সংলাপের ভূমিকা পালন করছে সিটি নির্বাচন -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : এমাজউদ্দীন আহমদ by এ কে এম জাকারিয়া
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ নাগরিক সংগঠন শত
নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন
করছেন। ঢাকা সিটি নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচন পরিচালনার
জন্য সম্প্রতি গঠিত আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের আহ্বায়ক হিসেবেও তিনি এখন
দায়িত্ব পালন করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো : বিএনপির আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হলো। আপনি কি তা মনে করেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ব্যর্থ হলো কোথায়? এক ঢাকা ছাড়া তো দেশের কোথাও পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। সেখানে শাসন-প্রশাসন বলে কিছু কাজ করেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে চলতে হয়েছে। দেশজুড়ে সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছে। আন্দোলন কাজে না দিলে তো এসবের প্রয়োজন পড়ত না। আন্দোলন দমনে সরকারকে গুম, খুন ও দমন-নিপীড়নের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এই সরকারের ধরন ও আচরণ সবার সামনে স্পষ্ট হয়েছে।
প্রথম আলো : এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি কী অর্জন করল?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এখন যে তিনটি সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এটা গত তিন মাসের আন্দোলনের ফল। এই নির্বাচনকে যদি এখন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি পরিস্থিতি তৈরি হবে। ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতি দূষিত হয়ে পড়েছে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বাভাবিক কাজ করতে পারছে না। যে র্যাব জনগণের নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের কেউ কেউ আজ ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করছে। এ ধরনের একটি বিষাক্ত পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের পথ হচ্ছে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ। এই নির্বাচন সেই সংলাপের ভূমিকা পালন করছে
প্রথম আলো : তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে আপনি সংলাপ মনে করছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এই নির্বাচনগুলো একধরনের সংলাপের ভূমিকা পালন করছে। নির্বাচনের জন্য প্রার্থীরা ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। প্রার্থীদের মাধ্যমে যে যোগাযোগ হচ্ছে, সেটাও একধরনের সংলাপ। এই নির্বাচনের পরও এর প্রভাব থাকবে। ভোটার ও ভোটপ্রার্থীদের মধ্যে এই সংলাপ ও আদান-প্রদানকে আমি খুবই ইতিবাচক মনে করছি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এখন পরিচালিত হচ্ছে দুজন প্রশাসকের মাধ্যমে, সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আসবেন।
প্রথম আলো : এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : আমি মনে করি না যে পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। নির্বাচন কমিশন অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি উপেক্ষা করছে। তবে আমি আশাবাদী যে তারা দেখে শিখবে। ভারতের নির্বাচন কমিশন যেভাবে নির্বাচন করে, তারাও সে ধরনের কাজ করার চেষ্টা করবে। আমরা চাই ইউরোপের উন্নত গণতন্ত্রে নির্বাচন কমিশন যেভাবে কাজ করে, তা থেকে তারা শিখুক। নিরপেক্ষভাবে দেখার দৃষ্টিকোণ অর্জন করুক। এই নির্বাচন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো হবে বলে আমি মনে করি না। আর বিষয়টি শুধু নির্বাচন কমিশনেরও নয়, জনগণের দায়িত্ব রয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে। নির্বাচন কমিশন ঠিক-বেঠিক যা-ই করুক না কেন, জনগণ কিন্তু সবই দেখবে ও বিবেচনায় নেবে। বলা যায় জনগণের পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকবে নির্বাচন কমিশন।
প্রথম আলো : আপনি এই তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলেন, কী ধারণা হলো?
এমাজউদ্দীন আহমদ : নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, ভোটার যেন তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। আর ভোটপ্রার্থীও যেন ভোট চাওয়ার জন্য ভোটারদের কাছে যেতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে একজন প্রার্থীর পক্ষে যেহেতু সব ভোটারের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই প্রয়োজন সভা-সমাবেশ ও মিছিলের। সব প্রার্থীর জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরি করা হলো নির্বাচন কমিশনের কাজ। আমরা এসবই বলে এসেছি। তারা সচেতনভাবে তা চাইলে করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন যদি প্রজ্ঞা ও নিরপেক্ষতার মনোভাব নিয়ে কাজ করে, তবে তাদের ভুল হওয়ার সুযোগ কম।
প্রথম আলো : এই নির্বাচনের প্রভাব কি জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এই নির্বাচন জাতীয় পর্যায়ে একধরনের মর্যাদাবোধ ও চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটাবে বলে আমি মনে করি। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যখন এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জনগণের ভোট পেয়ে যখন কেউ নির্বাচিত হবেন, তখন তাঁর মধ্যে একটি মর্যাদাবোধের পরিস্থিতি তৈরি হবে। যাঁরা একটি ভোট না পেয়েও সংসদে গেলেন, তাঁরা এটা বুঝতে পারবেন যে আইনগতভাবে সিদ্ধ হলেও এ ধরনের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সম্মানজনক নয়। এই নির্বাচন তাই আমাদের পরবর্তী রাজনীতির রূপরেখার মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে, বর্তমান চিন্তাভাবনাকে পাল্টে দিতে পারে।
প্রথম আলো : এটা আশার কথা, কিন্তু বর্তমান রাজনীতির যে ধারা, তাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সমস্যা হচ্ছে যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে করে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ধ্বংস বা নিঃশেষ করতে চায়। এটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা থাকতে হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এটা মানতে হবে যে দুই পক্ষের কোনো পক্ষই অপর পক্ষকে ধ্বংস করতে পারবে না। সংসদীয় রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে, দুই পক্ষকেই একসঙ্গে থাকতে হবে। পাশের দেশ ভারতের কথাই বলি, সেখানে প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ করেন, বিষয়টি অবহিত করেন। এসব থেকে আমরা অনেক দূরে আছি। এসব সমস্যা দূর হতে আরও সময় লাগবে।
প্রথম আলো : বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছে, এর এক বছরের মাথায় নতুন নির্বাচনের জন্য বিএনপি এক নজিরবিহীন আন্দোলন করল। আগাম বা নির্ধারিত সময়ে যখনই পরবর্তী নির্বাচন হোক, তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, বিএনপির অংশগ্রহণ কি নিশ্চিত করা যাবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : যখনই নির্বাচন হোক, নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও অবাধভাবে অনুষ্ঠানের জন্য কতগুলো শর্ত সংসদীয় ব্যবস্থায় আছে। প্রথমেই সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচন যখন হবে, তখন নির্বাচন কমিশনই সব ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করবে। তখন যেমন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীও থাকেন না, বিরোধী দলের নেতাও থাকেন না। ভারতের উদাহরণকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি, দেশ চালায় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সেখানে তখন মূল ভূমিকায় থাকে নির্বাচন কমিশন। ফলে ভারতে নির্বাচনের সময় কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সেটা কোনো বিবেচনার বিষয় নয়।
প্রথম আলো : আপনি আগে এক সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে।
এমাজউদ্দীন আহমদ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ও তা কার্যকর হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে। তখনো ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, এটা কয়েক মেয়াদ পর্যন্ত চলবে। সর্বশেষ উচ্চ আদালতের যে রায়, সেখানেও বলা হয়েছিল যে পরের দুই মেয়াদের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সব সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেটা চাওয়া হতে পারে না। আসলে নিজেদের স্বার্থেই রাজনৈতিক দলগুলোকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনভাবে নির্বাচন হতে হবে যে কে প্রধানমন্ত্রী বা কে বিরোধীদলীয় নেত্রী, সেটা নির্বাচনের সময় বিবেচ্য থাকবে না। কিন্তু এ জন্য পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে সেভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
প্রথম আলো : আগামী নির্বাচনের সময় তবে কী ধরনের সরকার আশা করছেন, বা এর আগে করণীয় কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এখন দেশে যে রাজনীতি চলছে, তাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তো আমরা ফেরেশতা নিয়ে আসতে পারব না। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেক বিচক্ষণ ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁরা যদি তাঁদের প্রজ্ঞার উচ্চতম ব্যবহার করতে পারেন, তবে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা ও একটি পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
প্রথম আলো : কিন্তু বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেখান থেকে শুরুটা হবে কীভাবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : প্রথমেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা থাকতে পারে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। এখন যেভাবে হয়েছে সেভাবে নয়। ফলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রক্রিয়ার সূচনা হতে পারে।
প্রথম আলো : নির্বাচনকালীন সরকার?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ভারতে যে ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার হয়, এখানেও সে ধরনের কিছু হতে পারে। এই সরকার অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে কাজ করবে। নির্বাচনের সময় বিশেষ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে না, উন্নয়নমূলক কাজ বা এ ধরনের কোনো উদ্যোগ বা প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনই তখন নির্বাচনকালীন প্রধান শক্তি হিসেবে সব কাজ করবে।
প্রথম আলো : সিটি নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে অরাজনৈতিক, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা আপনি শুরুতে বলেছেন। এই নির্বাচনকে ঘিরে আপনি সক্রিয় হয়েছেন। আপনার এই যুক্ততার পেছনে কী কাজ করছে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : তিন মাস ধরে যে আন্দোলন চলেছে, তাতে মানুষ মরেছে, সাধারণ মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়েছে। তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি পথ হিসেবে দেখছি। তাই এই বয়সেও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমি মনে করি, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যাবে। নগর পরিচালনা ও এর ব্যবস্থাপনার দোহাই দিয়ে ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে এর মধ্য দিয়ে বরং আমলাতন্ত্র বেড়েছে। এই নির্বাচন ঢাকার জন্য ইতিবাচক হবে বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে সামনের দিনগুলোতে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : এই নির্বাচনগুলো একধরনের সংলাপের ভূমিকা পালন করছে। নির্বাচনের জন্য প্রার্থীরা ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। প্রার্থীদের মাধ্যমে যে যোগাযোগ হচ্ছে, সেটাও একধরনের সংলাপ। এই নির্বাচনের পরও এর প্রভাব থাকবে। ভোটার ও ভোটপ্রার্থীদের মধ্যে এই সংলাপ ও আদান-প্রদানকে আমি খুবই ইতিবাচক মনে করছি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এখন পরিচালিত হচ্ছে দুজন প্রশাসকের মাধ্যমে, সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আসবেন।
প্রথম আলো : এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : আমি মনে করি না যে পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। নির্বাচন কমিশন অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি উপেক্ষা করছে। তবে আমি আশাবাদী যে তারা দেখে শিখবে। ভারতের নির্বাচন কমিশন যেভাবে নির্বাচন করে, তারাও সে ধরনের কাজ করার চেষ্টা করবে। আমরা চাই ইউরোপের উন্নত গণতন্ত্রে নির্বাচন কমিশন যেভাবে কাজ করে, তা থেকে তারা শিখুক। নিরপেক্ষভাবে দেখার দৃষ্টিকোণ অর্জন করুক। এই নির্বাচন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো হবে বলে আমি মনে করি না। আর বিষয়টি শুধু নির্বাচন কমিশনেরও নয়, জনগণের দায়িত্ব রয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে। নির্বাচন কমিশন ঠিক-বেঠিক যা-ই করুক না কেন, জনগণ কিন্তু সবই দেখবে ও বিবেচনায় নেবে। বলা যায় জনগণের পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকবে নির্বাচন কমিশন।
প্রথম আলো : আপনি এই তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলেন, কী ধারণা হলো?
এমাজউদ্দীন আহমদ : নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, ভোটার যেন তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। আর ভোটপ্রার্থীও যেন ভোট চাওয়ার জন্য ভোটারদের কাছে যেতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে একজন প্রার্থীর পক্ষে যেহেতু সব ভোটারের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই প্রয়োজন সভা-সমাবেশ ও মিছিলের। সব প্রার্থীর জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরি করা হলো নির্বাচন কমিশনের কাজ। আমরা এসবই বলে এসেছি। তারা সচেতনভাবে তা চাইলে করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন যদি প্রজ্ঞা ও নিরপেক্ষতার মনোভাব নিয়ে কাজ করে, তবে তাদের ভুল হওয়ার সুযোগ কম।
প্রথম আলো : এই নির্বাচনের প্রভাব কি জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এই নির্বাচন জাতীয় পর্যায়ে একধরনের মর্যাদাবোধ ও চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটাবে বলে আমি মনে করি। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যখন এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জনগণের ভোট পেয়ে যখন কেউ নির্বাচিত হবেন, তখন তাঁর মধ্যে একটি মর্যাদাবোধের পরিস্থিতি তৈরি হবে। যাঁরা একটি ভোট না পেয়েও সংসদে গেলেন, তাঁরা এটা বুঝতে পারবেন যে আইনগতভাবে সিদ্ধ হলেও এ ধরনের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সম্মানজনক নয়। এই নির্বাচন তাই আমাদের পরবর্তী রাজনীতির রূপরেখার মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে, বর্তমান চিন্তাভাবনাকে পাল্টে দিতে পারে।
প্রথম আলো : এটা আশার কথা, কিন্তু বর্তমান রাজনীতির যে ধারা, তাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ : সমস্যা হচ্ছে যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু মনে করে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ধ্বংস বা নিঃশেষ করতে চায়। এটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা থাকতে হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এটা মানতে হবে যে দুই পক্ষের কোনো পক্ষই অপর পক্ষকে ধ্বংস করতে পারবে না। সংসদীয় রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে, দুই পক্ষকেই একসঙ্গে থাকতে হবে। পাশের দেশ ভারতের কথাই বলি, সেখানে প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ করেন, বিষয়টি অবহিত করেন। এসব থেকে আমরা অনেক দূরে আছি। এসব সমস্যা দূর হতে আরও সময় লাগবে।
প্রথম আলো : বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছে, এর এক বছরের মাথায় নতুন নির্বাচনের জন্য বিএনপি এক নজিরবিহীন আন্দোলন করল। আগাম বা নির্ধারিত সময়ে যখনই পরবর্তী নির্বাচন হোক, তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, বিএনপির অংশগ্রহণ কি নিশ্চিত করা যাবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : যখনই নির্বাচন হোক, নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও অবাধভাবে অনুষ্ঠানের জন্য কতগুলো শর্ত সংসদীয় ব্যবস্থায় আছে। প্রথমেই সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচন যখন হবে, তখন নির্বাচন কমিশনই সব ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করবে। তখন যেমন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীও থাকেন না, বিরোধী দলের নেতাও থাকেন না। ভারতের উদাহরণকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি, দেশ চালায় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সেখানে তখন মূল ভূমিকায় থাকে নির্বাচন কমিশন। ফলে ভারতে নির্বাচনের সময় কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সেটা কোনো বিবেচনার বিষয় নয়।
প্রথম আলো : আপনি আগে এক সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে।
এমাজউদ্দীন আহমদ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ও তা কার্যকর হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে। তখনো ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, এটা কয়েক মেয়াদ পর্যন্ত চলবে। সর্বশেষ উচ্চ আদালতের যে রায়, সেখানেও বলা হয়েছিল যে পরের দুই মেয়াদের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সব সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেটা চাওয়া হতে পারে না। আসলে নিজেদের স্বার্থেই রাজনৈতিক দলগুলোকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এমনভাবে নির্বাচন হতে হবে যে কে প্রধানমন্ত্রী বা কে বিরোধীদলীয় নেত্রী, সেটা নির্বাচনের সময় বিবেচ্য থাকবে না। কিন্তু এ জন্য পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে সেভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
প্রথম আলো : আগামী নির্বাচনের সময় তবে কী ধরনের সরকার আশা করছেন, বা এর আগে করণীয় কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ : এখন দেশে যে রাজনীতি চলছে, তাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তো আমরা ফেরেশতা নিয়ে আসতে পারব না। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেক বিচক্ষণ ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁরা যদি তাঁদের প্রজ্ঞার উচ্চতম ব্যবহার করতে পারেন, তবে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা ও একটি পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
প্রথম আলো : কিন্তু বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেখান থেকে শুরুটা হবে কীভাবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : প্রথমেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা থাকতে পারে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। এখন যেভাবে হয়েছে সেভাবে নয়। ফলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রক্রিয়ার সূচনা হতে পারে।
প্রথম আলো : নির্বাচনকালীন সরকার?
এমাজউদ্দীন আহমদ : ভারতে যে ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার হয়, এখানেও সে ধরনের কিছু হতে পারে। এই সরকার অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে কাজ করবে। নির্বাচনের সময় বিশেষ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে না, উন্নয়নমূলক কাজ বা এ ধরনের কোনো উদ্যোগ বা প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনই তখন নির্বাচনকালীন প্রধান শক্তি হিসেবে সব কাজ করবে।
প্রথম আলো : সিটি নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে অরাজনৈতিক, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা আপনি শুরুতে বলেছেন। এই নির্বাচনকে ঘিরে আপনি সক্রিয় হয়েছেন। আপনার এই যুক্ততার পেছনে কী কাজ করছে?
এমাজউদ্দীন আহমদ : তিন মাস ধরে যে আন্দোলন চলেছে, তাতে মানুষ মরেছে, সাধারণ মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়েছে। তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি পথ হিসেবে দেখছি। তাই এই বয়সেও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমি মনে করি, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যাবে। নগর পরিচালনা ও এর ব্যবস্থাপনার দোহাই দিয়ে ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে এর মধ্য দিয়ে বরং আমলাতন্ত্র বেড়েছে। এই নির্বাচন ঢাকার জন্য ইতিবাচক হবে বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে সামনের দিনগুলোতে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : ধন্যবাদ।
No comments