ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা পুলিশ ও ঢাবি প্রশাসনের
ঢাবিতে যৌন হয়রানির দায়ে দুই ছাত্রলীগ নেতা আটক |
বর্ষবরণের
অনুষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ থেকে নিজেদের
রক্ষা করার চেষ্টা করছে পুলিশ। এজন্য যৌন নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত ও আটক
করার চেয়েও বস্ত্রহরণের ঘটনা ঘটেনি প্রমাণ করতে তৎপর তারা। একইভাবে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বস্ত্রহরণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা থেকে নিজেদের রক্ষা
করতে তৎপর ঢাবি প্রশাসনও। পুলিশ ও ঢাবি কর্তৃপক্ষ ঘটনা ধামচাপা দিতে চাইছে
বলে অভিযোগ করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকারীরা। পুলিশ দাবি করছে,
ঘটনার পর থেকে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে বস্ত্রহরণের কোন দৃশ্য
পাওয়া যায়নি। তবে নারীদের ঠেলা-ধাক্কা ও জড়িয়ে ধরার দৃশ্য এতে রয়েছে। এসব
দৃশ্য থেকে ছবি প্রিন্ট করা হয়েছে। ওইসব ছবিকে অবলম্বন করে বখাটেদের শনাক্ত
করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বখাটেদের শনাক্ত করতে ঢাবি কর্তৃপক্ষও
সহযোগিতা করছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। ইতিমধ্যে সিসি ক্যামেরার
ফুটেজে প্রাপ্ত ছবি ঢাবি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই সঙ্গে
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে বখাটেদের ছবি প্রিন্ট ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে
প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছে ডিবিসহ পুলিশের একাধিক
টিম। তবে গতকাল পর্যন্ত বখাটেদের কারও পরিচয় পাওয়া যায়নি। আজ-কালের মধ্যেই
বখাটেদের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। পুলিশের রমনা জোনের
অতিরিক্ত উপকমিশনার ইব্রাহিম খান জানান, ১লা বৈশাখ উপলক্ষে টিএসসি এলাকায়
১৯টি সিসি ক্যামেরা ছিল। এসব ক্যামেরার ফুটেজগুলো বারবার দেখা হয়েছে। এর
কোথাও বস্ত্রহরণের কোন দৃশ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি ঘটনার সময় টিএসসি এলাকায়
দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তারাও বস্ত্রহরণের বিষয়ে কিছু জানেন না।
ঘটনাস্থল থেকে ২৫ গজ দূরে দায়িত্ব পালন করছিলেন শাহবাগ থানার পরিদর্শক
(তদন্ত) সাইদুল হক ভূঁইয়া। তিনি জানিয়েছেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ তার কাছে
তখন কেউ করেনি। বস্ত্র হরণের মতো ঘটনা তার চোখে পড়েনি।
এ ঘটনায়
নির্যাতিতাদের উদ্ধার করতে গিয়ে আহত অমিত দে জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের
দুই নম্বর গেট ও রাজু ভাস্কর্যসংলগ্ন এলাকায় বস্ত্রহরণের ঘটনা ঘটে।
পাশাপাশি তিনটি স্থানে তিনটি গ্রুপ চারদিক ঘেরাও করে নারীদের বস্ত্র হরণ ও
যৌন নির্যাতন করছিল। তখন পাশেই দুজন পুলিশ সদস্য ছিল। অমিত বলেন, তাদের পা
ধরতে শুধু বাকি ছিলো। নারীদের উদ্ধার করার জন্য শুরুতেই বারবার তাদের
অনুরোধ করেছি আমি। কিন্তু তারা তখন সাড়া দেয়নি। এমনকি রাজু ভাস্কর্যের অন্য
পাশে থাকা পুলিশকেও অনুরোধ করেছিলেন অমিত। তারা তখন জানিয়েছে, একেকটি
স্পটের দায়িত্ব একেকটি গ্রুপের। উদ্যানের দুই নম্বর গেটের দায়িত্ব তাদের
না। ভিডিও ফুটেজে বস্ত্রহরণের দৃশ্য না থাকা প্রসঙ্গে অমিত জানান,
বস্ত্রহরণের সময় ওই স্থানে লাইটের অভাবে অন্ধকার ছিল। চারদিকে বখাটেরা
ঘেরাও করে রেখেছিল। এটি ফুটেজে দেখা না গেলেও আলামত নিশ্চয়ই আছে বলে মনে
করেন তিনি।
একইভাবে ওই ঘটনায় নির্যাতিতাদের উদ্ধার করতে গিয়ে আহত ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি সভাপতি লিটন নন্দী অভিযোগ করেন, ঢাবির ভিসি ও প্রক্টর এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য ওই বস্ত্রহরণের ঘটনা আড়াল করতে চাইছেন। তিনি জানান, বস্ত্রহরণের ঘটনা তদন্ত শুরু হলে বিপাকে পড়েন ঘটনাস্থলের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা। একইভাবে ঢাবি এলাকায় এ ধরনের ঘটনায় সমালোচিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পুলিশ ও ঢাবি প্রশাসন নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য বস্ত্রহরণের বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) এম এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার জানান, বখাটেদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে ডিবিসহ পুলিশের কয়েকটি টিম কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।
‘প্রক্টর ও পুলিশ যৌন নিপীড়ক ও অপরাধীদের সহযোগী’
এদিকে ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত সংহতি সমাবেশে অংশ নিয়ে অধ্যাপক আনু মুহম্মদ বলেছেন, পুলিশ ও প্রক্টর নাকি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে শ্লীলতাহানির কোন কিছুই দেখেনি। তারা সত্য ও যৌন নিপীড়নকে অস্বীকার করেছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, তারা যৌন নিপীড়ক ও অপরাধীদের সহযোগী। যৌন সন্ত্রাসদের দেশের অসুস্থ রাজনীতি, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পৃষ্ঠপোষকতা করছে। মিথ্যা বলে তাদেরকে রক্ষায় ব্যস্ত হয়েছে। পুলিশের উপর ভরসা করে না থেকে উৎসবের দিন সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এসময় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এ ঘটনায় মুখে ও চোখে কুলুপ এঁটে ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সত্যকে ঢাকার চেষ্টা করবেন না। সঠিক দায়িত্ব পালন করতে না পারলে সরে দাঁড়ান নতুবা দুর্বৃত্তের সহযোগী হিসেবে সকলের কাছে আখ্যায়িত হবেন। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসান তারেকের সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, সাংবাদিক কামাল লোহানী, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার, ঢাবি শাখার সভাপতি লিটন নন্দী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, যে কোন উৎসবে নারীরা বলতে পারবে না অবাঞ্ছিত হাত শরীরে আঘাত করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও দায়ভার কেউ নেয় না। পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তারা দায়িত্ব পালন করেনি। সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ঘৃণা উচ্চারণ করছি। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্র্থীরাই ৫২, ৬২, ৬৯ ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে এ ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোন প্রতিবাদ নেই। পুলিশ উপস্থিত থাকলেও ব্যবস্থা নেয়নি, আর প্রক্টর দাবা খেলায় ব্যস্ত ছিল। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে পাড়া-মহল্লায় প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া সমাবেশ থেকে ছয় দফা দাবি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ছয়দফা দাবিগুলো হলো অবিলম্বে ঢাবি প্রক্টরের অপসারণ, যৌন নিপীড়নকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, কর্তব্যরত পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার তদন্ত করে বিচার, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নীতিমালা এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সর্বক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ দুপুর ১২টায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন, আগামীকাল সারা দেশে বিক্ষোভ ও সংহতি সমাবেশ, ২০শে এপ্রিল সকাল ১১টায় অপরাজেয় বাংলা থেকে কার্জন হল পর্যন্ত মানববন্ধন, ২১শে এপ্রিল সকাল ১১টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি পেশ। এর মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় গতকালও উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস। দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এসব কর্মসূচি থেকে দায়িত্বে অবহেলা ও মিথ্যাচার করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এ এম আমজাদ ও পুলিশ সদস্যদের শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। এদিকে সিসি ক্যামরার ফুটেজে কয়েকজন দোষীকে শনাক্ত করা গেলেও পরিচয় না জানায় তাদের এখনও আটক করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল সকালে ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘প্রতিবাদ কার্টুন’ প্রদর্শন করে। টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। কার্টুনে নারী নির্যাতন বিরোধী বিভিন্ন চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। নারী উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্ল্লোগানসংবলিত ব্যানার-ফেস্টুনও প্রদর্শন করা হয়। পরে একই স্থানে মানববন্ধন করে ‘এঙ্গেজ ম্যান অ্যান্ড বয়েজ নেটওয়ার্ক’। তারা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ, ব্যথিত এবং লজ্জিত’ লেখা সম্বলিত ব্যানার নিয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন। বিকালে টিএসসির সামনের চত্বরে দোষীদের গেপ্তার এবং শাস্তির দাবিতে সমাবেশ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সংগঠনের সভাপতি গোলাম কুদ্দুসের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, হাসান আরিফ প্রমুখ। রামেন্দু মজুমদার বলেন, এমন লজ্জাজনক ঘটনার পর নিজেকে পুরুষ হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। গৌরবের জায়গাগুলোতে আজ কালিমা লিপ্ত হচ্ছে। এদেরকে পশু বললে পশুরাও লজ্জা পাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, অনেক সঙ্কট পার করতে পারলেও আমাদের রুচি, ভাবনা এবং চেতনায় পরিবর্তন আসেনি। পুলিশ প্রধান সর্বত্র শান্তি স্থাপনের কথা বলছেন। কিন্তু কোথায় শান্তি? এ বিষয়ে কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। আগের ঘটনাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা এগুলো উস্কে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস তার বক্তব্যে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। এই স্থানেই হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আবার একই স্থানেই নারীদের হয়রানি করা হয়েছে। সমাবেশ থেকে আগামী ২১শে এপ্রিল মানববন্ধন করার ঘোষণা দেন তিনি।
ছাত্রদলের কর্মসূচি: এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নববর্ষে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রলীগের অব্যহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রদল। গতকাল কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। দেশের সকল জেলা, মহানগর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে এ কর্মসূচি পালন করা হবে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পাশে (গোল চিহ্নত) পয়লা বৈশাখে যৌন হয়রানির ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা নিশাত ইমতিয়াজ বিজয়। |
একইভাবে ওই ঘটনায় নির্যাতিতাদের উদ্ধার করতে গিয়ে আহত ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি সভাপতি লিটন নন্দী অভিযোগ করেন, ঢাবির ভিসি ও প্রক্টর এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য ওই বস্ত্রহরণের ঘটনা আড়াল করতে চাইছেন। তিনি জানান, বস্ত্রহরণের ঘটনা তদন্ত শুরু হলে বিপাকে পড়েন ঘটনাস্থলের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা। একইভাবে ঢাবি এলাকায় এ ধরনের ঘটনায় সমালোচিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পুলিশ ও ঢাবি প্রশাসন নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য বস্ত্রহরণের বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) এম এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার জানান, বখাটেদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে ডিবিসহ পুলিশের কয়েকটি টিম কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।
‘প্রক্টর ও পুলিশ যৌন নিপীড়ক ও অপরাধীদের সহযোগী’
এদিকে ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত সংহতি সমাবেশে অংশ নিয়ে অধ্যাপক আনু মুহম্মদ বলেছেন, পুলিশ ও প্রক্টর নাকি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে শ্লীলতাহানির কোন কিছুই দেখেনি। তারা সত্য ও যৌন নিপীড়নকে অস্বীকার করেছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, তারা যৌন নিপীড়ক ও অপরাধীদের সহযোগী। যৌন সন্ত্রাসদের দেশের অসুস্থ রাজনীতি, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পৃষ্ঠপোষকতা করছে। মিথ্যা বলে তাদেরকে রক্ষায় ব্যস্ত হয়েছে। পুলিশের উপর ভরসা করে না থেকে উৎসবের দিন সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এসময় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এ ঘটনায় মুখে ও চোখে কুলুপ এঁটে ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সত্যকে ঢাকার চেষ্টা করবেন না। সঠিক দায়িত্ব পালন করতে না পারলে সরে দাঁড়ান নতুবা দুর্বৃত্তের সহযোগী হিসেবে সকলের কাছে আখ্যায়িত হবেন। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসান তারেকের সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তৃতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, সাংবাদিক কামাল লোহানী, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার, ঢাবি শাখার সভাপতি লিটন নন্দী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, যে কোন উৎসবে নারীরা বলতে পারবে না অবাঞ্ছিত হাত শরীরে আঘাত করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও দায়ভার কেউ নেয় না। পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তারা দায়িত্ব পালন করেনি। সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ঘৃণা উচ্চারণ করছি। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্র্থীরাই ৫২, ৬২, ৬৯ ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে এ ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোন প্রতিবাদ নেই। পুলিশ উপস্থিত থাকলেও ব্যবস্থা নেয়নি, আর প্রক্টর দাবা খেলায় ব্যস্ত ছিল। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে পাড়া-মহল্লায় প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া সমাবেশ থেকে ছয় দফা দাবি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ছয়দফা দাবিগুলো হলো অবিলম্বে ঢাবি প্রক্টরের অপসারণ, যৌন নিপীড়নকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, কর্তব্যরত পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার তদন্ত করে বিচার, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নীতিমালা এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সর্বক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ দুপুর ১২টায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন, আগামীকাল সারা দেশে বিক্ষোভ ও সংহতি সমাবেশ, ২০শে এপ্রিল সকাল ১১টায় অপরাজেয় বাংলা থেকে কার্জন হল পর্যন্ত মানববন্ধন, ২১শে এপ্রিল সকাল ১১টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি পেশ। এর মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় গতকালও উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস। দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এসব কর্মসূচি থেকে দায়িত্বে অবহেলা ও মিথ্যাচার করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এ এম আমজাদ ও পুলিশ সদস্যদের শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। এদিকে সিসি ক্যামরার ফুটেজে কয়েকজন দোষীকে শনাক্ত করা গেলেও পরিচয় না জানায় তাদের এখনও আটক করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল সকালে ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘প্রতিবাদ কার্টুন’ প্রদর্শন করে। টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। কার্টুনে নারী নির্যাতন বিরোধী বিভিন্ন চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। নারী উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্ল্লোগানসংবলিত ব্যানার-ফেস্টুনও প্রদর্শন করা হয়। পরে একই স্থানে মানববন্ধন করে ‘এঙ্গেজ ম্যান অ্যান্ড বয়েজ নেটওয়ার্ক’। তারা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ, ব্যথিত এবং লজ্জিত’ লেখা সম্বলিত ব্যানার নিয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন। বিকালে টিএসসির সামনের চত্বরে দোষীদের গেপ্তার এবং শাস্তির দাবিতে সমাবেশ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সংগঠনের সভাপতি গোলাম কুদ্দুসের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, হাসান আরিফ প্রমুখ। রামেন্দু মজুমদার বলেন, এমন লজ্জাজনক ঘটনার পর নিজেকে পুরুষ হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। গৌরবের জায়গাগুলোতে আজ কালিমা লিপ্ত হচ্ছে। এদেরকে পশু বললে পশুরাও লজ্জা পাবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, অনেক সঙ্কট পার করতে পারলেও আমাদের রুচি, ভাবনা এবং চেতনায় পরিবর্তন আসেনি। পুলিশ প্রধান সর্বত্র শান্তি স্থাপনের কথা বলছেন। কিন্তু কোথায় শান্তি? এ বিষয়ে কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। আগের ঘটনাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা এগুলো উস্কে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস তার বক্তব্যে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। এই স্থানেই হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আবার একই স্থানেই নারীদের হয়রানি করা হয়েছে। সমাবেশ থেকে আগামী ২১শে এপ্রিল মানববন্ধন করার ঘোষণা দেন তিনি।
ছাত্রদলের কর্মসূচি: এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নববর্ষে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রলীগের অব্যহত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রদল। গতকাল কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। দেশের সকল জেলা, মহানগর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে এ কর্মসূচি পালন করা হবে।
No comments