স্মরণ- লালন শাহ
লালন শাহ আমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম
প্রধান দিকপাল। বাউলসঙ্গীতের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি একই সাথে বাউলগানের
রচয়িতা ও গায়ক। ১৭৭২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, লালন শাহ
যৌবনকালে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন
সাথীরা তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। এমতাবস্থায় সিরাজ সাঁই নামে এক মুসলমান
ফকির তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে
তোলেন। এরপর লালন তার কাছে দীক্ষিত হন এবং ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ
বসবাস শুরু করেন।
লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেছিলেন। সহজ-সরল শব্দময় এই গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। তিনি মাদকসেবন, পরনারী গমন, মূর্তিপূজা ও পীরপূজার বিরোধী ছিলেন। তার লেখা হামদ ও না’তও রয়েছে।
তিনি জাতিভেদ মানতেন না। তাই তিনি গেয়েছেন ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন কয়, জাতির কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ লালনের গান বাংলার সব সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয়। তার ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ ইত্যাদি গান সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
লালনের গান একসময় এতই জনপ্রিয় ছিল যে, তা সাধারণ মানুষ ও নৌকার মাঝি-মাল্লাদের মুখে মুখেও ফিরত। শিক্ষিত মহলে এ গানের কদর বাড়ছে। কুষ্টিয়া শহরের কাছে ছেউড়িয়ার আখড়ায় বসে লালন আজীবন সঙ্গীতচর্চা করেন। লালনের নিজ হাতে লেখা গানের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। কুষ্টিয়ার সাংবাদিক ও সমাজসেবক কাঙাল হরিনাথ (১৮৩৩-৯৬) ও সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) লালন শাহ ও তার গানের সাথে পরিচিত ছিলেন। হরিনাথ ছিলেন তার সাক্ষাৎ শিষ্য। ছেউড়িয়া থেকে ছয় মাইল দূরে শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ লালন শাহের ২৯৮টি গান সংগ্রহ এবং সেগুলো থেকে ২০টি গান প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তিনি ‘মানবধর্ম’বিষয়ক প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়ও লালনের গানের উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লালনকে বাঙালি শিক্ষিতসমাজে পরিচিত করেছেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক (১৭ অক্টোবর ১৮৯০) ছেউড়িয়ায় লালন পরলোক গমন করেন। প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ভক্তরা তার মাজারে সমবেত হন এবং গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
No comments