যারা ‘নায়ক’ হতে চেয়েছিল by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
সুন্দর গানের গলা ছিল গিয়াস হাজারীর। চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে একটি একক গানের অনুষ্ঠানও হয়েছিল তাঁর। গান শুনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা। এমনকি উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ ও গায়কির মিলও খুঁজে পেয়েছিলেন অত্যুৎসাহীদের কেউ কেউ। সেদিনের সে প্রশংসায় এতই আপ্লুত হয়েছিলেন গিয়াস, নিজের নামের কিছুটা পাল্টে ‘গিয়াস হাজারিকা’ নামে পরিচিতিও তৈরি করেছিলেন নিজ উদ্যোগে। অডিও প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেক থেকে একটি গানের অ্যালবাম প্রকাশের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিলেন গিয়াস। শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজে নিবেদিত থাকলে আজ সংগীতজগতে তাঁর একটি অবস্থান তৈরি হলেও হতে পারত। কিন্তু হয়নি। গিয়াস হাজারিকা জড়িয়ে পড়লেন অন্য এক হিরোইজমের নেশায়।
সংবাদপত্রের পাতায় গিয়াস হাজারিকার ছবি ছাপা হলো গায়ক হিসেবে নয়, সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে আট তরুণের হত্যাকাণ্ড ঘটনার পর পুলিশি তৎপরতা ও তদন্ত সূত্রে উঠে আসে গিয়াস হাজারিকার নাম। সেটা ২০০০ সাল। জানা গেল নাটকীয় অনেক কিছু। তাঁর ঘরের শোকেসে থরে থরে সাজানো থাকত দেশি-বিদেশি নানা অস্ত্র। বন্ধু-বান্ধবের কাছে এসব দুর্লভ সংগ্রহ প্রদর্শন করতেন, গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতেন এসব অস্ত্রের নাম ও দাম। গুলি করে পুকুরের মাছ শিকার করার মতো তাঁর অদ্ভুত বিলাসিতার কথাও মুখে মুখে প্রচারিত ছিল তখন। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রভাবশালী মানুষ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। স্থানীয় কলেজে ছাত্র সংসদ গঠিত হতে পারত না তাঁর অনুমোদন ছাড়া। ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে যেমন ছিল তাঁর ভূমিকা, তেমনি শিবিরের হাতে ছাত্রলীগের কর্মী খুনের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর কাছ থেকে কিনে নেওয়া অস্ত্র।
বিত্তবান পরিবারের সন্তান, সংগীতের অনুরাগী গিয়াস কেন পা বাড়িয়েছিলেন অন্ধকার জগতে? কারণ, তিনি দ্রুত ‘নায়ক’ উঠতে চেয়েছিলেন। অর্থে-বিত্তে-শক্তি-সামর্থ্যে সবার সমীহ আদায় করতে চেয়েছিলেন দ্রুত। কিন্তু জীবন তো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের মতো সহজ ধারায়, ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন পরিচালকের নির্দেশে চলে না। গিয়াস হাজারিকারও তাই ‘নায়ক’ হওয়া হয়নি; বরং যে রকম নির্মম মৃত্যু অনিবার্য নিয়তি ছিল তাঁর, সে রকমই ঘটেছে। কারাভোগ করেছেন কিছুদিন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েও মুক্তি মেলেনি নিজের তৈরি বৃত্ত থেকে। ২০০৫ সালে র্যা বের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছিলেন গিয়াস হাজারিকা।
হাসানুল করিম (মানিক) নামের আরেকজন তরুণকে চিনতাম। দেশের প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কাছে কিছুদিন সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন বলেও শুনেছি। চমৎকার গজল গাইয়ে হিসেবে সীমিত পরিসরে গুণমুগ্ধ কিছু শ্রোতাও জুটেছিল তাঁর। কিন্তু তাঁরও জীবনের গল্প হয়ে গেল অন্য রকম। নিজের সহজাত প্রতিভাকে মূল্য দিতে শিখলেন না মানিক। শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের সন্তান মানিক জড়িয়ে পড়েছিলেন কুসঙ্গে। হত্যা মামলার কয়েকজন আসামিকে ছাড়িয়ে আনার জন্য চট্টগ্রাম আদালত ভবনে পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন। পরে পুলিশের হাতেই প্রাণ হারাতে হয় তাঁকে। সেটা ১৯৮৮ বা ১৯৮৯ সালের ঘটনা।
আলম নামের আর এক সন্ত্রাসীর উত্থানে একসময় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল পুরো চট্টগ্রাম শহর। নন্দনকানন এলাকায় এই সন্ত্রাসী এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল যে, শত শত তরুণ অনুসারী জুটে গিয়েছিল তার। কথিত আছে, আলম ঈদের দিন যখন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেত, তখন গাড়িবহরে থাকা সমর্থকেরা গুলি ফুটিয়ে উল্লাস প্রকাশ করত। মনে পড়ে, সদরঘাট এলাকার এক ব্যবসায়ী তার দাবি অনুযায়ী চাঁদা পরিশোধ না করায় একটি নির্জন মাঠে দাঁড় করিয়ে তাঁর শরীরের চারপাশে মাটিতে একের পর এক ফাঁকা গুলি করে পৈশাচিক উল্লাস করেছিল আলম। ভয়ে যখন প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন সেই ব্যবসায়ী, তখন তাঁর পায়ে গুলি করে তাঁকে ফেলে রেখে গিয়েছিল সেখানে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকেও আলমের দাবি অনুযায়ী টাকা পাঠাতে হয়েছিল তাঁকে।
আলম গ্রেপ্তার হওয়ার পর কারাগারেও তাঁর দৌরাত্ম্য অব্যাহত ছিল। কারা প্রশাসনকে পর্যন্ত তটস্থ থাকতে হতো বলে শোনা যায়। সেই আলমের সঙ্গে একদিন ভিজিটিং আওয়ারে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর মা ও বোন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেদিনই সেখানে আর এক কয়েদি কাদের (মাছ কাদের নামে পরিচিত) পূর্বশত্রুতার জের ধরে অতর্কিতে ধারালো ব্লেড দিয়ে তার গলা ও কাঁধের রগ কেটে দেয়। মা ও বোনের সামনে, অপেক্ষমাণ অনেক দর্শনার্থীর সামনে, এমনকি কারাপ্রহরীদেরও সামনে ছটফট করতে করতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আলম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আলমের মা ও বোন তখন চিৎকার করে কেঁদে সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন, দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, কারাপ্রহরীরা যেন ইচ্ছা করেই সময়ক্ষেপণ করেছিলেন। হয়তো তাঁরা চেয়েছিলেন এভাবেই ‘আপদ বিদায় হোক’।
এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা আমরা দেখেছি, অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও প্রকারান্তরে ভুক্তভোগীর কাছে যা স্বস্তির বিষয় হয়ে উঠেছে। কখনো অস্ত্রের জোরে কখনো বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে উঠেছে কিছু তরুণ। অর্থে-বিত্তে-ক্ষমতায় তাঁদের নায়ক (বস্তুত খলনায়ক) হয়ে ওঠার উদগ্র বাসনা শেষ পর্যন্ত ডেকে এনেছে করুণ পরিণতি।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনের দেয়ালে কোনো না কোনো তরুণের নামে একটি স্লোগান উৎকীর্ণ থাকত—‘অমুক ঘুমাও শান্তিতে, আমরা জেগে আছি তোমার হত্যার বদলা নিতে’। রাউজানের বাবর-মুজিব বা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের কামালের হত্যাকারীরা অনেকেই এ রকম প্রতিশোধের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন প্রতিপক্ষের হাতে। অর্থাৎ একটি মৃত্যুর মধ্যেই উপ্ত থাকে আরও মৃত্যুর বীজ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠনের নেতা হামিদের প্রবল প্রতাপের কথা এখনো মনে আছে অনেকের। চারপাশে অস্ত্রধারী ক্যাডার নিয়ে বীরদর্পে ক্যাম্পাসে বিচরণ করতেন হামিদ। সেই হামিদের কবজিসমেত হাত কেটে নিয়ে শিবিরের সন্ত্রাসীদের উল্লাস মিছিলের কথাও ভুলতে পারবেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা।
জাতীয় পার্টির আমলে হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাউজান এলাকায় আবদুল্লাহ ওরফে আবদুইয়া নামের এক সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছিলেন সেখানকার প্রশাসনের চেয়েও ক্ষমতাবান। দু-একজন মন্ত্রী-সাংসদের আশীর্বাদে আবদু বাহিনী গাড়ির বহর নিয়ে সশস্ত্র মহড়া দিত এলাকায়। ওই সব এলাকা থেকে একসময় কয়েক শ পরিবার নিজেদের বসতবাড়ি জমিজমা ফেলে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। তাবলিগ জামাতে যোগ দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর পর এলাকায় ফিরে এসে জনসমক্ষে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন আবদুল্লাহ। কিন্তু অতীত তাঁকে ছাড়েনি। হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল তাঁর বুক। সেটা সম্ভবত ২০০৮ সাল।
এই ঘটনাগুলো অতীতের। অজস্র ঘটনার মধ্য থেকে দৈবচয়ন করে নেওয়া কিছু অংশ। নতুন করে এসব গল্পের অবতারণা কেন? কারণ, ইতিহাসের অলিখিত নিয়মটাই এই যে, ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়। আজ যাঁরা নতুন করে অস্ত্রের জোরে, ক্ষমতার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে ‘নায়ক’ হয়ে উঠতে চান, তাঁদের শুধু বলব, এই সব বহুল পঠিত গল্পের দু-একটি পৃষ্ঠা নতুন করে পাঠ করুন। তাহলে হয়তো জীবন নিয়ে আবার নতুন করে ভাবার সুযোগ আসবে। বদলেও যেতে পারে জীবন।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
সংবাদপত্রের পাতায় গিয়াস হাজারিকার ছবি ছাপা হলো গায়ক হিসেবে নয়, সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে আট তরুণের হত্যাকাণ্ড ঘটনার পর পুলিশি তৎপরতা ও তদন্ত সূত্রে উঠে আসে গিয়াস হাজারিকার নাম। সেটা ২০০০ সাল। জানা গেল নাটকীয় অনেক কিছু। তাঁর ঘরের শোকেসে থরে থরে সাজানো থাকত দেশি-বিদেশি নানা অস্ত্র। বন্ধু-বান্ধবের কাছে এসব দুর্লভ সংগ্রহ প্রদর্শন করতেন, গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতেন এসব অস্ত্রের নাম ও দাম। গুলি করে পুকুরের মাছ শিকার করার মতো তাঁর অদ্ভুত বিলাসিতার কথাও মুখে মুখে প্রচারিত ছিল তখন। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রভাবশালী মানুষ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। স্থানীয় কলেজে ছাত্র সংসদ গঠিত হতে পারত না তাঁর অনুমোদন ছাড়া। ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে যেমন ছিল তাঁর ভূমিকা, তেমনি শিবিরের হাতে ছাত্রলীগের কর্মী খুনের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর কাছ থেকে কিনে নেওয়া অস্ত্র।
বিত্তবান পরিবারের সন্তান, সংগীতের অনুরাগী গিয়াস কেন পা বাড়িয়েছিলেন অন্ধকার জগতে? কারণ, তিনি দ্রুত ‘নায়ক’ উঠতে চেয়েছিলেন। অর্থে-বিত্তে-শক্তি-সামর্থ্যে সবার সমীহ আদায় করতে চেয়েছিলেন দ্রুত। কিন্তু জীবন তো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের মতো সহজ ধারায়, ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন পরিচালকের নির্দেশে চলে না। গিয়াস হাজারিকারও তাই ‘নায়ক’ হওয়া হয়নি; বরং যে রকম নির্মম মৃত্যু অনিবার্য নিয়তি ছিল তাঁর, সে রকমই ঘটেছে। কারাভোগ করেছেন কিছুদিন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েও মুক্তি মেলেনি নিজের তৈরি বৃত্ত থেকে। ২০০৫ সালে র্যা বের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছিলেন গিয়াস হাজারিকা।
হাসানুল করিম (মানিক) নামের আরেকজন তরুণকে চিনতাম। দেশের প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কাছে কিছুদিন সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন বলেও শুনেছি। চমৎকার গজল গাইয়ে হিসেবে সীমিত পরিসরে গুণমুগ্ধ কিছু শ্রোতাও জুটেছিল তাঁর। কিন্তু তাঁরও জীবনের গল্প হয়ে গেল অন্য রকম। নিজের সহজাত প্রতিভাকে মূল্য দিতে শিখলেন না মানিক। শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের সন্তান মানিক জড়িয়ে পড়েছিলেন কুসঙ্গে। হত্যা মামলার কয়েকজন আসামিকে ছাড়িয়ে আনার জন্য চট্টগ্রাম আদালত ভবনে পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন। পরে পুলিশের হাতেই প্রাণ হারাতে হয় তাঁকে। সেটা ১৯৮৮ বা ১৯৮৯ সালের ঘটনা।
আলম নামের আর এক সন্ত্রাসীর উত্থানে একসময় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল পুরো চট্টগ্রাম শহর। নন্দনকানন এলাকায় এই সন্ত্রাসী এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল যে, শত শত তরুণ অনুসারী জুটে গিয়েছিল তার। কথিত আছে, আলম ঈদের দিন যখন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেত, তখন গাড়িবহরে থাকা সমর্থকেরা গুলি ফুটিয়ে উল্লাস প্রকাশ করত। মনে পড়ে, সদরঘাট এলাকার এক ব্যবসায়ী তার দাবি অনুযায়ী চাঁদা পরিশোধ না করায় একটি নির্জন মাঠে দাঁড় করিয়ে তাঁর শরীরের চারপাশে মাটিতে একের পর এক ফাঁকা গুলি করে পৈশাচিক উল্লাস করেছিল আলম। ভয়ে যখন প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন সেই ব্যবসায়ী, তখন তাঁর পায়ে গুলি করে তাঁকে ফেলে রেখে গিয়েছিল সেখানে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকেও আলমের দাবি অনুযায়ী টাকা পাঠাতে হয়েছিল তাঁকে।
আলম গ্রেপ্তার হওয়ার পর কারাগারেও তাঁর দৌরাত্ম্য অব্যাহত ছিল। কারা প্রশাসনকে পর্যন্ত তটস্থ থাকতে হতো বলে শোনা যায়। সেই আলমের সঙ্গে একদিন ভিজিটিং আওয়ারে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর মা ও বোন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেদিনই সেখানে আর এক কয়েদি কাদের (মাছ কাদের নামে পরিচিত) পূর্বশত্রুতার জের ধরে অতর্কিতে ধারালো ব্লেড দিয়ে তার গলা ও কাঁধের রগ কেটে দেয়। মা ও বোনের সামনে, অপেক্ষমাণ অনেক দর্শনার্থীর সামনে, এমনকি কারাপ্রহরীদেরও সামনে ছটফট করতে করতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আলম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আলমের মা ও বোন তখন চিৎকার করে কেঁদে সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন, দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, কারাপ্রহরীরা যেন ইচ্ছা করেই সময়ক্ষেপণ করেছিলেন। হয়তো তাঁরা চেয়েছিলেন এভাবেই ‘আপদ বিদায় হোক’।
এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা আমরা দেখেছি, অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও প্রকারান্তরে ভুক্তভোগীর কাছে যা স্বস্তির বিষয় হয়ে উঠেছে। কখনো অস্ত্রের জোরে কখনো বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে উঠেছে কিছু তরুণ। অর্থে-বিত্তে-ক্ষমতায় তাঁদের নায়ক (বস্তুত খলনায়ক) হয়ে ওঠার উদগ্র বাসনা শেষ পর্যন্ত ডেকে এনেছে করুণ পরিণতি।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনের দেয়ালে কোনো না কোনো তরুণের নামে একটি স্লোগান উৎকীর্ণ থাকত—‘অমুক ঘুমাও শান্তিতে, আমরা জেগে আছি তোমার হত্যার বদলা নিতে’। রাউজানের বাবর-মুজিব বা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের কামালের হত্যাকারীরা অনেকেই এ রকম প্রতিশোধের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন প্রতিপক্ষের হাতে। অর্থাৎ একটি মৃত্যুর মধ্যেই উপ্ত থাকে আরও মৃত্যুর বীজ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠনের নেতা হামিদের প্রবল প্রতাপের কথা এখনো মনে আছে অনেকের। চারপাশে অস্ত্রধারী ক্যাডার নিয়ে বীরদর্পে ক্যাম্পাসে বিচরণ করতেন হামিদ। সেই হামিদের কবজিসমেত হাত কেটে নিয়ে শিবিরের সন্ত্রাসীদের উল্লাস মিছিলের কথাও ভুলতে পারবেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা।
জাতীয় পার্টির আমলে হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাউজান এলাকায় আবদুল্লাহ ওরফে আবদুইয়া নামের এক সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছিলেন সেখানকার প্রশাসনের চেয়েও ক্ষমতাবান। দু-একজন মন্ত্রী-সাংসদের আশীর্বাদে আবদু বাহিনী গাড়ির বহর নিয়ে সশস্ত্র মহড়া দিত এলাকায়। ওই সব এলাকা থেকে একসময় কয়েক শ পরিবার নিজেদের বসতবাড়ি জমিজমা ফেলে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। তাবলিগ জামাতে যোগ দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর পর এলাকায় ফিরে এসে জনসমক্ষে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন আবদুল্লাহ। কিন্তু অতীত তাঁকে ছাড়েনি। হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল তাঁর বুক। সেটা সম্ভবত ২০০৮ সাল।
এই ঘটনাগুলো অতীতের। অজস্র ঘটনার মধ্য থেকে দৈবচয়ন করে নেওয়া কিছু অংশ। নতুন করে এসব গল্পের অবতারণা কেন? কারণ, ইতিহাসের অলিখিত নিয়মটাই এই যে, ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়। আজ যাঁরা নতুন করে অস্ত্রের জোরে, ক্ষমতার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে ‘নায়ক’ হয়ে উঠতে চান, তাঁদের শুধু বলব, এই সব বহুল পঠিত গল্পের দু-একটি পৃষ্ঠা নতুন করে পাঠ করুন। তাহলে হয়তো জীবন নিয়ে আবার নতুন করে ভাবার সুযোগ আসবে। বদলেও যেতে পারে জীবন।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
No comments