শব্দলীলা ছন্দকলায় নিরীক্ষাপ্রবণ কবি হাসান হাফিজ by সাযযাদ কাদির
শুভ জন্মদিন, হাসান হাফিজ। আমাদের সকল
শুভাশিস তাঁর প্রতি। এই সঙ্গে তাঁর পরিবারের প্রতিও। কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক
তিনি। পরিচয় আছে আরো। সম্পাদক, গবেষক, সংগঠক। ১৫ অক্টোবর ৬০তম জন্মদিন ছিল
তাঁর। এ উপলক্ষে একজন পাঠক ও অনুরাগী হিসাবে জানাই অশেষ প্রীতি, কামনা করি
জীবন ও কর্মের উত্তরোত্তর সাফল্য ও সার্থকতা। পার হয়ে আসা বছরগুলোর মতো
আগামী বছরগুলোও তাঁর উজ্জ্বল হয়ে উঠুক সৃষ্টিশীলতায়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে
চলার সম্ভাবনার প্রত্যয়ী। দানে ও প্রাপ্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠুক জীবন। হাসান
হাফিজকে নিয়ে সব সময়ই কিছু না কিছু বলার থাকে আমার, আজকে সবার সঙ্গে বলার
এই শুভদিনে অল্পকিছু বলার সুযোগটা চাই না হারাতে। তবে বিশেষভাবে বলি তাঁর
কবিতা সম্পর্কে। কারণ কবি পরিচয়ই তাঁর প্রধান।
কবিতার পাঠক হিসেবে এক বিশেষ সীমাবদ্ধতা আছে আমার। প্রথমে আকৃষ্ট হই তিনটি নামেÑ কবিতার, কবিতার বইয়ের ও কবির নামে। তারপর অবগাহন করি কবিতায়। এ ক্ষেত্রে হাসান হাফিজের বইয়ের নাম আকর্ষণ করেছে আমাকে সব সময়েই। তাঁর নিজের নাম যেমন সুচয়িত, তেমনই সুচিন্তিত তাঁর কবিতা ও কবিতার বইয়ের নাম। সর্বশেষ কাব্য ‘রোমান্টিক কবিতা’ (২০১৪)-এ উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী তাঁর স্বতন্ত্র কবিতার বইয়ের সংখ্যা ৩৭ (কবিতা সঙ্কলন-গ্রন্থের সংখ্যা ৮)। প্রতিটি বইয়ের নামই আকর্ষণীয়, আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে কয়েকটি নাম (তুমি বধূ অবিবাহের, ভালোবাসার অগ্নিচুমুক, বিভ্রমের বিষলতা, স্তবগান সুন্দরের, নীরবতাই অস্ত্র আমার, পুণ্য পুঁজি কিছু নাই, শিশুকালের জবাকুসুম, মনে মনে নিরলে গোপনে)। আসলে কবি তাঁর সৌন্দর্যবোধের প্রথম প্রমাণ দেন ওই নামে। এ ক্ষেত্রে হাসান হাফিজের যে বৈশিষ্ট্য তা দৃষ্টি এড়ায়নি কারও। আবদুল মান্নান সৈয়দও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এক লেখায় (... ‘তুমি বধূ অবিবাহের, কবি হাসান হাফিজের এ রকম একটি কবিতাগ্রন্থের নাম দেখে চমকে গিয়েছিলাম একদিন। কবিতা তথা শিল্প, প্রথমত এমনকি শেষত, কি নয় একটি আশ্চর্য বিদ্যুচ্চমক? ঝোড়ো আকাশে বা নীলাকাশে বিদ্যুতের এমুড়ো-ওমুড়ো ছুটে যাওয়াই কবিতা। সেই বিদ্যুৎ দেখে আমরা চমকে যাই, ভিতরে কেঁপে উঠি। হাসান হাফিজের কবিতাগ্রন্থের এ রকম নাম দেখে বুঝেছিলাম সত্তর দশকের এই কবির ভিতরে অগ্নি আছে।...)
নাম রচনায় হাসান হাফিজের সৃষ্টিশীল হওয়ার প্রধান কারণ তিনটি (শব্দজাগরণ, ছন্দচেতন ও নিরীক্ষাপ্রবণ কবিমন)। তাঁর কবিতাকে সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ করেছে এই বৈশিষ্ট্যগুলোই। এমনিতে তাঁর কবিতার ভাব বা বিষয় এই সময়কার জীবন-সংঘর্ষ থেকে উৎসারিত, আমাদের মনের অনেক কথা ভাষা পেয়েছে তাঁর উচ্চারণে। প্রেম, প্রকৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ প্রভৃতি উচ্চকিত করেছে তাঁর কবিতাকে।
কবিতায় হাসান হাফিজের শব্দময়তা অনেক পাঠককে মনে করিয়ে দিতে পারে ‘শব্দই কবিতা’ ধরনের বিভিন্ন উক্তিতে। আলাওল লিখেছেন, ‘কাব্যে সিন্ধু শব্দ মুক্তা কবি সে ডুবারু। বহু যতেœ ডুবি তোলে রতন সুচারু॥’ (‘পদ্মাবতী’) একটি শব্দময় উক্তিও মনে পড়ছে (পুরুষকঠিন সংসারতপ্ত পুরুষচিত্তকে আনন্দের নিবিড় বন্ধনে বাঁধিতে বসনভূষণ ছলাকলামঞ্জুল অঙ্গনাজনের ললিতাদেহের যে প্রয়োজন যে কোনও অর্থ তথা ভাবকে রসের নিবিড়বন্ধনে বাঁধিতে তদানুরূপ ছন্দোধ্বনি অলঙ্কারসমৃদ্ধ বাণীরমণীর শব্দশরীরের প্রয়োজন।’ (রামজীবন আচার্য, ‘নজরুল এক বিস্ময়’) এ সম্পর্কে নিজস্ব ভাষ্য আছে হাসান হাফিজেরওÑ ‘... শব্দের বিবাহলগ্ন হয়ে থাকি ঘোরে মগ্ন/উপাসনা তপস্যার দিনরাত্রি পার/কবির মগজে ঘোরো, ঘুড়ি হয়ে তীব্র ওড়ো/ওগো শব্দ জব্দলতা বলো তুমি কার?’ (‘শব্দের বিবাহে’, “শিশুকালের জবাকুসুম”)
এমন প্রশ্ন ছিল মধুসূদনেরও, ‘ কে কবিÑ কবে কে মোরে? ঘটকালি করি, শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন...?’ আসলে হাসান হাফিজ জানেন, ‘শব্দে রচিত কবিতা শব্দ অতিক্রম করে যায়।’ একইভাবে কবিতায় বিশেষভাবে ছন্দভঙ্গিম হলেও ‘ছন্দোবন্ধনে’ই তাঁর সাধনা ‘অধরা মাধুরী’ কে ধরার। তাই লিখেছেনÑ ‘ছন্দ ভেঙে প্রকরণ উলটেপালটে/ভালোবাসা তোমার নৈকট্যে যাবো.ছন্দ ব্যাকরণ ভাঙা/সামাজিক প্রথা সনাতন/বস্তাপচা নিয়ম নিগড়/ভাঙচুর করতে পারলে/কত যে আনন্দ তৃপ্তি/অন্য কেউই বুঝবে না/ এ সাফল্য কতটা গভীর/ এ অর্জন কত মহত্তর...’ (‘ভেঙেচুরে ছন্দ-নীরবতা’, “বল ভরসা দাও রে দয়াল”)
সৃষ্টিশীলতা সব সময়েই মুক্তি খোঁজে নতুন-নতুন নিরীক্ষায়, সেখানে সাফল্য বড় কথা নয়, খোঁজটাই আসল। হাসান হাফিজের নিরীক্ষা শব্দলীলায় যেমন, ছন্দকলায়ও তেমন। কবিতার গঠন নিয়েও নানারকম নিরীক্ষা আছে তাঁর। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে পড়ছে তাঁর এক পঙ্ক্তির কবিতা: ‘এমন পথ কি কাম্য? যেই পথে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই?’ কিংবা ‘লোভী হতে ইচ্ছে নেই বিন্দুমাত্র কাঙালের পরিচয়ই যথেষ্ট আমার’ (‘প্রতিটিই এক পঙ্ক্তি’, “জলরেখায় শব্দজোড়”)।
হাসান হাফিজের কবিত্ব অন্য কবিদের, কবিতার পাঠকদের আহাদিত করুক এই কামনা করি। কয়েক বছর আগে তাঁকে সম্মানিত করেছে বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। ৬০তম জন্মবার্ষিকীতে অভিনন্দন জানাই তাঁর সকল সম্মাননায়। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে কবির জন্মদিন পালন সম্পর্কে তাঁর এক আলোচিত কবিতা : ‘এক একটি জন্মদিন/ জীবন পাহাড় থেকে নি¤œগামী/এক একটি সিঁড়ি/ অতিক্রমে কান্তি আছে/অবসাদ অনুতাপ জ্বালাপোড়া/অপচয়ও আছে।. তারপর যথারীতি/ বিস্মরণ, নিন্দামন্দ/কারও কারও স্বস্তি সুখ এতে!/ মরে গেলে আদৌ কি বেঁচে যাওয়া যায়? (“ভাঙাচোরা সিঁড়ি’, “শিশুকালের জবাকুসুম”)।
No comments