পেশাজীবী সংগঠনে নির্বাচন জটিলতা by আলী রীয়াজ
দুটি
ভিন্ন পেশা-সংশ্লিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি
হয়েছে। এর একটি জাতীয় প্রেসক্লাব এবং অন্যটি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল।
প্রথমটি সংশ্লিষ্ট পেশার মানুষের স্বতঃপ্রণোদিত তৈরি একটি কাঠামো,
দ্বিতীয়টি একটি স্বশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যার চেয়ারম্যান পদাধিকার
বলে অ্যাটর্নি জেনারেল।
সংশ্লিষ্ট পেশার বাইরের সাধারণ লোকজন যে এই দুই নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী, এমন মনে করার কারণ নেই। যেসব নির্বাচন নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের উৎসাহ থাকে এবং যাতে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকার কথা, গত কয়েক বছরে সেগুলোর যে বেহাল দশা দাঁড়িয়েছে, তাতে করে যেকোনো নির্বাচন নিয়েই উৎসাহে ঘাটতি পড়ার কথা। এ ধরনের পেশাদারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ, উৎসাহ আগেও ছিল না, এখনো থাকার কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দুই নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা আলোচনার দাবি করে এই কারণে যে এসব ঘটনার মধ্যে কিছু প্রবণতা দৃশ্যমান এবং সেগুলো খুব ইতিবাচক মনে হয় না।
জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ডিসেম্বরে। কিন্তু কয়েক দফা পেছানোর পর ২৯ মে যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল এখন তাও বাতিল হয়ে গেছে। এপ্রিল মাস থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছিল যে রাজনৈতিক দলের অনুসারী হিসেবে বিভক্ত সাংবাদিকেরা নিজেদের মধ্যে ‘সমঝোতা’ করে একটি প্যানেল তৈরি করবেন।
সহজ ভাষায়, আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত সাংবাদিকেরা জাতীয় রাজনীতিতে তাঁদের প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি করবেন। রাজনীতিতে আপস-সমঝোতা না হলেও প্রেসক্লাবের কমিটি নির্বাচনে আলাপ-আলোচনা এবং তাঁর ইতিবাচক ফলাফলকে বাইরে থেকে দেখে ইতিবাচক বলেই মনে করা যায়। বিশেষ করে যখন বাস্তবতা এই যে দেশের সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত, সেখানে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানটিতে সাংবাদিকেরা অন্তত দেখা-সাক্ষাৎ করতে, একত্র হতে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটাকে আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক বলেই গণ্য করা উচিত। মন্দের ভালো বলেই একে বিবেচনা করতে হবে; কেননা একজন সাংবাদিক কী করে দলীয় পরিচয়ে পরিচিত হন এবং তা প্রচারে উৎসাহী হন, সেটা আমার বোধগম্যের বাইরে।
তবে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের আলাদা করে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়; যে সমাজে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের পরিচয় দলের ভিত্তিতে, সেখানে সাংবাদিকেরা বাদ থাকবেন এমন ভাবাটা নির্বুদ্ধিতা মাত্র। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ব্যক্তিরা হয়তো দলীয় আনুগত্যের কারণ দেখানোর চেষ্টা করতে পারবেন, কিন্তু ‘এক শ’ বা ‘হাজার’ ‘বুদ্ধিজীবীর’ সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরা কোনো ‘যুক্তি’ দিতে পারবেন কি না, সেটা ভাবার বিষয়। কিন্তু প্রেসক্লাবের নির্বাচনে জটিলতা এই দলীয় পরিচয়ের কারণে সৃষ্টি হয়নি। জটিলতা দেখা দিয়েছে যখন নির্বাচনে এই ‘সমঝোতার’ বাইরে কেউ কেউ প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে যে সমঝোতার মাধ্যমে প্যানেল তৈরি হলে নির্বাচনের দরকার হবে না; জনশ্রুতি এই রকম যে নির্বাচন পরিচালনা পরিষদকে এই প্যানেলকে বিজয়ী ঘোষণার চাপও এসেছিল বলে তাঁরা পদত্যাগ করেছেন। এসবের সত্যাসত্য যাচাই করার বিষয়টি আপাতত বাইরে থাকুক; কিন্তু একটি বিষয় তো স্পষ্ট যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও সাংবাদিকেরা চাইলে ‘সমঝোতা’ করতে পারেন।
আগেও বলেছি, সমঝোতা দোষের বিষয় নয়। অনেকে এই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, আদর্শিকভাবে বিপরীত মেরুর পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় কোনো কোনো পক্ষের আদর্শিক সততা, বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শুধু তা-ই নয়, অনেকে সরকার–সমর্থকদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের ‘সমঝোতা’কে ভবিষ্যৎ রাজনীতির ইঙ্গিত বলে বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা বা আশঙ্কার বিষয়; এ ধরনের জল্পনার বিষয়কে আমি আপাতত বিবেচনার বাইরেই রাখতে চাই।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন, দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার অর্থ কেন এমন দাঁড়াবে যে এর বাইরে আর কারও কিছু বলার থাকবে না? তার চেয়েও বড় বিষয় হলো যে সমঝোতা কার্যকর করতে না পারলেই নির্বাচন বাদ দিয়ে দিতে হবে কেন? নির্বাচনপ্রক্রিয়া, যাতে একজন ভোটারের পছন্দের সুযোগ তৈরি হয়, তা বাদ দেওয়ার অর্থ কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অনাস্থা। যে সাংবাদিকেরা প্রতিদিন দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান বিষয়ে কথা বলেন, তাঁরা নিজেরাই যদি নিজেদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ বা অনুৎসাহী হন, তবে তাঁরা কী করে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের জন্য, দেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য বা দেশে গণতন্ত্রের জন্য দাবি তোলেন?
ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত নির্বাচন করতে না পারার বিষয়টি নিঃসন্দেহে তাঁদের নিজস্ব পেশার বিষয়, তাতে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে না, কিন্তু সমাজে নির্বাচনকে একটি প্রভাবমুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সমস্যা কত গভীর, সেটা বোঝা যায় এই পরিস্থিতিকে ভালো করে লক্ষ করলেই।
এই একই বিবেচনাতেই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। সেখানে এই রকম ‘সমঝোতা’র কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু জটিলতা দেখা দিয়েছে ভোটার তালিকা নিয়ে। তালিকায় বিভিন্ন জটিলতার কারণে নির্বাচন ইতিমধ্যেই ২০ মে থেকে ২৭ মে পেছানো হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে ভোটার তালিকায় হাজার খানেক সদস্য একাধিকবার ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। ভোটার তালিকার ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীদের কয়েকজন। সেগুলো যে একেবারে অগ্রহণযোগ্য নয়, সেটা বোঝা যায় নির্বাচন পেছানোয়। এর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে নির্বাচন স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে করা রিট; যার সঙ্গে ভোটার তালিকার বিষয় যুক্ত নয়। আজ এই বিষয়ে আদেশ দেওয়ার কথা।
নির্বাচনে নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকার বিষয়ে আইনজীবীদের বোঝানোর ধৃষ্টতা দেখানোর ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু যে বিষয়ে তাঁদের এবং অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই তা হলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন, প্রক্রিয়া হিসেবে তার বিভিন্ন দিককে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার বিষয়ে আইনজীবীরা দেশের সাধারণ নাগরিক এবং নির্বাচন কমিশনের জন্য খুব বেশি আশার আলো দেখাতে পারলেন কি না, সেটা ভেবে দেখুন।
আইনজীবী ও সাংবাদিকদের নির্বাচন নিয়ে এসব কথা বলার পাশাপাশি এটা স্মরণ করা ছাড়া উপায় নেই যে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিষয়টি এখন ইতিহাসের বিষয়। ১৯৯১ সালে দেশে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ পেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই থেকে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চার একটি অন্যতম উপায় ‘নির্বাচন তিরোহিত’ হয়েছে। তার কারণ যা-ই থাকুক, পরিণতি ভালো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা (গত আড়াই দশকে যাঁরাই ক্ষমতায় থেকেছেন) যে বার্তা পাঠিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের একাংশ যে তা বুঝতে পেরেছে, সেটা তাঁদের আচরণেই স্পষ্ট।
যে সমাজের অগ্রসর, অন্ততপক্ষে সবচেয়ে সরব অংশের সদস্যদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনকে গড়ে তোলার ব্যাপারে তাগিদ অনুপস্থিত, যেখানে সমঝোতার অর্থ ভাগাভাগি এবং অন্যদের কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে কর্ণপাত না করা, সেখানে জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। জাতীয় নির্বাচনের বিবেচনায় এসব ‘ছোটখাটো’ নির্বাচনের জটিলতার মধ্যে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
সংশ্লিষ্ট পেশার বাইরের সাধারণ লোকজন যে এই দুই নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী, এমন মনে করার কারণ নেই। যেসব নির্বাচন নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের উৎসাহ থাকে এবং যাতে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকার কথা, গত কয়েক বছরে সেগুলোর যে বেহাল দশা দাঁড়িয়েছে, তাতে করে যেকোনো নির্বাচন নিয়েই উৎসাহে ঘাটতি পড়ার কথা। এ ধরনের পেশাদারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ, উৎসাহ আগেও ছিল না, এখনো থাকার কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দুই নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা আলোচনার দাবি করে এই কারণে যে এসব ঘটনার মধ্যে কিছু প্রবণতা দৃশ্যমান এবং সেগুলো খুব ইতিবাচক মনে হয় না।
জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ডিসেম্বরে। কিন্তু কয়েক দফা পেছানোর পর ২৯ মে যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল এখন তাও বাতিল হয়ে গেছে। এপ্রিল মাস থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছিল যে রাজনৈতিক দলের অনুসারী হিসেবে বিভক্ত সাংবাদিকেরা নিজেদের মধ্যে ‘সমঝোতা’ করে একটি প্যানেল তৈরি করবেন।
সহজ ভাষায়, আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত সাংবাদিকেরা জাতীয় রাজনীতিতে তাঁদের প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি করবেন। রাজনীতিতে আপস-সমঝোতা না হলেও প্রেসক্লাবের কমিটি নির্বাচনে আলাপ-আলোচনা এবং তাঁর ইতিবাচক ফলাফলকে বাইরে থেকে দেখে ইতিবাচক বলেই মনে করা যায়। বিশেষ করে যখন বাস্তবতা এই যে দেশের সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত, সেখানে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানটিতে সাংবাদিকেরা অন্তত দেখা-সাক্ষাৎ করতে, একত্র হতে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটাকে আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক বলেই গণ্য করা উচিত। মন্দের ভালো বলেই একে বিবেচনা করতে হবে; কেননা একজন সাংবাদিক কী করে দলীয় পরিচয়ে পরিচিত হন এবং তা প্রচারে উৎসাহী হন, সেটা আমার বোধগম্যের বাইরে।
তবে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের আলাদা করে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়; যে সমাজে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের পরিচয় দলের ভিত্তিতে, সেখানে সাংবাদিকেরা বাদ থাকবেন এমন ভাবাটা নির্বুদ্ধিতা মাত্র। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ব্যক্তিরা হয়তো দলীয় আনুগত্যের কারণ দেখানোর চেষ্টা করতে পারবেন, কিন্তু ‘এক শ’ বা ‘হাজার’ ‘বুদ্ধিজীবীর’ সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরা কোনো ‘যুক্তি’ দিতে পারবেন কি না, সেটা ভাবার বিষয়। কিন্তু প্রেসক্লাবের নির্বাচনে জটিলতা এই দলীয় পরিচয়ের কারণে সৃষ্টি হয়নি। জটিলতা দেখা দিয়েছে যখন নির্বাচনে এই ‘সমঝোতার’ বাইরে কেউ কেউ প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে যে সমঝোতার মাধ্যমে প্যানেল তৈরি হলে নির্বাচনের দরকার হবে না; জনশ্রুতি এই রকম যে নির্বাচন পরিচালনা পরিষদকে এই প্যানেলকে বিজয়ী ঘোষণার চাপও এসেছিল বলে তাঁরা পদত্যাগ করেছেন। এসবের সত্যাসত্য যাচাই করার বিষয়টি আপাতত বাইরে থাকুক; কিন্তু একটি বিষয় তো স্পষ্ট যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও সাংবাদিকেরা চাইলে ‘সমঝোতা’ করতে পারেন।
আগেও বলেছি, সমঝোতা দোষের বিষয় নয়। অনেকে এই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, আদর্শিকভাবে বিপরীত মেরুর পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় কোনো কোনো পক্ষের আদর্শিক সততা, বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শুধু তা-ই নয়, অনেকে সরকার–সমর্থকদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের ‘সমঝোতা’কে ভবিষ্যৎ রাজনীতির ইঙ্গিত বলে বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা বা আশঙ্কার বিষয়; এ ধরনের জল্পনার বিষয়কে আমি আপাতত বিবেচনার বাইরেই রাখতে চাই।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন, দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার অর্থ কেন এমন দাঁড়াবে যে এর বাইরে আর কারও কিছু বলার থাকবে না? তার চেয়েও বড় বিষয় হলো যে সমঝোতা কার্যকর করতে না পারলেই নির্বাচন বাদ দিয়ে দিতে হবে কেন? নির্বাচনপ্রক্রিয়া, যাতে একজন ভোটারের পছন্দের সুযোগ তৈরি হয়, তা বাদ দেওয়ার অর্থ কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অনাস্থা। যে সাংবাদিকেরা প্রতিদিন দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান বিষয়ে কথা বলেন, তাঁরা নিজেরাই যদি নিজেদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ বা অনুৎসাহী হন, তবে তাঁরা কী করে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের জন্য, দেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য বা দেশে গণতন্ত্রের জন্য দাবি তোলেন?
ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত নির্বাচন করতে না পারার বিষয়টি নিঃসন্দেহে তাঁদের নিজস্ব পেশার বিষয়, তাতে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে না, কিন্তু সমাজে নির্বাচনকে একটি প্রভাবমুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সমস্যা কত গভীর, সেটা বোঝা যায় এই পরিস্থিতিকে ভালো করে লক্ষ করলেই।
এই একই বিবেচনাতেই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। সেখানে এই রকম ‘সমঝোতা’র কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু জটিলতা দেখা দিয়েছে ভোটার তালিকা নিয়ে। তালিকায় বিভিন্ন জটিলতার কারণে নির্বাচন ইতিমধ্যেই ২০ মে থেকে ২৭ মে পেছানো হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে ভোটার তালিকায় হাজার খানেক সদস্য একাধিকবার ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। ভোটার তালিকার ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীদের কয়েকজন। সেগুলো যে একেবারে অগ্রহণযোগ্য নয়, সেটা বোঝা যায় নির্বাচন পেছানোয়। এর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে নির্বাচন স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে করা রিট; যার সঙ্গে ভোটার তালিকার বিষয় যুক্ত নয়। আজ এই বিষয়ে আদেশ দেওয়ার কথা।
নির্বাচনে নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকার বিষয়ে আইনজীবীদের বোঝানোর ধৃষ্টতা দেখানোর ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু যে বিষয়ে তাঁদের এবং অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই তা হলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন, প্রক্রিয়া হিসেবে তার বিভিন্ন দিককে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার বিষয়ে আইনজীবীরা দেশের সাধারণ নাগরিক এবং নির্বাচন কমিশনের জন্য খুব বেশি আশার আলো দেখাতে পারলেন কি না, সেটা ভেবে দেখুন।
আইনজীবী ও সাংবাদিকদের নির্বাচন নিয়ে এসব কথা বলার পাশাপাশি এটা স্মরণ করা ছাড়া উপায় নেই যে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিষয়টি এখন ইতিহাসের বিষয়। ১৯৯১ সালে দেশে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ পেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই থেকে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চার একটি অন্যতম উপায় ‘নির্বাচন তিরোহিত’ হয়েছে। তার কারণ যা-ই থাকুক, পরিণতি ভালো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা (গত আড়াই দশকে যাঁরাই ক্ষমতায় থেকেছেন) যে বার্তা পাঠিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের একাংশ যে তা বুঝতে পেরেছে, সেটা তাঁদের আচরণেই স্পষ্ট।
যে সমাজের অগ্রসর, অন্ততপক্ষে সবচেয়ে সরব অংশের সদস্যদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনকে গড়ে তোলার ব্যাপারে তাগিদ অনুপস্থিত, যেখানে সমঝোতার অর্থ ভাগাভাগি এবং অন্যদের কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে কর্ণপাত না করা, সেখানে জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। জাতীয় নির্বাচনের বিবেচনায় এসব ‘ছোটখাটো’ নির্বাচনের জটিলতার মধ্যে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments