শিশুসন্তানকে হত্যার নৃশংস বর্ণনা সৎমায়ের by নুরুজ্জামান লাবু
‘রাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য বারবার ডাকাডাকি
করছিল মায়মুনা। এতে বিরক্ত হই। এজন্য তাকে প্রথমে মারধর করি। এতে সে
চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। চিৎকারের শব্দ যেন বাইরে না যায় এজন্য ওর মুখ চাপ
দিয়ে ধরি। ছুটে গিয়ে আবার চিৎকার শুরু করে। পরে ওড়না মুখে গুজে ধরে থাকি।
একটু পর দেখি মায়মুনা আর নড়াচড়া করছে না। পরে তার লাশ নিয়ে বাথরুমের পানির
ড্রামে চুবিয়ে রাখি।’ ছয় বছরের শিশু মায়মুনাকে নৃশংসভাবে হত্যার এমন
লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন সৎমা সুমাইয়া ইসলাম শারমিন। গতকাল সকালে ঢাকার মুখ্য
মহানগর হাকিম আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট স্নিগ্ধা রাণী চক্রবর্তীর কাছে
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন শারমিন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত
তার স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করা হয়। স্বীকারোক্তিতে শিশু মায়মুনাকে হত্যার
আদ্যোপান্ত বর্ণনা দেন তিনি।
গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকার হাসনাহেনা লেনের ৮৯/১১ নম্বর বাসার বাথরুমের ড্রামের ভেতর থেকে শিশু মায়মুনার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার কাঁধ ও হাতের কব্জি ভাঙা ছিল। মায়মুনার পিতা আবদুর রাজ্জাক বাদী হয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন ও অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। লাশ উদ্ধারের পরপরই পুলিশ মায়মুনার সৎমা সুমাইয়া ইসলাম শারমিনকে গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মায়মুনাকে হত্যার কথা অস্বীকার করে। শনিবার পুলিশ তাকে দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। একপর্যায়ে শিশু মায়মুনাকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজী হন তিনি।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সৎমা সুমাইয়া ইসলাম শারমিন বলেন, ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে মায়মুনার বাবা আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তিনি ধলপুরের হাসনাহেনা লেনের ৮৯/১১ নম্বর বাসার চারতলায় স্বামী ওয়াসার স্টোর কিপার, শাশুড়ি ফুলজান বিবি ও স্বামীর আগের ঘরের সন্তান মায়মুনাকে নিয়ে থাকতেন। প্রথম দিকে তিনি মায়মুনাকে আদর করতেন। কিন্তু বছর খানেক পর তার নিজের একটি কন্যা সন্তান হয়। এরপর থেকে তিনি আর স্বামীর আগের ঘরের সন্তান মায়মুনাকে সহ্য করতে পারতেন না। দিন দিন মায়মুনা অসহ্য হয়ে উঠছিল। মনে হতো স্বামী আবদুর রাজ্জাক মায়মুনাকে বেশি ভালোবাসে। এক মাস নয় দিন আগে তার আরেকটি কন্যা শিশু হয়। সিজারের মাধ্যমে সন্তান হওয়ায় তার শরীরও অসুস্থ ছিল। দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার পর মায়মুনা আরো বেশি অসহ্য হয়ে ওঠে।
সৎমা শারমিন বলেন, গত বৃহস্পতিবার তার স্বামী আব্দুর রাজ্জাক গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে যান। ওইদিন রাতেই একা থাকতে ভয় করে বলে শাশুড়ি ফুলজান বিবির কাছ থেকে মায়মুনাকে ডেকে তার ঘরে নিয়ে আসেন। মায়মুনা সবসময় তার দাদি ফুলজান বিবির সঙ্গে ঘুমাতো। রাতে তার সঙ্গে মায়মুনা ঘুমায়। শারমিন দাবি করেন, মায়মুনা অসহ্য হয়ে উঠলেও তাকে হত্যার কোন পরিকল্পনা ছিল না তার। ঘুম না আসার কারণে তিনি রাতে ঘুমের ওষুধও খেয়েছিলেন। রাত ৩টার দিকে মায়মুনা হঠাৎ তাকে ডাকাডাকি শুরু করে। তাকে টয়লেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। এতে তিনি বিরক্ত হন। বারবার ডাকাডাকির কারণে মায়মুনাকে তিনি চড়-থাপ্পড় মারেন। এসময় মায়মুনা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। মধ্যরাতে মায়মুনার চিৎকারের শব্দ যেন বাইরে না যায় এজন্য তিনি মুখ চেপে ধরেন। এতে ছটফটানো শুরু করে মায়মুনা। হাত থেকে ছুটে গিয়ে আবারও চিৎকার শুরু করে। এতে তিনি আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওড়না দিয়ে মায়মুনার মুখ চেপে ধরেন। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে মায়মুনা আর নড়াচড়া করছে না। পরে ওড়না সরিয়ে দেখেন মায়মুন নিথর হয়ে পড়ে আছে। কয়েকবার ডাকাডাকি করে বুঝতে পারেন মায়মুনা আর বেঁচে নেই। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সৎমা বলেন, মায়মুনার লাশ বিছানায় নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ বসে থাকেন। এরপর যে কোন একটি নাটক সাজানোর চেষ্টা করেন। পরে রাতেই মায়মুনার লাশ কোলে নিয়ে বাথরুমে যান। সেখানে ড্রাম ভর্তি পানিতে নিহত মায়মুনার মাথার অংশটি নিচের দিকে চুবিয়ে দেন। পা দুটো ড্রামের বাইরে রেখে ফিরে আসেন নিজের ঘরে। পরে ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকেন। সকালে তার শাশুড়ি মায়মুনাকে ডাকাডাকি করে। তিনি এসময় শাশুড়িকে বলেন, সকালে উঠে হয়তো বাথরুমে গেছে। পরে শাশুড়ি বাথরুমে গিয়ে মায়মুনাকে ড্রামের ভেতরে অর্ধেক আর বাইরে অর্ধেক দেখে চিৎকার শুরু করে। পরে পুলিশ গিয়ে মায়মুনার লাশ উদ্ধার করে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, মায়মুনার সৎমা শারমিন অনেক চতুর। সে পরিকল্পিতভাবে মায়মুনাকে হত্যা করেছে। কিন্তু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সে এসব তথ্য এড়িয়ে ঘটনাক্রমে হত্যা করার কথা বলেছে। এর আগেও সে কয়েকবার মায়মুনাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মমিনুল হক চৌধুরী বলেন, পরিকল্পিত হোক আর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তেই হোক শারমিন হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এখন দ্রুত মামলার অভিযোগপত্র দিয়ে দেয়া হবে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শঙ্কর রায বলেন, আমরা প্রথমেই ধারণা করেছিলাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৎমা শারমিন জড়িত। কিন্তু সে প্রথমে হত্যায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। কখনও মায়মুনাকে জিনে মেরেছে আবার কখনো ‘আল্লাহ জানে’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে রিমান্ডে নিয়ে টানা জিজ্ঞাসাবাদে সে এক পর্যায়ে সবকিছু বলতে থাকে। স্বজনেরা জানান, মায়মুনা স্থানীয় একটি মাদরাসার প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। পাঁচ বছর আগে তার মা রুনা আক্তারের মৃত্যু নিয়ে ধূম্রজাল রয়েছে। সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা থাকা অবস্থায় মায়মুনার মা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এঘটনায় মায়মুনার বাবা আব্দুর রাজ্জাক কিছুদিন জেলও খেটেছেন। পরে মায়মুনার নামে সাত লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে দেয়ার শর্তে তাকে জেল থেকে বের করে আনা হয়। স্বজনদের ধারণা, একারণেও সৎমা শারমিন মায়মুনাকে সহ্য করতে পারতো না।
No comments