দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট by আলী আহমদ
মূল * প্যাত্রিক মোদিয়ানো *ভূমিকা ও অনুবাদ * নাজিব ওয়াদুদ
সমকালীন ফরাসি সাহিত্যে প্যাট্রিক মোদিয়ানোর অবস্থান একেবারে প্রথম সারিতে। গ্রন্থের সংখ্যা, পাঠকপ্রিয়তা, কিংবা শৈল্পিক উৎকর্ষ, যে কোনো বিবেচনাতেই তিনি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। এ পর্যন্ত ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, স্বদেশের বাইরে তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। তাকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার পত্রপত্রিকায় আলোচনা-পর্যালোচনাও হয়েছে একেবারেই কম। সে কারণে সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষিত হওয়ার পর ফ্রান্সের বাইরের সচেতন এবং অতি-পাঠ-প্রবণ সাহিত্যপ্রেমিকরাও চোখ কুঞ্চিত করে বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করেছেন- ‘কে ইনি? এর নাম আগে তো কখনও শুনিনি! তাতে অবশ্য কিছু আসে-যায় না। মোদিয়ানো বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছেন, এবং এখন সবাই তার নাম জানছেন, তার বই কেনার হিড়িক পড়ে গেছে সারা বিশ্বে, সেটাই বড় কথা।
প্যাট্রিক মোদিয়ানো মূলত উপন্যাসই লিখেছেন, আর রয়েছে শিশুসাহিত্য ও কয়েকটি চিত্রনাট্য। কিন্তু তার নিজেরই মত হচ্ছে তিনি যেন ‘সব সময় একই বই লিখে চলেছেন।’ তার কারণ হচ্ছে তার সবগুলো উপন্যাসেরই বিষয় হচ্ছে স্মৃতি-বিস্মৃতির লুকোচুরি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অধিকৃত ফ্রান্সে ইহুদি জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন দিক থেকে, এই একই বিষয়কে তিনি ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেখেছেন বারবার। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, হারিয়ে-যাওয়া জিনিসের সন্ধানে ‘অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর ম্যানিয়া’ দ্বারা আক্রান্ত তিনি। কিন্তু সময় তার বিষয় নয়, এমনকি মাধ্যমও নয়, বরং তিনি সময়ের সঙ্গে যেন নিজেও প্রবাহিত হয়েছেন, ডুবে থেকেছেন সময়ের অভ্যন্তরে। স্মৃতি ও সময় নিয়ে তার এ অবসেশনের জন্য তাকে ‘একালের প্র“স্তু’ও বলেন কেউ কেউ।
মোদিয়ানোর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ঊনত্রিশ। তবে তার এতসব সৃষ্টিকর্মের মধ্যে তিনটি রচনাকে মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচনা করেন সাহিত্য সমালোচকরা। উপন্যাস তিনটি হচ্ছে- ‘মিসিং পারসন’, ‘আউট অফ দি ডার্ক’ এবং ‘ডোরা ব্র“ডার’। এই তালিকায় ‘হানিমুন’কেও যুক্ত করতে চান কেউ কেউ। এ উপন্যাসগুলো তার মূল প্রবণতার প্রতিনিধিস্থানীয়ও বটে। স্মৃতি ও সময় নিয়ে যে ‘ম্যানিয়া’র কথা তিনি বলেছেন এ উপন্যাসগুলোর প্রত্যেকটিতেই তার সন্ধান পাওয়া যাবে। তবে এর প্রয়োগ সবচেয়ে ব্যাপক ও গভীর হয়েছে ‘ডোরা ব্র“ডার’ উপন্যাসে। মোদিয়ানোর অন্যতম প্রধান ও বিখ্যাত এ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে, ফ্রান্সে। এটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন বার্কলি, সেটা ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস থেকে। এরপর আরেকটি ইংলিশ অনুবাদ করেন জোয়ান্না কিলমার্টিন। এ অনুবাদটি ২০০০ সালে ‘দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট’ নামে একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় লন্ডনের র্যানডম হাউস এবং বস্টনের হারভিল প্রেস থেকে।
‘দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট’ এমন একটি শঙ্কর জাতীয় রচনা যার মধ্যে অনেকগুলো প্রকরণ মিলে-মিশে-গলে একাকার হয়ে গেছে। এতে ইতিহাস, জীবনী, আত্মজৈবনিক রচনা, রহস্য উপন্যাস, প্রবন্ধ, সংবাদপত্রের রিপোর্ট, সবকিছুর সংমিশ্রণ ঘটেছে। তবে এর কেন্দ্রে রয়েছে মূল চরিত্র, ডোরা ব্রুডার। সবকিছু তাকে আবর্তিত করেই গতিমান হয়েছে। উদ্দেশ্য ডোরা ব্রুডারের পরিচয় অনুসন্ধান করা। সে ১৫ বছর বয়সী এক ইহুদি পরিবারের কন্যাসন্তান, কনভেন্টে পড়ে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ফ্রান্সের পতন হলে সেখানকার ইহুদি অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে চরম নিপীড়ন। এ নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে যায় ডোরা ব্র“ডার। কিন্তু ধরা পড়ে। তারপর হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্ধকারে।
জোয়ান্না কিলমার্টিন-কৃত অনুবাদ ‘দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট’ উপন্যাসের শুরুর খানিকটা অংশ এখানে অনূদিত হল।
ডোরা ব্রুডার
আট বছর আগে, ১৯৪১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখের প্যারিস সয়েরের একটি পুরনো কপিতে চোখ বুলাতে গিয়ে তৃতীয় পৃষ্ঠার একটা হেডলাইনে আমার চোখ আটকে গেল :
প্যারিস :
এক তরুণী বালিকা নিখোঁজ। তার নাম ডোরা ব্র“ডার, বয়স ১৫ বছর, উচ্চতা ১.৫৫ মিটার, ডিম্বাকার মুখাবয়ব, হালকা-বাদামি চোখ, পরণে ছিল ধূসর স্পোর্টস জ্যাকেট, লাল পুলওভার, নেভি-ব্লু স্কার্ট ও হ্যাট, আর বাদামি রঙের ব্যায়ামের জুতা। ঠিকানা- সব যোগাযোগ- মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এম্মি ব্রুডার, ৪১ বুলেভার্ড অরনানো, প্যারিস।
বুলেভার্ড অরনানোর আশপাশের এলাকাগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। আমার শৈশবে, যখন আমার মা সেইন্ট ওয়েন ফ্লি-মার্কেটে যেতেন তখন আমি তার সঙ্গ নিতাম। আমরা কখনও কখনও পোর্তা দ্য ক্লিগন্যানকুর্তে বাস থেকে নামতাম, কখনও বা, হঠাৎ-হঠাৎ, নামতাম ১৮নং অ্যারোন্ডিসেমেন্ট টাউন হলের বাইরে। সব সময়, দিনটা হতো শনিবার, নয়তো রোববার বিকাল।
আমি এ কথাগুলো লিখছি ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে। বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই, থামতেই চায় না। আগামীকাল ডিসেম্বর শুরু হবে, ডোরার পালিয়ে যাওয়ার পর ৫৫ বছর পেরিয়ে যাবে। আগে-ভাগেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, আর যা হয় আরকি- রাত নেমে ঢেকে দিচ্ছে এসব বর্ষণমুখর দিনের ধূসরতা এবং একঘেয়েমিকে, তখন সত্যিই এটা দিনের সময় কিনা সে কথা ভেবে অবাক হয় মানুষ। আর যদি এর মধ্যে আর কিছু না ঘটে, তাহলে এক ধরনের বিষণ্ন অন্ধকার ব্যাপ্ত হয়ে থাকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তারপর রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠে, দোকানের জানালা এবং ক্যাফেগুলো আলোকোজ্জ্বল হয়। ঝরঝরে সান্ধ্য বাতাস, বর্ণালী নকশাগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, রাস্তার মোড়গুলোতে গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় জমে যায়, সড়কে লোকজন ছুটে চলে। আর এসব আলো আর শোরগোলের মাঝখানে, আমার সহজে বিশ্বাস হতে চায় না যে এই সেই মহানগরী যেখানে ডোরা বসবাস করত তার বাপ-মায়ের সঙ্গে, যেখানে আমার পিতা বাস করতেন যখন তার বয়স ছিল আমার এখনকার বয়সের চেয়ে ২৪ বছর কম। আমার অনুভব হচ্ছে যেন বা আমি একাকি তখনকার প্যারিসের সঙ্গে এখনকার প্যারিসের মধ্যে একটা সংযোগসূত্র নির্মাণ করছি, একা-একা এসব খুটিনাটি ব্যাপার বিস্তারিতভাবে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে। কখনও কখনও এ সংযোগসূত্র ছিঁড়ে যাওয়ার মতো মাত্রায় সম্প্রসারিত হয়ে পড়ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে অন্যসব সন্ধ্যাগুলো পর্যন্ত, যখন আজকের নগরীর পেছনে ধাবমান ক্ষণস্থায়ী আলোয় আমার সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠছে গতকালকের নগরী।
আমার পূর্ববর্তী অনেক লেখকের মতো আমিও কাকতালীয়তে বিশ্বাস করি, এবং কখনও কখনও, ঔপন্যাসিকের অলোকদৃষ্টির প্রতিভাতেও,- ‘প্রতিভা’ শব্দটা উপযুক্ত হল না, কারণ এতে এক ধরনের উত্তমর্ণ ভাব নিহিত আছে।
অলোকদৃষ্টি, অর্থাৎ অতিন্দ্রিয় দর্শনক্ষমতা, স্রেফ একটা পেশাগত জিনিস : কল্পনার দরকারী উল্লম্ফন, মনকে খুটিনাটির প্রতি নিবিষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা- বাস্তবে, অবচেতনার প্রতি- যাতে সূত্রটা হারিয়ে না যায় এবং যেন স্বাভাবিক আলস্যের কাছে পরাজয় না ঘটে। এসব উত্তেজনা, মস্তিষ্কক্রিয়ার এ অনুশীলন, শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় ‘অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সংক্রান্ত সংজ্ঞার উচ্ছ্বাস’-এর দিকে, এরকমভাবেই ‘অলোকদৃষ্টি’ শব্দটার সংজ্ঞা দিয়েছেন লারুসি তার ডিকশনারিতে।
১৯৮৮-র ডিসেম্বরে, ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের প্যারিস সয়েরে প্রকাশিত ডোরার সন্ধান লাভের ঘোষণাটা পড়ার পর, আমি এটা নিয়ে অবিরাম ভেবেছি, মাসের পর মাস। কিছু কিছু খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তৃত বিবরণ আমাকে সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে: ‘৪১ বুলেভার্ড অরনানো, উচ্চতা ১.৫৫ মিটার, ডিম্বাকার মুখাবয়ব, হালকা-বাদামি চোখ, ধূসর স্পোর্টস জ্যাকেট, তামাটে-লাল পুলওভার, নেভি-ব্লু স্কার্ট ও হ্যাট, আর বাদামি রঙের ব্যায়ামের জুতা।’ আর সবকিছু খামবদ্ধ হয়ে আছে অন্ধকার, অজ্ঞতা, বিস্মরণ আর বিস্মৃতির ভেতর। আমি ডোরা ব্র“ডার সম্পর্কে ক্ষীণতম ইঙ্গিতেরও সন্ধান পাব, সেটা অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় আমার কাছে। সেই সময় যে শূন্যতা আমি অনুভব করি সেটা আমাকে ‘হানিমুন’ উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে, ডোরা ব্রুডারের প্রতি আমার অব্যাহত মনোযোগ নিবদ্ধ রাখার উপায় হিসেবে এটা ভালো কাজ দিয়েছে, এবং সম্ভবত, আমি নিজেকে বলেছি, তার সম্পর্কে বিশদীকরণ বা তাকে চমৎকার করে চিত্রিত করতে,- কোথায় সে ছিল, তার জীবন সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দিতে প্ররোচিত করেছে। আমি তার পিতা-মাতা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, অজানা ছিল তার পলায়ন-পরবর্তী পরিণতিও। আমার সম্বল ছিল কেবল এটুকু যে আমি তার নাম জানতে পেরেছি- ডোরা ব্রুডার- আর কিছু নয়, না কোনো তারিখ, বা না কোনো জন্মস্থান- আর জেনেছি তার পিতার নাম- আর্নেস্ট ব্র“ডার, ২১.৫.৯৯, ভিয়েনা, রাষ্ট্রহীন- এটা পাওয়া গিয়েছে সেই তালিকা থেকে যাতে ১৮ সেপ্টেম্বর অসউইচে পালিয়ে যাওয়া লোকদের নাম রয়েছে।
‘হানিমুন’ লেখার সময় কয়েকজন নারীর কথা আমার মনে ছিল, ১৯৬০-এর দশকে তাদের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল- অ্যানি বি, বেলা ডি- ডোরার সমবয়সী এরা, একজনের ক্ষেত্রে তো এক মাসের মতো পার্থক্য। এরা হয়তো একই দুর্ভাগ্যের শিকার, দখলদারিত্বের সময় একই পরিস্থিতির কবলে পতিত হয়েছে, আর তাদের সঙ্গে তার সাদৃশ্য রয়েছে। আজ, আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, সত্যের অস্পষ্ট আলোকচ্ছটা অবচেতনভাবে আত্মীকরণ করার আগে আমাকে ২০০ পৃষ্ঠা লিখতে হতো।
ব্যাপারটা মাত্র কয়েক লাইনের : ‘ট্রেনটা নেশনে থেমেছে। লাইন আর যায়নি, শেষ এখানেই। রিগঁদ আর ইনগ্রিস গিয়েছে বাস্তিলের দিকে, সেখান থেকে নিশ্চয়ই দিক বদল করেছে পোর্টা দোরির উদ্দেশে। তারা মেট্রো থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা বিশাল তুষারক্ষেত্রের ভেতর। [ ...] কয়েকটা ছোট ছোট সড়ক পেরিয়ে স্লেজ ফিরে গিয়েছিল বুলেভার্ড স্যুট-এ।’
পেছনের এ রাস্তাগুলো রিউ দ্য পিকাস এবং হলি হার্ট অফ মেরি-র আড়ালে পড়েছে, এ কনভেন্ট থেকেই ডোরা ব্র“ডার পালিয়েছিল। সেদিন ছিল ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যা, যখন সম্ভবত প্যারিসে তুষারপাত হচ্ছিল। বইটিতে এটাই একমাত্র মুহূর্ত যখন, সেটা না জেনেই, আমি কাল ও স্থানগত দিক থেকে তার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম।
সমকালীন ফরাসি সাহিত্যে প্যাট্রিক মোদিয়ানোর অবস্থান একেবারে প্রথম সারিতে। গ্রন্থের সংখ্যা, পাঠকপ্রিয়তা, কিংবা শৈল্পিক উৎকর্ষ, যে কোনো বিবেচনাতেই তিনি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। এ পর্যন্ত ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, স্বদেশের বাইরে তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। তাকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার পত্রপত্রিকায় আলোচনা-পর্যালোচনাও হয়েছে একেবারেই কম। সে কারণে সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষিত হওয়ার পর ফ্রান্সের বাইরের সচেতন এবং অতি-পাঠ-প্রবণ সাহিত্যপ্রেমিকরাও চোখ কুঞ্চিত করে বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করেছেন- ‘কে ইনি? এর নাম আগে তো কখনও শুনিনি! তাতে অবশ্য কিছু আসে-যায় না। মোদিয়ানো বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছেন, এবং এখন সবাই তার নাম জানছেন, তার বই কেনার হিড়িক পড়ে গেছে সারা বিশ্বে, সেটাই বড় কথা।
প্যাট্রিক মোদিয়ানো মূলত উপন্যাসই লিখেছেন, আর রয়েছে শিশুসাহিত্য ও কয়েকটি চিত্রনাট্য। কিন্তু তার নিজেরই মত হচ্ছে তিনি যেন ‘সব সময় একই বই লিখে চলেছেন।’ তার কারণ হচ্ছে তার সবগুলো উপন্যাসেরই বিষয় হচ্ছে স্মৃতি-বিস্মৃতির লুকোচুরি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অধিকৃত ফ্রান্সে ইহুদি জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন দিক থেকে, এই একই বিষয়কে তিনি ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেখেছেন বারবার। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, হারিয়ে-যাওয়া জিনিসের সন্ধানে ‘অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর ম্যানিয়া’ দ্বারা আক্রান্ত তিনি। কিন্তু সময় তার বিষয় নয়, এমনকি মাধ্যমও নয়, বরং তিনি সময়ের সঙ্গে যেন নিজেও প্রবাহিত হয়েছেন, ডুবে থেকেছেন সময়ের অভ্যন্তরে। স্মৃতি ও সময় নিয়ে তার এ অবসেশনের জন্য তাকে ‘একালের প্র“স্তু’ও বলেন কেউ কেউ।
মোদিয়ানোর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ঊনত্রিশ। তবে তার এতসব সৃষ্টিকর্মের মধ্যে তিনটি রচনাকে মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচনা করেন সাহিত্য সমালোচকরা। উপন্যাস তিনটি হচ্ছে- ‘মিসিং পারসন’, ‘আউট অফ দি ডার্ক’ এবং ‘ডোরা ব্র“ডার’। এই তালিকায় ‘হানিমুন’কেও যুক্ত করতে চান কেউ কেউ। এ উপন্যাসগুলো তার মূল প্রবণতার প্রতিনিধিস্থানীয়ও বটে। স্মৃতি ও সময় নিয়ে যে ‘ম্যানিয়া’র কথা তিনি বলেছেন এ উপন্যাসগুলোর প্রত্যেকটিতেই তার সন্ধান পাওয়া যাবে। তবে এর প্রয়োগ সবচেয়ে ব্যাপক ও গভীর হয়েছে ‘ডোরা ব্র“ডার’ উপন্যাসে। মোদিয়ানোর অন্যতম প্রধান ও বিখ্যাত এ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে, ফ্রান্সে। এটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন বার্কলি, সেটা ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস থেকে। এরপর আরেকটি ইংলিশ অনুবাদ করেন জোয়ান্না কিলমার্টিন। এ অনুবাদটি ২০০০ সালে ‘দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট’ নামে একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় লন্ডনের র্যানডম হাউস এবং বস্টনের হারভিল প্রেস থেকে।
‘দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট’ এমন একটি শঙ্কর জাতীয় রচনা যার মধ্যে অনেকগুলো প্রকরণ মিলে-মিশে-গলে একাকার হয়ে গেছে। এতে ইতিহাস, জীবনী, আত্মজৈবনিক রচনা, রহস্য উপন্যাস, প্রবন্ধ, সংবাদপত্রের রিপোর্ট, সবকিছুর সংমিশ্রণ ঘটেছে। তবে এর কেন্দ্রে রয়েছে মূল চরিত্র, ডোরা ব্রুডার। সবকিছু তাকে আবর্তিত করেই গতিমান হয়েছে। উদ্দেশ্য ডোরা ব্রুডারের পরিচয় অনুসন্ধান করা। সে ১৫ বছর বয়সী এক ইহুদি পরিবারের কন্যাসন্তান, কনভেন্টে পড়ে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ফ্রান্সের পতন হলে সেখানকার ইহুদি অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে চরম নিপীড়ন। এ নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে যায় ডোরা ব্র“ডার। কিন্তু ধরা পড়ে। তারপর হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্ধকারে।
জোয়ান্না কিলমার্টিন-কৃত অনুবাদ ‘দ্য সার্চ ওয়ারেন্ট’ উপন্যাসের শুরুর খানিকটা অংশ এখানে অনূদিত হল।
ডোরা ব্রুডার
আট বছর আগে, ১৯৪১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখের প্যারিস সয়েরের একটি পুরনো কপিতে চোখ বুলাতে গিয়ে তৃতীয় পৃষ্ঠার একটা হেডলাইনে আমার চোখ আটকে গেল :
প্যারিস :
এক তরুণী বালিকা নিখোঁজ। তার নাম ডোরা ব্র“ডার, বয়স ১৫ বছর, উচ্চতা ১.৫৫ মিটার, ডিম্বাকার মুখাবয়ব, হালকা-বাদামি চোখ, পরণে ছিল ধূসর স্পোর্টস জ্যাকেট, লাল পুলওভার, নেভি-ব্লু স্কার্ট ও হ্যাট, আর বাদামি রঙের ব্যায়ামের জুতা। ঠিকানা- সব যোগাযোগ- মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এম্মি ব্রুডার, ৪১ বুলেভার্ড অরনানো, প্যারিস।
বুলেভার্ড অরনানোর আশপাশের এলাকাগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। আমার শৈশবে, যখন আমার মা সেইন্ট ওয়েন ফ্লি-মার্কেটে যেতেন তখন আমি তার সঙ্গ নিতাম। আমরা কখনও কখনও পোর্তা দ্য ক্লিগন্যানকুর্তে বাস থেকে নামতাম, কখনও বা, হঠাৎ-হঠাৎ, নামতাম ১৮নং অ্যারোন্ডিসেমেন্ট টাউন হলের বাইরে। সব সময়, দিনটা হতো শনিবার, নয়তো রোববার বিকাল।
আমি এ কথাগুলো লিখছি ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে। বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই, থামতেই চায় না। আগামীকাল ডিসেম্বর শুরু হবে, ডোরার পালিয়ে যাওয়ার পর ৫৫ বছর পেরিয়ে যাবে। আগে-ভাগেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, আর যা হয় আরকি- রাত নেমে ঢেকে দিচ্ছে এসব বর্ষণমুখর দিনের ধূসরতা এবং একঘেয়েমিকে, তখন সত্যিই এটা দিনের সময় কিনা সে কথা ভেবে অবাক হয় মানুষ। আর যদি এর মধ্যে আর কিছু না ঘটে, তাহলে এক ধরনের বিষণ্ন অন্ধকার ব্যাপ্ত হয়ে থাকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তারপর রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠে, দোকানের জানালা এবং ক্যাফেগুলো আলোকোজ্জ্বল হয়। ঝরঝরে সান্ধ্য বাতাস, বর্ণালী নকশাগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, রাস্তার মোড়গুলোতে গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় জমে যায়, সড়কে লোকজন ছুটে চলে। আর এসব আলো আর শোরগোলের মাঝখানে, আমার সহজে বিশ্বাস হতে চায় না যে এই সেই মহানগরী যেখানে ডোরা বসবাস করত তার বাপ-মায়ের সঙ্গে, যেখানে আমার পিতা বাস করতেন যখন তার বয়স ছিল আমার এখনকার বয়সের চেয়ে ২৪ বছর কম। আমার অনুভব হচ্ছে যেন বা আমি একাকি তখনকার প্যারিসের সঙ্গে এখনকার প্যারিসের মধ্যে একটা সংযোগসূত্র নির্মাণ করছি, একা-একা এসব খুটিনাটি ব্যাপার বিস্তারিতভাবে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে। কখনও কখনও এ সংযোগসূত্র ছিঁড়ে যাওয়ার মতো মাত্রায় সম্প্রসারিত হয়ে পড়ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে অন্যসব সন্ধ্যাগুলো পর্যন্ত, যখন আজকের নগরীর পেছনে ধাবমান ক্ষণস্থায়ী আলোয় আমার সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠছে গতকালকের নগরী।
আমার পূর্ববর্তী অনেক লেখকের মতো আমিও কাকতালীয়তে বিশ্বাস করি, এবং কখনও কখনও, ঔপন্যাসিকের অলোকদৃষ্টির প্রতিভাতেও,- ‘প্রতিভা’ শব্দটা উপযুক্ত হল না, কারণ এতে এক ধরনের উত্তমর্ণ ভাব নিহিত আছে।
অলোকদৃষ্টি, অর্থাৎ অতিন্দ্রিয় দর্শনক্ষমতা, স্রেফ একটা পেশাগত জিনিস : কল্পনার দরকারী উল্লম্ফন, মনকে খুটিনাটির প্রতি নিবিষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা- বাস্তবে, অবচেতনার প্রতি- যাতে সূত্রটা হারিয়ে না যায় এবং যেন স্বাভাবিক আলস্যের কাছে পরাজয় না ঘটে। এসব উত্তেজনা, মস্তিষ্কক্রিয়ার এ অনুশীলন, শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় ‘অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী সংক্রান্ত সংজ্ঞার উচ্ছ্বাস’-এর দিকে, এরকমভাবেই ‘অলোকদৃষ্টি’ শব্দটার সংজ্ঞা দিয়েছেন লারুসি তার ডিকশনারিতে।
১৯৮৮-র ডিসেম্বরে, ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের প্যারিস সয়েরে প্রকাশিত ডোরার সন্ধান লাভের ঘোষণাটা পড়ার পর, আমি এটা নিয়ে অবিরাম ভেবেছি, মাসের পর মাস। কিছু কিছু খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তৃত বিবরণ আমাকে সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে: ‘৪১ বুলেভার্ড অরনানো, উচ্চতা ১.৫৫ মিটার, ডিম্বাকার মুখাবয়ব, হালকা-বাদামি চোখ, ধূসর স্পোর্টস জ্যাকেট, তামাটে-লাল পুলওভার, নেভি-ব্লু স্কার্ট ও হ্যাট, আর বাদামি রঙের ব্যায়ামের জুতা।’ আর সবকিছু খামবদ্ধ হয়ে আছে অন্ধকার, অজ্ঞতা, বিস্মরণ আর বিস্মৃতির ভেতর। আমি ডোরা ব্র“ডার সম্পর্কে ক্ষীণতম ইঙ্গিতেরও সন্ধান পাব, সেটা অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় আমার কাছে। সেই সময় যে শূন্যতা আমি অনুভব করি সেটা আমাকে ‘হানিমুন’ উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে, ডোরা ব্রুডারের প্রতি আমার অব্যাহত মনোযোগ নিবদ্ধ রাখার উপায় হিসেবে এটা ভালো কাজ দিয়েছে, এবং সম্ভবত, আমি নিজেকে বলেছি, তার সম্পর্কে বিশদীকরণ বা তাকে চমৎকার করে চিত্রিত করতে,- কোথায় সে ছিল, তার জীবন সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দিতে প্ররোচিত করেছে। আমি তার পিতা-মাতা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, অজানা ছিল তার পলায়ন-পরবর্তী পরিণতিও। আমার সম্বল ছিল কেবল এটুকু যে আমি তার নাম জানতে পেরেছি- ডোরা ব্রুডার- আর কিছু নয়, না কোনো তারিখ, বা না কোনো জন্মস্থান- আর জেনেছি তার পিতার নাম- আর্নেস্ট ব্র“ডার, ২১.৫.৯৯, ভিয়েনা, রাষ্ট্রহীন- এটা পাওয়া গিয়েছে সেই তালিকা থেকে যাতে ১৮ সেপ্টেম্বর অসউইচে পালিয়ে যাওয়া লোকদের নাম রয়েছে।
‘হানিমুন’ লেখার সময় কয়েকজন নারীর কথা আমার মনে ছিল, ১৯৬০-এর দশকে তাদের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল- অ্যানি বি, বেলা ডি- ডোরার সমবয়সী এরা, একজনের ক্ষেত্রে তো এক মাসের মতো পার্থক্য। এরা হয়তো একই দুর্ভাগ্যের শিকার, দখলদারিত্বের সময় একই পরিস্থিতির কবলে পতিত হয়েছে, আর তাদের সঙ্গে তার সাদৃশ্য রয়েছে। আজ, আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, সত্যের অস্পষ্ট আলোকচ্ছটা অবচেতনভাবে আত্মীকরণ করার আগে আমাকে ২০০ পৃষ্ঠা লিখতে হতো।
ব্যাপারটা মাত্র কয়েক লাইনের : ‘ট্রেনটা নেশনে থেমেছে। লাইন আর যায়নি, শেষ এখানেই। রিগঁদ আর ইনগ্রিস গিয়েছে বাস্তিলের দিকে, সেখান থেকে নিশ্চয়ই দিক বদল করেছে পোর্টা দোরির উদ্দেশে। তারা মেট্রো থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা বিশাল তুষারক্ষেত্রের ভেতর। [ ...] কয়েকটা ছোট ছোট সড়ক পেরিয়ে স্লেজ ফিরে গিয়েছিল বুলেভার্ড স্যুট-এ।’
পেছনের এ রাস্তাগুলো রিউ দ্য পিকাস এবং হলি হার্ট অফ মেরি-র আড়ালে পড়েছে, এ কনভেন্ট থেকেই ডোরা ব্র“ডার পালিয়েছিল। সেদিন ছিল ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যা, যখন সম্ভবত প্যারিসে তুষারপাত হচ্ছিল। বইটিতে এটাই একমাত্র মুহূর্ত যখন, সেটা না জেনেই, আমি কাল ও স্থানগত দিক থেকে তার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম।
No comments