মন্তিয়েলের বিধবা বউ by গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
হোসে মন্তিয়েল যখন মারা গেল, একটা বিহিত হয়েছে সবাই এমন অনুভব করল শুধু তার বিধবা বউ ছাড়া; তবে সে যে আসলেই মারা গেছে এটা বিশ্বাস করতে শহরবাসীর কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে গেল। অনেকেই সন্দেহ করতে লাগল, গুমোট ঘরে মৃতদেহটা দেখার পর বালিশগুলো আর লিলেনের চাদরের সঙ্গে গাদাগাদি করে রাখা হলুদ কফিনের ভেতর, যেটার দুপাশ তরমুজের মতো গোলাকার। বেশ সুন্দর করে শেভ করা, গায়ে সাদা পোশাক, পেটেন্ট-চামড়ার বুট পায়ে এবং তাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল যে সে সময়ের মতো এত প্রাণবন্ত কখনোই মনে হয়নি তাকে। প্রতি রোববারের আটটার নৈশভোজে উপস্থিত হওয়া সেই একই দোন চেপে মন্তিয়েল, কেবল পার্থক্য এই যে ঘোড়া দাবড়ানোর চাবুকের পরিবর্তে তার হাতের ভেতর ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতিকৃতি। কফিনের ঢাকনায় পেরেক ঠোকা এবং পারিবারিক জাঁকাল সমাধিস্তম্ভের ভেতর কবরের দেয়াল ঘিরে ফেলার ঘটনাগুলো দেখে গোটা শহরবাসী বিশ্বাস করল যে, লোকটা মৃতের ভূমিকায় অভিনয় করছে না।
দাফনের পর, শুধু এই ব্যাপারটা তার বিধবা বউ ছাড়া অন্য সবার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো যে হোসে মন্তিয়েলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সবাই যখন ধারণা করছিল ওত পেতে থাকা কেউ পেছন থেকে তাকে গুলি করবে, তার বিধবা বউ নিশ্চিত ছিল যে তাকে বৃদ্ধাবস্থায় বিছানায় শুয়ে মরতে দেখবে, পাপ স্বীকার করার পর, কোনো যন্ত্রণাভোগ ছাড়াই, আধুনিক কালের কোনো সন্তের মতো। কিন্তু তার বর্ণনায় কিছু ভুল হয়েছিল। হোসে মন্তিয়েল মরেছে তার দোল-বিছানায়, ১৯৫১ সালে, আগস্টের ২ তারিখ বেলা দুইটার সময়, তার মৃত্যু হয়েছিল আক্রোশজনিত মূর্ছার ঘটনায়—যে ব্যাপারে চিকিৎসকের নিষেধ ছিল। তবে সে আশা করছিল সমস্ত শহর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেবে এবং সবাই এত ফুল আনবে যে আঁটবে না ঘরে। তবু কেবল তার নিজের দলের লোকেরা এবং সমধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভাইয়েরাই উপস্থিত থাকল এবং একমাত্র ফুলের ডালা তারা পেল পৌর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। তার ছেলে, জার্মানিতে তার বাণিজ্যদূতের পদ থেকে এবং তার দুই মেয়ে প্যারিস থেকে তিন পাতার টেলিগ্রাম পাঠাল। কেউ দেখলেই বুঝবে খসড়াটা লেখা হয়েছে দাঁড়ানোর ওপর, টেলিগ্রাফ অফিসের পর্যাপ্ত কালি ব্যবহার করে এবং ২০ ডলার মূল্যের শব্দসংখ্যা খুঁজে পাওয়ার আগে তাদের অনেকগুলো টেলিগ্রাম ফরম ছিঁড়তে হয়েছে। তাদের কেউই ফিরে আসার আশ্বাস দেয়নি। সেই রাতে, ৬২ বছর বয়সে সেই বালিশে অশ্রুপাত করতে করতে, যাতে শুয়ে শেষ বিশ্রাম নিয়েছিল লোকটা যে তাকে সুখী করতে চেয়েছে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ প্রথমবারের মতো অপমানবোধের স্বাদ বুঝতে পারল। ‘আমি চিরকালের মতো বন্দী করে রাখব নিজেকে’, সে ভাবল। ‘আমাকে যেন তারা হোসে মন্তিয়েলের সঙ্গে একই কফিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ দুনিয়া সম্পর্কে আমি আর বেশি কিছুই জানতে চাই না।’
সে ছিল আলাভোলা, দুর্বল নারী, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছে কুড়ি বছর বয়সে, চেয়েছে কেবল তাকেই যে ছিল তার পাণিপ্রার্থী, যার সঙ্গে কুড়ি ফিটের কম দূরত্ব থেকে দেখা করার অনুমতি ছিল তাদের। বাস্তবতার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ তার কখনোই ছিল না। তারা তার স্বামীর মৃতদেহ বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর, সে নিজের অশ্রুর ভেতর দিয়ে বুঝেছে তার নিজেকেও একই সঙ্গে টেনে নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তার নতুন জীবনকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেই অভিমুখ সে খুঁজে পেল না। তাকে শুরু করতে হলো একদম গোড়া থেকে।
অসংখ্য রহস্যের ভেতর হোসে মন্তিয়েলকে নিজের সঙ্গে কবরে নিয়ে যেতে হলো একটি ভারী সিন্দুক। মেয়র সমস্যাটির দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। তিনি সিন্দুকটাকে প্রাঙ্গণে রাখার নির্দেশ দিলেন, দেয়ালের বিপরীতে এবং দুজন পুলিশ তালা লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করল। সমস্ত সকাল ধরে মন্তিয়েলের বিধবা বউ শুনতে পাচ্ছিল ভারী অগ্নিবর্ষণের শব্দ এবং পর্যায়ক্রমিক নির্দেশ, যা চিৎকার করে করে বলে যাচ্ছিলেন মেয়র।
‘ওটা হলো শেষ খড়কুটো’, সে ভাবল। ‘ঈশ্বরের কাছে পাঁচ বছর ধরে প্রার্থনা করেছি যাতে গোলাগুলি শেষ হয়, আর এখন আমাকে তাদের ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে আমার বাড়িতে গোলাগুলির জন্য।’ সেদিন সে সমন্বিত চেষ্টা চালাল মৃত্যুকে ডাকার। কিন্তু কারও প্রত্যুত্তর পেল না। সে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করেছিল যখন একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ বাড়ির ভিত নাড়িয়ে দিল। ভারী সিন্দুকটাকে ভাঙতে তাদের ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটাতে হয়েছে।
মন্তিয়েলের বিধবা বউ সজোরে দীর্ঘশ্বাস টানল। অক্টোবর মাসটা ছিল বিলুয়া বৃষ্টিতে অন্তহীন, মন্তিয়েলের অগোছালো ও প্রকাণ্ড খামারবাড়িতে গন্তব্যহীনভাবে চলতে শুরু করে সে নিঃশেষিত বোধ করল। পরিবারের বয়োবৃদ্ধ এবং নিরলস বন্ধু কারমিকায়েল সাহেব ভূসম্পত্তির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অবশেষে সে যখন তার স্বামীর মৃত্যুর অকাট্য সত্যের মুখোমুখি হলো, মন্তিয়েলের বিধবা বউ বাড়ি দেখাশোনা করতে বেরিয়ে এল শোবার ঘর থেকে। সমস্ত সাজসজ্জা সে খুলে ফেলল, আসবাবপত্রগুলো ঢেকে দিল শোকের রঙে এবং দেয়ালে টাঙানো মৃত লোকটার প্রতিকৃতিতে অন্ত্যেষ্টির রিবন জুড়ে দিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দুমাস পর, সে ফিরে পেল তার নখ কামড়ানোর অভ্যাস। একদিন অতিরিক্ত কান্নায় তার দুচোখ লাল এবং উদ্বেল হলো যখন সে দেখল যে কারমিকায়েল সাহেব ছাতা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকছেন।
‘ছাতা বন্ধ করেন, কারমিকায়েল সাহেব’, সে তাকে বলল। ‘এত দুর্ভাগ্য পোহানোর পর, আপনার কাছে আমাদের এটাই চাইবার ছিল যে, আপনি ছাতা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকবেন।’
কারমিকায়েল সাহেব ছাতাটা এক কোনায় রাখলেন। তিনি ছিলেন এক বুড়ো কালো মানুষ—উজ্জ্বল ত্বক, সাদা জামা গায়ে এবং বুড়ো আঙুলের গিঁটের ফুলে ওঠা গেঁজে যাতে চাপ না লাগে তাই চাকু দিয়ে জুতোটা চেরা।
‘শুকিয়ে যাওয়ার সময়ই শুধু এইটা হয়।’
তার স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম মন্তিয়েলের বিধবা বউ জানালা খুলল। এত দুর্দশা, তার ওপর এই শীতকাল, সে বিড়বিড় করল, তার নখ কামড়াতে কামড়াতে। ‘মনে হচ্ছে, কখনোই আর পরিষ্কার হবে না।’
‘আইজ কিংবা কালকের মধ্যে হইতেছে না’, নির্বাহী লোকটি বললেন। ‘গত রাইতে আমার পায়ের গেঁজ আমাকে ঘুমাইতে দেয় নাই।’
কারমিকায়েল সাহেবের গেঁজের বায়ুমণ্ডলীয় ভবিষ্যদ্বাণীকে সে বিশ্বাস করে। নিবিড়ভাবে সে দেখল জনহীন চত্বরটাকে, নিশ্চুপ বাড়িগুলোকে যার কোনো দরজাই খোলা হয়নি হোসে মন্তিয়েলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সাক্ষ্য হিসেবে, অতঃপর হতাশবোধ করল সে, তার নখগুলো নিয়ে, অপরিসীম জমিজমা নিয়ে, এবং অনন্তসংখ্যক বাধ্যবাধকতা নিয়ে যা সে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিল তার স্বামীর কাছ থেকে এবং যেসব কিছুকে সে কখনোই বুঝে উঠতে পারবে না।
‘এ জগতের সবটাই ভুল’, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল সে।
সেই দিনগুলোতে যারা তাকে দেখেছে তাদের এমন ভাবার কারণ ছিল যে, সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু তখনকার চেয়ে অত প্রাঞ্জল সে কখনোই ছিল না। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার আগে থেকে অক্টোবরের বিষণ্ণ² সকালগুলোতে সে তার ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছে, মৃতদের প্রতি সমবেদনা নিয়ে এবং এই চিন্তা করে যে ঈশ্বর যদি রোববারে বিশ্রাম না নিতেন জগৎটাকে তিনি ঠিকঠাকমতো তৈরি করে উঠতে পারতেন।
সেই দিনটাকে তিনি ব্যবহার করতে পারতেন কিছু শিথিল লক্ষ্যকে ভালো করে বেঁধেছেঁদে নেওয়ার কাজে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ এমনটাই বলত। সর্বোপরি, ঈশ্বরের তো অনন্তকালের সবটা ছিলই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।
তার স্বামীর মৃত্যুর পর, যে একমাত্র পার্থক্যটা ঘটেছে তা হলো এরপর তার অকাট্য কারণ ছিল এমন তমসাবৃত ভাবনায় নোঙর করার।
এভাবে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ যখন নিজেকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলল, কারমিকায়েল সাহেব জাহাজডুবি আটকানোর চেষ্টা করলেন। কিছুই ভালো যাচ্ছিল না। হোসে মন্তিয়েল যে সন্ত্রাসের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিল, সেই হুমকি আর না থাকায় শহরবাসী প্রতিশোধ নিয়ে যাচ্ছিল। কখনো না আসা গ্রাহকের অপেক্ষা করতে করতে প্রাঙ্গণে সার করে রাখা জগের দুধ টক হয়ে গেল, এবং চাকের মধু চাকেই নষ্ট হলো, এবং পনির বানানোর ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পোকা জন্মে স্ফীত হয়ে উঠল পনির। বৈদ্যুতিক আলোর বাতি এবং নকল-মার্বেলের দেবদূতখচিত সমাধিসৌধের ভেতর থেকে হোসে মন্তিয়েল ছয় বছরের হত্যা ও জবরদস্তির মূল্য দিয়ে যাচ্ছিল। দেশের ইতিহাসে কেউই এত অল্প সময়ে এত ধনসম্পদ অর্জন করেনি। একনায়কতন্ত্রের সময়ের প্রথম মেয়র যখন শহরে এলেন, তখন হোসে মন্তিয়েল ছিল সব সরকারের আমলের সতর্ক দলীয় কর্মী, যে তার জীবনের অর্ধেক সময় নিজের অন্তর্বাসের ভেতর কাটিয়েছে তার চালকলের সামনে বসে থেকে। একটা সময় সে সুখী মানুষ ও একজন বিশ্বাসী হিসেবে বিশেষ সুখ্যাতি উপভোগ করেছিল, কারণ সে প্রকাশ্যে জোরেশোরে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যদি সে লটারি জেতে একটা মানুষ-সমান আকারের সেন্ট জোসেফের মূর্তি গির্জায় দেবে, এবং সপ্তাহ দুয়েক পর সে মোটা অঙ্কের পুরস্কার জিতে যায় এবং তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। প্রথমবারের মতো সে জুতা পরে, যখন নিষ্ঠুর নতুন মেয়র যিনি ভেতরে ভেতরে পুলিশ সার্জেন্টদের হাতে রাখেন, প্রতিপক্ষকে দমন করার ত্বরিত আদেশ নিয়ে এলেন। হোসে মন্তিয়েল তার বিশ্বস্ত গুপ্তচর হিসেবে কাজ শুরু করল। সেই আদর্শ ব্যবসায়ী, তার শত্রুদের ধনী ও গরিবে পৃথক করতে যার মোটা মানুষের মেজাজে এতটুকুও অস্বস্তি জাগেনি। পাবলিক স্কয়ারে পুলিশ গরিব লোকগুলোকে গুলি করল। ধনী লোকদের শহর ছেড়ে চলে যেতে ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো। গণহত্যার পরিকল্পনা করে হোসে মন্তিয়েল মেয়রের সঙ্গে তার শ্বাসরোধী অফিস কক্ষে একসঙ্গে আটকা থাকল দিনগুলো শেষ হওয়া অব্দি, যখন তার স্ত্রী মৃতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে যাচ্ছিল। মেয়র অফিস ছেড়ে যখন চলে যাবে, সে তার স্বামীর পথ আটকাবে।
‘ওই লোকটা একটা খুনি’, সে তাকে বলবে। ‘সরকারের ওপর তোমার প্রভাবকে তুমি ব্যবহার করো যাতে তারা ওই পশুটাকে তাড়াতে পারে; শহরের কোনো মানুষকেই সে জীবিত রাখবে না।’
আর হোসে মন্তিয়েল, কত ব্যস্ত সেই দিনগুলোতে, তার দিকে না তাকিয়েই তাকে পাশে সরিয়ে দিয়েছে, এ কথা বলতে বলতে, ‘এ রকম বোকামি কোরো না।’ প্রকৃত প্রস্তাবে গরিবদের হত্যা করাটা তার কাজ ছিল না, তার কাজটা ছিল বরং শহর থেকে ধনীদের বিতাড়ন করা। মেয়র তাদের দরজাগুলোতে গুলিবর্ষণ করে ঝাঁঝরি বানিয়ে ফেলার পর এবং যখন তাদের শহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হলো হোসে মন্তিয়েল তাদের জমিজমা ও গবাদিপশুগুলো তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল এমন দামে যে দাম সে নিজেই নির্ধারণ করেছিল।
‘মূর্খতা কোরো না’, তার স্ত্রী তাকে বলল। ‘তুমি তোমারই সর্বনাশ করছে তাদের সাহায্য করতে গিয়ে, যাতে তারা অন্যত্র গিয়ে অনাহারে না মরে, আর তারা কখনোই তোমাকে ধন্যবাদ জানাবে না।’
এবং হোসে মন্তিয়েল যার এখন হাসারও সময় নেই, তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগল, ‘তুমি তোমার রান্নাঘরে যাও, আমাকে এত জ্বালাতন কোরো না।’
এভাবে এক বছরের কম সময়ে বিরোধী দল পদানত হয়ে পড়ল এবং হোসে মন্তিয়েল হয়ে উঠল শহরের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি। সে তার কন্যাদের পাঠাল প্যারিসে। পুত্রের জন্য জার্মানিতে বাণিজ্যদূতের একটা পদ জোগাড় করল এবং নিজেকে তার সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করার কাজে নিয়োজিত করল। কিন্তু সে তার অঢেল সম্পত্তি উপভোগের জন্য এমনকি ছয়টি বছর সময়ও বেঁচে থাকতে পারল না।
তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর পর, মন্তিয়েলের বিধবা বউ সিঁড়িতে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ শুনছিল কেবলই খারাপ খবর আসার। সব সময় গোধূলিতে কেউ আসে। ‘আবারও দস্যুরা’, তারা বলত। ‘গতকাল ওরা ৫০টি বকনা বাছুরের একটি দলকে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।’ তার দোলনার ভেতর স্থির হয়ে বসে থেকে, নখ কামড়ে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ তার অপমানবোধকেই হজম করেছে।
‘হোসে মন্তিয়েল, আমি তোমাকে বলেছিলাম’, নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে বলেছিল। ‘এটা একটা অকৃতজ্ঞ শহর। কবরে তোমার শরীর এখনো উষ্ণ অথচ জগৎ তোমার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
বাড়িতে ফিরে এল না কেউই। এই বৃষ্টিশূন্য অন্তহীন মাসগুলোতে একমাত্র যে মানবসত্তাকে সে দেখেছে তিনি হলেন অনলস কারমিকায়েল সাহেব, ছাতা বন্ধ করে যিনি কখনোই বাড়িতে ঢুকতেন না। অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। কারমিকায়েল সাহেব মন্তিয়েলের ছেলেকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছেন। তিনি তাকে সমঝোতার অগ্রভাগে থাকা এবং বিধবার কল্যাণ-সম্পর্কিত বিবেচনার অনুমতি থাকার সুবিধার ব্যাপারগুলো ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি সব সময়ই ছলনাপূর্ণ জবাব পেতেন। অবশেষে, হোসে মন্তিয়েলের ছেলে খোলাখুলিভাবে জানাল যে, সে ফিরতে চায় না এই ভয়ে যে তাকে গুলি করে হত্যা করা হতে পারে। কাজেই, কারমিকায়েল সাহেব বিধবার ঘরে গেলেন এমন স্বীকারোক্তি করতে যে তিনি তাকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন।
‘ভালো’, সে বলল। ‘আমি আছি পনির আর মাছির মুকুট যতক্ষণ আছে। যদি আপনি চান, চলে যান শিগগির আর আমাকে শান্তিতে মরতে দেন।’
তখন থেকে জগতের সঙ্গে তার একমাত্র সংযোগ হবে কিছু চিঠিপত্র, যেগুলো মাসের শেষে সে তার মেয়েকে লিখবে। ‘এটা একটা অভিশপ্ত শহর’, সে বলবে। ‘চিরদিন ওখানে থাকো আর আমার জন্য দুঃখ কোরো না। তোমরা সুখে আছ জেনেই আমি সুখী।’ তার মেয়েরা ছাড়া ছাড়াভাবে উত্তর দেবে। তাদের চিঠিগুলো সব সময় সুখী এবং সে বুঝতে পারত সেগুলো লেখা হয়েছে কোনো উষ্ণ আর খুব উদ্ভাসিত কোনো স্থানে এবং মেয়েরা যখন তাদের ভাবনা থামাত নিজেদের দেখতে পেত অনেকগুলো আয়নার ভেতর পুনরাবৃত্ত হতে। তাদের কেউই ফিরে আসতে রাজি হলো না। ‘এখানে রয়েছে সভ্যতা’, তারা বলবে। ‘তা ছাড়া ওখানে আমাদের জন্য কোনো ভালো উপায়ও নেই। এমন একটা অসভ্য দেশে বাস করা অসম্ভব, যেখানে রাজনীতির প্রশ্নে মানুষ হত্যা করা হয়।’ চিঠিগুলো পড়ে মন্তিয়েলের বিধবা বউ ভালো বোধ করবে এবং মাথার ভেতর এর প্রতিটি বাক্যকে সমর্থন করবে।
কোনো এক উপলক্ষে, তার মেয়েরা প্যারিসের মাংসের বাজারে কথা বললে দোকানিরা তাদের বলবে যে, ফ্যাকাশে লাল শূকর জবাই করা হয়েছে এবং পুরোটাই ঝোলানো আছে ফুলের মালা আর মুকুটশোভিত দরজায়। শেষে তার মেয়েদের তরফ থেকে পৃথক একটি চিঠি যুক্ত হবে: ‘ভাবো তো, তারা সবচেয়ে বড় আর সুন্দর কার্নেশনটা রেখেছে শুয়োরের গোয়ার ভেতর।’ বাক্যটা পড়ে দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম মন্তিয়েলের বিধবা বউ হাসল। সে তার শোবার ঘরে ঢুকল বাড়ির আলো না নিভিয়েই এবং শুয়ে পড়ার আগে বৈদ্যুতিক শীতপাখাটা ঘুরিয়ে দিল দেয়ালের দিকে। তারপর রাত্রির টেবিলের দেরাজ থেকে কিছু কাঁচি, ব্যান্ডেজ সরঞ্জামের পাত্র এবং একটি জপমালা নিল; সে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখে ব্যান্ডেজ বাঁধল, কামড়ানোর কারণে যাতে জ্বালাপোড়া করছিল। তারপর প্রার্থনা শুরু করল, তবে দ্বিতীয় রহস্যটি ছিল এই যে, সে জপমালাটি রেখেছিল তার বাম হাতে, কেননা ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে জপমালার গুটিগুলোকে সে অনুভব করতে পারছিল না। এক মুহূর্তের জন্য দূরাগত মেঘগর্জনের কম্পন শুনতে পেল সে। তারপর তার মাথা বুকের দিকে আনত করে ঘুমিয়ে পড়ল। জপমালাসহ তার হাতটি পড়ে থাকল পাশে, তারপর সে প্রাঙ্গণে দেখতে পেল বড় মাকে, কোলের ওপর একটা সাদা চাদর আর একটি চিরুনিসহ, বুড়ো আঙুলে চাপ দিয়ে উকুন মারছেন। সে তাকে জিগ্যেস করল:
‘আমি কখন মরব?’
বড় মা তার মাথা তুললেন।
‘যখন তোমার বাহুতে ক্লান্তি শুরু হবে।’
গল্পটি অনূদিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে হার্পার পেরেনিয়াল প্রকাশিত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কালেক্টেড স্টোরিজ থেকে। বইটি এসপানিওল থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন গ্রেগরি রাবাসা ও জে এস বার্নস্টেইন।
দাফনের পর, শুধু এই ব্যাপারটা তার বিধবা বউ ছাড়া অন্য সবার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো যে হোসে মন্তিয়েলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সবাই যখন ধারণা করছিল ওত পেতে থাকা কেউ পেছন থেকে তাকে গুলি করবে, তার বিধবা বউ নিশ্চিত ছিল যে তাকে বৃদ্ধাবস্থায় বিছানায় শুয়ে মরতে দেখবে, পাপ স্বীকার করার পর, কোনো যন্ত্রণাভোগ ছাড়াই, আধুনিক কালের কোনো সন্তের মতো। কিন্তু তার বর্ণনায় কিছু ভুল হয়েছিল। হোসে মন্তিয়েল মরেছে তার দোল-বিছানায়, ১৯৫১ সালে, আগস্টের ২ তারিখ বেলা দুইটার সময়, তার মৃত্যু হয়েছিল আক্রোশজনিত মূর্ছার ঘটনায়—যে ব্যাপারে চিকিৎসকের নিষেধ ছিল। তবে সে আশা করছিল সমস্ত শহর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেবে এবং সবাই এত ফুল আনবে যে আঁটবে না ঘরে। তবু কেবল তার নিজের দলের লোকেরা এবং সমধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভাইয়েরাই উপস্থিত থাকল এবং একমাত্র ফুলের ডালা তারা পেল পৌর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। তার ছেলে, জার্মানিতে তার বাণিজ্যদূতের পদ থেকে এবং তার দুই মেয়ে প্যারিস থেকে তিন পাতার টেলিগ্রাম পাঠাল। কেউ দেখলেই বুঝবে খসড়াটা লেখা হয়েছে দাঁড়ানোর ওপর, টেলিগ্রাফ অফিসের পর্যাপ্ত কালি ব্যবহার করে এবং ২০ ডলার মূল্যের শব্দসংখ্যা খুঁজে পাওয়ার আগে তাদের অনেকগুলো টেলিগ্রাম ফরম ছিঁড়তে হয়েছে। তাদের কেউই ফিরে আসার আশ্বাস দেয়নি। সেই রাতে, ৬২ বছর বয়সে সেই বালিশে অশ্রুপাত করতে করতে, যাতে শুয়ে শেষ বিশ্রাম নিয়েছিল লোকটা যে তাকে সুখী করতে চেয়েছে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ প্রথমবারের মতো অপমানবোধের স্বাদ বুঝতে পারল। ‘আমি চিরকালের মতো বন্দী করে রাখব নিজেকে’, সে ভাবল। ‘আমাকে যেন তারা হোসে মন্তিয়েলের সঙ্গে একই কফিনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ দুনিয়া সম্পর্কে আমি আর বেশি কিছুই জানতে চাই না।’
সে ছিল আলাভোলা, দুর্বল নারী, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছে কুড়ি বছর বয়সে, চেয়েছে কেবল তাকেই যে ছিল তার পাণিপ্রার্থী, যার সঙ্গে কুড়ি ফিটের কম দূরত্ব থেকে দেখা করার অনুমতি ছিল তাদের। বাস্তবতার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ তার কখনোই ছিল না। তারা তার স্বামীর মৃতদেহ বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর, সে নিজের অশ্রুর ভেতর দিয়ে বুঝেছে তার নিজেকেও একই সঙ্গে টেনে নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তার নতুন জীবনকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেই অভিমুখ সে খুঁজে পেল না। তাকে শুরু করতে হলো একদম গোড়া থেকে।
অসংখ্য রহস্যের ভেতর হোসে মন্তিয়েলকে নিজের সঙ্গে কবরে নিয়ে যেতে হলো একটি ভারী সিন্দুক। মেয়র সমস্যাটির দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। তিনি সিন্দুকটাকে প্রাঙ্গণে রাখার নির্দেশ দিলেন, দেয়ালের বিপরীতে এবং দুজন পুলিশ তালা লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করল। সমস্ত সকাল ধরে মন্তিয়েলের বিধবা বউ শুনতে পাচ্ছিল ভারী অগ্নিবর্ষণের শব্দ এবং পর্যায়ক্রমিক নির্দেশ, যা চিৎকার করে করে বলে যাচ্ছিলেন মেয়র।
‘ওটা হলো শেষ খড়কুটো’, সে ভাবল। ‘ঈশ্বরের কাছে পাঁচ বছর ধরে প্রার্থনা করেছি যাতে গোলাগুলি শেষ হয়, আর এখন আমাকে তাদের ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে আমার বাড়িতে গোলাগুলির জন্য।’ সেদিন সে সমন্বিত চেষ্টা চালাল মৃত্যুকে ডাকার। কিন্তু কারও প্রত্যুত্তর পেল না। সে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করেছিল যখন একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ বাড়ির ভিত নাড়িয়ে দিল। ভারী সিন্দুকটাকে ভাঙতে তাদের ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটাতে হয়েছে।
মন্তিয়েলের বিধবা বউ সজোরে দীর্ঘশ্বাস টানল। অক্টোবর মাসটা ছিল বিলুয়া বৃষ্টিতে অন্তহীন, মন্তিয়েলের অগোছালো ও প্রকাণ্ড খামারবাড়িতে গন্তব্যহীনভাবে চলতে শুরু করে সে নিঃশেষিত বোধ করল। পরিবারের বয়োবৃদ্ধ এবং নিরলস বন্ধু কারমিকায়েল সাহেব ভূসম্পত্তির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অবশেষে সে যখন তার স্বামীর মৃত্যুর অকাট্য সত্যের মুখোমুখি হলো, মন্তিয়েলের বিধবা বউ বাড়ি দেখাশোনা করতে বেরিয়ে এল শোবার ঘর থেকে। সমস্ত সাজসজ্জা সে খুলে ফেলল, আসবাবপত্রগুলো ঢেকে দিল শোকের রঙে এবং দেয়ালে টাঙানো মৃত লোকটার প্রতিকৃতিতে অন্ত্যেষ্টির রিবন জুড়ে দিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দুমাস পর, সে ফিরে পেল তার নখ কামড়ানোর অভ্যাস। একদিন অতিরিক্ত কান্নায় তার দুচোখ লাল এবং উদ্বেল হলো যখন সে দেখল যে কারমিকায়েল সাহেব ছাতা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকছেন।
‘ছাতা বন্ধ করেন, কারমিকায়েল সাহেব’, সে তাকে বলল। ‘এত দুর্ভাগ্য পোহানোর পর, আপনার কাছে আমাদের এটাই চাইবার ছিল যে, আপনি ছাতা খুলে বাড়ির ভেতর ঢুকবেন।’
কারমিকায়েল সাহেব ছাতাটা এক কোনায় রাখলেন। তিনি ছিলেন এক বুড়ো কালো মানুষ—উজ্জ্বল ত্বক, সাদা জামা গায়ে এবং বুড়ো আঙুলের গিঁটের ফুলে ওঠা গেঁজে যাতে চাপ না লাগে তাই চাকু দিয়ে জুতোটা চেরা।
‘শুকিয়ে যাওয়ার সময়ই শুধু এইটা হয়।’
তার স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম মন্তিয়েলের বিধবা বউ জানালা খুলল। এত দুর্দশা, তার ওপর এই শীতকাল, সে বিড়বিড় করল, তার নখ কামড়াতে কামড়াতে। ‘মনে হচ্ছে, কখনোই আর পরিষ্কার হবে না।’
‘আইজ কিংবা কালকের মধ্যে হইতেছে না’, নির্বাহী লোকটি বললেন। ‘গত রাইতে আমার পায়ের গেঁজ আমাকে ঘুমাইতে দেয় নাই।’
কারমিকায়েল সাহেবের গেঁজের বায়ুমণ্ডলীয় ভবিষ্যদ্বাণীকে সে বিশ্বাস করে। নিবিড়ভাবে সে দেখল জনহীন চত্বরটাকে, নিশ্চুপ বাড়িগুলোকে যার কোনো দরজাই খোলা হয়নি হোসে মন্তিয়েলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সাক্ষ্য হিসেবে, অতঃপর হতাশবোধ করল সে, তার নখগুলো নিয়ে, অপরিসীম জমিজমা নিয়ে, এবং অনন্তসংখ্যক বাধ্যবাধকতা নিয়ে যা সে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিল তার স্বামীর কাছ থেকে এবং যেসব কিছুকে সে কখনোই বুঝে উঠতে পারবে না।
‘এ জগতের সবটাই ভুল’, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল সে।
সেই দিনগুলোতে যারা তাকে দেখেছে তাদের এমন ভাবার কারণ ছিল যে, সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু তখনকার চেয়ে অত প্রাঞ্জল সে কখনোই ছিল না। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার আগে থেকে অক্টোবরের বিষণ্ণ² সকালগুলোতে সে তার ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছে, মৃতদের প্রতি সমবেদনা নিয়ে এবং এই চিন্তা করে যে ঈশ্বর যদি রোববারে বিশ্রাম না নিতেন জগৎটাকে তিনি ঠিকঠাকমতো তৈরি করে উঠতে পারতেন।
সেই দিনটাকে তিনি ব্যবহার করতে পারতেন কিছু শিথিল লক্ষ্যকে ভালো করে বেঁধেছেঁদে নেওয়ার কাজে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ এমনটাই বলত। সর্বোপরি, ঈশ্বরের তো অনন্তকালের সবটা ছিলই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।
তার স্বামীর মৃত্যুর পর, যে একমাত্র পার্থক্যটা ঘটেছে তা হলো এরপর তার অকাট্য কারণ ছিল এমন তমসাবৃত ভাবনায় নোঙর করার।
এভাবে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ যখন নিজেকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলল, কারমিকায়েল সাহেব জাহাজডুবি আটকানোর চেষ্টা করলেন। কিছুই ভালো যাচ্ছিল না। হোসে মন্তিয়েল যে সন্ত্রাসের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিল, সেই হুমকি আর না থাকায় শহরবাসী প্রতিশোধ নিয়ে যাচ্ছিল। কখনো না আসা গ্রাহকের অপেক্ষা করতে করতে প্রাঙ্গণে সার করে রাখা জগের দুধ টক হয়ে গেল, এবং চাকের মধু চাকেই নষ্ট হলো, এবং পনির বানানোর ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পোকা জন্মে স্ফীত হয়ে উঠল পনির। বৈদ্যুতিক আলোর বাতি এবং নকল-মার্বেলের দেবদূতখচিত সমাধিসৌধের ভেতর থেকে হোসে মন্তিয়েল ছয় বছরের হত্যা ও জবরদস্তির মূল্য দিয়ে যাচ্ছিল। দেশের ইতিহাসে কেউই এত অল্প সময়ে এত ধনসম্পদ অর্জন করেনি। একনায়কতন্ত্রের সময়ের প্রথম মেয়র যখন শহরে এলেন, তখন হোসে মন্তিয়েল ছিল সব সরকারের আমলের সতর্ক দলীয় কর্মী, যে তার জীবনের অর্ধেক সময় নিজের অন্তর্বাসের ভেতর কাটিয়েছে তার চালকলের সামনে বসে থেকে। একটা সময় সে সুখী মানুষ ও একজন বিশ্বাসী হিসেবে বিশেষ সুখ্যাতি উপভোগ করেছিল, কারণ সে প্রকাশ্যে জোরেশোরে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যদি সে লটারি জেতে একটা মানুষ-সমান আকারের সেন্ট জোসেফের মূর্তি গির্জায় দেবে, এবং সপ্তাহ দুয়েক পর সে মোটা অঙ্কের পুরস্কার জিতে যায় এবং তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। প্রথমবারের মতো সে জুতা পরে, যখন নিষ্ঠুর নতুন মেয়র যিনি ভেতরে ভেতরে পুলিশ সার্জেন্টদের হাতে রাখেন, প্রতিপক্ষকে দমন করার ত্বরিত আদেশ নিয়ে এলেন। হোসে মন্তিয়েল তার বিশ্বস্ত গুপ্তচর হিসেবে কাজ শুরু করল। সেই আদর্শ ব্যবসায়ী, তার শত্রুদের ধনী ও গরিবে পৃথক করতে যার মোটা মানুষের মেজাজে এতটুকুও অস্বস্তি জাগেনি। পাবলিক স্কয়ারে পুলিশ গরিব লোকগুলোকে গুলি করল। ধনী লোকদের শহর ছেড়ে চলে যেতে ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো। গণহত্যার পরিকল্পনা করে হোসে মন্তিয়েল মেয়রের সঙ্গে তার শ্বাসরোধী অফিস কক্ষে একসঙ্গে আটকা থাকল দিনগুলো শেষ হওয়া অব্দি, যখন তার স্ত্রী মৃতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে যাচ্ছিল। মেয়র অফিস ছেড়ে যখন চলে যাবে, সে তার স্বামীর পথ আটকাবে।
‘ওই লোকটা একটা খুনি’, সে তাকে বলবে। ‘সরকারের ওপর তোমার প্রভাবকে তুমি ব্যবহার করো যাতে তারা ওই পশুটাকে তাড়াতে পারে; শহরের কোনো মানুষকেই সে জীবিত রাখবে না।’
আর হোসে মন্তিয়েল, কত ব্যস্ত সেই দিনগুলোতে, তার দিকে না তাকিয়েই তাকে পাশে সরিয়ে দিয়েছে, এ কথা বলতে বলতে, ‘এ রকম বোকামি কোরো না।’ প্রকৃত প্রস্তাবে গরিবদের হত্যা করাটা তার কাজ ছিল না, তার কাজটা ছিল বরং শহর থেকে ধনীদের বিতাড়ন করা। মেয়র তাদের দরজাগুলোতে গুলিবর্ষণ করে ঝাঁঝরি বানিয়ে ফেলার পর এবং যখন তাদের শহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হলো হোসে মন্তিয়েল তাদের জমিজমা ও গবাদিপশুগুলো তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল এমন দামে যে দাম সে নিজেই নির্ধারণ করেছিল।
‘মূর্খতা কোরো না’, তার স্ত্রী তাকে বলল। ‘তুমি তোমারই সর্বনাশ করছে তাদের সাহায্য করতে গিয়ে, যাতে তারা অন্যত্র গিয়ে অনাহারে না মরে, আর তারা কখনোই তোমাকে ধন্যবাদ জানাবে না।’
এবং হোসে মন্তিয়েল যার এখন হাসারও সময় নেই, তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগল, ‘তুমি তোমার রান্নাঘরে যাও, আমাকে এত জ্বালাতন কোরো না।’
এভাবে এক বছরের কম সময়ে বিরোধী দল পদানত হয়ে পড়ল এবং হোসে মন্তিয়েল হয়ে উঠল শহরের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি। সে তার কন্যাদের পাঠাল প্যারিসে। পুত্রের জন্য জার্মানিতে বাণিজ্যদূতের একটা পদ জোগাড় করল এবং নিজেকে তার সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করার কাজে নিয়োজিত করল। কিন্তু সে তার অঢেল সম্পত্তি উপভোগের জন্য এমনকি ছয়টি বছর সময়ও বেঁচে থাকতে পারল না।
তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর পর, মন্তিয়েলের বিধবা বউ সিঁড়িতে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ শুনছিল কেবলই খারাপ খবর আসার। সব সময় গোধূলিতে কেউ আসে। ‘আবারও দস্যুরা’, তারা বলত। ‘গতকাল ওরা ৫০টি বকনা বাছুরের একটি দলকে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।’ তার দোলনার ভেতর স্থির হয়ে বসে থেকে, নখ কামড়ে, মন্তিয়েলের বিধবা বউ তার অপমানবোধকেই হজম করেছে।
‘হোসে মন্তিয়েল, আমি তোমাকে বলেছিলাম’, নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে বলেছিল। ‘এটা একটা অকৃতজ্ঞ শহর। কবরে তোমার শরীর এখনো উষ্ণ অথচ জগৎ তোমার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
বাড়িতে ফিরে এল না কেউই। এই বৃষ্টিশূন্য অন্তহীন মাসগুলোতে একমাত্র যে মানবসত্তাকে সে দেখেছে তিনি হলেন অনলস কারমিকায়েল সাহেব, ছাতা বন্ধ করে যিনি কখনোই বাড়িতে ঢুকতেন না। অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। কারমিকায়েল সাহেব মন্তিয়েলের ছেলেকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছেন। তিনি তাকে সমঝোতার অগ্রভাগে থাকা এবং বিধবার কল্যাণ-সম্পর্কিত বিবেচনার অনুমতি থাকার সুবিধার ব্যাপারগুলো ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি সব সময়ই ছলনাপূর্ণ জবাব পেতেন। অবশেষে, হোসে মন্তিয়েলের ছেলে খোলাখুলিভাবে জানাল যে, সে ফিরতে চায় না এই ভয়ে যে তাকে গুলি করে হত্যা করা হতে পারে। কাজেই, কারমিকায়েল সাহেব বিধবার ঘরে গেলেন এমন স্বীকারোক্তি করতে যে তিনি তাকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন।
‘ভালো’, সে বলল। ‘আমি আছি পনির আর মাছির মুকুট যতক্ষণ আছে। যদি আপনি চান, চলে যান শিগগির আর আমাকে শান্তিতে মরতে দেন।’
তখন থেকে জগতের সঙ্গে তার একমাত্র সংযোগ হবে কিছু চিঠিপত্র, যেগুলো মাসের শেষে সে তার মেয়েকে লিখবে। ‘এটা একটা অভিশপ্ত শহর’, সে বলবে। ‘চিরদিন ওখানে থাকো আর আমার জন্য দুঃখ কোরো না। তোমরা সুখে আছ জেনেই আমি সুখী।’ তার মেয়েরা ছাড়া ছাড়াভাবে উত্তর দেবে। তাদের চিঠিগুলো সব সময় সুখী এবং সে বুঝতে পারত সেগুলো লেখা হয়েছে কোনো উষ্ণ আর খুব উদ্ভাসিত কোনো স্থানে এবং মেয়েরা যখন তাদের ভাবনা থামাত নিজেদের দেখতে পেত অনেকগুলো আয়নার ভেতর পুনরাবৃত্ত হতে। তাদের কেউই ফিরে আসতে রাজি হলো না। ‘এখানে রয়েছে সভ্যতা’, তারা বলবে। ‘তা ছাড়া ওখানে আমাদের জন্য কোনো ভালো উপায়ও নেই। এমন একটা অসভ্য দেশে বাস করা অসম্ভব, যেখানে রাজনীতির প্রশ্নে মানুষ হত্যা করা হয়।’ চিঠিগুলো পড়ে মন্তিয়েলের বিধবা বউ ভালো বোধ করবে এবং মাথার ভেতর এর প্রতিটি বাক্যকে সমর্থন করবে।
কোনো এক উপলক্ষে, তার মেয়েরা প্যারিসের মাংসের বাজারে কথা বললে দোকানিরা তাদের বলবে যে, ফ্যাকাশে লাল শূকর জবাই করা হয়েছে এবং পুরোটাই ঝোলানো আছে ফুলের মালা আর মুকুটশোভিত দরজায়। শেষে তার মেয়েদের তরফ থেকে পৃথক একটি চিঠি যুক্ত হবে: ‘ভাবো তো, তারা সবচেয়ে বড় আর সুন্দর কার্নেশনটা রেখেছে শুয়োরের গোয়ার ভেতর।’ বাক্যটা পড়ে দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম মন্তিয়েলের বিধবা বউ হাসল। সে তার শোবার ঘরে ঢুকল বাড়ির আলো না নিভিয়েই এবং শুয়ে পড়ার আগে বৈদ্যুতিক শীতপাখাটা ঘুরিয়ে দিল দেয়ালের দিকে। তারপর রাত্রির টেবিলের দেরাজ থেকে কিছু কাঁচি, ব্যান্ডেজ সরঞ্জামের পাত্র এবং একটি জপমালা নিল; সে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখে ব্যান্ডেজ বাঁধল, কামড়ানোর কারণে যাতে জ্বালাপোড়া করছিল। তারপর প্রার্থনা শুরু করল, তবে দ্বিতীয় রহস্যটি ছিল এই যে, সে জপমালাটি রেখেছিল তার বাম হাতে, কেননা ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে জপমালার গুটিগুলোকে সে অনুভব করতে পারছিল না। এক মুহূর্তের জন্য দূরাগত মেঘগর্জনের কম্পন শুনতে পেল সে। তারপর তার মাথা বুকের দিকে আনত করে ঘুমিয়ে পড়ল। জপমালাসহ তার হাতটি পড়ে থাকল পাশে, তারপর সে প্রাঙ্গণে দেখতে পেল বড় মাকে, কোলের ওপর একটা সাদা চাদর আর একটি চিরুনিসহ, বুড়ো আঙুলে চাপ দিয়ে উকুন মারছেন। সে তাকে জিগ্যেস করল:
‘আমি কখন মরব?’
বড় মা তার মাথা তুললেন।
‘যখন তোমার বাহুতে ক্লান্তি শুরু হবে।’
গল্পটি অনূদিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে হার্পার পেরেনিয়াল প্রকাশিত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কালেক্টেড স্টোরিজ থেকে। বইটি এসপানিওল থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন গ্রেগরি রাবাসা ও জে এস বার্নস্টেইন।
No comments