পিঁপড়াপুরাণ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বিশ্বশান্তির প্রবক্তা বিশ্বনেতাদের মতো ক্ষুদ্রতর প্রাণী পিঁপড়া পর্যন্ত এখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের লাইমলাইটে স্থান করে নিয়েছে। যদিও পিঁপড়া নিয়ে গবেষণা করে এখন পর্যন্ত কোনো জীববিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পাননি, তবে কয়েক দিন আগে একদল গবেষক জানিয়েছেন, মানুষের চেয়ে পিঁপড়ার ওজন বেশি। সংবাদের শিরোনাম দেখে খটকা লাগে—একটি পিঁপড়ার ওজন কি আমার চেয়ে বেশি? তা কী করে সম্ভব? পুরো খবরটা পড়ে আসল কথা জানা গেল। অনাগত দিনের সম্ভাব্য নোবেল লরেটররা যা বলেছেন তার অর্থ এই নয় যে একটি পিঁপড়ার ওজন একজন মানুষের চেয়ে বেশি। গবেষণার ফলাফল হলো, এই পৃথিবীতে যত পিঁপড়া আছে মাটিতে বা গাছে বা দেয়ালে বাসা বেঁধে, তার ওজন পৃথিবীর সাড়ে ছয় শ কোটি মানুষের চেয়ে বেশি। আমাদের দক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কয়েক লাখ ভোটারকেই ঠিকমতো গুনতে পারে না, সেখানে পশ্চিমি গবেষকেরা দুনিয়ার সব পিঁপড়ার শুমারি করলেন এবং ওয়েটিং মেশিনে দাঁড় করিয়ে কীভাবে তাদের ওজন মাপলেন, তা তাজ্জবের ব্যাপারই বটে। তবে মানুষের ওজন বেশি না পিঁপড়ার ওজন বেশি, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রশ্ন আসে না। সেটা পৃথিবীর সমস্যা। এই গ্রহ কতটা ভার বহন করতে সক্ষম, সেটা তার ব্যাপার। পিপীলিকার পদভারে যদি এই পৃথিবী পিষ্ট হয়, তা হলে আমাদেরও দাঁড়ানোর ঠাঁই থাকবে না।
দুনিয়া গোল্লায় যাক, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আজ পিঁপড়া একটি চরিত্র। মাটির গর্ত থেকে রাজনীতির মঞ্চে স্থান করে নিয়েছে প্রজাতি হিসেবে পিঁপড়া। কারও কোনো এক বইয়ের দিকে আঙুল তুলে মহাজোটের এক মন্ত্রী পবিত্র হজে যাওয়ার কয়েক হপ্তা আগে থেকে রাজনীতির ইতিহাসে পিঁপড়া শব্দটির প্রয়োগ ঘটান। একেবারে খাঁটি বিজ্ঞানসম্মত সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ওই মাননীয় মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেন হাতির সঙ্গে আর ওই বইয়ের লেখককে একট পিঁপড়া। বঙ্গবন্ধুর বড়ত্ব ও লেখকের ক্ষুদ্রত্ব বোঝাতেই এই উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ওই হতভাগ্য লেখককেই যে শুধু পিঁপড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন তা-ই নয়, নিজেকেও তিনি তুলনা করেছেন পিঁপড়ার সঙ্গে। বলেছেন, ‘আমরা হলাম পিঁপড়া।’ আমরা বলতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের বুঝিয়ে থাকবেন। এমনকি যাঁরা পত্রপত্রিকায় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে থাকেন, তাঁদেরও যোগ করতে পারেন।
হাতির সঙ্গে পিঁপড়ার যে সমানুপাত বা ব্যবধান, তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। মাননীয় নিজেকে অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গেও তুলনা করতে পারতেন। তা বেমানান হতো না, বরং সমানুপাতিক দিক থেকে তা মানানসই–ই হতো। যেমন: আরশোলা, মেঠো ইঁদুর, গেছো ব্যাঙ, বনবিড়াল, গুইসাপ, বেজি, শাখামৃগ, ভোঁদড়, বাগডাঁশ, খ্যাঁকশিয়াল প্রভৃতি প্রাণীর সঙ্গেও আমরা নিজেদের তুলনা করতে পারি। বরং আমাদের মানুষ পরিচয়ই আজ অনেকখানি গৌণ হয়ে পড়েছে। তবে মন্ত্রী মহোদয়কেই সমর্থন করে বলছি, আমাদের জাতীয় জীবনে এবং রাজনীতির অঙ্গনে পিঁপড়া অপ্রাসঙ্গিক নয়। মন্ত্রী মহোদয়ের কয়েক সপ্তাহব্যাপী নিজেকে পিঁপড়ার সঙ্গে তুলনা করা ভুল ছিল না। তাঁর ওই বক্তব্যের আগেই পিঁপড়া বিষয়ে এক গবেষণার ওপর একটি প্রতিবেদন দৈনিক সমকাল-এ পাঠ করে বড়ই উপকৃত হই এবং মন্ত্রী মহোদয়ের উপমার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি। ‘পিঁপড়াদের মধ্যেও হিংসা-বিদ্বেষ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়:
‘দল বেঁধে কাজ করার সামর্থ্যের জন্য পিঁপড়ার সুখ্যাতি আছে। এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে থাকে সম্প্রদায়ের কল্যাণের বিষয়টি। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের আবাসস্থল মূলত চাতুর্যপূর্ণ, স্বার্থপর আর দুর্নীতিপরায়ণ আচরণের লালনক্ষেত্র। আর এ অভিযোগের বেশির ভাগ তিরই তাদের মধ্যে রাজপরিবার তথা পুরুষ পিঁপড়ার দিকে।’ এই জগতে কোন প্রজাতি কোন প্রজাতির দ্বারা প্রভাবিত হয়, তা কেউ জানে না। পিঁপড়ার দ্বারা বাঙালি প্রভাবিত হয়েছে, নাকি বাঙালির দ্বারা পিঁপড়াজাতি প্রভাবিত হয়েছে তা গবেষণার বিষয় এবং আগেই বলেছি, পিঁপড়া ও বাঙালির স্বভাব নিয়ে গবেষণা হবে এবং গবেষকেরা নোবেল পুরস্কারও পাবেন। বিশেষ বিশেষ দলীয় পিঁপড়ারা বাঙালির মতো শুধু নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্যই রাষ্ট্রীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার করে। চাতুর্য জিনিসটি পিঁপড়ার মতোই বাঙালির অথবা বাঙালি নেতাদের মতোই পিঁপড়ারও বৈশিষ্ট্য। স্বার্থপরতা সম্ভবত পিঁপড়া প্রজাতির মধ্যে শুরুতে ছিল না, বাঙালির থেকে শিখেছে। পিঁপড়ার রাজত্বে যেহেতু বড় বড় প্রজেক্ট নেই, কোটি কোটি টাকার কেনাকাটা নেই, ব্যাংকঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা নেই, তাই দুর্নীতিপরায়ণতা তাদের মধ্যে ৪২ বছর আগেও ছিল না। এ দোষ তারা রপ্ত করেছে বাঙালি থেকে। পিঁপড়ার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা গবেষকেরা বলেননি, তা হলো: যেখানেই মিছরির টুকরা, সেখানেই ছুটে যায় পিঁপড়া। মিছরিটি শুষে খেয়ে নিঃশেষ না করা পর্যন্ত সেখান থেকে নড়ে না। সুতরাং যারা নিজেদের পিঁপড়া হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁরা সততার পরিচয় দিচ্ছেন। পিঁপড়ার আরেক স্বভাব কামড়ানো। বড়ই জ্বালা সে কামড়ের। যে দেশের শাসকশ্রেণির মধ্যে পিঁপড়ার সংখ্যা বেশি, তার যন্ত্রণার শেষ নেই। পিঁপড়া-বাঙালি ভাই ভাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
দুনিয়া গোল্লায় যাক, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আজ পিঁপড়া একটি চরিত্র। মাটির গর্ত থেকে রাজনীতির মঞ্চে স্থান করে নিয়েছে প্রজাতি হিসেবে পিঁপড়া। কারও কোনো এক বইয়ের দিকে আঙুল তুলে মহাজোটের এক মন্ত্রী পবিত্র হজে যাওয়ার কয়েক হপ্তা আগে থেকে রাজনীতির ইতিহাসে পিঁপড়া শব্দটির প্রয়োগ ঘটান। একেবারে খাঁটি বিজ্ঞানসম্মত সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ওই মাননীয় মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেন হাতির সঙ্গে আর ওই বইয়ের লেখককে একট পিঁপড়া। বঙ্গবন্ধুর বড়ত্ব ও লেখকের ক্ষুদ্রত্ব বোঝাতেই এই উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ওই হতভাগ্য লেখককেই যে শুধু পিঁপড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন তা-ই নয়, নিজেকেও তিনি তুলনা করেছেন পিঁপড়ার সঙ্গে। বলেছেন, ‘আমরা হলাম পিঁপড়া।’ আমরা বলতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের বুঝিয়ে থাকবেন। এমনকি যাঁরা পত্রপত্রিকায় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে থাকেন, তাঁদেরও যোগ করতে পারেন।
হাতির সঙ্গে পিঁপড়ার যে সমানুপাত বা ব্যবধান, তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। মাননীয় নিজেকে অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গেও তুলনা করতে পারতেন। তা বেমানান হতো না, বরং সমানুপাতিক দিক থেকে তা মানানসই–ই হতো। যেমন: আরশোলা, মেঠো ইঁদুর, গেছো ব্যাঙ, বনবিড়াল, গুইসাপ, বেজি, শাখামৃগ, ভোঁদড়, বাগডাঁশ, খ্যাঁকশিয়াল প্রভৃতি প্রাণীর সঙ্গেও আমরা নিজেদের তুলনা করতে পারি। বরং আমাদের মানুষ পরিচয়ই আজ অনেকখানি গৌণ হয়ে পড়েছে। তবে মন্ত্রী মহোদয়কেই সমর্থন করে বলছি, আমাদের জাতীয় জীবনে এবং রাজনীতির অঙ্গনে পিঁপড়া অপ্রাসঙ্গিক নয়। মন্ত্রী মহোদয়ের কয়েক সপ্তাহব্যাপী নিজেকে পিঁপড়ার সঙ্গে তুলনা করা ভুল ছিল না। তাঁর ওই বক্তব্যের আগেই পিঁপড়া বিষয়ে এক গবেষণার ওপর একটি প্রতিবেদন দৈনিক সমকাল-এ পাঠ করে বড়ই উপকৃত হই এবং মন্ত্রী মহোদয়ের উপমার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি। ‘পিঁপড়াদের মধ্যেও হিংসা-বিদ্বেষ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়:
‘দল বেঁধে কাজ করার সামর্থ্যের জন্য পিঁপড়ার সুখ্যাতি আছে। এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে থাকে সম্প্রদায়ের কল্যাণের বিষয়টি। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের আবাসস্থল মূলত চাতুর্যপূর্ণ, স্বার্থপর আর দুর্নীতিপরায়ণ আচরণের লালনক্ষেত্র। আর এ অভিযোগের বেশির ভাগ তিরই তাদের মধ্যে রাজপরিবার তথা পুরুষ পিঁপড়ার দিকে।’ এই জগতে কোন প্রজাতি কোন প্রজাতির দ্বারা প্রভাবিত হয়, তা কেউ জানে না। পিঁপড়ার দ্বারা বাঙালি প্রভাবিত হয়েছে, নাকি বাঙালির দ্বারা পিঁপড়াজাতি প্রভাবিত হয়েছে তা গবেষণার বিষয় এবং আগেই বলেছি, পিঁপড়া ও বাঙালির স্বভাব নিয়ে গবেষণা হবে এবং গবেষকেরা নোবেল পুরস্কারও পাবেন। বিশেষ বিশেষ দলীয় পিঁপড়ারা বাঙালির মতো শুধু নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্যই রাষ্ট্রীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার করে। চাতুর্য জিনিসটি পিঁপড়ার মতোই বাঙালির অথবা বাঙালি নেতাদের মতোই পিঁপড়ারও বৈশিষ্ট্য। স্বার্থপরতা সম্ভবত পিঁপড়া প্রজাতির মধ্যে শুরুতে ছিল না, বাঙালির থেকে শিখেছে। পিঁপড়ার রাজত্বে যেহেতু বড় বড় প্রজেক্ট নেই, কোটি কোটি টাকার কেনাকাটা নেই, ব্যাংকঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা নেই, তাই দুর্নীতিপরায়ণতা তাদের মধ্যে ৪২ বছর আগেও ছিল না। এ দোষ তারা রপ্ত করেছে বাঙালি থেকে। পিঁপড়ার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের কথা গবেষকেরা বলেননি, তা হলো: যেখানেই মিছরির টুকরা, সেখানেই ছুটে যায় পিঁপড়া। মিছরিটি শুষে খেয়ে নিঃশেষ না করা পর্যন্ত সেখান থেকে নড়ে না। সুতরাং যারা নিজেদের পিঁপড়া হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁরা সততার পরিচয় দিচ্ছেন। পিঁপড়ার আরেক স্বভাব কামড়ানো। বড়ই জ্বালা সে কামড়ের। যে দেশের শাসকশ্রেণির মধ্যে পিঁপড়ার সংখ্যা বেশি, তার যন্ত্রণার শেষ নেই। পিঁপড়া-বাঙালি ভাই ভাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments