ডাক্তাররাই কি মেরে ফেললেন অহনাকে? by রাশেদ রাব্বি
‘মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে অহনাকে স্কুলে ভর্তি করি। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এখনও আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করি, কিন্তু অহনা আসে না, বাবা-বাবা বলে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না।’- কথাগুলো ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করা শিশু অহনার বাবা স্থপতি মির্জা শাহপার জলিলের।
তিনি অভিযোগ করেন, মাথাব্যথাসহ কিছু উপসর্গ দেখা দিলে প্রথম থেকেই দু’জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে অহনার চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে অহনার ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতে সাড়ে চার মাস কেটে যায়। চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মনোভাবের বলি হয়ে মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে নিভে যায় ছোট্ট মেয়েটির জীবন। মেয়ের মৃত্যুর জন্য চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে কয়েকজন চিকিৎসক এবং স্কয়ার হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মির্জা শাহপার জলিল। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- ডা. নওশাদ-উন-নবী, চিফ কনসালটেন্ট, শিশু বিভাগ ও নিওন্যাটোলজি, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল; ডা. মো. মাসুদুর রহমান, কনসালটেন্ট শিশু বিভাগ এবং পিআইসিইউ, স্কয়ার হাসপাতাল; অধ্যাপক ডা. সানোয়ার হোসেন, পরিচালক (চিকিৎসাসেবা) স্কয়ার হাসপাতাল; এবং তপন চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্কয়ার হাসপাতাল। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্তদের একজন এসব নিয়ে নাক না গলানোর পরামর্শ দেন। বাদীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং-৩৩ ঢাকা, বিগত ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে নালিশি দরখাস্তে বর্ণিত অভিযোগের প্রকৃত ও অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করে অভিযোগটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল বিষয় উল্লেখ করে সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) তৎকালীন ভিসিকে নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শহিদুল্লাকে আহ্বায়ক এবং নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনকে সদস্যসচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কাজ কতটা এগিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে বিষয়ে আমি বলতে পারছি না। তবে তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই অতিরিক্ত সময়ের জন্য আবেদন করে।
তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব বিএসএমএমইউ’র নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন তদন্তাধীন বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত এখনও চলছে। এটি একটি জাটিল অভিযোগ। এ জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।
মামলার বিষয়ে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে ল্যাবএইড গ্রুপের এজিএম সাইফুর রহমান লেলিন যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ল্যাবএইডের বিরুদ্ধে নয়। তাই এ বিষয়ে হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হবে না। ডা. নওশাদ-উন-নবীর সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
স্কয়ার হাসপাতালে যোগাযোগ করলে শিফট ইনচার্জ সুপ্রকাশ চাকমা অভিযুক্তদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে বলেন। স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসাসেবা অধ্যাপক সানোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আদালতের নির্দেশে তদন্তকাজ এখনও চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার বা হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হবে না। একই হাসপাতালের কনসালটেন্ট শিশু বিভাগ এবং পিআইসিইউ ডা. মো. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং প্রতিবেদককে এ বিষয়ে নাক না গলানোর জন্য বলেন।
পরিবারের অভিযোগ : অহনার জন্ম ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি। সাড়ে তিন বছর বয়সে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসিমাখা মুখটি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। ঝাপসা হতে থাকে চোখ। মেয়ের অসুস্থতায় দিশেহারা বাবা-মা রাজধানীর নামি-দামি ডাক্তারদের কাছে ছুটে যান। কিন্তু কোথাও সঠিক রোগ নির্ণয় হয়নি। ‘ওর (অহনার) কিছু হয়নি’ বলে বিদায় করে দেয়।
পারিবারিক তথ্যমতে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে অহনা। কোনো কারণ ছাড়াই বমি, কিছুই খেতে না পারা, খেলেই বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এ সময় একদিন রাজধানীর কাজীপাড়ার আল হেলাল স্পেশালাইজড হসপিটালের সিইও ডা. আবু শামীমের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে ডিহাইড্রেশন হয়েছে এমন আশংকায় রাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। ভর্তির পর অহনার ইলেকট্রোলাইট, সিবিসি টেস্ট করা হলেও নেগেটিভ কিছু না পাওয়ায় অহনাকে ডিসচার্জ করা হয়। তবে ডিসচার্জ লেটারে ডায়াগনসিসের জায়গায় প্রশ্নবোধক (??) চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এটা কিছু নয় সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করেন ডা. আবু শামীম।
প্রায় দেড় মাস একই সমস্যায় ভুগে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে অহনা। খাওয়া-দাওয়া কমতে থাকে। ১৮ মে ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হসপিটালের চিকিৎসক ডা. নওশাদ-উন-নবীর কাছে নিয়ে গেলে তিনি জানান, অহনা ভারটিগো/মাইগ্রেনে ভুগছে। কোনো প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ছাড়াই ডা. নওশাদ-উন-নবী অহনাকে বমির ওষুধ, কিছু ভিটামিন এবং বমি হলে একটি বিদেশী এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানোর পরামর্শ দেন।
মির্জা শাহপার জলিল বলেন, দু’জন বড় পেডিয়াট্রিক স্পেশালিস্টের কাছ থেকে কিছু হয়নি শুনে আশ্বস্ত হই। কিন্তু অহনা আরও দুর্বল হতে থাকে। এ অবস্থায় আবার নওশাদ-উন-নবীর কাছে গেলে তিনি কিছু ওষুধ দেন এবং দু’দিন পর যেতে বলেন। কিন্তু ওই দু’দিনে অহনার শারীরিক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়ে। ঘাড় শক্ত হয়ে যায় এবং বারবার মাথাব্যথার কথা বলতে থাকে। এ অবস্থায় ডা. নওশাদ-উন-নবীর কাছে গেলে তিনি ওষুধ চালিয়ে যেতে বলেন এবং অবস্থার অবনতি হলে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। ওই দিনই অহনা আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বেলা সাড়ে ১১টায় ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হসপিটালের আইপিডিতে ভর্তি করা হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর একজন ডিউটি ডাক্তার এসে এমআরআই করতে হবে বলে চলে যান। বিকাল ৫টায় এমআরআই শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় ডিউটি ডাক্তার জানান, পরীক্ষায় অহনার ব্রেনে একটা টিউমার পাওয়া গেছে, যেটা বেশ খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
অহনার বাবা বলেন, এটা শোনার পর আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। কারণ ওর উপসর্গগুলো প্রকাশ করার প্রথম দিন থেকে দু’জন স্পেশালিস্টের কাছে চিকিৎসা শুরু করি। তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে সাড়ে চার মাস পর বিষয়টি আমরা জানতে পারি। তিনি বলেন, এর পরই ডা. নওশাদের কাছে গেলে, ‘এটি নিউরোলজিস্টদের বিষয়’- এ কথা বলে আমাকে বিদায় করেন।
নিউরোলজিস্ট ডা. মিজানুর রহমান সন্ধ্যা ৭টায় অহনাকে দেখে তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ বলে মন্তব্য করেন এবং জরুরি ভিত্তিতে অহনার ব্রেনে আটকে পড়া ঈঝঋ রিলিজ করাতে হবে বলে জানান। ডা. মিজান তাদের আরও বলেন, টিউমারটি অপসারণ (VP Shunt operation with tumor removal) না করালে প্রথমত সে অন্ধ হয়ে যাবে এবং মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বে। এ বিষয়ে তিনি একই হাসপাতালের চিকিৎসক নিউরোসার্জন ডা. জিল্লুর রহমানের পরামর্শ নিতে বলেন। তাৎক্ষণিকভাবে ডা. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত জানান মির্জা শাহপার জলিল। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি অহনাকে দেখেন এবং অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। কারণ হিসেবে ডা. জিল্লুর বলেন, ল্যাবএইড স্পেশালাইজডে এ ধরনের অপারেশনের পর শিশুদের রাখার কোনো পিআইসিইউ সুবিধা নেই।
অহনার বাবার অভিযোগ, বেলা ১১টায় মেয়েকে ল্যাবএইডে ভর্তি করি আর রাত সাড়ে ১১টায় হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই বলে স্থানান্তর করতে বলা হয়। আসলে পুরো দিনের টাকা পাওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর জীবন-মরণের বিষয়টি তুচ্ছ করে এ ধরনের আচরণ করেছে। পরে ল্যাবএইডের একজন ডিউটি ডাক্তারের পরামর্শে অহনাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই।
মির্জা শাহপার জলিল জানান, স্কয়ার হাসপাতালে নেয়ার পরে জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা দ্রুত টাকা জমা দিয়ে অহনাকে ভর্তি করার তাগাদা দেন। সে অনুযায়ী ভর্তি করার পর রোগীর বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তারা ‘রোগী এখন আমাদের অধীনে, কি করতে হবে আমরাই সিদ্ধান্ত নেব’- এ কথা বলে দ্রুত অহনাকে পিআইসিইউতে নিয়ে যায়। পরদিন সকাল ৯টায় নিউরোসার্জন ডা. পার্থ প্রতিম বিষ্ণু অহনার বাবা-মা’কে ডেকে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে বলে জানান।
স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে মির্জা শাহপার জলিল বলেন, এ সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ভর্তির সময় ডিউটি ডাক্তাররা আমাদের কথা না শোনায় অহনার জীবন থেকে মূল্যবান ১৬টি ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়। এটাও তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
তিনি জানান, এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় ডা. পার্থ প্রতিম বিষ্ণু ওটি থেকে বেরিয়ে অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে বলে জানান। তবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মেয়ের দেখা না পেয়ে আবার ডা. পার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পোস্ট অপারেটিভে নিয়ে অহনাকে দেখান। এরপর অহনা জ্ঞান হারালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তার অবস্থা আশংকাজনক বলে ঘোষণা করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে এর কারণ জানতে চাইলে ওই চিকিৎসকরা তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন।
এ অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য মেয়েকে বিদেশে নিতে চাইলেও স্কয়ার হাসপাতালের পক্ষ থেকে অশোভন আচরণ করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংককের সামিতিভেজ শ্রীনাকারিন চিলড্রেন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় অহনাকে। সেখানকার চিকিৎসকরা দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে তার টিউমারের ৯৯ ভাগ অপসারণ করেন। অপারেশনের পর অহনার জ্ঞান ফেরে এবং সে তার বাবা-মা’কে চিনতে পারে। তবে ধীরে ধীরে তার শরীর খারাপ হতে থাকে। অহনা এরপর আরও প্রায় দেড় মাস বেঁচে ছিল।
অহনার বাবা যুগান্তরকে বলেন, সামিতিভেজের সার্জনরা তাকে জানিয়েছেন, ব্রেন হেমরেজের রিকভারি করার গোল্ডেন টাইম হল ৬ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা করা। কিন্তু অহনার হেমরেজের স্থায়িত্ব ৪৮ ঘণ্টার বেশি। তাদের তথ্যমতে, স্থানীয় চিকিৎসকদের অবহেলায় অহনার বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যায়।
তিনি অভিযোগ করেন, মাথাব্যথাসহ কিছু উপসর্গ দেখা দিলে প্রথম থেকেই দু’জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে অহনার চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে অহনার ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতে সাড়ে চার মাস কেটে যায়। চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মনোভাবের বলি হয়ে মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে নিভে যায় ছোট্ট মেয়েটির জীবন। মেয়ের মৃত্যুর জন্য চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে কয়েকজন চিকিৎসক এবং স্কয়ার হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মির্জা শাহপার জলিল। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- ডা. নওশাদ-উন-নবী, চিফ কনসালটেন্ট, শিশু বিভাগ ও নিওন্যাটোলজি, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল; ডা. মো. মাসুদুর রহমান, কনসালটেন্ট শিশু বিভাগ এবং পিআইসিইউ, স্কয়ার হাসপাতাল; অধ্যাপক ডা. সানোয়ার হোসেন, পরিচালক (চিকিৎসাসেবা) স্কয়ার হাসপাতাল; এবং তপন চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্কয়ার হাসপাতাল। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্তদের একজন এসব নিয়ে নাক না গলানোর পরামর্শ দেন। বাদীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং-৩৩ ঢাকা, বিগত ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে নালিশি দরখাস্তে বর্ণিত অভিযোগের প্রকৃত ও অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করে অভিযোগটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জটিল বিষয় উল্লেখ করে সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) তৎকালীন ভিসিকে নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শহিদুল্লাকে আহ্বায়ক এবং নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনকে সদস্যসচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কাজ কতটা এগিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে বিষয়ে আমি বলতে পারছি না। তবে তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই অতিরিক্ত সময়ের জন্য আবেদন করে।
তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব বিএসএমএমইউ’র নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন তদন্তাধীন বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত এখনও চলছে। এটি একটি জাটিল অভিযোগ। এ জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।
মামলার বিষয়ে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে ল্যাবএইড গ্রুপের এজিএম সাইফুর রহমান লেলিন যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ল্যাবএইডের বিরুদ্ধে নয়। তাই এ বিষয়ে হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হবে না। ডা. নওশাদ-উন-নবীর সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
স্কয়ার হাসপাতালে যোগাযোগ করলে শিফট ইনচার্জ সুপ্রকাশ চাকমা অভিযুক্তদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে বলেন। স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসাসেবা অধ্যাপক সানোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আদালতের নির্দেশে তদন্তকাজ এখনও চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার বা হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হবে না। একই হাসপাতালের কনসালটেন্ট শিশু বিভাগ এবং পিআইসিইউ ডা. মো. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং প্রতিবেদককে এ বিষয়ে নাক না গলানোর জন্য বলেন।
পরিবারের অভিযোগ : অহনার জন্ম ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি। সাড়ে তিন বছর বয়সে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসিমাখা মুখটি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। ঝাপসা হতে থাকে চোখ। মেয়ের অসুস্থতায় দিশেহারা বাবা-মা রাজধানীর নামি-দামি ডাক্তারদের কাছে ছুটে যান। কিন্তু কোথাও সঠিক রোগ নির্ণয় হয়নি। ‘ওর (অহনার) কিছু হয়নি’ বলে বিদায় করে দেয়।
পারিবারিক তথ্যমতে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে অহনা। কোনো কারণ ছাড়াই বমি, কিছুই খেতে না পারা, খেলেই বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এ সময় একদিন রাজধানীর কাজীপাড়ার আল হেলাল স্পেশালাইজড হসপিটালের সিইও ডা. আবু শামীমের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে ডিহাইড্রেশন হয়েছে এমন আশংকায় রাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। ভর্তির পর অহনার ইলেকট্রোলাইট, সিবিসি টেস্ট করা হলেও নেগেটিভ কিছু না পাওয়ায় অহনাকে ডিসচার্জ করা হয়। তবে ডিসচার্জ লেটারে ডায়াগনসিসের জায়গায় প্রশ্নবোধক (??) চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এটা কিছু নয় সব ঠিক হয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করেন ডা. আবু শামীম।
প্রায় দেড় মাস একই সমস্যায় ভুগে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে অহনা। খাওয়া-দাওয়া কমতে থাকে। ১৮ মে ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হসপিটালের চিকিৎসক ডা. নওশাদ-উন-নবীর কাছে নিয়ে গেলে তিনি জানান, অহনা ভারটিগো/মাইগ্রেনে ভুগছে। কোনো প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ছাড়াই ডা. নওশাদ-উন-নবী অহনাকে বমির ওষুধ, কিছু ভিটামিন এবং বমি হলে একটি বিদেশী এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানোর পরামর্শ দেন।
মির্জা শাহপার জলিল বলেন, দু’জন বড় পেডিয়াট্রিক স্পেশালিস্টের কাছ থেকে কিছু হয়নি শুনে আশ্বস্ত হই। কিন্তু অহনা আরও দুর্বল হতে থাকে। এ অবস্থায় আবার নওশাদ-উন-নবীর কাছে গেলে তিনি কিছু ওষুধ দেন এবং দু’দিন পর যেতে বলেন। কিন্তু ওই দু’দিনে অহনার শারীরিক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়ে। ঘাড় শক্ত হয়ে যায় এবং বারবার মাথাব্যথার কথা বলতে থাকে। এ অবস্থায় ডা. নওশাদ-উন-নবীর কাছে গেলে তিনি ওষুধ চালিয়ে যেতে বলেন এবং অবস্থার অবনতি হলে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। ওই দিনই অহনা আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বেলা সাড়ে ১১টায় ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হসপিটালের আইপিডিতে ভর্তি করা হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর একজন ডিউটি ডাক্তার এসে এমআরআই করতে হবে বলে চলে যান। বিকাল ৫টায় এমআরআই শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় ডিউটি ডাক্তার জানান, পরীক্ষায় অহনার ব্রেনে একটা টিউমার পাওয়া গেছে, যেটা বেশ খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
অহনার বাবা বলেন, এটা শোনার পর আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। কারণ ওর উপসর্গগুলো প্রকাশ করার প্রথম দিন থেকে দু’জন স্পেশালিস্টের কাছে চিকিৎসা শুরু করি। তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে সাড়ে চার মাস পর বিষয়টি আমরা জানতে পারি। তিনি বলেন, এর পরই ডা. নওশাদের কাছে গেলে, ‘এটি নিউরোলজিস্টদের বিষয়’- এ কথা বলে আমাকে বিদায় করেন।
নিউরোলজিস্ট ডা. মিজানুর রহমান সন্ধ্যা ৭টায় অহনাকে দেখে তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ বলে মন্তব্য করেন এবং জরুরি ভিত্তিতে অহনার ব্রেনে আটকে পড়া ঈঝঋ রিলিজ করাতে হবে বলে জানান। ডা. মিজান তাদের আরও বলেন, টিউমারটি অপসারণ (VP Shunt operation with tumor removal) না করালে প্রথমত সে অন্ধ হয়ে যাবে এবং মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বে। এ বিষয়ে তিনি একই হাসপাতালের চিকিৎসক নিউরোসার্জন ডা. জিল্লুর রহমানের পরামর্শ নিতে বলেন। তাৎক্ষণিকভাবে ডা. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত জানান মির্জা শাহপার জলিল। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি অহনাকে দেখেন এবং অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। কারণ হিসেবে ডা. জিল্লুর বলেন, ল্যাবএইড স্পেশালাইজডে এ ধরনের অপারেশনের পর শিশুদের রাখার কোনো পিআইসিইউ সুবিধা নেই।
অহনার বাবার অভিযোগ, বেলা ১১টায় মেয়েকে ল্যাবএইডে ভর্তি করি আর রাত সাড়ে ১১টায় হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই বলে স্থানান্তর করতে বলা হয়। আসলে পুরো দিনের টাকা পাওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর জীবন-মরণের বিষয়টি তুচ্ছ করে এ ধরনের আচরণ করেছে। পরে ল্যাবএইডের একজন ডিউটি ডাক্তারের পরামর্শে অহনাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই।
মির্জা শাহপার জলিল জানান, স্কয়ার হাসপাতালে নেয়ার পরে জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা দ্রুত টাকা জমা দিয়ে অহনাকে ভর্তি করার তাগাদা দেন। সে অনুযায়ী ভর্তি করার পর রোগীর বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তারা ‘রোগী এখন আমাদের অধীনে, কি করতে হবে আমরাই সিদ্ধান্ত নেব’- এ কথা বলে দ্রুত অহনাকে পিআইসিইউতে নিয়ে যায়। পরদিন সকাল ৯টায় নিউরোসার্জন ডা. পার্থ প্রতিম বিষ্ণু অহনার বাবা-মা’কে ডেকে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে বলে জানান।
স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে মির্জা শাহপার জলিল বলেন, এ সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ভর্তির সময় ডিউটি ডাক্তাররা আমাদের কথা না শোনায় অহনার জীবন থেকে মূল্যবান ১৬টি ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়। এটাও তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
তিনি জানান, এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় ডা. পার্থ প্রতিম বিষ্ণু ওটি থেকে বেরিয়ে অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে বলে জানান। তবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মেয়ের দেখা না পেয়ে আবার ডা. পার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পোস্ট অপারেটিভে নিয়ে অহনাকে দেখান। এরপর অহনা জ্ঞান হারালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তার অবস্থা আশংকাজনক বলে ঘোষণা করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে এর কারণ জানতে চাইলে ওই চিকিৎসকরা তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন।
এ অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য মেয়েকে বিদেশে নিতে চাইলেও স্কয়ার হাসপাতালের পক্ষ থেকে অশোভন আচরণ করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংককের সামিতিভেজ শ্রীনাকারিন চিলড্রেন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় অহনাকে। সেখানকার চিকিৎসকরা দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে তার টিউমারের ৯৯ ভাগ অপসারণ করেন। অপারেশনের পর অহনার জ্ঞান ফেরে এবং সে তার বাবা-মা’কে চিনতে পারে। তবে ধীরে ধীরে তার শরীর খারাপ হতে থাকে। অহনা এরপর আরও প্রায় দেড় মাস বেঁচে ছিল।
অহনার বাবা যুগান্তরকে বলেন, সামিতিভেজের সার্জনরা তাকে জানিয়েছেন, ব্রেন হেমরেজের রিকভারি করার গোল্ডেন টাইম হল ৬ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা করা। কিন্তু অহনার হেমরেজের স্থায়িত্ব ৪৮ ঘণ্টার বেশি। তাদের তথ্যমতে, স্থানীয় চিকিৎসকদের অবহেলায় অহনার বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যায়।
No comments