্রায় পৌঁছানো হয় কোয়ানডন জঙ্গলে। এরপর এক দিন এক রাত হাঁটা পথ।
রেনং উপকূলে উঠলে দুই থেকে চার ঘণ্টা হাঁটতে হয়। তারপর রাস্তা মেলে। সেখানে আগে থেকে গাড়ি থাকে। ওই সব গাড়িতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা চলার পর বাদাম বেসার পৌঁছায়। সড়কপথে পুরো পথ এসব লোককে পিকআপ ভ্যানের পেছনে শুইয়ে রাখা হয়। আর পাঙ্না নামলে প্রথমে সাগর তীর থেকে দুই থেকে চার ঘণ্টা হাঁটতে হয়। তারপর গাড়িতে আট ঘণ্টা চড়ে বাদাম বেসার।
চতুর্থ ধাপ: এজেন্টরা বড় নৌকা থেকে এসব মানুষকে এনে বাদাম বেসার জঙ্গল ক্যাম্পে জনপ্রতি ২৩ হাজার বাথ (এক বাথ বাংলাদেশি প্রায় আড়াই টাকা) বিক্রি করে। এখানে যারা ক্রেতা, এরাই মূল চক্র। পাচারকারীদের ভাষায় ‘মাফিয়া’। মাফিয়ার সংখ্যা বেশি নয়। এরা বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের। এই মাফিয়ারাই মিলেমিশে বড় নৌকা ভাড়া করে পাঠায়। তাদের অধীন মাঝারি, ছোট ও মাঠপর্যায়ের দালালেরা চারটি পর্যায়ে কাজ করে।
জঙ্গলে স্থাপন করা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা আলাদা। ক্যাম্পে রাখার জন্য দিতে হয় জনপ্রতি ১০ হাজার বাথ। এ টাকায় থাকা, পাহারা, খাবার দেওয়া ও মালয়েশিয়া সীমান্ত পার করে ক্যাম্প পরিচালনাকারীরা। একজন ব্যক্তি এক দিন থাকুক আর এক বছর থাকুক ভাড়া ১০ হাজার বাথ।
একেকটি ক্যাম্পে কয়েকজন মাফিয়ার কেনা মানুষ থাকে। সঙ্গে প্রত্যেক মাফিয়ার একজন বা দুজন প্রতিনিধি থাকে। এদের কাজ হলো নির্যাতন করে ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা।
এর মধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ন্যূনতম ৬০ হাজার বাথ সমপরিমাণ আর বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে। এ ক্ষেত্রে মাফিয়াদের প্রতিনিধিরা কেনা মানুষদের মারধর করে। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই।
কেউ মরলেও দালালের লোকসান নেই: পুলিশের সোর্স ও বাদাম বেসারের বাসিন্দা পাচারকারী চক্রের সাবেক ওই সদস্য বললেন, ক্যাম্প থেকে কেউ পালালে বা পুলিশের হাতে আটক হলে লোকসান হয়। কিন্তু মারা গেলে লোকসান নেই। কারণ, কেউ মারা গেলে ওই ব্যক্তি বাবদ ক্যাম্পের ভাড়া দিতে হবে না।
এ কারণে আমৃত্যু জঙ্গল ক্যাম্পে রাখা হয়। তবে জঙ্গল ক্যাম্প সব সময় এক জায়গায় থাকে না। মাঝে মাঝে সরানো হয়। অনেকটা ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলো মূলত মোটা পলিথিনের চাল আর খুঁটি দিয়ে চারপাশে কাঠ বা বাঁশ দিয়ে খুপরির মতো তৈরি। কোনো কোনো ক্যাম্পে শুধু পলিথিনের চাল দেওয়া। ক্যাম্পে একই ব্যক্তিদের সব সময় একসঙ্গে রাখা হয় না। বিভিন্ন ক্যাম্পে অদলবদল করা হয়। নারীদের রাখা হয় পৃথক ক্যাম্পে।
এসব ক্যাম্পে নির্যাতনে কিংবা অনাহার-অর্ধাহারে অনেকে মারা যান। অনেকে হাঁটতে পারেন না। তাঁদের এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে লুঙ্গিতে বসিয়ে চার কোনায় চারজন ধরে বহন করা হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ব্যাংকক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এমন অনেককে পেয়েছেন, যাঁরা হাঁটতে পারেন না। এরা মূলত ভিটামিন বি-এর অভাবে বেরি বেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে এ দশা হয়েছে। অনেকে মারা গেছেন জ্বরে।
কথা হয় সংখলার বন্দিশালায় থাকা কিশোরগঞ্জের সবুজ নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ক্যাম্পে খাবার বলতে দুই বেলা পলিথিনে দুই মুঠো সাদা ভাত ও শসা। সঙ্গে বড়জোর মরিচ। সারা দিনে দুই বেলা এক গ্লাস পরিমাণে পানি দেওয়া হয়। হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া, কুলি করার সুযোগ নেই। শৌচকর্মের জন্য জঙ্গলে এক জায়গায় গর্ত করে প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা দেওয়া। মাটির ঢিলা হচ্ছে পরিষ্কার হওয়ার সম্বল। আর মারধর তো আছেই। রাত হলে মেয়েদের ক্যাম্প থেকে চিৎকার শোনা যেত।
সবুজ বলেন, ‘মুখে বলে বোঝাতে পারব নারে ভাই, এটা একটা দোজখ, দুনিয়ার দোজখখানা।’
চার ধাপেই পৃথক ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দালালের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ থেকে শুরু করে চার ধাপে মানুষ কেনাবেচা, জলে-স্থলে পরিবহন, মালয়েশিয়ায় পাঠানো—সবই পৃথক ব্যবস্থাপনায় হলেও সব পর্যায়ে মাফিয়াদের অংশীদারি আছে। সব পর্যায়ের লাভের টাকার ভাগ তাদের কাছে আসে। যেমন জঙ্গল ক্যাম্প পরিচালনা করে থাই মাফিয়ারা, তাদের সঙ্গে ক্যাম্পে অংশীদারি আছে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের মাফিয়াদের। আবার বড় নৌকা ভাড়া করা, থাইল্যান্ডের উপকূলে এনে ছোট নৌকায় বিক্রি—সব ক্ষেত্রেই সবার অংশীদারি আছে। উদ্ধার হওয়া আরাকানের লোকদের ত্রাণ সাহায্যে নিয়োজিত রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন থাইল্যান্ডের সভাপতি মো. আনোয়ারের মতে, অনেকটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের মতো চলছে এ নেটওয়ার্ক।
ভুক্তভোগীরা জানান, শেষ ধাপ হলো সবচেয়ে জঘন্য ও কষ্টের। মুক্তিপণ দিতে না পারলে এখানেই জীবনের শেষ।
‘জঙ্গল ক্যাম্প’ নামে পরিচিতি পাওয়া শেষ ধাপ থেকে বিভিন্ন সময়ে মুক্তি পাওয়া ও উদ্ধার হওয়া অনেক বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা এখন থাইল্যান্ডের বন্দিশালায় আছেন। এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী এবং পাচারকারী চক্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সংখলা প্রদেশের স্থানীয় বাসিন্দা এবং ধরা পড়া দালালদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে দোভাষীর কাজ করা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে পাচারের রুট, ঘাটে ঘাটে হাতবদল ও মানুষ বেচাকেনার চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রথম ঘাট: বাংলাদেশিদের পাচারের ক্ষেত্রে প্রথম ঘাট হলো কক্সবাজারের টেকনাফ। বিভিন্ন এলাকা থেকে মাঠপর্যায়ের দালালেরা লোকজন এনে টেকনাফের ছোট ইঞ্জিন নৌকায় তুলে দেন। জনপ্রতি দালালেরা পান ১০ হাজার টাকা। টেকনাফ উপকূল থেকে ছোট নৌকায় এসব লোকেক নেওয়া হয় সমুদ্রে থাকা বড় ইঞ্জিন নৌকায়। মাছ ধরা ট্রলার বা ট্রলারের আদলে কাঠের তৈরি এসব বড় নৌকাকে পাচারকারীরা বলে ‘শিপ’ বা জাহাজ।
এসব জাহাজ বা বড় নৌকা যদি বাংলাদেশ জলসীমার কাছাকাছি থাকে, তাহলে টেকনাফের ছোট নৌকাগুলো ৪–৬ ঘণ্টা চলার পর সেখানে পৌঁছায়। আর যদি বাংলাদেশের জলসীমার বাইরে থাকে, তাহলে এক দিন এক রাত চলতে হয়। একেকটি ছোট নৌকায় ১০–১৫ জন করে নেওয়া হয়। এ সময় মানুষগুলোকে নৌকায় শুইয়ে রেখে গায়ের ওপর মাছ ধরার জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: বড় নৌকায় তুলে দিলে ছোট নৌকার মালিকেরা জনপ্রতি পান ১০ হাজার থাই বাথের সমান ২৫ হাজার টাকা। একইভাবে মিয়ানমারের দালালেরা আরাকান উপকূল থেকে ছোট নৌকায় রোহিঙ্গাদের এনে বড় নৌকায় বিক্রি করে মিয়ানমারের মুদ্রায় দুই লাখ কিয়াত (বাংলাদেশি ১৪ হাজার টাকার সমান)।
বড় নৌকায় ৩০০ থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত লোক নেওয়া হয়। ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত বড় নৌকা ছাড়ে না। এ জন্য এক থেকে দুই মাসও অপেক্ষা করা হয়।
পাচারকারীদের-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই দীর্ঘ সময় বড় নৌকাগুলো থাকে মিয়ানমারের জলসীমায় সে দেশের নৌবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করে। এ জন্য নৌকাপ্রতি মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে দিতে হয় ওই দেশি মুদ্রায় তিন লাখ কিয়াত (বাংলাদেশি ২১ হাজার টাকার সমান)। ১৫ দিন রাখার জন্য এ টাকা দেওয়া হলেও নৌকাগুলো সাধারণত দুই মাস পর্যন্ত রাখে।
একবার বড় নৌকায় উঠে গেলে আর ফেরার সুযোগ নেই। সেখানে অনেকটা বন্দিদশায় থাকেন সবাই। গাদাগাদি করে রাখা হয়। খাবার দেওয়া হয় সামান্য ভাত ও মরিচ। পানিও অপর্যাপ্ত। কেউ অসুস্থ হলে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। সংখলার ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা আরাকানের জাফর আহমদ বললেন, তাঁদের নৌকা থেকে অসুস্থ দুজনকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
নৌকায় পাহারায় থাকে সশস্ত্র পাহারাদার। সংখ্যায় পাঁচ-ছয়জন। কারও কারও হাতে অস্ত্রও থাকে। কেউ কোনো বিষয়ে বাগ্বিতণ্ডা করলে প্রহরীরা মেরে সাগরে ফেলে দেয়।
এ ধরনের চক্রের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেছেন এবং এখন সংখলার পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন—এমন একজন রোহিঙ্গা এই প্রতিবেদককে বলেন, চার-পাঁচজন লোক দিয়ে চার-পাঁচ শ লোককে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। এ জন্য প্রত্যেক নৌকায় শুরুতেই এক-দুজনকে হত্যা করে সবার মধ্যে আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়া হয়।
একেকটি নৌকায় বিভিন্ন চক্রের পাঠানো মানুষ থাকে। নৌকায় সংশ্লিষ্ট চক্রের একজন করে প্রতিনিধি থাকে। তারা নৌকায় তুলেই এক দফা নির্যাতন করে এসব মানুষকে দিয়ে দেশে স্বজনদের ফোন করায় এবং টাকা দাবি করে।
তৃতীয় ধাপ: নৌকা পূর্ণ হওয়ার পর সেটি যাত্রা শুরু করে। টানা সাত দিন, সাত রাত চলার পর থাইল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছায়। সেখানে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামে। এরপর ছোট নৌকায় করে স্থলভূমিতে তোলা হয়।
থাই উপকূলে বড় জাহাজ থেকে এসব মানুষকে বিক্রি করা হয় এখানকার চক্রের কাছে। পাচারকারীদের ভাষায় ‘এজেন্টের’ কাছে। এজেন্টরা জনপ্রতি ১৫ হাজার বাথ পরিশোধ করে বড় নৌকাকে।
এই এজেন্টদের ব্যবস্থাপনায় সবাইকে স্থলভাগে তোলা হয়। বেশির ভাগ সময় দক্ষিণ থাইল্যান্ডের সংখলার রাত্তফুম, সতুন, রেনং ও ফুকেটের পাঙ্না উপকূলের পাহাড় বা জঙ্গল এলাকা দিয়ে পাচার করা মানুষদের তোলা হয়। এর বাইরে রেইয়ং উপকূলও পাচারকারী চক্র রুট হিসেবে ব্যবহার করেছে, তবে সেটা অনেক কম।
এর মধ্যে ছোট নৌকায় যদি সতুন উপকূলে তোলা হয়, তারপর দুই ঘণ্টা হেঁটে রাস্তা পাওয়া যায়। সেখানে পিকআপ ভ্যান থাকে। তাতে করে মানুষগুলোকে নেওয়া হয় কোয়ানডন নামক সংখলা প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায়। এটা দুই ঘণ্টার যাত্রা। এরপর এক দিন এক রাত হাঁটিয়ে নেওয়া হয় মালয়েশিয়ার সীমান্তের খুব কাছে বাদাম বেসার জঙ্গলে পাচারকারীদের ক্যাম্পে।
রাত্তাফুম দিয়ে তুললে গাড়িতে প্রায় চার ঘণ্টার যাত্রায় পৌঁছানো হয় কোয়ানডন জঙ্গলে। এরপর এক দিন এক রাত হাঁটা পথ।
রেনং উপকূলে উঠলে দুই থেকে চার ঘণ্টা হাঁটতে হয়। তারপর রাস্তা মেলে। সেখানে আগে থেকে গাড়ি থাকে। ওই সব গাড়িতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা চলার পর বাদাম বেসার পৌঁছায়। সড়কপথে পুরো পথ এসব লোককে পিকআপ ভ্যানের পেছনে শুইয়ে রাখা হয়। আর পাঙ্না নামলে প্রথমে সাগর তীর থেকে দুই থেকে চার ঘণ্টা হাঁটতে হয়। তারপর গাড়িতে আট ঘণ্টা চড়ে বাদাম বেসার।
চতুর্থ ধাপ: এজেন্টরা বড় নৌকা থেকে এসব মানুষকে এনে বাদাম বেসার জঙ্গল ক্যাম্পে জনপ্রতি ২৩ হাজার বাথ (এক বাথ বাংলাদেশি প্রায় আড়াই টাকা) বিক্রি করে। এখানে যারা ক্রেতা, এরাই মূল চক্র। পাচারকারীদের ভাষায় ‘মাফিয়া’। মাফিয়ার সংখ্যা বেশি নয়। এরা বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের। এই মাফিয়ারাই মিলেমিশে বড় নৌকা ভাড়া করে পাঠায়। তাদের অধীন মাঝারি, ছোট ও মাঠপর্যায়ের দালালেরা চারটি পর্যায়ে কাজ করে।
জঙ্গলে স্থাপন করা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা আলাদা। ক্যাম্পে রাখার জন্য দিতে হয় জনপ্রতি ১০ হাজার বাথ। এ টাকায় থাকা, পাহারা, খাবার দেওয়া ও মালয়েশিয়া সীমান্ত পার করে ক্যাম্প পরিচালনাকারীরা। একজন ব্যক্তি এক দিন থাকুক আর এক বছর থাকুক ভাড়া ১০ হাজার বাথ।
একেকটি ক্যাম্পে কয়েকজন মাফিয়ার কেনা মানুষ থাকে। সঙ্গে প্রত্যেক মাফিয়ার একজন বা দুজন প্রতিনিধি থাকে। এদের কাজ হলো নির্যাতন করে ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা।
এর মধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ন্যূনতম ৬০ হাজার বাথ সমপরিমাণ আর বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে। এ ক্ষেত্রে মাফিয়াদের প্রতিনিধিরা কেনা মানুষদের মারধর করে। টাকা না দেওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই।
কেউ মরলেও দালালের লোকসান নেই: পুলিশের সোর্স ও বাদাম বেসারের বাসিন্দা পাচারকারী চক্রের সাবেক ওই সদস্য বললেন, ক্যাম্প থেকে কেউ পালালে বা পুলিশের হাতে আটক হলে লোকসান হয়। কিন্তু মারা গেলে লোকসান নেই। কারণ, কেউ মারা গেলে ওই ব্যক্তি বাবদ ক্যাম্পের ভাড়া দিতে হবে না।
এ কারণে আমৃত্যু জঙ্গল ক্যাম্পে রাখা হয়। তবে জঙ্গল ক্যাম্প সব সময় এক জায়গায় থাকে না। মাঝে মাঝে সরানো হয়। অনেকটা ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলো মূলত মোটা পলিথিনের চাল আর খুঁটি দিয়ে চারপাশে কাঠ বা বাঁশ দিয়ে খুপরির মতো তৈরি। কোনো কোনো ক্যাম্পে শুধু পলিথিনের চাল দেওয়া। ক্যাম্পে একই ব্যক্তিদের সব সময় একসঙ্গে রাখা হয় না। বিভিন্ন ক্যাম্পে অদলবদল করা হয়। নারীদের রাখা হয় পৃথক ক্যাম্পে।
এসব ক্যাম্পে নির্যাতনে কিংবা অনাহার-অর্ধাহারে অনেকে মারা যান। অনেকে হাঁটতে পারেন না। তাঁদের এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে লুঙ্গিতে বসিয়ে চার কোনায় চারজন ধরে বহন করা হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ব্যাংকক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এমন অনেককে পেয়েছেন, যাঁরা হাঁটতে পারেন না। এরা মূলত ভিটামিন বি-এর অভাবে বেরি বেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে এ দশা হয়েছে। অনেকে মারা গেছেন জ্বরে।
কথা হয় সংখলার বন্দিশালায় থাকা কিশোরগঞ্জের সবুজ নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ক্যাম্পে খাবার বলতে দুই বেলা পলিথিনে দুই মুঠো সাদা ভাত ও শসা। সঙ্গে বড়জোর মরিচ। সারা দিনে দুই বেলা এক গ্লাস পরিমাণে পানি দেওয়া হয়। হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া, কুলি করার সুযোগ নেই। শৌচকর্মের জন্য জঙ্গলে এক জায়গায় গর্ত করে প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা দেওয়া। মাটির ঢিলা হচ্ছে পরিষ্কার হওয়ার সম্বল। আর মারধর তো আছেই। রাত হলে মেয়েদের ক্যাম্প থেকে চিৎকার শোনা যেত।
সবুজ বলেন, ‘মুখে বলে বোঝাতে পারব নারে ভাই, এটা একটা দোজখ, দুনিয়ার দোজখখানা।’
চার ধাপেই পৃথক ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দালালের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ থেকে শুরু করে চার ধাপে মানুষ কেনাবেচা, জলে-স্থলে পরিবহন, মালয়েশিয়ায় পাঠানো—সবই পৃথক ব্যবস্থাপনায় হলেও সব পর্যায়ে মাফিয়াদের অংশীদারি আছে। সব পর্যায়ের লাভের টাকার ভাগ তাদের কাছে আসে। যেমন জঙ্গল ক্যাম্প পরিচালনা করে থাই মাফিয়ারা, তাদের সঙ্গে ক্যাম্পে অংশীদারি আছে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের মাফিয়াদের। আবার বড় নৌকা ভাড়া করা, থাইল্যান্ডের উপকূলে এনে ছোট নৌকায় বিক্রি—সব ক্ষেত্রেই সবার অংশীদারি আছে। উদ্ধার হওয়া আরাকানের লোকদের ত্রাণ সাহায্যে নিয়োজিত রোহিঙ্গা সোসাইটি ইন থাইল্যান্ডের সভাপতি মো. আনোয়ারের মতে, অনেকটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের মতো চলছে এ নেটওয়ার্ক।
No comments