বিবেকদংশনে আত্মাহুতি এবং বিবেককে কোরবানি by সিরাজুর রহমান

মালালা বলেছে, ওরা আমার মাথায় একটা গুলি ছুড়েছে, সারা দুনিয়া সে গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে। সত্যি তাই। ১৭ বছরের স্কুলছাত্রীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া নিয়ে নিশ্চয়ই নোবেল কমিটিও চিন্তাভাবনা করেছে, কিন্তু শেষ অবধি তারা পুরস্কার দেয়াই ভালো বিবেচনা করেছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া থেকেও মনে হচ্ছে তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।  সোয়াতের মেয়ে মালালা ইউসুফজাই। পাকিস্তানের এই উপত্যকায় তালেবানদের প্রভাব বেশি। তারা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ও লেখাপড়া শেখার ঘোরতর বিরোধী; কিন্তু মালালা পড়াশোনা করবেই, স্কুলে যাবেই। অন্য মেয়েদেরও সে স্কুলে যেতে উৎসাহ দিচ্ছিল। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাস থামিয়ে তালেবানেরা তাকে গুলি করে দুই বছর আগে। তাকে শাস্তি দিয়ে তালেবানেরা সব মেয়েকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। ব্রিটেন মালালার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করে। সুস্থ হয়ে মালালা  পড়াশোনা করছে আর সুযোগ পেলেই মেয়েদের শিক্ষা দানের গুরুত্বের কথা বলছে। গত বছর জাতিসঙ্ঘে তার ভাষণে বিশ্বব্যাপী সাড়া জেগেছিল। নাইজেরিয়ায় বোকো হারামরা দুই শ’ স্কুলের ছাত্রীকে ছিনতাই করে নিয়ে যায় গত এপ্রিল মাসে। তারাও তালেবানদের মতো নারী শিক্ষার ঘোরতর বিরোধী। মালালা নাইজেরিয়ায়ও ছুটে গিয়েছিল মেয়েদের এবং তাদের বাবা-মাদের ভরসা ও উৎসাহ দিতে, তারা যেন ভয় পেয়ে লেখাপড়া ছেড়ে না দেয়। মালালা ইউসুফজাইকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দান গোটা বিশ্বের জাগ্রত বিবেকের প্রতীক। মালালার গুণগ্রাহীদের এখনো কিছু শঙ্কা আছে। গোটা দুনিয়ার মানুষ তাকে দেখতে, তার কথা শুনতে চাইবে। তার লেখাপড়ায় মনোযোগ তাতে ভিন্নমুখী হবে না তো? আরো কেউ কেউ এখানে-ওখানে সমালোচনা করছেন। সেটাও স্বাভাবিক। ঈর্ষাপরায়ণতা বলে একটা কথা সব ভাষাতেই আছে। আমার বিবেচনায় নোবেল কমিটির নির্বাচনগুলো সব সময়ই মোটামুটি সঠিক হয়। তারা চোখ-কান খোলা রাখে, কার কী প্রকৃত কিংবা ভুয়া অর্জন খোঁজখবর নেয়, চেষ্টা-তদবিরে বিভ্রান্ত হয় না। তারা বাংলাদেশের ড. ইউনূসকে শান্তি পুরস্কার দিয়েছে। ইউনূস গ্রামীণ নারীর দারিদ্র্য অপনোদন ও তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গ্রামীণব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। ধীরে ধীরে বিশ্বের আরো বহু দেশ তার সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছে। মালালাও শান্তি পুরস্কার পেয়েছে নারীর শিক্ষা প্রসার করে তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টির কারণে।
মালালার সাথে এ পুরস্কার ভাগাভাগি করে পেয়েছেন ভারতের কৈলাশ সত্যার্থী। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত কৈলাশ সত্যার্থী বহু বছর ধরে ভারতের শিশু ক্রীতদাস প্রথা দূর করার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। এবং মনে রাখতে হবে যে ভারতে কয়েক কোটি শিশু ক্রীতদাস ও মেয়াদি শ্রমিক আছে। সত্তরের দশকে আমি এ ক্ষেত্রের অন্য এক কর্মী সুব্রাহ্মনিয়াম স্বামীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বিবিসির জন্য। সঠিক কত কোটি তিনি বলেছিলেন এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে সত্যার্থীর পুরস্কারপ্রাপ্তি সম্বন্ধেও নিশ্চয়ই কিছু লোকের চোখ টাটাবে, কিছু লোক খামাখা ঈর্ষাতুর হবে। আসলে কিছু লোক স্বভাবতই বিবেকের দরজায় কুলুপ এঁটে রাখে। এই বিবেকের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম কিছু দিন থেকে। ব্রিটেনের ব্রেন্ডা লেইল্যান্ড ধনী মহিলা ছিলেন। বয়স ৬৩ হয়েছিল। সন্তানেরা বড় হয়ে অন্যত্র সরে গেছে। এ দেশে সেটাই নিয়ম। ছেলেমেয়ে স্কুল শেষ করে মা-বাবার বাড়ি ছেড়ে যায়। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। কেউ চাকরি নেয়। ব্রেন্ডা বিধবা কি তালাকি জানতে পারিনি। ইংল্যান্ডের লেস্টারশায়ারে ছবির মতো সুন্দর গ্রাম বার্টন ওভারিতে নিজ বাড়িতে একাই থাকতেন। প্রতিদিন হাঁটতে যেতেন। বাকি সময় কম্পিউটার আর ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সেটাই তার কাল হলো। কিছুকাল ধরে প্রায়ই টুইটারে যাকে সম্ভব নানা বাণী পাঠাতেন।
নিরুদ্দেশ ম্যাডেলিন আর ব্রেন্ডার আত্মাহুতি
সম্প্রতি ম্যাকান পরিবারের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য পাঠিয়ে ব্রেন্ডা বলতে গেলে লোকের কান ঝালাপালা করে ফেলেছিলেন। এখানে এসে ম্যাকান পরিবার সম্বন্ধে জানা প্রয়োজন। স্বামী জেরি সুদক্ষ শল্য চিকিৎসক, আর স্ত্রী কেট ম্যাকান পারিবারিক চিকিৎসক। দুটো ফুটফুটে মেয়েÑ তিন বছরের ম্যাডেলিন বড়, ছোটটার তখন বয়স ছিল প্রায় দুই বছর। ২০০৭ সালে তারা সপরিবারে ছুটিতে গিয়েছিল পর্তুগালে। সমুদ্রের ধারে সুন্দর একটা হলিডে ফ্যাট ভাড়া নিয়েছিল। এক রাতে ম্যাকান দম্পতি পাশেই এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিল অন্য ফ্যাটের বন্ধুদের সাথে। কেট দুই মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে গিয়েছিল। মাঝে দু-একবার এসে দেখেও গিয়েছিল। ফিরে এসে তারা দেখে বড় মেয়ে ম্যাডেলিন বিছানায় কিংবা কোথাও নেই। সাথে সাথে পুলিশ ডাকা হয়। তারা সে বাড়িতে এবং আশপাশে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালিয়েও তিন বছরের ম্যাডেলিনকে খুঁজে পায়নি। তদন্ত ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে। কাছাকাছি কোথাও মাটিতে সামান্য ব্যতিক্রম দেখলে খুঁড়েও দেখা হয়েছে। কেউ একজন খবর দিয়েছিল যে, সে রাতে সে এক লোককে দেখেছে ছোট্ট একটি শিশুকে কোলে করে সমুদ্রের দিকে যেতে। তদন্ত করে তাতেও আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বছর দুই পরে পর্তুগিজ পুলিশ নথিপত্র বন্ধ করে তদন্ত গুটিয়ে ফেলে; কিন্তু ম্যাকান দম্পতি হাল ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তারা ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালায়, ম্যাডেলিনকে তাদের খুঁজে পেতেই হবে। তাদের এবং জনমতের চাপে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তদন্তের ভার নেয়। পর্তুগিজ পুলিশের সহায়তায় তারাও কয়েক দিন ধরে তন্ন তন্ন তল্লাশি চালায়। কাছাকাছি কয়েকটা নরম মাটির জায়গা খুঁড়েও দেখে তারা। কিন্তু ম্যাডেলিন ম্যাকান আজো নিরুদ্দেশই রয়ে গেল। পর্তুগিজ পুলিশের যে স্থানীয় অফিসার ম্যাডেলিনের নিখোঁজ হওয়ার তদন্ত করছিলেন, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি একটি বই লেখেন। সে বইতে তিনি এ সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, ম্যাডেলিনের বাবা-মা হয়তো দৈবাত মেয়েকে মেরে ফেলেছিলেন এবং লাশ গুম করেছিলেন। ইতোমধ্যে ব্রিটেনে বারবার ম্যাকান দম্পতির টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থিতিতে হয়তো কারো কারো বিরক্তি সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা কিছুকাল থেকে কিছু লোক টুইটার ইত্যাদিতে দম্পতি সম্বন্ধে নানা রকম অপ্রীতিকর ভাষায় মন্তব্য ও গালাগাল করে যাচ্ছিল। তাদের তৎপরতা মিডিয়ারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মিডিয়ার কোনো কোনো অংশ তাদের ‘ট্রোল’ (দানব) বলে বর্ণনা করতে শুরু করে। টুইটারে কয়েক দিন ধরে ম্যাকান দম্পতি সম্বন্ধে তার কটু মন্তব্যের পরে এ দেশের জনপ্রিয় স্কাই টেলিভিশন নিউজের সংবাদদাতা মার্টিন ব্রান্ট অক্টোবরের গোড়ায় একদিন ব্রেন্ডা লেইল্যান্ডকে ধরে ফেলেন তার বাড়ির দরজায়। মার্টিন ব্রান্ট জানতে চান ব্রেন্ডা কেন এমন করে ম্যাকানদের পেছনে লেগেছেন। ব্রেন্ডা জেদ ধরেন যে তিনি ঠিক কাজই করছেন। তিনি আরো বলেন, দেখা পেলে ম্যাকানদের জিজ্ঞেস করার মতো অনেক প্রশ্ন তার আছে। ব্রেন্ডা বলেন, তিনি অন্যায় কিংবা বেআইনি কিছু করেননি। স্কাই টেলিভিশন এ বিষয়ে একটা অনুষ্ঠান প্রচার করে। গত ৪ অক্টোবর শনিবার বাড়ির কাছের অভিজাত হোটেল মেরিয়টের এক কামরায় ব্রেন্ডার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তদন্তের পর পুলিশ বলেছে, তারা এ সম্বন্ধে আর কাউকে সন্দেহ করছে না। পুলিশি ভাষায় তার অর্থ হচ্ছে, ব্রেন্ডা লেইল্যান্ড আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ আরো বলেছে, ব্রেন্ডাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কিংবা তার বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
অ্যালিস গ্রসের হৃদয়বিদারক কাহিনী
আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা প্রকাশ পায় ৪ অক্টোবর শনিবারই। তারপর থেকে এ ঘটনাটিও মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আগস্ট মাসের শেষে অ্যালিস গ্রস নামে পশ্চিম লন্ডনের ১৪ বছরের এক কিশোরী প্রতিদিনের মতো তার বাড়ি থেকে হাঁটতে বেরিয়েছিল, কিন্তু সে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। পুলিশ গোড়ায় এটাকে নিরুদ্দেশের ঘটনা বলেই ধরে নিয়েছিল। এ বয়সের ছেলেমেয়ের মাথা কিছু গরম থাকে। মতানৈক্য কিংবা বাবা-মায়ের শাসনে চটে গিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে ওঠে। মাথা ঠাণ্ডা হলে আবার বাড়ি ফিরে আসে। তখন পুলিশের সন্দেহ আরো গভীর হয়। তারা অ্যালিসের বাড়ি এবং তার সচরাচর হাঁটার পথের ধারেকাছে তল্লাশি শুরু করে। তল্লাশির এলাকা ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হয়। অ্যালিস পুরনোকালের পরিবহনের এক খালের পাশ দিয়ে অনেকটা পথ হাঁটত। সে খালেও তল্লাশি চালায় পুলিশ। একপর্যায়ে এ দেশের ছয়টি পুলিশ বাহিনী এই তল্লাশিতে যোগ দেয়। ইতোমধ্যে অ্যালিস যে পথ দিয়ে হাঁটছিল সে পথের সিসিটিভি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা শুরু করে পুলিশ। দেখা গেল, ওই খালের ওপরের সেতু পেরিয়ে অ্যালিস হেঁটে যাচ্ছে। তার কয়েক মিনিট পরই সেই সেতুর ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে একটা লোক। পুলিশ তাকে পূর্ব ইউরোপের ল্যাটভিয়া থেকে আসা বিল্ডিং শ্রমিক আর্নিস জালকালন্স বলে শনাক্ত করে। এ দেশে কয়েক বছর ধরে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর কয়েক লাখ লোক মূলত শ্রমিকের কাজ করতে আসে। সে দেশগুলোতে মাইনে-মজুরি খুব কম। তা ছাড়া ব্রিটিশেরা অনেক কাজ করতে চায় না। এ দেশের খামার মালিক, বিল্ডিং কোম্পানিগুলো সস্তায় মওসুমি কাজে পূর্ব ইউরোপীয় শ্রমিক নিয়োগ করে। কিছু দিন কিছু অর্থ জমিয়ে লোকগুলো আবার দেশে ফিরে যায়। কিছু দৃষ্টান্ত দিলেই বুঝতে পারবেন। যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার মাঝে মধ্যে আমাকে সাহায্য করেন, তার দেশ পোল্যান্ডে। যে মহিলা আমাদের বাড়ি পরিষ্কার আর জামাকাপড় ইস্ত্রি করেন, তার বাড়ি রুমানিয়ায়। আর আমাদের বাগানের মালী হাঙ্গেরির লোক। আর্নিস জালকালন্স সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে গিয়ে পুলিশ বের করে ল্যাটভিয়ায় নিজের স্ত্রীকে হত্যার দায়ে সে সাত বছর জেল খেটেছে। ২০০৯ সালে পশ্চিম লন্ডনেই ১৪ বছরের এক মেয়েকে সে যৌন নির্যাতন করে। তখন থেকে নিরুদ্দেশ আর্নিসের জন্য নিবিড় তল্লাশি শুরু করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। তাদের কয়েকজন অফিসার তার খোঁজে ল্যাটভিয়া পর্যন্ত গিয়েছিল। ল্যাটভিয়ার পুলিশের সহায়তায় তল্লাশি চালিয়েও তার কোনো হদিস পাওয়া গেল না। লোকটা যেন হাওয়া হয়ে গেল; কিন্তু পুলিশ খোঁজ ছাড়েনি। এ দিকে অবিরাম তল্লাশিতে পাঁচ সপ্তাহ পর অ্যালিসের মৃতদেহ পাওয়া গেল যে খালের ধারে সে হাঁটতে যেত তারই তলায়। স্বল্প পানির নিচে কবর খুঁড়ে বস্তাভর্তি লাশটি পুঁতে দিয়ে তার ওপর কাঠ-পাথর ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। সেজন্যই প্রথমবারের তদন্তে পুলিশ লাশের সন্ধান পায়নি। তার কয়েক দিন পরই ৪ অক্টোবর পুলিশ কাছাকাছি একটা পার্কে গাছ থেকে ঝুলানো একটি গলিত লাশ আবিষ্কার করে। পুলিশের ফরেনসিক তদন্তে সেটা আর্নিস জালকালন্সের বলে শনাক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রেও পুলিশ বলেছে তারা অন্য কাউকে সন্দেহ করছে না। অর্থাৎ আর্নিস আত্মহত্যা করেছিল।
বিবেকের কাছ থেকে ছুটি নিচ্ছে ওরা
দু-দুটো আত্মহত্যা; কিন্তু কোনো কি প্রয়োজন ছিল? আর্নিস ধুরন্ধর লোক এবং ইইউতে ইউরোপীয় নাগরিকদের চলাচল খুবই শিথিল বলা চলে। সে  অবশ্যই জানত ব্রিটেনে এখন আর প্রাণদণ্ড দেয়া হয় না। সে নিশ্চয়ই জানত ব্রিটিশ পুলিশ সহজে হাল ছেড়ে দেয় না। বিশেষ করে খুনের ব্যাপারে। উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করে আজকাল তারা ৩০-৪০ বছরের পুরনো খুনিকেও পাকড়াও করছে। অন্তত কিছুকাল পালিয়ে থাকার চেষ্টা করতে পারত সে। সেটা না করে যেখানে সে অ্যালিসকে পুঁতে দিয়েছিল, তারই কাছাকাছি এক গাছে গলায় ফাঁস দিয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। আর ব্রেন্ডা লেইল্যান্ড। তার বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার সম্বন্ধে তদন্ত করার কোনো পরিকল্পনাও ছিল না তাদের। তবুও কেন সে আত্মহত্যা করতে গেল? নিশ্চয়ই স্কাই টেলিভিশনের প্রতিনিধির জিজ্ঞাসাবাদের পর তার বিবেকের উদ্রেক হয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল ম্যাকান পরিবারকে গালাগাল করে, তাদের সম্বন্ধে কুৎসা রটনা করে সে ভালো করেনি। হয়তো আর্নিস জালকালন্সও বিবেকের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। হয়তো অবশেষে তার পাষণ্ড মনেও বিবেক জাগ্রত হয়েছিল।
বাংলাদেশে কুৎসা রটনা অনেকটা রাজনীতিকদের পদোন্নতির পথের সোপানে পরিণত হয়েছে। সরকারে পদোন্নতি আর দলে প্রভাব বাড়ানোর আশায় নেতা-মন্ত্রীরা অনর্গল এর-তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে চলেছেন। সম্মানী ব্যক্তির সুনামকে সামান্য রাজনৈতিক সুবিধা লাভের লোভে হরহামেশা ধূলিলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন মন্ত্রীরাও। বিবেক বলে কোনো বস্তু কি তাদের মধ্যে নেই? সে বিবেক কি এতই মৃত যে সে আর কোনো দিন জেগে উঠবে না? কুৎসা বা গিবত মহান আল্লাহ তায়ালারও বিরক্তি উৎপাদন করে বলে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। ইহরাম বেঁধে হজ করে এলেই কি তাদের সব পাপ মাফ হয়ে গেল? তারা আবার ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেলেন?
বিবেকের কাছ থেকে ছুটি
দুর্নীতি অবশ্যই আল্লাহর আইনে অপরাধ। মানুষের আইনেও দুর্নীতি আর দুষ্কৃতিকে অপরাধ করা হয়েছে; কিন্তু একজন থার্ডকাস উকিল আর কুখ্যাত রাজনীতিকের অধীনে কমিটি করে সোয়া সাত হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে এ তালিকায় কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। ছিল কয়েকটি খুনের মামলায় অভিযুক্ত দাগী ব্যক্তিরাও। বিগত ছয় বছরে বহু দুর্নীতির কথা মানুষ শুনেছে এবং জানে। বিশ্বব্যাংক, মার্কিন আর কানাডীয় সরকার সবাই মিলে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশে সেসব অভিযোগের ফাইল এখন মুছে ফেলা হয়েছে। লোকে বলে, রাজনীতিকদের হুকুমে এবং তাদের প্রশ্রয়ে কয়েক হাজার মানুষ গুম ও খুন হয়েছে; সরকারের মন্ত্রীদের নির্দেশে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ আর ডাকাত বধের অজুহাতে বহু রাজনৈতিক বিরোধীকে হত্যা করা হয়েছে।
এবারে আর থার্ডকাস উকিলের অধীনে কমিটি করে নয়, এবারে ফার্স্টকাস সরকারি আজ্ঞাবহদের নিয়ে গঠিত কমিশন দুদককে দিয়ে মন্ত্রী-নেতাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ স্খালন করা হচ্ছেÑ যেমন করে ঘষেমেজে ঘরের মেঝের রক্তের দাগ মুছে ফেলা হয়। সারা জীবন শুনে এসেছি, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। কিন্তু প্রায়ই ভাবি, সে বাতাস কেন এত ধীরে বহে, ধর্ম কী করে এত কিছু সয়? এ দিকে ওপরওয়ালাদের কলকাঠি নাড়ানোয় রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে আর অভিযোগ গঠন করছে দুদক। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে এসব নেতা যাতে অংশ নিতে না পারেন এবং বিনা বাধায় দখলি স্বত্বে গদি আঁকড়ে থাকা সরকার লোক দেখানো নির্বাচনে জয়ী হয়ে ‘বৈধতা’ লাভ করতে পারে সে জন্যই এতসব আয়োজন। আর হ্যাঁ, দুদকেরও কিছু কাজ দেখাতে হবে তো দেশের মানুষকে?
এ দিকে দেশের অবস্থা কি ভাবছেন কেউ? নবজাতক বেচাকেনা হচ্ছে, প্রেমে বিফল হয়ে ছেলেরা মেয়ের মাকে খুন করছে, মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় হবুবর ঘরে আগুন লাগিয়ে মা আর দুই মেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে, শিক্ষক কচি শিশুকে ধর্ষণ করছেÑ এসব অমানুষিক খবর পড়তে পড়তে ঘেন্না ধরে যাচ্ছে। নেতানেত্রীরা বিবেকবঞ্চিত। শত অপরাধ করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। লাখ লাখ টাকার গরু লোক দেখানোভাবে কোরবানি দিয়ে তারা যেন বিবেককেই কোরবানি দিচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি তরুণসমাজও বিবেকের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে। এই ভাগ্যহত দেশটার কাছ থেকে আর কী আশা করব?
(লন্ডন, ১৪.১০.১৪)
serajurrahman34@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.