রাজনীতির বিভক্তি লাশেও by সাজেদুল হক
এ এক নয়া কিসিমের বিভক্তি। অদ্ভুত
হলেও সত্য মৃত মানুষরাও এখন এখানে কথা বলেন। লাশেরাও রাজনীতি করেন।
রাজনৈতিক বিশ্বাসকে ভিত্তি করে বিভক্ত হয়ে যায় জানাজা। এক দলের লোকেরা অন্য
দলের লোকের জানাযায় যোগ দেন না। এমনকি কারও কারও জানাযায় বাধাও দেয়া
হচ্ছে। গোপনে আর দ্রুত লাশ দাপনে চাপ দেয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এ সবই
ঘটছে বাংলাদেশে। রাজনৈতিক বিভক্তি যদিও এ অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। বৃটিশ
শাসনের মূল নীতি ছিল ডিভাইড অ্যান্ড রুল। নেশন ডিভাইডেড- আন্তর্জাতিক
মিডিয়ায় আমাদের নিয়ে এ শিরোনাম ব্যবহার হয়েছে বহুবার। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে
বিভক্ত হলেও সামাজিকভাবে বিভক্ত ছিল না বাংলাদেশ। একই পরিবারে কেউ আওয়ামী
লীগ, কেউ বিএনপি, কেউ জাতীয় পার্টি, কেউ বা জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত
ছিলেন। সামাজিক উৎসবে আর মৃতের প্রতি শ্রদ্ধায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একই
কাতারে শামিল হয়েছেন মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি পরম শ্রদ্ধা
প্রদর্শনের বহু নজির বারবার স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি কিভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন
করেছেন তার বয়ান লিপিবদ্ধ রয়েছে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। যেন বাংলাদেশেরই
অসমাপ্ত জীবনী। স্বাধীনতাবিরোধী খান এ সবুর, ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো
প্রতিপক্ষের প্রতিও বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। রক্ষা করেছেন
ব্যক্তিগত সম্পর্ক। কিন্তু সেই বাংলাদেশ আর নেই। একেবারে প্রাচীন আর
নিভৃতের যে কোন গ্রামও আজ রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিভক্ত। পরমতসহিষ্ণুতা যেন ঠাই
পেয়েছে জাদুঘরে। রক্তের সম্পর্কও পরাজিত হচ্ছে রাজনীতির কাছে।
ভিন্নমতালম্বীর লাশ শহীদ মিনারে নিতেও মানা।
মূল্যবোধের অবক্ষয়: বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. মীজানুর রহমান শেলী এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, সমাজে এ ধরনের বিভক্তি শুধু দুঃখজনকই নয়, আমাদের রাজনীতি, সমাজ ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের আলামত। মতের বিরোধিতা সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক সুশীল আচরণের এ ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে আমরা রক্ষা করেছি। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও আমাদের সমাজে ঐক্য ছিল। এরপর বৃটিশ শাসনের অবসানে প্রথমে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশে এখন সে অর্থে কোন সংঘাত নেই। কিন্তু সমাজের উপরি পর্যায়ে যে বিভক্তি দেখা যাচ্ছে তা মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং ভয়াবহ বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। এ ভাবে চলতে থাকলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। তিনি বলেন, যুদ্ধের মধ্যেও নিয়ম-নীতি থাকে। জেনেভা কনভেনশনসহ যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে যুদ্ধের সময় সে সব চুক্তি মেনে চলতে হয়। না হয় আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। ড. মীজানুর রহমান শেলী বলেন, শহুরে সমাজ যেমন বিভক্ত গ্রামীণ সমাজ এখনও তেমন বিভক্ত নয়। আমি মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। সেখানে দেখি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সব দলের নেতারাই একসঙ্গে যোগ দেন। তিনি বলেন, আমাদের উচ্চ শ্রেণীর সমাজে শহুরে সমাজে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে তা নিরসনে সরকার, রাজপথের এবং সংসদের বিরোধী দল তথা শীর্ষ নেতাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এ বিভক্তি রোধ করা না গেলে বিপর্যয় নেমে আসবে। সমাজে বিভক্তি এবং এর প্রভাব প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম খান বলেন, বিভক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। সহিষ্ণুতা ও বিশ্বাসের অভাবের কারণে সমাজে এ বিভক্তি এসেছে। এটা দুঃখজনক। এখন রাজনীতিবিদদেরই দায়িত্ব এ পথ খুঁজে বের করা কিভাবে এ বিভক্তি দূর করা যায়। তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সংহতি প্রয়োজন।
অশুভ প্রবণতা: সংসদ ভবনের জানাযা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুন্দর দৃশ্য ছিল। মুসলিম কোন বর্তমান বা সাবেক সংসদ সদস্যের মৃত্যু হলে তার লাশ নিয়ে আসা হতো সংসদ প্লাজায়। সব দলের নেতারা অংশ নিতেন সে জানাযায়। মৃত সংসদ সদস্য চলে যেতেন সব আলোচনা-সমালোচনার উর্ধ্বে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এর কিছু ব্যতিক্রম দৃশ্য। প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসার ক্ষেত্রে দেখা মেলে ব্যতিক্রমের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের এ সাংবাদিক বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অথচ মৃত্যুর পর সংসদ ভবনে তার জানাযা হয়নি। তাকে কোন রাষ্ট্রীয় সম্মানও দেয়া হয়নি। ধারণা করা হয়, জীবনের শেষ দিকে বিশেষত টিভি আলোচনায় ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করাতেই কৌশলে তার সংসদ ভবনের জানাযা বাতিল করে সরকার। অতিসম্প্রতি প্রয়াত ভাষা মতিনকেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। ভাষা আন্দোলনে অনেকে নানা ভাবে অবদান রাখলেও সে আন্দোলনের ‘প্রধান সেনাপতি’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন আজীবন সংগ্রামী আবদুল মতিন। অথচ এমন একজন মানুষও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। কিন্তু কেন? তবে রাষ্ট্র কাদের? রাষ্ট্রীয় সম্মানও বা কাদের জন্য? সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায়নি। হয়তো ক্ষমতাসীনদের গুনকীর্তন করতে পারেন নি, এটাও তার অপরাধ বিবেচিত হতে পারে। সর্বশেষ অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম। জীবনের বেশির ভাগ সময় বামপন্থার রাজনীতিতে যুক্ত এ সমাজবিশ্লেষক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ঝুঁকে পড়েছিলেন বিএনপির দিকে। যদিও বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদও তিনি নেননি। টিভি টকশোতে নানা বিষয়ে নিজের মতামত দিয়েছেন। যে কোন ব্যক্তিরই অধিকার আছে এ মতের সঙ্গে একমত বা ভিন্নমত পোষণ করার। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ বয়ান করেছেন মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও পিয়াস করিমের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধের কথা। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় বেদনা যখন হাজার মাইল দূরের ফেলে আসা দেশ থেকে দুঃসংবাদ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে; যখন জানান দেয় যে হারিয়েছি প্রিয়জন বা বন্ধুকে। তখন বোঝা যায় দুঃসংবাদ বইবার ভার কতটা কঠিন। তখন মনে পড়ে শেষ কথাগুলো কবে বলা হয়েছিল; কি কথা হয়েছিল; কি কথা বলা হয়নি, কি কথা বলা দরকার ছিল। এক সময় কাছের মানুষ ছিল যারা, ভূগোলের দূরত্ব যাঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছে তাঁদের নতুন-পুরনো স্মৃতিরা জেগে ওঠে; সেটা আমার ইচ্ছা নিরপেক্ষ। ১৯৭৯ সালের দিকে পরিচয়, সে তো অনেক দিনের কথা। তারপরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সময় গেছে, আবার যোগাযোগ তৈরির সময় গেছে; দেখা হওয়ার সময় গেছে, না দেখার সময় গেছে। কিন্তু দেখা হলে কথা তো শুরু হয়েছে সেখান থেকেই যেখানে আমাদের শেষ কথা হয়েছিল। ঐকমত্যে-ভিন্নমতে আমরা তো বন্ধুই থাকি। সেই বন্ধুত্বের দাবিতে বলতেই পারি এটা যাওয়ার সময় নয়। গত বছর অক্টোবরে ওয়াশিংটনে আমাদের ভিন্নমতের যে আলোচনাটা শুরু এখনও তা শেষ হয়নি। পিয়াস করিম, এখন তোমার যাওয়ার সময় ছিল না।’ বেশির ভাগ মানুষ এ প্রয়াত রাজনৈতিক বিশ্লেষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেও মৃত্যুর পর তার লাশ শহীদ মিনারে নেয়ার ক্ষেত্রেও তৈরি করা হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। সরকারপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো তার লাশ প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেয় কৌশলের আশ্রয়। অন্যদিকে, নাগরিক সমাজের ব্যানারে আরেকদল বুদ্ধিজীবী তার লাশ শহীদ মিনারে নেয়ার ঘোষণা দেন। দুঃখজনক আর বেদনাদায়ক এক ভাঙনের দিকেই যেন ক্রমশ এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের সমাজ।
মূল্যবোধের অবক্ষয়: বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. মীজানুর রহমান শেলী এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, সমাজে এ ধরনের বিভক্তি শুধু দুঃখজনকই নয়, আমাদের রাজনীতি, সমাজ ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের আলামত। মতের বিরোধিতা সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক সুশীল আচরণের এ ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে আমরা রক্ষা করেছি। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও আমাদের সমাজে ঐক্য ছিল। এরপর বৃটিশ শাসনের অবসানে প্রথমে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশে এখন সে অর্থে কোন সংঘাত নেই। কিন্তু সমাজের উপরি পর্যায়ে যে বিভক্তি দেখা যাচ্ছে তা মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং ভয়াবহ বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। এ ভাবে চলতে থাকলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। তিনি বলেন, যুদ্ধের মধ্যেও নিয়ম-নীতি থাকে। জেনেভা কনভেনশনসহ যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে যুদ্ধের সময় সে সব চুক্তি মেনে চলতে হয়। না হয় আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। ড. মীজানুর রহমান শেলী বলেন, শহুরে সমাজ যেমন বিভক্ত গ্রামীণ সমাজ এখনও তেমন বিভক্ত নয়। আমি মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। সেখানে দেখি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সব দলের নেতারাই একসঙ্গে যোগ দেন। তিনি বলেন, আমাদের উচ্চ শ্রেণীর সমাজে শহুরে সমাজে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে তা নিরসনে সরকার, রাজপথের এবং সংসদের বিরোধী দল তথা শীর্ষ নেতাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এ বিভক্তি রোধ করা না গেলে বিপর্যয় নেমে আসবে। সমাজে বিভক্তি এবং এর প্রভাব প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম খান বলেন, বিভক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। সহিষ্ণুতা ও বিশ্বাসের অভাবের কারণে সমাজে এ বিভক্তি এসেছে। এটা দুঃখজনক। এখন রাজনীতিবিদদেরই দায়িত্ব এ পথ খুঁজে বের করা কিভাবে এ বিভক্তি দূর করা যায়। তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সংহতি প্রয়োজন।
অশুভ প্রবণতা: সংসদ ভবনের জানাযা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুন্দর দৃশ্য ছিল। মুসলিম কোন বর্তমান বা সাবেক সংসদ সদস্যের মৃত্যু হলে তার লাশ নিয়ে আসা হতো সংসদ প্লাজায়। সব দলের নেতারা অংশ নিতেন সে জানাযায়। মৃত সংসদ সদস্য চলে যেতেন সব আলোচনা-সমালোচনার উর্ধ্বে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এর কিছু ব্যতিক্রম দৃশ্য। প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসার ক্ষেত্রে দেখা মেলে ব্যতিক্রমের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের এ সাংবাদিক বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অথচ মৃত্যুর পর সংসদ ভবনে তার জানাযা হয়নি। তাকে কোন রাষ্ট্রীয় সম্মানও দেয়া হয়নি। ধারণা করা হয়, জীবনের শেষ দিকে বিশেষত টিভি আলোচনায় ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করাতেই কৌশলে তার সংসদ ভবনের জানাযা বাতিল করে সরকার। অতিসম্প্রতি প্রয়াত ভাষা মতিনকেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। ভাষা আন্দোলনে অনেকে নানা ভাবে অবদান রাখলেও সে আন্দোলনের ‘প্রধান সেনাপতি’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন আজীবন সংগ্রামী আবদুল মতিন। অথচ এমন একজন মানুষও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। কিন্তু কেন? তবে রাষ্ট্র কাদের? রাষ্ট্রীয় সম্মানও বা কাদের জন্য? সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায়নি। হয়তো ক্ষমতাসীনদের গুনকীর্তন করতে পারেন নি, এটাও তার অপরাধ বিবেচিত হতে পারে। সর্বশেষ অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম। জীবনের বেশির ভাগ সময় বামপন্থার রাজনীতিতে যুক্ত এ সমাজবিশ্লেষক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ঝুঁকে পড়েছিলেন বিএনপির দিকে। যদিও বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদও তিনি নেননি। টিভি টকশোতে নানা বিষয়ে নিজের মতামত দিয়েছেন। যে কোন ব্যক্তিরই অধিকার আছে এ মতের সঙ্গে একমত বা ভিন্নমত পোষণ করার। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ বয়ান করেছেন মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও পিয়াস করিমের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধের কথা। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় বেদনা যখন হাজার মাইল দূরের ফেলে আসা দেশ থেকে দুঃসংবাদ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে; যখন জানান দেয় যে হারিয়েছি প্রিয়জন বা বন্ধুকে। তখন বোঝা যায় দুঃসংবাদ বইবার ভার কতটা কঠিন। তখন মনে পড়ে শেষ কথাগুলো কবে বলা হয়েছিল; কি কথা হয়েছিল; কি কথা বলা হয়নি, কি কথা বলা দরকার ছিল। এক সময় কাছের মানুষ ছিল যারা, ভূগোলের দূরত্ব যাঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছে তাঁদের নতুন-পুরনো স্মৃতিরা জেগে ওঠে; সেটা আমার ইচ্ছা নিরপেক্ষ। ১৯৭৯ সালের দিকে পরিচয়, সে তো অনেক দিনের কথা। তারপরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সময় গেছে, আবার যোগাযোগ তৈরির সময় গেছে; দেখা হওয়ার সময় গেছে, না দেখার সময় গেছে। কিন্তু দেখা হলে কথা তো শুরু হয়েছে সেখান থেকেই যেখানে আমাদের শেষ কথা হয়েছিল। ঐকমত্যে-ভিন্নমতে আমরা তো বন্ধুই থাকি। সেই বন্ধুত্বের দাবিতে বলতেই পারি এটা যাওয়ার সময় নয়। গত বছর অক্টোবরে ওয়াশিংটনে আমাদের ভিন্নমতের যে আলোচনাটা শুরু এখনও তা শেষ হয়নি। পিয়াস করিম, এখন তোমার যাওয়ার সময় ছিল না।’ বেশির ভাগ মানুষ এ প্রয়াত রাজনৈতিক বিশ্লেষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেও মৃত্যুর পর তার লাশ শহীদ মিনারে নেয়ার ক্ষেত্রেও তৈরি করা হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। সরকারপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো তার লাশ প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেয় কৌশলের আশ্রয়। অন্যদিকে, নাগরিক সমাজের ব্যানারে আরেকদল বুদ্ধিজীবী তার লাশ শহীদ মিনারে নেয়ার ঘোষণা দেন। দুঃখজনক আর বেদনাদায়ক এক ভাঙনের দিকেই যেন ক্রমশ এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের সমাজ।
No comments