১৩ বছরের বালিকার ভাষ্যে ইবোলা by বিন্টু সানোহ
ইবোলা নামটি আমার কাছে মধুর কিছু নয়। সত্যভাষণ হলো, এ শব্দটি শুনতেও আমার ঘৃণা হয়। এ রোগে আমার পরিবার ও শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেছে। জীবন কঠিন ছিল, তবু তা একরকম কেটে যেত। আমি আমার চাচি ও আরও অনেক সদস্যের সঙ্গে একটি বড় বাড়িতে থাকতাম। আমরা বরাবরই দরিদ্র ছিলাম, তবে সুখ কখনোই সোনার হরিণের মতো অধরা ছিল না। কিন্তু এখন আমরা আতঙ্কিত। পরিচিত ও অপরিচিত বহু মানুষ এ রোগে মারা গেছে, এখনো যাচ্ছে। প্রতিদিনই বহু শিশু অনাথ হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রথম যখন ইবোলার প্রকোপ দেখা গেল, তখন আমরা খুব একটা আতঙ্কিত হইনি। তারপর শুরু হলো ‘স্পর্শকাতরকরণ’, আমাদের সম্প্রদায়ের সব গোষ্ঠী ও এনজিওগুলো ইবোলা নিয়ে কথা বলা শুরু করল। ‘ইবোলা বাস্তব কোনো বিষয় নয়’—এ নিয়ে কেনেমায় একটি দাঙ্গাও হয়। অনেকেই বলল, সরকার ইবোলা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। কারণ, সিয়েরা লিওনের পূর্বাঞ্চল ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছে, আর সরকার হচ্ছে উত্তরের। আর পূর্বাঞ্চল হচ্ছে বিরোধী দলের এলাকা।
তারপর, আগস্টের শুরুর দিকে পরিস্থিতি বদলে যায়। সরকার কেনেমা ও কাইলাহুন শহরে ঢোকা ও সেখান থেকে বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আমরা ঘেরাও হয়ে পড়ি, আর এখনো সে অবস্থায়ই আছি। আমার চাচি সাধারণত বাণিজ্য মেলা থেকে স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতেন, কিন্তু এর ফলে তাঁর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িতে আমাদের খুব কম টাকা ছিল, কিছু ধনী ছাড়া। চাচি বলেন, এই ধনী মানুষেরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে টাকা কামিয়েছে। আমাদের গ্রামে ইবোলার প্রকোপ দেখা গেলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। সেখানে একজন ফার্মাসিস্ট অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি আলসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট মানুষ হওয়ায় আমরা তাঁকে বিশ্বাস করেছিলাম, অথবা এর চেয়ে ভালো কিছু জানা-বোঝার সুযোগ আমাদের ছিল না। তাঁর অসুস্থতার সময় অনেক মানুষই তাঁর সংস্পর্শে এসেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের প্রথা অনুসারে মরদেহ গোসল করিয়ে সমাধিস্থ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
কিন্তু স্থানীয় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যুর খবর পৌঁছালে আমরা জানতে পারি, তিনি ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর দুই সপ্তাহ পর, যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন ও মৃতদেহের গোসল করিয়েছিলেন, তাঁরাও একে একে অসুস্থ হতে শুরু করেন। তারপর আরও ১৬ জন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাদের পরীক্ষা করে দেখা যায়, তারা ইবোলায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে আমার চাচিও আছেন। এদের মধ্যে ম্যারি নামের ১৪ বছরের একটি মেয়ে ও আমার চাচি দৈবক্রমে বেঁচে যান, তা নাহলে আমি নিজেও একজন ইবোলা-এতিমে পরিণত হতাম। পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে আরও পাঁচ বাড়ির ১৭ জন মারা যায়, নয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুদিন পর, হাসপাতাল থেকে ভয়ংকর পোশাক পরিহিত কিছু লোক আমাদের বাড়িতে এসে সব বিছানাপত্র বের করে আগুন ধরিয়ে দেয়, ঘরের ভেতরে সর্বত্র রাসায়নিক স্প্রে করে। আমাদের পাড়াটি শহরের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। আমাদের বলা হয়, পরবর্তী ২১ দিন সেখান থেকে কেউ বের হতে পারবে না বা ঢুকতেও পারবে না। চাচি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও খুব দুর্বল ছিলেন, তিনি রান্নাবান্না করতে পারতেন না বা খাবারের খোঁজে বেরও হতে পারতেন না। ফলে আমাদের ক্ষুধার জ্বালায় ভুগতে হয়েছে। পরে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসে।
আমরা বালগার খেতে চাইনি, এটা খেলে পেটে নানা ধরনের সমস্যা হয়। আর একবার কোনো সমস্যা হলে তাকে নির্ঘাত ইবোলা-আক্রান্ত বলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ফলে আমার গরিব চাচি গারি (শস্যদানা থেকে প্রস্তুত আটা) কেনেন, এর দাম ছিল মাত্র ১৫ পেন্স। এক কাপ গারি দিয়ে তিনজন মানুষকে এক বেলা খাওয়ানো যায়। আমাদের গ্রামেই প্রায় ১০০ শিশু অনাথ হয়। এবার একটু ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, আমি কীভাবে স্কুলে যাব? আমার চাচি কীভাবে আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাবেন? অন্যদের ওপর নির্ভর করা কঠিন। আমরা স্বনির্ভর হতে চাই। আমার বন্ধুদের মধ্যে যাদের বিইসিসিই পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তাদের তিনজন ইতিমধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। বাঁচার জন্য আমার ওপরও এখন বিয়ে করার চাপ রয়েছে, বড়দিনের পোশাকের জন্যও এটা করতে হবে। সিয়েরা লিওনে টাকা না থাকলে মেয়েদের এসব করতে হয়। এটা ঠিক না হলেও স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এই ইবোলা যদি শিগগির দূর না হয়, তাহলে স্কুল খোলার আগে আরও অনেক মেয়েই হয়তো গর্ভবতী হয়ে পড়বে। আমার এখন স্কুলে থাকার কথা থাকলেও সব স্কুলই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আমি উদ্বিগ্ন, কারণ স্কুল খুললেও অনেকেই দারিদ্র্য ও অকাল গর্ভধারণের কারণে স্কুল ত্যাগে বাধ্য হবে। যে মানুষেরা ও পরিবারসমূহ ইবোলায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের পরিবার সবচেয়ে বাজেভাবে আক্রান্ত হয়। তাদের উসকানি দেওয়া হচ্ছে, কলঙ্কের কারণে তারা অসহায়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সেখানে কোনো ব্যবসা নেই, অর্থ নেই, খাবার নেই, স্কুল নেই। এ অবস্থা থেকে বের হতে কে আমাদের সহায় হবে?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
বিন্টু সানোহ: সিয়েরা লিওনের ইবোলা-আক্রান্ত একটি গ্রামের ১৩ বছর বয়সী বালিকা।
তারপর, আগস্টের শুরুর দিকে পরিস্থিতি বদলে যায়। সরকার কেনেমা ও কাইলাহুন শহরে ঢোকা ও সেখান থেকে বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আমরা ঘেরাও হয়ে পড়ি, আর এখনো সে অবস্থায়ই আছি। আমার চাচি সাধারণত বাণিজ্য মেলা থেকে স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতেন, কিন্তু এর ফলে তাঁর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িতে আমাদের খুব কম টাকা ছিল, কিছু ধনী ছাড়া। চাচি বলেন, এই ধনী মানুষেরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে টাকা কামিয়েছে। আমাদের গ্রামে ইবোলার প্রকোপ দেখা গেলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। সেখানে একজন ফার্মাসিস্ট অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি আলসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট মানুষ হওয়ায় আমরা তাঁকে বিশ্বাস করেছিলাম, অথবা এর চেয়ে ভালো কিছু জানা-বোঝার সুযোগ আমাদের ছিল না। তাঁর অসুস্থতার সময় অনেক মানুষই তাঁর সংস্পর্শে এসেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের প্রথা অনুসারে মরদেহ গোসল করিয়ে সমাধিস্থ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
কিন্তু স্থানীয় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যুর খবর পৌঁছালে আমরা জানতে পারি, তিনি ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর দুই সপ্তাহ পর, যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন ও মৃতদেহের গোসল করিয়েছিলেন, তাঁরাও একে একে অসুস্থ হতে শুরু করেন। তারপর আরও ১৬ জন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাদের পরীক্ষা করে দেখা যায়, তারা ইবোলায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে আমার চাচিও আছেন। এদের মধ্যে ম্যারি নামের ১৪ বছরের একটি মেয়ে ও আমার চাচি দৈবক্রমে বেঁচে যান, তা নাহলে আমি নিজেও একজন ইবোলা-এতিমে পরিণত হতাম। পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে আরও পাঁচ বাড়ির ১৭ জন মারা যায়, নয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুদিন পর, হাসপাতাল থেকে ভয়ংকর পোশাক পরিহিত কিছু লোক আমাদের বাড়িতে এসে সব বিছানাপত্র বের করে আগুন ধরিয়ে দেয়, ঘরের ভেতরে সর্বত্র রাসায়নিক স্প্রে করে। আমাদের পাড়াটি শহরের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। আমাদের বলা হয়, পরবর্তী ২১ দিন সেখান থেকে কেউ বের হতে পারবে না বা ঢুকতেও পারবে না। চাচি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও খুব দুর্বল ছিলেন, তিনি রান্নাবান্না করতে পারতেন না বা খাবারের খোঁজে বেরও হতে পারতেন না। ফলে আমাদের ক্ষুধার জ্বালায় ভুগতে হয়েছে। পরে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসে।
আমরা বালগার খেতে চাইনি, এটা খেলে পেটে নানা ধরনের সমস্যা হয়। আর একবার কোনো সমস্যা হলে তাকে নির্ঘাত ইবোলা-আক্রান্ত বলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ফলে আমার গরিব চাচি গারি (শস্যদানা থেকে প্রস্তুত আটা) কেনেন, এর দাম ছিল মাত্র ১৫ পেন্স। এক কাপ গারি দিয়ে তিনজন মানুষকে এক বেলা খাওয়ানো যায়। আমাদের গ্রামেই প্রায় ১০০ শিশু অনাথ হয়। এবার একটু ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, আমি কীভাবে স্কুলে যাব? আমার চাচি কীভাবে আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাবেন? অন্যদের ওপর নির্ভর করা কঠিন। আমরা স্বনির্ভর হতে চাই। আমার বন্ধুদের মধ্যে যাদের বিইসিসিই পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তাদের তিনজন ইতিমধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। বাঁচার জন্য আমার ওপরও এখন বিয়ে করার চাপ রয়েছে, বড়দিনের পোশাকের জন্যও এটা করতে হবে। সিয়েরা লিওনে টাকা না থাকলে মেয়েদের এসব করতে হয়। এটা ঠিক না হলেও স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এই ইবোলা যদি শিগগির দূর না হয়, তাহলে স্কুল খোলার আগে আরও অনেক মেয়েই হয়তো গর্ভবতী হয়ে পড়বে। আমার এখন স্কুলে থাকার কথা থাকলেও সব স্কুলই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আমি উদ্বিগ্ন, কারণ স্কুল খুললেও অনেকেই দারিদ্র্য ও অকাল গর্ভধারণের কারণে স্কুল ত্যাগে বাধ্য হবে। যে মানুষেরা ও পরিবারসমূহ ইবোলায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের পরিবার সবচেয়ে বাজেভাবে আক্রান্ত হয়। তাদের উসকানি দেওয়া হচ্ছে, কলঙ্কের কারণে তারা অসহায়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সেখানে কোনো ব্যবসা নেই, অর্থ নেই, খাবার নেই, স্কুল নেই। এ অবস্থা থেকে বের হতে কে আমাদের সহায় হবে?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া
বিন্টু সানোহ: সিয়েরা লিওনের ইবোলা-আক্রান্ত একটি গ্রামের ১৩ বছর বয়সী বালিকা।
No comments