পানি বাণিজ্যিকীকরণ ও সর্বজনের বিপদ by আনু মুহাম্মদ

‘রাজা ছাড়া মানুষ বাঁচে/মানুষ ছাড়া রাজ্য বাঁচে না।
প্রাণী ছাড়া ঘাস বাঁচে/ঘাস ছাড়া প্রাণী বাঁচে না।
মানুষ ছাড়া পানি বাঁচে/পানি ছাড়া প্রাণ বাঁচে না।’
—নাইজেরীয় লোককবি

আমাদের পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই পানি। আমাদের শরীরের পানির অনুপাতও এর কাছাকাছি শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ। এই পানি-প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করেও আমরা দেখছি, পানি ক্রমেই একটি দুর্লভ ও ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হচ্ছে। একদিকে খাদ্য নিয়ে বিলাসিতা, অন্যদিকে ন্যূনতম খাদ্যের জন্য হাহাকার; একদিকে পানির অপরিমিত ব্যবহার, পানির যথেচ্ছাচার দূষণ, অন্যদিকে ন্যূনতম পানির জন্য কোটি কোটি মানুষের মরণদশা—এই বৈপরীত্যই বর্তমান বিশ্বের চিত্র। পানির সংকট ও বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য পানি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। শুধু পান করার জন্যই নয়, জগৎ টিকিয়ে রাখার জন্য, অন্য সব খাদ্য উৎপাদনের জন্যও পানি অপরিহার্য। এই অপরিহার্যতাই পানির দিকে কোম্পানির মুনাফার আকর্ষণ তৈরি করেছে। আর তাতে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বিপদ বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পানি প্রকৃতির অংশ, এটা কেউ তৈরি করেনি। এটি সর্বজনের। প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি সবার জন্মগত অধিকার। এই পানি কেন কোম্পানির মালিকানায় যাবে? পানি কেন পণ্যে পরিণত হবে? কেন পানি কিনে খেতে হবে?
পৃথিবীর যত পানি, তার শতকরা প্রায় ৯৭ দশমিক ৫ ভাগই সমুদ্রে, অতএব নোনা। এই পানি ধারণ করে আছে জানা-অজানা অনেক সম্পদ। বাকি শতকরা ২ দশমিক ৫ ভাগের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি জমে আছে বরফ হয়ে, যা জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। বাকি পানির তিন-চতুর্থাংশই ভূগর্ভস্থ পানি, যা এই পৃথিবীকে শুধু বাঁচিয়ে রাখেনি, তাকে অবিরাম সৃজনশীল রেখেছে। বাকি অর্থাৎ শতকরা মাত্র শূন্য দশমিক ৩ ভাগ পানি আছে নদী, খাল-বিল, জলাশয় ইত্যাদিতে। অতএব, সব মিলিয়ে পৃথিবীর মোট পানির শতকরা ১ ভাগের কম পানযোগ্য।
বাংলাদেশের মানুষ বিপুল সুপেয় পানির আধারের মধ্যে বাস করে। পৃথিবীর বহু দেশ পানযোগ্য পানির ভয়াবহ সংকটে আছে। কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলে খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। একেকজনকে দিনে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা এই কাজে ব্যয় করতে হয়। আর এই কাজ করতে হয় মেয়েদেরই। প্রতিদিন ভারী পাত্র নিয়ে পানির জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটার দৃশ্য পৃথিবীর বহু দেশে খুব পরিচিত।
ভারত-পাকিস্তানেও বহু অঞ্চল আছে, যেখানে একটি জলাশয় বা একটি কূপ থেকে পানি সংগ্রহের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে, কোনো বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অধিকাংশ এলাকায়ও খাওয়ার পানির সংকট প্রকট। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সমুদ্রের পানি থেকে লবণ দূর করে সুপেয় পানির জোগান দিচ্ছে। বর্তমানে প্রধানত পারস্য উপসাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় প্রায় ১৫ হাজার ডিস্যালিনাইজেশন প্ল্যান্ট থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি গ্যালন সুপেয় পানি জোগান দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে যান্ত্রিক সেচের মাধ্যমে বিপুল পানির চাহিদা তৈরির মাধ্যমে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার ভূ-উপরিস্থিত পানি দূষিত করছে। এ ছাড়া আছে ভবন-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে নদী, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। ইটের ভাটা, শিল্পবর্জ্য তো আছেই। এর পাশাপাশি আছে সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ, কোথাও বন্যানিয়ন্ত্রণের নামে, কোথাও সড়ক পরিবহনের সুবিধার জন্য বাছবিচারহীনভাবে বাঁধ-কালভার্ট নির্মাণ। এগুলোর ফলে কোথাও নদীর অবাধ প্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও পানির প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে পানি, মাটি, অতঃপর মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে।
শুধু দেশের ভেতর নয়, ভারতে নির্মিত বাঁধ এবং পানিনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাও বাংলাদেশের জন্য হুমকি। ফারাক্কা বাঁধ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন, নদীর প্রবাহ, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র্য—সবকিছুরই অপরিমেয় ক্ষতি করেছে। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলও এখন এর জন্য ক্ষতির শিকার। এর ওপর আবার টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। সম্প্রতি চীনও ব্রহ্মপুত্র নিয়ে যে বাঁধ পরিকল্পনা করছে, তা বাস্তবায়িত হলে ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারা বিশ্বেই বাঁধ একটি বড় বাণিজ্যিক তৎপরতা। শুধু বাঁধের কারণে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে আট কোটি মানুষ এখন উদ্বাস্তু।
বিশ্বব্যাপী পানিদূষণের একটি বড় কারণ যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা ও তার ব্যবহার। সমুদ্র, মহাকাশসহ বিভিন্ন স্থানে পারমাণবিক, রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা বা প্রয়োগ করতে গিয়ে কিংবা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বায়ুমণ্ডল থেকে ভূগর্ভস্থ পর্যন্ত সবই বিপজ্জনক মাত্রায় দূষণের শিকার হচ্ছে। জাপানের ফুকুশিমায় তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনায়ই বায়ু, পানি, খাদ্য—সবকিছুর ওপর যে ভয়াবহ প্রভাবের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাপী এগুলোর সম্ভাব্য বিপদ কল্পনা করাও কঠিন। বিষাক্ত অস্ত্রের সার্বক্ষণিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল কী হচ্ছে, তার বেশির ভাগই আমাদের অজানা। কেননা, যারা এসবের জন্য দায়ী, প্রচারযন্ত্রের ওপরও তাদেরই নিয়ন্ত্রণ।
১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই উন্নয়নের নামে জগতের বাকি সবকিছু ব্যক্তিমালিকানা, বাণিজ্য আর মুনাফার কর্তৃত্বে আনার উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। খনিজ সম্পদ, সড়ক, রেলপথ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ শুধু নয়; ক্রমে পানিও এই আগ্রাসনের অধীনে যাচ্ছে। এই কাজে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো পানির বাণিজ্যিকীকরণেও অগ্রণী। ঋণের জালের বিশেষ শর্ত হিসেবে পানি ব্যক্তিমালিকানায় বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে রূপান্তরের চাপ দিনে দিনে বেড়েছে। পানি-বাণিজ্যের উচ্চ মুনাফার সম্ভাবনায় এই খাতে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগও তাই ক্রমবর্ধমান। এখন বিশ্বের তিনটি বৃহৎ পানি বহুজাতিক কোম্পানি হলো সুয়েজ, ভিওলিয়া ভিভেন্দি এবং আরডব্লিউই। কোক-পেপসি এবং যারা খাওয়ার পানি দখল করে পানীয়-বাণিজ্য করছে, তারাও এখন পানি-বাণিজ্যে প্রবেশ করেছে। জার্মান কয়লা কোম্পানি আরডব্লিউই, যাদের মুনাফা বাড়াতে পানিসম্পদ বিনষ্ট হয়, তারাও এখন পানি-বাণিজ্য শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী বলিভিয়া নব্বইয়ের দশকের শেষেই পানি বাণিজ্যিকীকরণ করার নীতি গ্রহণ করে। সেই মোতাবেক মার্কিন কোম্পানি বেখটেল বলিভিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর কোচাবাম্বার সব পানি সরবরাহব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে। এমনকি বৃষ্টির পানিও তাদের কর্তৃত্বাধীন করা হয়। পানির দাম পরিশোধে ব্যর্থ হলে নাগরিকদের ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত করারও অধিকার দেওয়া হয় এই মার্কিন কোম্পানিকে। বলিভিয়ার গ্যাস নিয়েও এ রকম চুক্তি করা হয়।
রাস্তায় প্রতিরোধ তৈরি করা ছাড়া তখন বলিভিয়ার জনগণের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। তারা তা-ই করেছে। ক্রমে পানি ও গ্যাসসম্পদ রক্ষার আন্দোলন বলিভিয়ায় বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এর মধ্য দিয়ে পানির ওপর বলিভিয়ার সব নাগরিকের অধিকার, গ্যাসসম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা এখন স্বীকৃত। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাবই বলছে, ১৯৯০-এর দশকে যত পানি সরবরাহব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানার বাণিজ্যিক তৎপরতার আওতায় আনা হয়েছিল, তার ৮৪ ভাগ ২০০৭ পর্যন্ত টিকে আছে, ২৪টি দেশ পানিব্যবস্থার আবারও রাষ্ট্রীয়করণ করেছে। বিভিন্ন সমীক্ষার সূত্রে দ্য ওয়াটার বিজনেস গ্রন্থ দেখাচ্ছে যে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পানির ওপর সুয়েজ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের পরই পানিদূষণ বৃদ্ধি পায়। কানাডার অন্টারিওতে পানিদূষণে কমপক্ষে সাতজন মৃত্যুবরণ করে, কেননা তাদের প্ল্যান্ট ও টেস্ট-প্রক্রিয়া তারা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে গোপন রেখেছিল। মরক্কোর মানুষ কাসাব্লাঙ্কায় পানির দাম তিন গুণ বৃদ্ধির মধ্যেই বাণিজ্যিকীকরণের মর্ম বুঝতে পেরেছিল। আর্জেন্টিনার পানির কর্তৃত্বও পেয়েছিল সুয়েজ কোম্পানি। ফলে পানির দাম দ্বিগুণ হয়েছিল, কিন্তু এর গুণগত মানের অবনতি হয়েছিল। মানুষের প্রতিবাদে, বিল পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানোয় পরে কোম্পানি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। একই কারণে ব্রিটেনেও পানির দাম বেড়ে যায়। পানির বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিবাদে নিউজিল্যান্ডের মানুষকেও রাস্তায় নামতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও পানি বাণিজ্যিকীকরণে সুয়েজ কর্তৃত্ব পেয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই পানি এমন বিষাক্ত হয়েছিল যে কলেরা মহামারি আকার নেওয়ায় পানি-সংযোগ অনেক দিন বিচ্ছিন্ন থাকে। ইরাক ধ্বংসযজ্ঞের পর বেখটেল ও এসব কোম্পানির জন্য সোনায় সোহাগা হয়। এখন আর বিশুদ্ধ পানি পান ইরাকের মানুষের জন্য সহজ নয়। জীবন, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসা—সবই এখন আগ্রাসী দখলদারদের কবলে। ঘানা ও উরুগুয়েও এই পথে গিয়েছিল, পরে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জনবিক্ষোভ তৈরি হয়। ২০০৪ সালে গণভোটের মাধ্যমে এ দুই দেশে পানির ব্যক্তি বাণিজ্যিকীকরণ নিষিদ্ধ হয়। নেদারল্যান্ডসও একই বছর সর্বজনের পানি সরবরাহ ব্যক্তীকরণ নিষিদ্ধ করে আইন পাস করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করলে জনগণের বর্তমান অসুখ-বিসুখের শতকরা ৭০ ভাগ কমে যাবে। অথচ বিপুল আধারের মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। হেলায়ফেলায় নিজেদের সম্পদকে অভিশাপে পরিণত করতে বাংলাদেশের শাসকদের জুড়ি পাওয়া ভার। যত দিন যাচ্ছে, তত পানিদূষণ বাড়ছে; বোতল পানির বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে। পানি সরবরাহের মূল ব্যবস্থাও নানা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার আয়োজন চলছে। ভিওলিয়া, সুয়েজসহ দেশি-বিদেশি পানি-বণিকেরা এখন নানাভাবে বাংলাদেশে হাজির হচ্ছে। অন্যদিকে, দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিল। বাছবিচারহীন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প ভূগর্ভস্থ ও উপরিস্থ পানির জন্য একের পর এক বিপদ ডেকে আনছে। সম্ভাবনা বাড়ছে পানি ব্যবসার। বিপদ বাড়ছে সর্বজনের।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu

No comments

Powered by Blogger.