এসো হে বৈশাখ by আনিসুজ্জামান
গ্রীষ্মকাল—বৈশাখের
খরতাপে হৃদয় তৃষায় হানে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কবুল করেছেন, সময়টা আরামের নয়।
তারই মধ্যে লোকে গলা ফাটিয়ে বলছে, এসো হে বৈশাখ। বাঙালি না হলে এমন আর
কে করে! করে তার নববর্ষকে আবাহন করার জন্য।
সারা বছরে নববর্ষের সূচনা করার মতো অনুকূল সময় আরও ছিল। এক সময়ে তা-ই হতো। অগ্রহায়ণ মাসের নাম থেকেই বোঝা যায়, কোনো এক কালে তাকেই গণ্য করা হতো বছরের (হায়ন) শুরু (অগ্র) বলে। তখন হেমন্তকাল—চারদিকে নরম রোদ, একটু হিম-হিম ভাব। বেশ আরামের কাল। কিন্তু সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। অগ্রহায়ণ বদলে বাঙালি তার নববর্ষ আরম্ভ করল বৈশাখ থেকে। অগ্নিস্নানই সই, কালবৈশাখিতেও ভয় নেই। ধোপদুরস্ত বাঙালি গগন বিদীর্ণ করে চিৎকার করছে, এসো হে বৈশাখ।
অন্য জায়গার বাঙালির চেয়ে বাংলাদেশের বাঙালিই একটু বেশি করে অমন করে। নববর্ষকে সে দেখে তার সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের অংশ বলে। একদা পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির নববর্ষ-উদ্যাপনকে নিরুৎসাহ করতে চেয়েছিল, বাধাও দিয়েছিল প্রকারান্তরে। তবেই হুঁশ হলো বঙ্গসন্তানের। সারা বছর বাংলা তারিখের খোঁজ নেই তার, কিন্তু সে মরিয়া হয়ে গেল পয়লা বৈশাখে। কোমর বেঁধে লেগে গেল দিনটা পালন করতে। নববর্ষ-উদ্যাপন এখন বাংলাদেশের প্রধানতম উৎসব। এর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের স্বকীয়তা, আমাদের অস্তিত্বের শিকড়।
পঞ্জিকাই একটা জাতির পরিচয়ের মূলসূত্র নয়। কিন্তু নিজেদের যে একটা পঞ্জিকা আছে—স্বতন্ত্র, একান্ত, বিশেষ—তা একটা বলবার বিষয়, সবাইকে জানানোর মতো কথা—আনন্দের, গৌরবের, অহংকারের ব্যাপার। সনমাত্রেরই উদ্ভব হিসেব-নিকেশের জন্য। রাজস্ব সংগ্রহের প্রয়োজনেই তো বাংলা সনের সূচনা। তাই আশ্চর্য নয় যে, ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলাই ছিল এককালে নববর্ষের মূল উৎসব। তার মধ্যে অবশ্য আনন্দের উপকরণও ছিল। হালখাতা উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়ার, বিশেষ করে মিষ্টান্ন বিতরণের, রেওয়াজ ছিল। বৈশাখি মেলায় হরেক রকমের সামগ্রীর প্রদর্শনী ও কেনাবেচা ছিল বিনোদনের একটা উৎস। কোনো না কোনোভাবে সবাই দিনটাকে উৎসবের আনন্দ দিয়ে ভরে রাখার চেষ্টা করত।
ইংরেজদের নিউ ইয়ার্স ডে পালনের দেখাদেখি শিক্ষিত নাগরিক সমাজে নববর্ষ-পালন শুরু হয় উনিশ শতকের শেষভাগে। নৃত্যগীতবাদ্য দিয়ে দিনটিকে সুশোভিত ও আমোদিত করার কাজে অগ্রণী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সবখানে।
বাংলাদেশ-অঞ্চলে নববর্ষ-উৎসব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ছায়ানটের উদ্যোগে। পাকিস্তান সরকার নববর্ষ পালনে আপত্তি করে জেনে আমাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। এখন তো ছায়ানটের পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট বা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলা একাডেমির বক্তৃতা ও কবিতা পাঠের আসর, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর সংগীতানুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। রবীন্দ্র-সরোবরে বসছে গানের আসর। গত কয়েক বছর ধরে সুরের ধারা চৈত্রসংক্রান্তিতে বর্ষশেষের অনুষ্ঠান করছে, যা শেষ হচ্ছে মধ্যরাত্রির পরে নববর্ষ আবাহন করে। বিসিকের বৈশাখি মেলা নববর্ষের দিনটিকে সৌষ্ঠবমণ্ডিত করে আসছে। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের সর্বত্র নববর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে সাড়ম্বরে।
তারপরেও, কিংবা তা সত্ত্বেও, এ-কথা সত্য যে, রমনার বটমূলে ছায়ানটের নববর্ষ-উৎসব আক্রান্ত হয়েছে, হতাহত হয়েছে মানুষ, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আনন্দযজ্ঞে ছড়িয়ে পড়েছে ভীতি আর কান্না। আমাদের সমাজে কিছু মানুষ সবক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনেন এবং শিরক ও বেদাতের সন্ধান করেন। নরহত্যাকে তাঁরা গুরুতর পাপ বলে মনে করেন না। মেয়েদের কপালে টিপ পরা থেকে শুরু করে পিচ-ঢালা পথে আলপনা আঁকাকে তাঁরা বিধর্মীয় আচার বলে সাব্যস্ত করেন এবং তা দমন করতে তৎপর হন। এসব প্রয়াসে তাঁরা যে একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন, তা নয়। মেয়েদের সাম্প্রতিক পোশাক-আশাক দেখলে তা বোঝা যাবে। কেউ তার পছন্দমতো খাওয়াপরা চলাফেরা করতেই পারে। গোলমাল লাগে যখন কেউ অপরের পছন্দ-অপছন্দে হস্তক্ষেপ করে, তখন।
ছায়ানটের অনুষ্ঠানে সেই বোমা-হামলার পরে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে সামনে পেয়ে টেলিভিশনের সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, এরকম দুর্বিপাকের পরে তারা কি আর আসবে এখানে? ছেলেমেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দ্বিধাহীনচিত্তে তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়েছিল, ‘সামনের পয়লা বৈশাখে আবার আমরা আসব।’
এইখানেই পয়লা বৈশাখের শক্তি। শুধু পয়লা বৈশাখের নয়, বাঙালির সকল উৎসবের। আমাদের ইতিহাসের ধারা, ঐতিহ্যের পারম্পর্য বহন করে নিয়ে চলেছে দেশের সরল মানুষ। তারা অদম্য, তারা অপরাজেয়। তারা একুশে ফেব্রুয়ারিতে তা দেখিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানে তা দেখিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে তা দেখিয়েছে। শাশ্বত বাঙালিত্বের সন্ধানে তাদের যাত্রা থামবার নয়, স্বকীয় সংস্কৃতির লালনে তাদের প্রয়াস শেষ হওয়ার নয়। জয় হোক তাদের। আমাদের ভবিষ্যৎ তাদেরই হাতে।
নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে।
সারা বছরে নববর্ষের সূচনা করার মতো অনুকূল সময় আরও ছিল। এক সময়ে তা-ই হতো। অগ্রহায়ণ মাসের নাম থেকেই বোঝা যায়, কোনো এক কালে তাকেই গণ্য করা হতো বছরের (হায়ন) শুরু (অগ্র) বলে। তখন হেমন্তকাল—চারদিকে নরম রোদ, একটু হিম-হিম ভাব। বেশ আরামের কাল। কিন্তু সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। অগ্রহায়ণ বদলে বাঙালি তার নববর্ষ আরম্ভ করল বৈশাখ থেকে। অগ্নিস্নানই সই, কালবৈশাখিতেও ভয় নেই। ধোপদুরস্ত বাঙালি গগন বিদীর্ণ করে চিৎকার করছে, এসো হে বৈশাখ।
অন্য জায়গার বাঙালির চেয়ে বাংলাদেশের বাঙালিই একটু বেশি করে অমন করে। নববর্ষকে সে দেখে তার সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের অংশ বলে। একদা পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির নববর্ষ-উদ্যাপনকে নিরুৎসাহ করতে চেয়েছিল, বাধাও দিয়েছিল প্রকারান্তরে। তবেই হুঁশ হলো বঙ্গসন্তানের। সারা বছর বাংলা তারিখের খোঁজ নেই তার, কিন্তু সে মরিয়া হয়ে গেল পয়লা বৈশাখে। কোমর বেঁধে লেগে গেল দিনটা পালন করতে। নববর্ষ-উদ্যাপন এখন বাংলাদেশের প্রধানতম উৎসব। এর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের স্বকীয়তা, আমাদের অস্তিত্বের শিকড়।
পঞ্জিকাই একটা জাতির পরিচয়ের মূলসূত্র নয়। কিন্তু নিজেদের যে একটা পঞ্জিকা আছে—স্বতন্ত্র, একান্ত, বিশেষ—তা একটা বলবার বিষয়, সবাইকে জানানোর মতো কথা—আনন্দের, গৌরবের, অহংকারের ব্যাপার। সনমাত্রেরই উদ্ভব হিসেব-নিকেশের জন্য। রাজস্ব সংগ্রহের প্রয়োজনেই তো বাংলা সনের সূচনা। তাই আশ্চর্য নয় যে, ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলাই ছিল এককালে নববর্ষের মূল উৎসব। তার মধ্যে অবশ্য আনন্দের উপকরণও ছিল। হালখাতা উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়ার, বিশেষ করে মিষ্টান্ন বিতরণের, রেওয়াজ ছিল। বৈশাখি মেলায় হরেক রকমের সামগ্রীর প্রদর্শনী ও কেনাবেচা ছিল বিনোদনের একটা উৎস। কোনো না কোনোভাবে সবাই দিনটাকে উৎসবের আনন্দ দিয়ে ভরে রাখার চেষ্টা করত।
ইংরেজদের নিউ ইয়ার্স ডে পালনের দেখাদেখি শিক্ষিত নাগরিক সমাজে নববর্ষ-পালন শুরু হয় উনিশ শতকের শেষভাগে। নৃত্যগীতবাদ্য দিয়ে দিনটিকে সুশোভিত ও আমোদিত করার কাজে অগ্রণী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সবখানে।
বাংলাদেশ-অঞ্চলে নববর্ষ-উৎসব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ছায়ানটের উদ্যোগে। পাকিস্তান সরকার নববর্ষ পালনে আপত্তি করে জেনে আমাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। এখন তো ছায়ানটের পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউট বা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলা একাডেমির বক্তৃতা ও কবিতা পাঠের আসর, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর সংগীতানুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। রবীন্দ্র-সরোবরে বসছে গানের আসর। গত কয়েক বছর ধরে সুরের ধারা চৈত্রসংক্রান্তিতে বর্ষশেষের অনুষ্ঠান করছে, যা শেষ হচ্ছে মধ্যরাত্রির পরে নববর্ষ আবাহন করে। বিসিকের বৈশাখি মেলা নববর্ষের দিনটিকে সৌষ্ঠবমণ্ডিত করে আসছে। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের সর্বত্র নববর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে সাড়ম্বরে।
তারপরেও, কিংবা তা সত্ত্বেও, এ-কথা সত্য যে, রমনার বটমূলে ছায়ানটের নববর্ষ-উৎসব আক্রান্ত হয়েছে, হতাহত হয়েছে মানুষ, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আনন্দযজ্ঞে ছড়িয়ে পড়েছে ভীতি আর কান্না। আমাদের সমাজে কিছু মানুষ সবক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনেন এবং শিরক ও বেদাতের সন্ধান করেন। নরহত্যাকে তাঁরা গুরুতর পাপ বলে মনে করেন না। মেয়েদের কপালে টিপ পরা থেকে শুরু করে পিচ-ঢালা পথে আলপনা আঁকাকে তাঁরা বিধর্মীয় আচার বলে সাব্যস্ত করেন এবং তা দমন করতে তৎপর হন। এসব প্রয়াসে তাঁরা যে একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন, তা নয়। মেয়েদের সাম্প্রতিক পোশাক-আশাক দেখলে তা বোঝা যাবে। কেউ তার পছন্দমতো খাওয়াপরা চলাফেরা করতেই পারে। গোলমাল লাগে যখন কেউ অপরের পছন্দ-অপছন্দে হস্তক্ষেপ করে, তখন।
ছায়ানটের অনুষ্ঠানে সেই বোমা-হামলার পরে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে সামনে পেয়ে টেলিভিশনের সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, এরকম দুর্বিপাকের পরে তারা কি আর আসবে এখানে? ছেলেমেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দ্বিধাহীনচিত্তে তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়েছিল, ‘সামনের পয়লা বৈশাখে আবার আমরা আসব।’
এইখানেই পয়লা বৈশাখের শক্তি। শুধু পয়লা বৈশাখের নয়, বাঙালির সকল উৎসবের। আমাদের ইতিহাসের ধারা, ঐতিহ্যের পারম্পর্য বহন করে নিয়ে চলেছে দেশের সরল মানুষ। তারা অদম্য, তারা অপরাজেয়। তারা একুশে ফেব্রুয়ারিতে তা দেখিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানে তা দেখিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে তা দেখিয়েছে। শাশ্বত বাঙালিত্বের সন্ধানে তাদের যাত্রা থামবার নয়, স্বকীয় সংস্কৃতির লালনে তাদের প্রয়াস শেষ হওয়ার নয়। জয় হোক তাদের। আমাদের ভবিষ্যৎ তাদেরই হাতে।
নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে।
No comments