পুরনোর পাওয়া ও নতুনের কাছে চাওয়া by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

গ্রামবাংলায় নববর্ষ উদ্যাপনে খুব আড়ম্বরতা কখনও ছিল না। অনেকটা বলে বয়ে আসা আত্মীয়ের মতো ছিল দিনটি, দীর্ঘদিন। তাকে বরণ করে নেয়া হতো, কিন্তু আচার, কিছু কৃত্য পালন করা হতো, কিন্তু উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য ছিল না। বরং তাতে আন্তরিকতা, আনন্দ আর নমিত কিছু আবেগের প্রকাশ দেখা যেত। ছোটবেলায় যে দু-একবার নববর্ষের দিনে গ্রামে গিয়েছি, চোখে পড়ত দিনটিকে আলাদা করে রাখার আয়োজনগুলো। কিন্তু তাতে উচ্ছ্বাসের আতিশয্য থাকত না, থাকত ব্যতিক্রমী উদ্যাপনের আনন্দ।
ব্যতিক্রম তো বটেই। সারা বছর যেত মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে, শোকে-দুঃখে, প্রত্যাশায়-প্রাপ্তিতে। দুই ঈদে অথবা পূজা-পার্বণে দু-এক দিনের ছেদ পড়ত সেই নিত্যদীনতায়। কিন্তু ধর্মীয় উৎসবে সবাই তো শামিল হতে পারত না। যারা ঈদ করছে, তারা পূজা-পার্বণে হয়তো জীবন-সংগ্রামে মাঠে, গঞ্জে অথবা অন্যত্র। নববর্ষ ছিল সবার জন্য একটা অভিন্ন উদ্যাপন। এদিনে সবাই যে কাজ থেকে হাত গুটিয়ে রাখতেন তা নয়। কিন্তু সব সম্প্রদায় মিলে ওই একটা দিনেই একটা জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারতেন। ওই একটা দিনে হিন্দু-মুসলমান একই সঙ্গে উৎসবের রং গায়ে মাখতেন। বাংলার কৃষক বরাবরই ছিলেন শোষণের শিকার, বাংলার মেহনতি মানুষও পুঁজির কাছে, ক্ষমতার কাছে ছিলেন পরাভূত। নববর্ষে ওই সব মানুষ কষ্ট ভুলে, গ্লানি ভুলে একটা অভিন্ন উদ্যাপনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন। আয়োজন ছিল খুব সামান্যই- একটুখানি ভালো খাওয়া, সন্তানদের জন্য, সম্ভব হলে নতুন জামা (যা অসম্ভবের পর্যায়ে থেকে যেত অনেকের জন্য), মেলা-উৎসবে সবাইকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাওয়া, একটুখানি কেনাকাটা করা- তাও যদি গাঁটে কিছু পয়সা থাকত। নববর্ষের মেলা ছিল এদের জন্য একটা সান্ত্বনার মতো। নববর্ষের মেলায় বিকিকিনিটা বড় ছিল না, ছিল অংশগ্রহণটা। যত মানুষ যেসব মেলায় যেত, তার একটা বড় অংশেরই হয়তো কিছু কেনার পয়সা থাকত না। তারপরও মেলা হতো সপ্রাণ। মেলায় থাকত আনন্দ, কোলাহল। নিত্যদিনের সংগ্রাম ভুলে থাকার কিছু উপলক্ষ।
নববর্ষের কাছে মানুষের চাওয়া ছিল কয়েকটি- প্রথমত. জীবনের কঠিন সংগ্রাম ভুলে কিছুটা আনন্দ, কিছুটা রং আর উদ্যাপনের বৈচিত্র্য তারা আশা করত। দ্বিতীয়ত. সব সম্প্রদায়ের সমান অংশগ্রহণ যেহেতু ছিল দিনটিতে, একটা বড় চাওয়া ছিল সম্প্রীতি, সৌভ্রাতৃত্ব। আর তৃতীয় একটি চাওয়া ছিল নিজেদের গণ্ডি ভেঙে সবার এক হয়ে যাওয়া, যেখানে সন্তানরা, প্রতিবেশীরা সবাই শামিল হবে। নববর্ষের মেলা ছিল উচ্চ-নীচের, নিকট-দূরের, ধনী-দরিদ্রের দেয়াল ভাঙার একটা প্রতীক। মেলা কখনও পুঁজির শাসনে পড়েনি। মেলা ছিল একটা-দুটো মুদ্রার বিনিময়ে বিমলানন্দ খুঁজে পাওয়া। মেলা ছিল নববর্ষের একটা বড় চাওয়া, যেহেতু মেলাতে টুকটাক কেনাকাটার আনন্দটা কখনও টাকার হিসাবে দেখা হতো না, হতো প্রাপ্তির তৃপ্তির হিসেবে।
নববর্ষে গঞ্জের বাজারে হালখাতা লেখা হতো। হালখাতায়- এক বছরের হিসাব নেয়া হতো। লাভ হলে লাভ, ক্ষতি হলে ক্ষতি- কিন্তু গঞ্জের ব্যবসায়ী এ লাভ-ক্ষতির আলোয় সব দেখতেন না। তার দোকানে বাতাসা-মিষ্টি থাকত, আগন্তুক সবাই তাতে ভাগ বসাত। হালখাতা ছিল সামাজিক একটি অনুষ্ঠান। ছোট-বড় ব্যবসায়ীকে তা নিজের কর্মফলের সামনাসামনি করত। হালখাতার হিসাবটা ছিল একই সঙ্গে ব্যবসা-দর্শন এবং আত্মদর্শন। কালু শাহের একটা গাছ আছে এই রকম, বছরে একবার দেখরে ভিতরে চাইয়া, মনটা আছে কিনা বিষয়ে ছাইয়া। বিষয় যদি মন ছেয়ে রাখে, তাহলে লোভ বাড়ে। আর লোভ বাড়লে কোনো নৈতিকতা কাজে আসে না।
হালখাতা লাল কাপড়ে মোড়া থাকত। তা জীবনকে, জীবনের চলমানতাকে ঘোষণা করত; জীবনহীন, শুকনো অঙ্কের হিসাবকে নয়। এ জন্য হালখাতা উৎসব হতো, মিষ্টি বিতরণ হতো, মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে দাঁড়াত।
২...
নববর্ষের রূপ পাল্টেছে। এখন শহরের নববর্ষ গ্রামের নববর্ষকে প্রভাবিত করছে। এখন নববর্ষ পোশাকপ্রধান, আচারপ্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ কথাটাও তো ঠিক যে, এখন নববর্ষ প্রবল উচ্ছ্বাস, হাসি-আনন্দ ও কোলাহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাতে নববর্ষের মূল চাওয়াটা মোটেও চাপা পড়েনি।
একটিই সমস্যা এই নতুন নববর্ষে- এটিকে একটা প্রচারের বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। মিডিয়া বলতে ছাপা এবং (প্রধানত) ইলেকট্রনিক মাধ্যমের যে সমন্বয়কে আমরা জানি, তা-ই এখন দায়িত্ব নিয়েছে প্রচারের এবং মিডিয়ার পিঠে হাত রেখেছে বড় পুঁজি অর্থাৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলো। তাতে আয়োজনটা ব্যাপক হয়, চাকচিক্য প্রবল হয়। কিন্তু প্রাণটাও থাকে। এ এক অদ্ভুত যোগ। এত চমক, কিন্তু প্রাণটা স্পন্দিত। তার কারণ ওই চাওয়া- নববর্ষের কাছে মানুষ নিত্যদীনতার জাঁতাকল থেকে মুক্তি চায়, উদ্যাপন চায়, সবার সঙ্গে প্রাণ মেলাতে চায়।
অর্থাৎ আয়োজনের উদ্যাপনের ব্যাপ্তি বেড়েছে, কিন্তু চাওয়াটা একই রয়ে গেছে।
আরেকটা চাওয়া হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ। এখন সারা দেশে- শহরে-বন্দরে-গ্রামে-গঞ্জে যে নববর্ষ পালন হয়, তাতে এ চেতনার বলিষ্ঠ এবং প্রত্যয়দীপ্ত একটি স্ফুরণ দেখা যায়। এখনও হালখাতা হয় এবং এখনও, আশ্চর্য, লাভ-ক্ষতির থেকেও সামাজিক দায়বদ্ধতাটা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই বাঙালিয়ানার শক্তি। একটি দিন, একটি উপলক্ষ- কিন্তু ইতিহাসের বিবর্তনে এর মহিমায় কোনো ছায়া পড়ে না। কর্পোরেট অংশগ্রহণেও না। বরং মহিমাটা আরও বাড়ে।
৩...
বাংলাদেশ এখন বিভাজিত একটা দেশ। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বিত্তগত বিভাজন এখন তীব্র। উগ্রবাদের বিস্তার হচ্ছে, বহুমতের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে সংকীর্ণ রাজনৈতিক চিন্তা। পুঁজির শাসন বেড়েছে।
এরকম দেশে নববর্ষ একটা বাণী নিয়ে আসে। বাণীটা এই কায়মনে বাঙালি হও, বিভেদ ভোল, বাংলার উদার আকাশের নিচে এক কাতারে দাঁড়াও- উদারতা শেখো ওই আকাশ থেকে। নিঃসর্গ থেকে।
এবারের চাওয়াও আমাদের যুগযুগের সেই চাওয়া- একতা চাই। আমরা বিভাজন চাই না। ভিন্নমত থাকবেই। কিন্তু তা যেন উগ্র না হয়। প্রাণঘাতী না হয়।
নববর্ষ হচ্ছে প্রাণের মেলার এক সমাবেশ। এ সমাবেশ আরও ব্যাপক হোক। আমরা চাই, নববর্ষের রং যেন সবাই মনের ভেতরে মেখে নেয়। তাহলে সারা বছর শুধু প্রাপ্তিতেই যাবে।
নববর্ষে কঠোরে-কোমলে কী সুন্দর এক উদ্যাপনকে দেখি আমরা। প্রকৃতি কঠোর আবার কোমল তার সৌন্দর্য। বাঙালি কঠোর হোক অশুভের বিরুদ্ধে, কিন্তু কোমল হোক সবার প্রতি।
নববর্ষ যেন আমাদের সবাইকে সারা বছরের জন্য রাঙিয়ে দিয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.