ধর্ম-দর্শন- সুস্থ সমাজ গঠনের পদ্ধতি by শাহ্ আব্দুল হান্নান
ইসলামি দাওয়াত ইসলামি আদর্শ ও বিধানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামি দাওয়াত হচ্ছে ইসলামের সংরক্ষণ এবং ইসলামি সমাজের রূপায়ণ ও অগ্রগতির পদ্ধতি। কুরআন মজিদেই ইসলামি দাওয়াতকে মুসলমানদের ওপর ফরজ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেনÑ ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন তোমরা ন্যায় ও সৎ কাজের নির্দেশ করো এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করো, বিরত রাখো’ (আল কুরআন : ৩, ১১০)।
‘তোমাদের মধ্যে একদল থাকা উচিত; যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’ (আল কুরআন : ৩, ১০৪)।
‘তোমাদের বানিয়েছি এক মধ্যপন্থী জাতি, যেন তোমরা বিশ্বমানবের হেদায়েতের সাক্ষী হতে পারো।’ (আল কুরআন : ২, ১৪৩)।
ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষকে ইসলামের অনুগত ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করা ও সুকৃতির প্রসার এবং দুষ্কৃতির মূলোৎপাটন করা। যেখানেই সম্ভব সেখানে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করাও নিশ্চয়ই ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য। কেননা, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং রাসূলের সুন্নাত হলো আমাদের আদর্শ। ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষ্য সম্পর্কে কুরআন পাকে বলা হয়েছেÑ ‘যখন তাদের দুনিয়ার বুকে ক্ষমতা দেয়া হয় তখন তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, সুকৃতির প্রতিষ্ঠা করে ও দুষ্কৃতির মূলোৎপাটন করে (আল কুরআন : ২২, ৪১)।
ইসলামি দাওয়াতের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিশ্চয়ই ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করাÑ এমন রাষ্ট্র, যা ইসলামি আইনকানুনের অনুগত হবে ও ইসলামের আলোকে সব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করবে এবং অনৈসলামিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে; কিন্তু যদি কোনো সময়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষ্যে বাস্তবভাবে কাজ করা সম্ভব নয়, তাহলে ইসলামি সমাজ ও ব্যক্তি তৈরি করাই হবে ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য। সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া ইসলামের দাবি বা শিক্ষা নয়। যেমনÑ কুরআন পাকে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘আল্লাহ কাউকে তার ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন না’ (আল কুরআন : ২, ২৬৮)।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, ইসলামি শিক্ষা হচ্ছে ক্ষমতানুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া। কাজেই ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য হবে, কোথাও ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করা এবং কোথাও ইসলামি সমাজ ও ব্যক্তি তৈরি করা। আর তা নির্ভর করবে পরিস্থিতি ও পরিবেশের ওপর।
ইসলামি দাওয়াতের এসব লক্ষ্য কার্যকর করার কর্মপদ্ধতি কী হতে পারে, তা নির্ধারণ করার জন্য আমাদের নবীর সুন্নাতের দিকে দেখতে হবে। নবীর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তিনি ইসলামি দাওয়াত প্রসারের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি খাওয়ার মজলিসে দাওয়াত দিয়েছেন, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আহ্বান জানিয়েছেন, গোপনে মক্কার আশপাশে এবং বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে প্রচার করেছেন, মক্কার বাইরের বিভিন্ন শহরে দাওয়াত দিতে বের হয়েছেন, হিজরত করেছেন, যুদ্ধ করেছেনÑ অর্থাৎ দাওয়াতের প্রসারের জন্য যখন যা উপযুক্ত মনে করেছেন, তা-ই করেছেন। তবে ইসলাম যে সাধারণ নৈতিক নিয়মাবলি দিয়েছে, তা কখনো ভঙ্গ করেননি। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ইসলামি দাওয়াতের ব্যাপারে নবীর সুন্নাত হলো, একটি উন্মুক্ত ও উদার পথ। অর্থাৎ ইসলামের নৈতিক নিয়মাবলির সীমার মধ্যে হলে যেকোনো কর্মপদ্ধতি অনুসরণই নবীর সুন্নাত মোতাবেক হবে। ইসলামি দাওয়াতের পদ্ধতি একটি মুক্ত ও খোলা বিষয় হওয়ার কারণেই বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামি আন্দোলন বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি নিয়েছে।
পদ্ধতিগত সুন্নাতের আলোচনার পর দেখতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি দাওয়াতের জন্য কী কী কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। ইসলামি আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য দু’টি পদ্ধতি হতে পারে। প্রথমত রাজনৈতিক, দ্বিতীয়ত সাংস্কৃতিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দল গঠন, স্বাধীন সংবাদপত্র ও প্রকাশনার সদ্ব্যবহার, নির্বাচনে অংশ নেয়া, সরকার গঠন, আইন ও শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে কাজ করে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে রাজনৈতিক পদ্ধতি বলা যেতে পারে। অন্য দিকে, উন্নত সাহিত্যের মাধ্যমে শিক্ষিত জনগণকে এবং অন্যান্য উপায়ে সাধারণ জনগণকে ইসলামি আদর্শ সম্পর্কে শিক্ষিত, অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করা এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে ইসলাম অনুসরণে উৎসাহিত করাকে ইসলামি দাওয়াতের সাংস্কৃতিক পদ্ধতি বলা যায়।
কোনো দেশে দাওয়াতের কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে, তা নির্ভর করবে সে দেশের পরিস্থিতির ওপর। এমনো হতে পারে যে, বিভিন্ন পদ্ধতিকে একই সাথে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে। তবে একটি কথা আমাদের খুব ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা বা আস্থাশীলতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে গত ষাট বছরের মধ্যে। এর আগে এরা ছিল বিভিন্ন উপনেশবাদী রাষ্ট্রের অধীনে। সে সময় তাদের গভীর ও সুদৃঢ় কোনো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ছিল না। ফলে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড যে ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে, মুসলিম বিশ্ব সে ধরনের কোনো স্থিতিশীলতা এখনো অর্জন করতে পারেনি। মুসলিম বিশ্বে এখনো হরহামেশা সামরিক বিপ্লব, নতুন নতুন দল গঠন, সরকার পরিবর্তন ও পতন লেগেই আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামি দাওয়াতের জন্য রাজনৈতিক পদ্ধতির সাথে সাথে সাংস্কৃতিক পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামি দাওয়াত ও মিশনের প্রসারের জন্য সাংস্কৃতিক পদ্ধতির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পদ্ধতিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হওয়া সম্ভব। সাংস্কৃতিক পদ্ধতির লক্ষ্য হবেÑ জনগণকে ইসলামি আদর্শ, বিধান, মূল্যবোধ ও ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাপকভাবে শিক্ষিত করে তোলা, যেন ইসলামি বিধান ও আদর্শ জনগণের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বিশ্বাস, বিবেক ও চিন্তার অংশে পরিণত হয়। জনগণের চিন্তাকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে হবে, যাতে যেকোনো সমস্যা ও বিষয়ে তাদের নজর সর্বপ্রথম স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম ও তার শিক্ষার দিকে নিবন্ধ হয়। সাংস্কৃতিক পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে হবে একটি শিক্ষা আন্দোলন। যত দিন পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামি রূপ দেয়া না হবে; অর্থাৎ ইসলামি শিক্ষা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে যথাযোগ্য মর্যাদা না পাবে, তত দিন পর্যন্ত উন্নত ইসলামি সাহিত্যের মাধ্যমেই কেবল শিক্ষিত সমাজকে ইসলামি বিধান, মূল্যবোধ ও ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ পথই আমাদের অনুসরণ করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে মুসলিম বিশ্বে গত পঞ্চাশ বছরে এক নতুন ইসলামি সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। এ সাহিত্যের ভাষা আধুনিক, এর পরিভাষা আধুনিক। সমাজবিজ্ঞানে বর্তমান সময়ের সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এ নতুন সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ সাহিত্য রচনায় যারা অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে উপমহাদেশের আল্লামা ইকবাল, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী, মওলানা আকরম খাঁ, খুররাম জাহ মুরাদ, উমর চোপড়া, খুরশীদ আলম ও ফররুখ আহমদ উল্লেখযোগ্য। আরব বিশ্বের সাইয়্যেদ কুতুব, ইউসুফ আল কারজাভি, মোস্তফা আল জারকা, সাঈদ রমাদান, তারিক রমাদান, মুহাম্মদ আল গাজালি ও অন্যদের মধ্যে আলিজা ইজেতবেগভিচ, মুহাম্মদ আসাদ, মরিয়ম জামিলা, ড. জামাল আল বাদাবি, আবদুুল হামিদ আবু সুলেমান ও টিবি আরভিংয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলামের প্রাথমিক যুগে রচিত সাহিত্যের পর এ নতুন সাহিত্য রচনার ফলে এক বিরাট শূন্যতার কিছুটা পূরণ হয়েছে। আমাদের মুসলিম বিশ্বের প্রতি কোণায় এ বিরাট সাহিত্যভাণ্ডারকে পৌঁছাতে হবে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় এ সাহিত্যের অনুবাদ করতে হবে, যাতে এক ভাষায় সাহিত্যের যে অভাব রয়েছে অন্যান্য ভাষায় রচিত সাহিত্য অনুবাদ করে তা পূরণ করা যায়।
বর্তমানে যে ইসলামি সাহিত্য রয়েছে তা যদিও যথেষ্ট উন্নত পর্যায়ের, তথাপি অনেক ক্ষেত্রে আরো প্রচুর সাহিত্য রচিত হওয়া দরকার। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এটিও একটি দিক। ইসলামি চিন্তাবিদ ও সংগঠনগুলো অবশ্য এ বিষয়ে অবহিত রয়েছেন। ইতোমধ্যেই মুসলিম বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি রিসার্চ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এদের তৈরি সাহিত্যকেও দ্রুত অনুবাদ করে মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।
সাধারণ জনগণকে অবশ্য এ সাহিত্য দিয়ে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দেয়া যাবে না। এ জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে জুমার খুতবা ও ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে হবে। অবশ্য জুমার খুতবাকে আরো সময়োপযোগী করার জন্য দেশবরেণ্য আলেমদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের কমিটি গঠন করে নতুনভাবে খুতবার বই প্রণয়ন করার দরকার হবে। এসব কাজই হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল কর্মসূচি।
ইসলামি দাওয়াতের সাংস্কৃতিক পদ্ধতিকে সফল করতে হলে ইসলামি সংগঠনগুলোকে এ কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উচিত সাংস্কৃতিক কাজকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া। অবশ্য সাংস্কৃতিক কাজে আত্মনিয়োগ করার সাথে এসব প্রতিষ্ঠানে সামাজিক খেদমত, কর্মীদের চরিত্র গঠন ও সংগঠনের শক্তি বাড়ানোর জন্য অন্যান্য কর্মসূচি নিতে হবে। কেননা চরিত্র গঠন ও সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি ছাড়া সাংস্কৃতিক কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে না।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব
‘তোমাদের মধ্যে একদল থাকা উচিত; যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে, সৎ কাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’ (আল কুরআন : ৩, ১০৪)।
‘তোমাদের বানিয়েছি এক মধ্যপন্থী জাতি, যেন তোমরা বিশ্বমানবের হেদায়েতের সাক্ষী হতে পারো।’ (আল কুরআন : ২, ১৪৩)।
ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষকে ইসলামের অনুগত ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করা ও সুকৃতির প্রসার এবং দুষ্কৃতির মূলোৎপাটন করা। যেখানেই সম্ভব সেখানে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করাও নিশ্চয়ই ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য। কেননা, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং রাসূলের সুন্নাত হলো আমাদের আদর্শ। ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষ্য সম্পর্কে কুরআন পাকে বলা হয়েছেÑ ‘যখন তাদের দুনিয়ার বুকে ক্ষমতা দেয়া হয় তখন তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, সুকৃতির প্রতিষ্ঠা করে ও দুষ্কৃতির মূলোৎপাটন করে (আল কুরআন : ২২, ৪১)।
ইসলামি দাওয়াতের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিশ্চয়ই ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করাÑ এমন রাষ্ট্র, যা ইসলামি আইনকানুনের অনুগত হবে ও ইসলামের আলোকে সব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করবে এবং অনৈসলামিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে; কিন্তু যদি কোনো সময়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষ্যে বাস্তবভাবে কাজ করা সম্ভব নয়, তাহলে ইসলামি সমাজ ও ব্যক্তি তৈরি করাই হবে ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য। সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া ইসলামের দাবি বা শিক্ষা নয়। যেমনÑ কুরআন পাকে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘আল্লাহ কাউকে তার ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন না’ (আল কুরআন : ২, ২৬৮)।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, ইসলামি শিক্ষা হচ্ছে ক্ষমতানুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া। কাজেই ইসলামি দাওয়াতের লক্ষ্য হবে, কোথাও ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করা এবং কোথাও ইসলামি সমাজ ও ব্যক্তি তৈরি করা। আর তা নির্ভর করবে পরিস্থিতি ও পরিবেশের ওপর।
ইসলামি দাওয়াতের এসব লক্ষ্য কার্যকর করার কর্মপদ্ধতি কী হতে পারে, তা নির্ধারণ করার জন্য আমাদের নবীর সুন্নাতের দিকে দেখতে হবে। নবীর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তিনি ইসলামি দাওয়াত প্রসারের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি খাওয়ার মজলিসে দাওয়াত দিয়েছেন, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আহ্বান জানিয়েছেন, গোপনে মক্কার আশপাশে এবং বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে প্রচার করেছেন, মক্কার বাইরের বিভিন্ন শহরে দাওয়াত দিতে বের হয়েছেন, হিজরত করেছেন, যুদ্ধ করেছেনÑ অর্থাৎ দাওয়াতের প্রসারের জন্য যখন যা উপযুক্ত মনে করেছেন, তা-ই করেছেন। তবে ইসলাম যে সাধারণ নৈতিক নিয়মাবলি দিয়েছে, তা কখনো ভঙ্গ করেননি। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ইসলামি দাওয়াতের ব্যাপারে নবীর সুন্নাত হলো, একটি উন্মুক্ত ও উদার পথ। অর্থাৎ ইসলামের নৈতিক নিয়মাবলির সীমার মধ্যে হলে যেকোনো কর্মপদ্ধতি অনুসরণই নবীর সুন্নাত মোতাবেক হবে। ইসলামি দাওয়াতের পদ্ধতি একটি মুক্ত ও খোলা বিষয় হওয়ার কারণেই বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামি আন্দোলন বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি নিয়েছে।
পদ্ধতিগত সুন্নাতের আলোচনার পর দেখতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি দাওয়াতের জন্য কী কী কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। ইসলামি আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য দু’টি পদ্ধতি হতে পারে। প্রথমত রাজনৈতিক, দ্বিতীয়ত সাংস্কৃতিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দল গঠন, স্বাধীন সংবাদপত্র ও প্রকাশনার সদ্ব্যবহার, নির্বাচনে অংশ নেয়া, সরকার গঠন, আইন ও শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে কাজ করে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে রাজনৈতিক পদ্ধতি বলা যেতে পারে। অন্য দিকে, উন্নত সাহিত্যের মাধ্যমে শিক্ষিত জনগণকে এবং অন্যান্য উপায়ে সাধারণ জনগণকে ইসলামি আদর্শ সম্পর্কে শিক্ষিত, অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করা এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে ইসলাম অনুসরণে উৎসাহিত করাকে ইসলামি দাওয়াতের সাংস্কৃতিক পদ্ধতি বলা যায়।
কোনো দেশে দাওয়াতের কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে, তা নির্ভর করবে সে দেশের পরিস্থিতির ওপর। এমনো হতে পারে যে, বিভিন্ন পদ্ধতিকে একই সাথে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে। তবে একটি কথা আমাদের খুব ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা বা আস্থাশীলতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে গত ষাট বছরের মধ্যে। এর আগে এরা ছিল বিভিন্ন উপনেশবাদী রাষ্ট্রের অধীনে। সে সময় তাদের গভীর ও সুদৃঢ় কোনো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ছিল না। ফলে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড যে ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে, মুসলিম বিশ্ব সে ধরনের কোনো স্থিতিশীলতা এখনো অর্জন করতে পারেনি। মুসলিম বিশ্বে এখনো হরহামেশা সামরিক বিপ্লব, নতুন নতুন দল গঠন, সরকার পরিবর্তন ও পতন লেগেই আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামি দাওয়াতের জন্য রাজনৈতিক পদ্ধতির সাথে সাথে সাংস্কৃতিক পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামি দাওয়াত ও মিশনের প্রসারের জন্য সাংস্কৃতিক পদ্ধতির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে এ পদ্ধতিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হওয়া সম্ভব। সাংস্কৃতিক পদ্ধতির লক্ষ্য হবেÑ জনগণকে ইসলামি আদর্শ, বিধান, মূল্যবোধ ও ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাপকভাবে শিক্ষিত করে তোলা, যেন ইসলামি বিধান ও আদর্শ জনগণের এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বিশ্বাস, বিবেক ও চিন্তার অংশে পরিণত হয়। জনগণের চিন্তাকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে হবে, যাতে যেকোনো সমস্যা ও বিষয়ে তাদের নজর সর্বপ্রথম স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম ও তার শিক্ষার দিকে নিবন্ধ হয়। সাংস্কৃতিক পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে হবে একটি শিক্ষা আন্দোলন। যত দিন পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামি রূপ দেয়া না হবে; অর্থাৎ ইসলামি শিক্ষা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে যথাযোগ্য মর্যাদা না পাবে, তত দিন পর্যন্ত উন্নত ইসলামি সাহিত্যের মাধ্যমেই কেবল শিক্ষিত সমাজকে ইসলামি বিধান, মূল্যবোধ ও ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ পথই আমাদের অনুসরণ করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে মুসলিম বিশ্বে গত পঞ্চাশ বছরে এক নতুন ইসলামি সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। এ সাহিত্যের ভাষা আধুনিক, এর পরিভাষা আধুনিক। সমাজবিজ্ঞানে বর্তমান সময়ের সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে এ নতুন সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ সাহিত্য রচনায় যারা অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে উপমহাদেশের আল্লামা ইকবাল, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী, মওলানা আকরম খাঁ, খুররাম জাহ মুরাদ, উমর চোপড়া, খুরশীদ আলম ও ফররুখ আহমদ উল্লেখযোগ্য। আরব বিশ্বের সাইয়্যেদ কুতুব, ইউসুফ আল কারজাভি, মোস্তফা আল জারকা, সাঈদ রমাদান, তারিক রমাদান, মুহাম্মদ আল গাজালি ও অন্যদের মধ্যে আলিজা ইজেতবেগভিচ, মুহাম্মদ আসাদ, মরিয়ম জামিলা, ড. জামাল আল বাদাবি, আবদুুল হামিদ আবু সুলেমান ও টিবি আরভিংয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলামের প্রাথমিক যুগে রচিত সাহিত্যের পর এ নতুন সাহিত্য রচনার ফলে এক বিরাট শূন্যতার কিছুটা পূরণ হয়েছে। আমাদের মুসলিম বিশ্বের প্রতি কোণায় এ বিরাট সাহিত্যভাণ্ডারকে পৌঁছাতে হবে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় এ সাহিত্যের অনুবাদ করতে হবে, যাতে এক ভাষায় সাহিত্যের যে অভাব রয়েছে অন্যান্য ভাষায় রচিত সাহিত্য অনুবাদ করে তা পূরণ করা যায়।
বর্তমানে যে ইসলামি সাহিত্য রয়েছে তা যদিও যথেষ্ট উন্নত পর্যায়ের, তথাপি অনেক ক্ষেত্রে আরো প্রচুর সাহিত্য রচিত হওয়া দরকার। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এটিও একটি দিক। ইসলামি চিন্তাবিদ ও সংগঠনগুলো অবশ্য এ বিষয়ে অবহিত রয়েছেন। ইতোমধ্যেই মুসলিম বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি রিসার্চ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এদের তৈরি সাহিত্যকেও দ্রুত অনুবাদ করে মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।
সাধারণ জনগণকে অবশ্য এ সাহিত্য দিয়ে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দেয়া যাবে না। এ জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে জুমার খুতবা ও ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে হবে। অবশ্য জুমার খুতবাকে আরো সময়োপযোগী করার জন্য দেশবরেণ্য আলেমদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের কমিটি গঠন করে নতুনভাবে খুতবার বই প্রণয়ন করার দরকার হবে। এসব কাজই হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল কর্মসূচি।
ইসলামি দাওয়াতের সাংস্কৃতিক পদ্ধতিকে সফল করতে হলে ইসলামি সংগঠনগুলোকে এ কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উচিত সাংস্কৃতিক কাজকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া। অবশ্য সাংস্কৃতিক কাজে আত্মনিয়োগ করার সাথে এসব প্রতিষ্ঠানে সামাজিক খেদমত, কর্মীদের চরিত্র গঠন ও সংগঠনের শক্তি বাড়ানোর জন্য অন্যান্য কর্মসূচি নিতে হবে। কেননা চরিত্র গঠন ও সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি ছাড়া সাংস্কৃতিক কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে না।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব
No comments