গল্প- বিবর by আহমেদ আববাস
রাসেল এক বিকেলে জগন্নাথপুরে নিজের জন্য
অন্যদের সাথে কনে দেখতে গেল। সে একজন সুদর্শন যুবক। দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ
থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এখন একটা ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত। হ্যান্ডসাম
স্যালারি। সুতরাং কনেটিও প্রিয়দর্শিনী হতে বাধা নেই। সায়মা মনোরমা। আছে
প্রাচুর্য। পাঁচ ফিটের ওপরে উচ্চতা, দোহারা গড়নে মানানসই ফিগার। উজ্জ্বল
শ্যামবর্ণ। বেগুনি ও হালকা নীলের জমিনে নীল ছোটপাড়ের কাতান শাড়িতে মোহনীয়
লাগে সায়মাকে। সাথে ম্যাচিং বেগুনি ব্লাউজের অভ্যর্থনা আবেদন সৃষ্টি করে।
যাকে ক্রমাগত দেখার জন্য চোখ টানে, সেই সুন্দরী। সায়মা এমনই একটি মেয়ে। তার
ওপর ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স। বরপরে পছন্দ হয়ে যায় সায়মাকে।
রাসেলেরও। একপর্যায়ে বর-কনের আলাপচারিতার আয়োজন করা হয়। ২০ মিনিট শেষে
উল্লসিত মনে বেরিয়ে আসে রাসেল। যথারীতি বর-কনে এবং উভয়ের সম্মিলিত আগ্রহে
সন্বন্ধ ফলপ্রসূ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দু’জনের কারোই ‘প্রি-ম্যারিটাল
প্যাশন’ না থাকায় আপনা থেকেই তাদের দেহমন উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।
রাসেলের প্রাক-পরিণয় অনুরাগ দানা বেঁধে ওঠে বাগদত্তার প্রতি। আর সার্বণিক
আসন্ন প্রণয়লীলার কথা ভেবে সময় কাটতে থাকে সায়মার। কর্মস্থল ঢাকায় ফেরে
রাসেল। শুরু হয় অপোর পালা, অপোর যন্ত্রণা; কবে আসবে সেই শুভণ। কবে সায়মা
তার বাহুলগ্না হবে। কবে সে সায়মার শরীরের ঘ্রাণে একাকার হয়ে যাবে। মানুষের
ভাবনাগুলো বাস্তবে রূপ নিলে পৃথিবীতে কারো কোনো ােভ থাকত না। ঈপ্সিত বস্তু
নিয়েই হয়তো মানুষ সুখী থাকতে চাইত। তবুও ঘববফ ্ এৎববফ বলতে একটা কথা আছে।
মানুষের প্রয়োজন সম্পন্ন হতে পারে; কিন্তু লোভ আগ্রাসী থাকে।
হঠাৎ একদিন রাসেল জানতে পারে সায়মার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। তার মনে হয়, বহুশ্রমে নির্মিত আলোকিত তাজমহলের ইটগুলো আচমকা এক ঝাপটায় ধসে পড়েছে। মনের গহিনে যন্ত্রণার তোলপাড় শুরু হয়, হতাশায় ভেঙে পড়ে। তার বাবার কাছ থেকে সেলফোনে বিষয়টি আরো নিশ্চিত হয়। তার বাবা জানায়, মেয়েপ কথা রাখেনি। লন্ডনি ছেলের সাথে সায়মার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের বাড়ি দোয়ারীবাজার। লন্ডনে হোটেল ব্যবসায় আছে। এখনই মেয়েকে লন্ডনে নিয়ে যাবে।
দুই বছর পার হয়ে গেছে। তবুও রাসেলের কম্পিউটারে অডিও সিডিতে বেজে চলেÑ ‘আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে... অথবা পুষ্প ছিল বৃশাখে, নারী তোমার অপোয়...।’ অবসরে এ ধরনের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেই এখন তার সময় কাটে।
এ দিকে কনের খোঁজে সুনামগঞ্জের দিরাই, ছাতক, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, তাহেরপুর প্রায় সর্বত্রই চষে বেড়ায় পাত্রপরে লোকজন। এমনকি দেিণর জেলা হবিগঞ্জ পর্যন্ত; কিন্তু যথাযথ পাত্রী মেলে না। কনে পছন্দ হলে ঘরবাড়ি, সামাজিক অবস্থান বাগড়া দেয়। কোথাও ঘরদোর সামঞ্জস্যপূর্ণ পেলেও পাত্রীর দাঁত উঁচু, গায়ের রঙ কালচে এবং উচ্চতায় খর্বাকার মনে হয়। আরো রয়েছে পাত্রের খুঁতখুঁতে ভাব।
নিজেকে নিজে বোঝায় রাসেলÑ একবার পছন্দনীয় কনে হাতছাড়া হয়েছে তো, কী হয়েছে? কনের কি অভাব? ডিজিটাল যুগে ওসব কেউ ভাবে নাকি? তুমি তো বাবা মহাভারতের দুষ্মন্ত নও যে, শকুন্তলা তোমার জন্য বসে থাকবে। আবার শরৎবাবুর দেবদাসও নও, অন্তিম মুহূর্তে পার্বতী ছুটে আসবে। তুমি এ যুগে বড়জোর মানিকবাবুর ‘ভয়ংকর’ গল্পের প্রসাদ হতে পারো, যে ভূষণের স্ত্রী আশাকে নিরাশ করেনিÑ
তবুও অপ্রকাশ্য চাপা অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে রাসেল। বিষয়টি কারো সাথে সে শেয়ারও করে না। মানুষের মানবিক দায়বদ্ধতা নিয়ে মাঝে মাঝে ভেবে হতাশ হয়।
আকস্মিকভাবে লন্ডনে চার সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের জন্য রাসেলের ওষুধ কোম্পানি তাকে নির্বাচিত করে। কখনো সে দেশের বাইরে পা রাখেনি; কিন্তু লন্ডনে তার কিছু নিকটাত্মীয় রয়েছেন। সেখানে গেলে তাদের সাথে দেখা হবে। এই ভেবে লন্ডন যেতে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে। চলে যায় লন্ডন।
কাকতালীয়ভাবে ব্রিকলেনের এক সুপার স্টোরে সায়মার সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তাৎণিক উত্তেজনা ও বিষাদে মাথাটা ঝিম ধরে যায় রাসেলের। সায়মার বিবর্ণ, প্রাণহীন, নিস্তেজ, স্বতোদহন চেহারা দেখে একটু ভাবিয়ে তোলে তাকেÑ এ জগতে কী না সম্ভব!
‘এরে সায়মা, তুমি ভালা আছনি’ বুকের গহিন থেকে রাসেলের মুখ ফসকে অতি কষ্টে বেরিয়ে আসে কুশল বাক্যটি।
‘দেখিয়া বুঝনাননি’ সায়মাও ােভের সাথে জানান দেয় এবং বলতে থাকে, ‘আমি হাছা আমার বাপ-মার লাগি শরম পাইছি। হাছা আমার কোনতা করার আছিল না।’
‘ইকটা তোমার শরীর দেখিয়া বুঝতাম পারছি। আমি তোমার থাকিয়া এব বিয়া করতাম পারছি নায়।’
‘আমার কথা ভাবিও নায়, তুমি বিয়া করিলাও।’
এভাবে কুশল বিনিময়, স্মৃতি রোমন্থন, আলাপচারিতা এবং অতীতবিধুরতায় ফিরে যায় দু’জন। তারা সে মুহূর্তে পূর্ব লন্ডনের বাংলা টাউন ব্রিকলেনে অবস্থান করছিল। একজন বাস করত হোয়াইট চ্যাপেলে আরেকজনের সাময়িক আবাসন ছিল বেকন স্ট্রিটে।
ফেরার পর শুরু হয় একে অপরের প্রতি মানসিক প্রতিক্রিয়া। দু’জন উদগ্রীব হয়ে ওঠে সাক্ষাতের জন্য। একজন অপরজনের জন্য পাগল হয়ে ওঠে।
সায়মার হাজব্যান্ড অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শিখে নিকটাত্মীয়দের সহায়তায় অল্প বয়সেই পাড়ি জমায় লন্ডনে। সেখানে সে একজন হোটেল ওয়ার্কার, সারা দিনের কাজ সেরে গভীর রাতে নেশা করে বাসায় ফেরে। নিত্যদিনের এই পরিস্থিতি সায়মাকে মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত করে। জীবন তার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। স্বাবলম্বী, সংসারে সচ্ছলতা এবং শিাকে কাজে লাগানোর জন্য চাকরিতে আগ্রহী হয় সায়মা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে ব্রিকলেনের একটি ইনফ্যান্ট স্কুলের শিকিা হলো সে।
ব্রিকলেনের বিখ্যাত এন্টারটেইনমেন্ট পার্কে মিলিত হয় রাসেল-সায়মা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে কাটাতে থাকে। এভাবে প্রতিদিন। ফলে একে অপরের প্রতি ঘনিষ্ঠ এবং ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রায় সাত দিনের অভিসার বিভিন্ন আলাপচারিতায় ভরে ওঠে। তারপর রাসেলের লন্ডনে অবস্থানের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
লন্ডন থেকে দেশে ফেরে রাসেল। তার সারা অবয়বে সায়মার স্মৃতি।
সায়মার আগ্রহের শেষ দেখতে আগ্রহী সে। সায়মাকে সে কথা দিয়ে এসেছে। কথা না রাখার জন্য সায়মার অভিভাবকদের প্রতি তার ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছিল। মানুষ কিভাবে কথা দিয়ে কথা না রাখে! রাসেল কি পারবে তার কথা রাখতে! সায়মা কি ফিরে আসতে পারবে?
No comments