দুই নেত্রীর দ্বন্দ্বের বলি জনগণ
বাংলাদেশের
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কদর্যতা সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে দ্রুত উপায় হলো ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যাওয়া। বাংলাদেশের সব থেকে
গুরুত্বপূর্ণ দুই রাজনৈতিক নেতা ‘দুই বেগম’ হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যকার
দীর্ঘ লড়াইয়ের বলি হলেন বার্ন ইউনিটের আহতরা। পেট্রলবোমা হামলার শিকার হয়ে
তারা এখানে ভর্তি হয়েছেন। এমনই এক হামলা থেকে কোনমতে বেঁচে আসা মোহাম্মদ
নাজমুল মোল্লাকে জিজ্ঞাসা করা হলে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে
তিনি বলেন, তারা সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে। তারা নিজেদের ভাইদের হত্যা
করছে। এবারের বসন্তে পরিশ্রান্ত নন এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা কম। জানুয়ারি
মাসে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া অবরোধের ডাক দিলে দেশ বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চাপ দিয়ে নতুন নির্বাচন
ডাকে বাধ্য করার আশা করেছিলেন তিনি। খালেদা জিয়া সমঝোতার প্রত্যাশা করে
থাকলেও তেমনটা হয় নি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত
হয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত কোন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নেই। রোববার বিশ্বব্যাংক
প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৬২ দিনের রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে
বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ২২০ কোটি ডলার। রিপোর্টে এই অর্থবছরের
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫.৬ শতাংশ হবে বলে বলা হয়। অবরোধ শুরু হওয়ার আগে
বিশ্বব্যাংকের ধারণা ছিল তা ৬.৬ শতাংশ হবে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়
থেকে শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেইন বলেন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর
আপনি যদি শিল্পের ক্ষতি করেন তাহলে কতদিন আপনি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে
পারবেন। একপর্যায়ে আপনার পুষিয়ে নেয়ার ক্ষমতাও প্রভাবিত হবে। এ সহিংসতার
পেছনের সূত্র খুঁজতে গেলে আসবে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের জাতীয় নির্বাচন।
ওই নির্বাচন দুই নেত্রীর মনোবাসনা পূরণের লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটায়। সরকারের
অধীনে নির্বাচনে জালিয়াতি হবে আশঙ্কায় খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করেন।
এদিকে শেখ হাসিনা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে বাদ রেখেই নির্বাচন
করেন। আর সামনের মাসগুলোতে আরেকটি নির্বাচনের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেন।
এবারের জানুয়ারিতে এক বছর অপেক্ষা করার পর খালেদা জিয়া অনির্দিষ্ট কালের
প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এরপর থেকে শতাধিক বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন।
পেট্রলবোমা হামলায় আরও অনেকে ভয়াবহভাবে আহত। সরকার কড়া পদক্ষেপের মাধ্যমে
আন্দোলনের জবাব দিয়েছে। খালেদা জিয়ার দলের নেতারা হয় গ্রেপ্তার বা
আত্মগোপনে আছেন। বিএনপি কর্মকর্তারা সহিংসতার দায় অস্বীকার করেছেন। কিন্তু
বলছেন হরতাল-অবরোধ ছাড়া তাদের কোন পথ খোলা নেই। এ আন্দোলন কর্মসূচিতে ক্ষতি
হয়েছে পুরো দেশের। পরীক্ষার আগে বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল। কৃষকরা পরিশ্রমের
ফসল চোখের সামনে পচতে দেখেছেন। পর্যটন কেন্দ্রগুলো প্রায় খালি হয়ে গেছে।
তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো গার্মেন্ট শিল্প, যা থেকে বাংলাদেশের
রপ্তানির ৮০ শতাংশ আসে। শাব্বির মাহমুদ নামের এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী
অন্যদের মতো এ প্রভাব অনুভব করেছেন। তার দুই কারখানায় ৮২০ জন শ্রমিক কাজ
করেন। ২০০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থানক্ষম তৃতীয় আরেকটি কারখানা খোলার কথা ছিল,
যা তিনি পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। হারিয়েছেন বায়ার। বাধ্য হয়েছেন শ্রমিক
ছাঁটাই করতে। যতটুকু কাজের অর্ডার ছিল তা পকেটের অতিরিক্ত টাকা খরচ করে
পাঠাতে হয়েছে আকাশপথে। কেননা, পেট্রলবোমা আতঙ্কের মধ্যে পণ্যবাহী
ট্রাকচালকদের চট্টগ্রাম পাঠাতে বিবেকে বাধা দিয়েছে তার। তিনি বলেন,
উৎপাদনকারীরা অর্থনীতির স্বার্থে উভয় নেত্রীর সঙ্গে সমঝোতার মধ্যস্থতা করার
চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোন লাভ হয় নি। বিজিএমইএ’র বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
আবারও বিশৃঙ্খলা শুরু হলে রপ্তানির পতন হতে পারে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এদিকে
বিপদের মুখে পড়বে তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা যাদের অনেকেই আসেন গ্রাম
থেকে। এমনই এক শ্রমিক মোমেনা আকতার (৩০) বলেন, আমি যদি খালি হাতে কোন সঞ্চয়
ছাড়া গ্রামে ফিরে যাই, তাহলে এটা হবে আমার জীবনের সব থেকে দুঃখজনক ঘটনা।
তার এক প্রতিবেশী মাহমুদা খাতুন (৫৫) বলেন, এসব কিছুর জন্য সরকার দায়ী। আমি
তাদেরকে বলবো, আপনারা দায়ী। আমি তাদেরকে দোষ দেবো। আমি বলবো, আপনাদের
জন্যই এসব কিছু হচ্ছে।
No comments