অনিকেত মানসলোকের নিপুণ কারিগর by আলী আহমদ
সাহিত্য
আর শান্তি- এ দুটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রায় প্রতি বছরই সমস্ত
পৃথিবীর বোদ্ধা মহলে বিতর্ক, মতানৈক্য আর বাকবিতণ্ডা শুরু হয় পুরস্কার
ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এবং তা চলে বেশ কিছুদিন। এমন বিতর্কের একেবারে
কোনো কারণও যে নেই তাও নয়। নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের
লিখিত দলিলের ‘কথা এবং ভাব’ দুটো থেকেই সরতে সরতে এখন এমন এক প্রায় অপরিচিত
ভূমিতে এসে দাঁড়িয়েছে, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা বিদগ্ধ জনদেরও অনেক সময়
বুঝে উঠতে কষ্ট হয় যে. বিশেষ কাউকে কেন ওই পুরস্কারটি দেয়া হল। সাহিত্যের
পুরস্কার নিয়েও অনেক বছরই বিতর্কের অবতারণা হয়; তারও কারণ থাকে। আমরা
যেহেতু সাহিত্যের পুরস্কার নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি, শান্তির পুরস্কার নিয়ে
আলোচনা তাই এখানে আর আনব না।
একটি বিষয় অবশ্য প্রথমেই পরিষ্কার করে নেয়া উচিত। বিশ্বসাহিত্যের মোটামুটি খোঁজখবর যারা রাখেন এবং (মূলত অনুবাদের মাধ্যমে হলেও) বড় মাপের সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত থাকেন, তাদের প্রত্যেকেরই মনে হয় নিজ নিজ ভালোবাসার লেখক কিংবা কবিদের নিয়ে একটি নিজস্ব তালিকা তৈরি করা থাকে। যে কোনো বছরের সাহিত্যে নোবেল ঘোষণার পর যদি নিজ তালিকার কেউ থাকেন তাহলে তারা বেশ খুশি হন; আর না থাকলে হতাশ, এমনকি কখনও কখনও বিষন্নতাও বোধ করেন। এ অনুভূতিটা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যদিক দিয়ে। পৃথিবীর বৃহত্তম এবং উন্নততর ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা অন্যতম এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের একেবারে গোড়ার দিকে (১৯১৩ সালে) এ ভাষার একজন কবি (রবীন্দ্রনাথ) সে পুরস্কার অর্জনের কারণে আমরা যথার্থই গর্বিত। কিন্তু নানাবিধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে জাতি হিসেবে বাঙালিরা শতাধিক বছরের আগের অবস্থানে আটকে আছি মনে হয়। একথা আমাদের মধ্যে সহজে প্রায় কেউই স্বীকার করতে চাইবেন বলে আমার মনে হয় না। শতাধিক বছর আগে পাওয়া নোবেল পুরস্কারের বর্তমান সময়ের যে অবস্থান, রবীন্দ্রনাথের পর থেকে আমাদের সাহিত্যের মানে আমরা কি তার ধারে-কাছে এখনও পর্যন্ত যেতে পেরেছি? পৃথিবীর অন্যান্য প্রধান ভাষার সাহিত্যকর্ম যেমন দেদারসে অনূদিত হয়ে সমস্ত বিশ্বের সাহিত্যামোদি মহলে পঠিত এবং আলোচিত-সমালোচিত হয়, বাংলাসাহিত্য কি তেমন হয়? নোবেলবিজয়ী আমাদের একমাত্র লেখক-কবিও এখন বাইরের জগতে আর তেমন একটা পরিচিত নন; পঠিতও নন। আর ক্ষীয়মাণ কুলীনদের মতো আমরা বাঙালিরা নতুন কিছু সৃষ্টিতে ক্রমাগত ব্যর্থ হতে হতে রবীন্দ্রনাথকে আরও বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরছি। রবীন্দ্রনাথকে কিংবা তার সুবিশাল ও মহৎ সৃষ্টিকে আমি মোটেই খাটো করে দেখছি না। কিন্তু এখন থেকে দেড় শতাধিক বছর আগের রবীন্দ্রনাথই আমাদের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার একমাত্র কাণ্ডারি হয়ে রইলেন, জাতীয় সাহিত্যের বিষয়ে বাংলার ও বাঙালির জন্য এটা মোটেই কোনো সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। আমি জানি শেকসপিয়ারের কথা, গ্যোয়েটের কথা, তলস্তয়ের কথা কিংবা তাদের চেয়েও পুরনো অথচ আজো খ্যাতিতে অম্লান সাহিত্যিকদের কথা টেনে রবীন্দ্রনাথকে তাদের পাশে বসাবেন কেউ কেউ। আমাদের তাতে আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই; এমনকি আমরা একমতও হবো হয়তো অনেক দিক দিয়ে। কিন্তু ওইসব খ্যাতিমানদের পায়ে পায়ে আরও অনেকে যে তাদের নিজের নিজের তথা পৃথিবীর সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, রবীন্দ্র-পরবর্তী কোনো বাঙালি লেখক-সাহিত্যিক তা’ কি করতে পেরেছেন? দোষ কোনোক্রমেই রবীন্দ্রনাথের নয়। এ হচ্ছে জাতি হিসেবে আমাদের অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা, দীনতা, এবং আমার বলতে ইচ্ছে করছে, ভগ্ন কুলীনদের মতো আমাদের ক্ষয়িষ্ণুতা।
আরেকটি বিষয় এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়। সমস্ত পৃথিবীর সাহিত্য পাঠকরা যেমন আমাদের খোঁজ রাখেন না, তার প্রতিশোধ হিসেবেই যেন আমরাও বিশ্বসাহিত্যের তেমন একটা খবর রাখি বলে মনে হয় না। তাই প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হলে আমরা সবাই-ই প্রায় চমকে উঠি। কারণ দু-একটি ব্যতিক্রমী বছর বাদ দিলে, প্রায় সব নামই পুরস্কার ঘোষণার পর আমরা প্রথমবারের মতো শুনতে পাই। তার কারণ ইংরেজিতেও এখন আমরা আর পড়তে পারি না এবং সে কারণেই সম্ভবত, পৃথিবীর খ্যাতনামা লেখক-সাহিত্যিকদের লেখা আমাদের এখানে আসেও না। অন্যদিকে ওই লেখকদের অনেকেই হয়তো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই বিশ-তিরিশটি ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পান, কিন্তু জনসংখ্যার গণনায় পৃথিবীর পঞ্চম নাকি অষ্টম (?) বৃহত্তম ভাষা বাংলায় তাদের প্রায় কেউই অনূদিত হন না, এমনকি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও! সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আমাদের দীনতা কতখানি প্রকট এ একটি বিষয়ই দগদগে ঘায়ের মতো আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পহেলা বৈশাখে ঢাকা উজাড় করা জনতা বকুলতলার সুললিত রবীন্দ্রসঙ্গীত, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের দু-তিন দিনব্যাপী নিয়মিত বর্ষবরণ, একুশে ফেব্র“য়ারির বাংলা-প্রীতির আদিখ্যেতা, বইমেলার উপচেপড়া ভিড়, রবীন্দ্র-সরোবরে অসংখ্য মানুষের গাদাগাদিতে উদাত্ত কণ্ঠের কবিতা আবৃত্তি, নাটকপাড়ার ক্রমশ ঝিমিয়ে আসা উৎসাহ, সেনা স্টেডিয়ামের বছরান্তিক সপ্তাহব্যাপী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে হাজারও সঙ্গীত রসিকদের রাত-ভোর করে দেয়া উপস্থিতি-এসবই কি তাহলে খুব ওপরের হালকা একটি প্রলেপ মাত্র! একটু আঁচড় কাটলেই যার ভেতরের নিরেট সংস্কৃতিহীনতার অসুন্দর, খসখসে উপরিতল সবার চোখের ওপর নিজেকে উদাম করে দেবে? একি ফাঁপা বেলুনের পাতলা আবরণ, ছোট্ট একটি আলপিনের আলতো ছোঁয়ায় যার অনস্তিত্বে বিলীন হয়ে যাবে?
দুয়েকবার বেকায়দায় ধাক্কা খেয়ে আমাদের ‘বুদ্ধিজীবীদের’ কেউ আর এখন নোবেলপ্রাপ্ত লেখককে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেন বলে মনে হয় না, করলে নিশ্চয়ই চোখে পড়ত। সাহিত্যে এবারের নোবেলজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ প্যাত্রিক মোদিয়ানোকে (Jean Patrick Modiano) নিয়ে এবারে অবশ্য নির্ভয়ে অমন মন্তব্য করা যেত। কারণ খোদ পশ্চিমা দুনিয়ার বাঘা বাঘা সব সংবাদপত্র আর সাময়িকী ‘প্যাত্রিক মোদিয়ানোকে?’ এবং সমজাতীয় আরও সব প্রশ্ন করে বসেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, এ বাঘা বাঘা কাগজ বলতে এখন ইংরেজি ভাষার প্রধান প্রধান কাগজগুলোকেই বোঝায়। সতের শতকীয় পৃথিবীতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-কূটনীতি ইত্যাদি প্রায় সবক্ষেত্রে ফরাসি ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। সে স্থান আঠারো শতকের প্রায় মাঝামাঝি শুরু হওয়া ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, তখনকার ইউরোপীয় কয়েকটি ঔপনিবেশি শক্তির চেয়ে বেশ খানিকটা দেরিতে শুরু করেও যুক্তরাজ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। উনিশ শতকের শেষার্ধ্ব থেকেই ইংরেজি ফরাসি ভাষাকে একটু একটু করে হটাতে হটাতে এখন একেবারেই কোণঠাসা করে ফেলেছে। ইংরেজদের সাম্রাজ্যের সূর্য এখন অস্তাচলগামী, অবস্থান, আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের তিন-চতুর্থাংশ সময় পর্যন্ত পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছিল যে যুক্তরাজ্য, আগামী দু-চার বছরের মধ্যেই সে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দশ নম্বরেরও নিচে নেমে যাবে। কিন্তু ইংরেজি ভাষা এখনও সমস্ত পৃথিবীতেই অপরিহার্য। ইংরেজি ছাড়া আর সব ভাষাই বস্তুতপক্ষে এখন নিজ নিজ গৃহকোণে ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে হয়। এক সময়ের অভিজাত ফরাসি ভাষাও এ অবমাননা থেকে রেহাই পায়নি।
মূলত এ কারণেই এবারের নোবেলজয়ী প্যাত্রিক মোদিয়ানো ফ্রান্সের বাইরে প্রায় অপরিচিতই ছিলেন। খোদ নোবেল কমিটির স্থায়ী সচিব পিটার ইংলুন্ড (Peter Englund) পুরস্কার ঘোষণার পর বলেছেন যে, ‘প্যাত্রিক মোদিয়ানো ফ্রান্সে সুপরিচিত নাম, কিন্তু অন্য কোথাও নয়।’ পুরস্কার ঘোষণার দিন, ৯ অক্টোবর, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাময়িকী The New Yorker এ নিবন্ধ লিখে Alexandra Schwartz বলেছেন, ‘ তিনি (মোদিয়ানো) ফ্রান্সে খুব বিখ্যাত কিন্তু এখানে বস্তুতপক্ষে কেউ তাকে চেনেন না।’ যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান প্রায় সব পত্রিকা ও সাময়িকীর ওই একই সুর লক্ষ্য করা গেছে এবারের সাহিত্যে নোবেলজয়ীর ব্যাপারে। এর কারণ আছে নিশ্চয়ই। ফরাসি ভাষার কোণঠাসা হয়ে পড়ার কথা আগেই বলেছি। তার সঙ্গে অবশ্যই যোগ হয়েছে প্যাত্রিক মোদিয়ানোর প্রচারবিমুখতা। গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়া তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলেন। তা’ না হলে তিনি কিন্তু ফরাসি দেশের বাইরে বৃহত্তর সাহিত্য বিশ্বে এতটা অপরিচিত থাকতেন না। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার প্রথম ও অন্যতম প্রধান উপন্যাসের জন্য তিনি অস্ট্রিয়া থেকে ২০১২ সালে ইউরোপের অন্যতম প্রধান সাহিত্য পুরস্কার ‘ইউরোপীয় সাহিত্যের জন্য অস্ট্রীয় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার’ লাভ করেন। ইংরেজি সাহিত্য বিশ্বের ম্যান বুকার সাহিত্য পুরস্কারের সমমর্যাদার ফরাসি সাহিত্য পুরস্কার চৎরী এড়হপড়ঁৎঃ ও তিনি জিতেছেন তার সাহিত্যকর্মের জন্য তারও আগে, ১৯৭৮ সালে। কাজেই, ইংরেজি প্রচার মাধ্যম তার ব্যাপারে যতটা নাক সিঁটকাক, তিনি ততটা অখ্যাত কেউ নন, যদিও বাইরের ইংরেজি প্রভাব বলয়ের সুবিশাল জগতে পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত অপরিচিত থেকে গিয়েছিলেন। এবার তারও অবসান ঘটল।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা এখানে বলে নেই। ইংরেজি ফরাসিকে কোণঠাসা করেছে ঠিকই, এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে এ যাবৎ তিরিশটি পুরস্কার জিতে ইংরেজির স্থান শীর্ষে, এবং ষোলোটি পুরস্কার জিতে ফরাসি বেশ পিছিয়ে পড়া দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু একক দেশ হিসেবে বিবেচনায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৫টি সাহিত্য পুরস্কার জিতে ফ্রান্সের অবস্থান শীর্ষে, ১১টি জিতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থানে এবং ৯টি জিতে ইংল্যান্ডের অবস্থান তৃতীয়। সুতরাং ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য এখনও দাপটের সঙ্গেই বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে অবস্থান করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইংরেজি সাহিত্য বিশ্বে প্যাত্রিক মোদিয়ানো তুলনামূলকভাবে কম খ্যাত হলেও একেবারে অপরিচিত নন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার দশটির মতো বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। একথা সত্য সেগুলোর কোনোটিই তেমন পাঠকপ্রিয়তা না পাওয়ার কারণে মোদিয়ানোর পরিচিতিও তেমন হয়নি।
মোদিয়ানোর সাহিত্যের মূল বিষয় অবশ্য সমকালীন সাহিত্যের পরিচিত ধারায়ই এগিয়েছে। নিরুদ্দেশ, পরিচয়হীনতা, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর পরিচিতি চিহ্ন। এর পেছনে তার নিজের জীবনের পটভূমি অবশ্যই কাজ করেছে। তার জন্ম ১৯৪৫ সালের ৩০ জুলাই প্যারিসের পশ্চিম শহরতলিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র মাস দুয়েক পরে। তার বাবা আলবেয়ার মোদিয়ানো (১৯১২-১৯৭৭) জন্মগ্রহণ করেন প্যারিসে, কিন্তু তাদের শিকড় অন্যত্র। গ্রিসের স্যালোনিকা শহরের সেফার্ডিক ইহুদি বংশোদ্ভূত এ আলবেয়ারের সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে পরিচয় ঘটে বেলজীয় (ফ্লেমিশ) বংশোদ্ভূত লুইসা কল্পা (Louisa Colpin)। নাৎসি অধিকৃত প্যারিসের বিভিন্ন স্থানে তারা লুকিয়ে-ছাপিয়ে দেখাশোনা করতে থাকেন। নাৎসি নিয়ম অনুযায়ী ইহুদি আলবেয়ার মোদিয়ানোর পোশাকের ওপর লক্ষ্যযোগ্যভাবে ‘ডেভিডের তারকা’ প্রদর্শন করার কথা থাকলেও, তিনি তা’ না করেই চলাফেরা করতেন এবং প্যারিসের দখলদার জার্মান বাহিনীর গুপ্তচর (estapo) সদর দফতরে প্রায়ই যেতেন আড্ডা মারতে। দখলদার নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে সুতরাং তার সম্পর্ক সহজেই অনুমেয়। এ সুযোগে আলবেয়ার কালোবাজারেও ব্যবসা করেন। বাবার প্রায় সার্বক্ষণিক অনুপস্থিতি আর অভিনেত্রী মায়ের ঘন ঘন সফরের কারণে প্যাত্রিক মোদিয়ানো নানা-নানির কাছেই বড় হয়ে ওঠেন। তার প্রথম ভাষাও তাই হয়ে ওঠে ফ্লেমিশ, ফরাসি নয়। যা হোক, রাষ্ট্রীয় সহায়তায় তিনি মাধ্যমিক স্তর পাস করার পর আর উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাননি। তার ছোটভাই রুদি তার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, কিন্তু মাত্র দশ বছর বয়সের সময় ওই ভাইটি মারা গেলে মোদিয়ানো খুব কষ্ট পান। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তার সব লেখা তিনি তার মৃত এই ছোটো ভাইকেই উৎসর্গ করেন। তিনি বিয়ে করেন ১৯৭০ সালে দোমিনিক দেরফুসকে (Dominique Dehrfuss)। তাদের দুটো মেয়ে জিনা (১৯৭৪) ও মারি (১৯৭৬)।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক কেনো (Queneau) এদিসিওঁ গলিমা (Editions Gallimard) নামক এক প্রকাশকের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালে এ প্রকাশকই প্রকাশ করেন তার প্রথম ও অন্যতম প্রধান উপন্যাস খধ চষধপব ফব ষ’বঃড়রষব. নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার যে দশ-বারোটি বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে তার মধ্যে এটি নেই। নাৎসি অধিকৃত প্যারিসের দখলদার বাহিনীর এক ইহুদি দালালের কর্মকাণ্ড হচ্ছে এ উপন্যাসের উপজীব্য। এ বই প্রকাশে তার বাবা এতটাই চটে যান যে তিনি এর সব কপি কিনে নিয়ে তা পাঠকের কাছ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।
প্যারিসের রাস্তাঘাট, অলিগলি, সময়ের সঙ্গে তাদের বিবর্তন, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অধিকৃত প্যারিসের বাসিন্দাদের, বিশেষ করে ইহুদিদের, জীবনের যে অনিশ্চয়তা মূলত তা-ই হচ্ছে তার উপন্যাসের উপজীব্য। একথা ঠিক যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’মাস পর জন্মগ্রহণ করে এগুলো জ্যঁ প্যাত্রিক মোদিয়ানোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু ওই প্রজন্মের সবাই-ই তাদের মানসিক উত্তরাধিকারের মধ্যে আজও সেই বোঝা বহন করে চলেছেন। তারই রূপকার হয়েছেন তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে মোদিয়ানো বলেছেন, ‘একেকটি উপন্যাস শেষ করে মনে হয় এ বোঝা এবার বুঝি সব নামানো গেল। কিন্তু আমি জানি আমি যা তারই ক্ষুদ্র-খণ্ড অংশ হিসেবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনার হাত ধরে ঘুরেফিরে বারবার এরা আসতেই থাকবে। যে সময়ে এবং যে স্থানে আমরা জন্মেছি শেষ পর্যন্ত তারাই আমরা কি তা নির্ধারণ করে দেয়।’ এ হচ্ছেন জ্যঁ প্যাত্রিক মোদিয়ানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অনিকেত মানসলোকের কারিগর। প্রায় তিরিশটির মতো বইয়ে তার উপন্যাসের পর উপন্যাসে, ক্রমাগত এ অবস্থাটি ধরারই প্রয়াস পেয়েছেন তিনি।
একটি বিষয় অবশ্য প্রথমেই পরিষ্কার করে নেয়া উচিত। বিশ্বসাহিত্যের মোটামুটি খোঁজখবর যারা রাখেন এবং (মূলত অনুবাদের মাধ্যমে হলেও) বড় মাপের সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত থাকেন, তাদের প্রত্যেকেরই মনে হয় নিজ নিজ ভালোবাসার লেখক কিংবা কবিদের নিয়ে একটি নিজস্ব তালিকা তৈরি করা থাকে। যে কোনো বছরের সাহিত্যে নোবেল ঘোষণার পর যদি নিজ তালিকার কেউ থাকেন তাহলে তারা বেশ খুশি হন; আর না থাকলে হতাশ, এমনকি কখনও কখনও বিষন্নতাও বোধ করেন। এ অনুভূতিটা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যদিক দিয়ে। পৃথিবীর বৃহত্তম এবং উন্নততর ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা অন্যতম এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের একেবারে গোড়ার দিকে (১৯১৩ সালে) এ ভাষার একজন কবি (রবীন্দ্রনাথ) সে পুরস্কার অর্জনের কারণে আমরা যথার্থই গর্বিত। কিন্তু নানাবিধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে জাতি হিসেবে বাঙালিরা শতাধিক বছরের আগের অবস্থানে আটকে আছি মনে হয়। একথা আমাদের মধ্যে সহজে প্রায় কেউই স্বীকার করতে চাইবেন বলে আমার মনে হয় না। শতাধিক বছর আগে পাওয়া নোবেল পুরস্কারের বর্তমান সময়ের যে অবস্থান, রবীন্দ্রনাথের পর থেকে আমাদের সাহিত্যের মানে আমরা কি তার ধারে-কাছে এখনও পর্যন্ত যেতে পেরেছি? পৃথিবীর অন্যান্য প্রধান ভাষার সাহিত্যকর্ম যেমন দেদারসে অনূদিত হয়ে সমস্ত বিশ্বের সাহিত্যামোদি মহলে পঠিত এবং আলোচিত-সমালোচিত হয়, বাংলাসাহিত্য কি তেমন হয়? নোবেলবিজয়ী আমাদের একমাত্র লেখক-কবিও এখন বাইরের জগতে আর তেমন একটা পরিচিত নন; পঠিতও নন। আর ক্ষীয়মাণ কুলীনদের মতো আমরা বাঙালিরা নতুন কিছু সৃষ্টিতে ক্রমাগত ব্যর্থ হতে হতে রবীন্দ্রনাথকে আরও বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরছি। রবীন্দ্রনাথকে কিংবা তার সুবিশাল ও মহৎ সৃষ্টিকে আমি মোটেই খাটো করে দেখছি না। কিন্তু এখন থেকে দেড় শতাধিক বছর আগের রবীন্দ্রনাথই আমাদের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার একমাত্র কাণ্ডারি হয়ে রইলেন, জাতীয় সাহিত্যের বিষয়ে বাংলার ও বাঙালির জন্য এটা মোটেই কোনো সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। আমি জানি শেকসপিয়ারের কথা, গ্যোয়েটের কথা, তলস্তয়ের কথা কিংবা তাদের চেয়েও পুরনো অথচ আজো খ্যাতিতে অম্লান সাহিত্যিকদের কথা টেনে রবীন্দ্রনাথকে তাদের পাশে বসাবেন কেউ কেউ। আমাদের তাতে আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই; এমনকি আমরা একমতও হবো হয়তো অনেক দিক দিয়ে। কিন্তু ওইসব খ্যাতিমানদের পায়ে পায়ে আরও অনেকে যে তাদের নিজের নিজের তথা পৃথিবীর সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, রবীন্দ্র-পরবর্তী কোনো বাঙালি লেখক-সাহিত্যিক তা’ কি করতে পেরেছেন? দোষ কোনোক্রমেই রবীন্দ্রনাথের নয়। এ হচ্ছে জাতি হিসেবে আমাদের অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা, দীনতা, এবং আমার বলতে ইচ্ছে করছে, ভগ্ন কুলীনদের মতো আমাদের ক্ষয়িষ্ণুতা।
আরেকটি বিষয় এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়। সমস্ত পৃথিবীর সাহিত্য পাঠকরা যেমন আমাদের খোঁজ রাখেন না, তার প্রতিশোধ হিসেবেই যেন আমরাও বিশ্বসাহিত্যের তেমন একটা খবর রাখি বলে মনে হয় না। তাই প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হলে আমরা সবাই-ই প্রায় চমকে উঠি। কারণ দু-একটি ব্যতিক্রমী বছর বাদ দিলে, প্রায় সব নামই পুরস্কার ঘোষণার পর আমরা প্রথমবারের মতো শুনতে পাই। তার কারণ ইংরেজিতেও এখন আমরা আর পড়তে পারি না এবং সে কারণেই সম্ভবত, পৃথিবীর খ্যাতনামা লেখক-সাহিত্যিকদের লেখা আমাদের এখানে আসেও না। অন্যদিকে ওই লেখকদের অনেকেই হয়তো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই বিশ-তিরিশটি ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পান, কিন্তু জনসংখ্যার গণনায় পৃথিবীর পঞ্চম নাকি অষ্টম (?) বৃহত্তম ভাষা বাংলায় তাদের প্রায় কেউই অনূদিত হন না, এমনকি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও! সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আমাদের দীনতা কতখানি প্রকট এ একটি বিষয়ই দগদগে ঘায়ের মতো আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পহেলা বৈশাখে ঢাকা উজাড় করা জনতা বকুলতলার সুললিত রবীন্দ্রসঙ্গীত, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের দু-তিন দিনব্যাপী নিয়মিত বর্ষবরণ, একুশে ফেব্র“য়ারির বাংলা-প্রীতির আদিখ্যেতা, বইমেলার উপচেপড়া ভিড়, রবীন্দ্র-সরোবরে অসংখ্য মানুষের গাদাগাদিতে উদাত্ত কণ্ঠের কবিতা আবৃত্তি, নাটকপাড়ার ক্রমশ ঝিমিয়ে আসা উৎসাহ, সেনা স্টেডিয়ামের বছরান্তিক সপ্তাহব্যাপী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে হাজারও সঙ্গীত রসিকদের রাত-ভোর করে দেয়া উপস্থিতি-এসবই কি তাহলে খুব ওপরের হালকা একটি প্রলেপ মাত্র! একটু আঁচড় কাটলেই যার ভেতরের নিরেট সংস্কৃতিহীনতার অসুন্দর, খসখসে উপরিতল সবার চোখের ওপর নিজেকে উদাম করে দেবে? একি ফাঁপা বেলুনের পাতলা আবরণ, ছোট্ট একটি আলপিনের আলতো ছোঁয়ায় যার অনস্তিত্বে বিলীন হয়ে যাবে?
দুয়েকবার বেকায়দায় ধাক্কা খেয়ে আমাদের ‘বুদ্ধিজীবীদের’ কেউ আর এখন নোবেলপ্রাপ্ত লেখককে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেন বলে মনে হয় না, করলে নিশ্চয়ই চোখে পড়ত। সাহিত্যে এবারের নোবেলজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক জ্যঁ প্যাত্রিক মোদিয়ানোকে (Jean Patrick Modiano) নিয়ে এবারে অবশ্য নির্ভয়ে অমন মন্তব্য করা যেত। কারণ খোদ পশ্চিমা দুনিয়ার বাঘা বাঘা সব সংবাদপত্র আর সাময়িকী ‘প্যাত্রিক মোদিয়ানোকে?’ এবং সমজাতীয় আরও সব প্রশ্ন করে বসেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, এ বাঘা বাঘা কাগজ বলতে এখন ইংরেজি ভাষার প্রধান প্রধান কাগজগুলোকেই বোঝায়। সতের শতকীয় পৃথিবীতে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-কূটনীতি ইত্যাদি প্রায় সবক্ষেত্রে ফরাসি ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। সে স্থান আঠারো শতকের প্রায় মাঝামাঝি শুরু হওয়া ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, তখনকার ইউরোপীয় কয়েকটি ঔপনিবেশি শক্তির চেয়ে বেশ খানিকটা দেরিতে শুরু করেও যুক্তরাজ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। উনিশ শতকের শেষার্ধ্ব থেকেই ইংরেজি ফরাসি ভাষাকে একটু একটু করে হটাতে হটাতে এখন একেবারেই কোণঠাসা করে ফেলেছে। ইংরেজদের সাম্রাজ্যের সূর্য এখন অস্তাচলগামী, অবস্থান, আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের তিন-চতুর্থাংশ সময় পর্যন্ত পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছিল যে যুক্তরাজ্য, আগামী দু-চার বছরের মধ্যেই সে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দশ নম্বরেরও নিচে নেমে যাবে। কিন্তু ইংরেজি ভাষা এখনও সমস্ত পৃথিবীতেই অপরিহার্য। ইংরেজি ছাড়া আর সব ভাষাই বস্তুতপক্ষে এখন নিজ নিজ গৃহকোণে ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে হয়। এক সময়ের অভিজাত ফরাসি ভাষাও এ অবমাননা থেকে রেহাই পায়নি।
মূলত এ কারণেই এবারের নোবেলজয়ী প্যাত্রিক মোদিয়ানো ফ্রান্সের বাইরে প্রায় অপরিচিতই ছিলেন। খোদ নোবেল কমিটির স্থায়ী সচিব পিটার ইংলুন্ড (Peter Englund) পুরস্কার ঘোষণার পর বলেছেন যে, ‘প্যাত্রিক মোদিয়ানো ফ্রান্সে সুপরিচিত নাম, কিন্তু অন্য কোথাও নয়।’ পুরস্কার ঘোষণার দিন, ৯ অক্টোবর, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাময়িকী The New Yorker এ নিবন্ধ লিখে Alexandra Schwartz বলেছেন, ‘ তিনি (মোদিয়ানো) ফ্রান্সে খুব বিখ্যাত কিন্তু এখানে বস্তুতপক্ষে কেউ তাকে চেনেন না।’ যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান প্রায় সব পত্রিকা ও সাময়িকীর ওই একই সুর লক্ষ্য করা গেছে এবারের সাহিত্যে নোবেলজয়ীর ব্যাপারে। এর কারণ আছে নিশ্চয়ই। ফরাসি ভাষার কোণঠাসা হয়ে পড়ার কথা আগেই বলেছি। তার সঙ্গে অবশ্যই যোগ হয়েছে প্যাত্রিক মোদিয়ানোর প্রচারবিমুখতা। গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়া তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলেন। তা’ না হলে তিনি কিন্তু ফরাসি দেশের বাইরে বৃহত্তর সাহিত্য বিশ্বে এতটা অপরিচিত থাকতেন না। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার প্রথম ও অন্যতম প্রধান উপন্যাসের জন্য তিনি অস্ট্রিয়া থেকে ২০১২ সালে ইউরোপের অন্যতম প্রধান সাহিত্য পুরস্কার ‘ইউরোপীয় সাহিত্যের জন্য অস্ট্রীয় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার’ লাভ করেন। ইংরেজি সাহিত্য বিশ্বের ম্যান বুকার সাহিত্য পুরস্কারের সমমর্যাদার ফরাসি সাহিত্য পুরস্কার চৎরী এড়হপড়ঁৎঃ ও তিনি জিতেছেন তার সাহিত্যকর্মের জন্য তারও আগে, ১৯৭৮ সালে। কাজেই, ইংরেজি প্রচার মাধ্যম তার ব্যাপারে যতটা নাক সিঁটকাক, তিনি ততটা অখ্যাত কেউ নন, যদিও বাইরের ইংরেজি প্রভাব বলয়ের সুবিশাল জগতে পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত অপরিচিত থেকে গিয়েছিলেন। এবার তারও অবসান ঘটল।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা এখানে বলে নেই। ইংরেজি ফরাসিকে কোণঠাসা করেছে ঠিকই, এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে এ যাবৎ তিরিশটি পুরস্কার জিতে ইংরেজির স্থান শীর্ষে, এবং ষোলোটি পুরস্কার জিতে ফরাসি বেশ পিছিয়ে পড়া দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু একক দেশ হিসেবে বিবেচনায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৫টি সাহিত্য পুরস্কার জিতে ফ্রান্সের অবস্থান শীর্ষে, ১১টি জিতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থানে এবং ৯টি জিতে ইংল্যান্ডের অবস্থান তৃতীয়। সুতরাং ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য এখনও দাপটের সঙ্গেই বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে অবস্থান করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইংরেজি সাহিত্য বিশ্বে প্যাত্রিক মোদিয়ানো তুলনামূলকভাবে কম খ্যাত হলেও একেবারে অপরিচিত নন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার দশটির মতো বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। একথা সত্য সেগুলোর কোনোটিই তেমন পাঠকপ্রিয়তা না পাওয়ার কারণে মোদিয়ানোর পরিচিতিও তেমন হয়নি।
মোদিয়ানোর সাহিত্যের মূল বিষয় অবশ্য সমকালীন সাহিত্যের পরিচিত ধারায়ই এগিয়েছে। নিরুদ্দেশ, পরিচয়হীনতা, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর পরিচিতি চিহ্ন। এর পেছনে তার নিজের জীবনের পটভূমি অবশ্যই কাজ করেছে। তার জন্ম ১৯৪৫ সালের ৩০ জুলাই প্যারিসের পশ্চিম শহরতলিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র মাস দুয়েক পরে। তার বাবা আলবেয়ার মোদিয়ানো (১৯১২-১৯৭৭) জন্মগ্রহণ করেন প্যারিসে, কিন্তু তাদের শিকড় অন্যত্র। গ্রিসের স্যালোনিকা শহরের সেফার্ডিক ইহুদি বংশোদ্ভূত এ আলবেয়ারের সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে পরিচয় ঘটে বেলজীয় (ফ্লেমিশ) বংশোদ্ভূত লুইসা কল্পা (Louisa Colpin)। নাৎসি অধিকৃত প্যারিসের বিভিন্ন স্থানে তারা লুকিয়ে-ছাপিয়ে দেখাশোনা করতে থাকেন। নাৎসি নিয়ম অনুযায়ী ইহুদি আলবেয়ার মোদিয়ানোর পোশাকের ওপর লক্ষ্যযোগ্যভাবে ‘ডেভিডের তারকা’ প্রদর্শন করার কথা থাকলেও, তিনি তা’ না করেই চলাফেরা করতেন এবং প্যারিসের দখলদার জার্মান বাহিনীর গুপ্তচর (estapo) সদর দফতরে প্রায়ই যেতেন আড্ডা মারতে। দখলদার নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে সুতরাং তার সম্পর্ক সহজেই অনুমেয়। এ সুযোগে আলবেয়ার কালোবাজারেও ব্যবসা করেন। বাবার প্রায় সার্বক্ষণিক অনুপস্থিতি আর অভিনেত্রী মায়ের ঘন ঘন সফরের কারণে প্যাত্রিক মোদিয়ানো নানা-নানির কাছেই বড় হয়ে ওঠেন। তার প্রথম ভাষাও তাই হয়ে ওঠে ফ্লেমিশ, ফরাসি নয়। যা হোক, রাষ্ট্রীয় সহায়তায় তিনি মাধ্যমিক স্তর পাস করার পর আর উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাননি। তার ছোটভাই রুদি তার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, কিন্তু মাত্র দশ বছর বয়সের সময় ওই ভাইটি মারা গেলে মোদিয়ানো খুব কষ্ট পান। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তার সব লেখা তিনি তার মৃত এই ছোটো ভাইকেই উৎসর্গ করেন। তিনি বিয়ে করেন ১৯৭০ সালে দোমিনিক দেরফুসকে (Dominique Dehrfuss)। তাদের দুটো মেয়ে জিনা (১৯৭৪) ও মারি (১৯৭৬)।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক কেনো (Queneau) এদিসিওঁ গলিমা (Editions Gallimard) নামক এক প্রকাশকের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালে এ প্রকাশকই প্রকাশ করেন তার প্রথম ও অন্যতম প্রধান উপন্যাস খধ চষধপব ফব ষ’বঃড়রষব. নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার যে দশ-বারোটি বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে তার মধ্যে এটি নেই। নাৎসি অধিকৃত প্যারিসের দখলদার বাহিনীর এক ইহুদি দালালের কর্মকাণ্ড হচ্ছে এ উপন্যাসের উপজীব্য। এ বই প্রকাশে তার বাবা এতটাই চটে যান যে তিনি এর সব কপি কিনে নিয়ে তা পাঠকের কাছ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।
প্যারিসের রাস্তাঘাট, অলিগলি, সময়ের সঙ্গে তাদের বিবর্তন, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অধিকৃত প্যারিসের বাসিন্দাদের, বিশেষ করে ইহুদিদের, জীবনের যে অনিশ্চয়তা মূলত তা-ই হচ্ছে তার উপন্যাসের উপজীব্য। একথা ঠিক যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’মাস পর জন্মগ্রহণ করে এগুলো জ্যঁ প্যাত্রিক মোদিয়ানোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু ওই প্রজন্মের সবাই-ই তাদের মানসিক উত্তরাধিকারের মধ্যে আজও সেই বোঝা বহন করে চলেছেন। তারই রূপকার হয়েছেন তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে মোদিয়ানো বলেছেন, ‘একেকটি উপন্যাস শেষ করে মনে হয় এ বোঝা এবার বুঝি সব নামানো গেল। কিন্তু আমি জানি আমি যা তারই ক্ষুদ্র-খণ্ড অংশ হিসেবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনার হাত ধরে ঘুরেফিরে বারবার এরা আসতেই থাকবে। যে সময়ে এবং যে স্থানে আমরা জন্মেছি শেষ পর্যন্ত তারাই আমরা কি তা নির্ধারণ করে দেয়।’ এ হচ্ছেন জ্যঁ প্যাত্রিক মোদিয়ানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অনিকেত মানসলোকের কারিগর। প্রায় তিরিশটির মতো বইয়ে তার উপন্যাসের পর উপন্যাসে, ক্রমাগত এ অবস্থাটি ধরারই প্রয়াস পেয়েছেন তিনি।
No comments