গদ্যকার্টুন- ফেসবুক ভালো না খারাপ? by আনিসুল হক
যেকোনো নতুন জিনিস এলে প্রথমে একটা
উত্তেজনা হয়। সেই উত্তেজনা খানিকটা থিতু হয়ে এলে সমাজে প্রশ্ন ওঠে, জিনিসটা
ভালো না খারাপ! প্রথমে যখন কবিতা এসেছে, উপন্যাস এসেছে, ছাপা বই এসেছে,
পত্রিকা এসেছে, টেলিফোন এসেছে, চলচ্চিত্র এসেছে, টেলিভিশন এসেছে, মোবাইল
ফোন এসেছে—এ ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। জিনিসটা যখন নতুন থাকে, তখন প্রশ্নটাও
জ্বলন্ত থাকে, জিনিসটা পুরোনো হতে থাকে, পুরোনো প্রেমের মতোই তার
উত্তেজনা আসে কমে। আমাদের লোকগানে আছে, ‘নতুন প্রেমে মন মজাইয়া করেছি কী
মস্ত ভুল, আমার লাভের মাঝে কী লাভ হইল, গলাতে কলঙ্কের ঢোল’। হয়তো লোককবি
ঢোলের উচ্চারণ ঢুলই করেছিলেন...
ইন্টারনেটের মাধ্যমে উড়ে এসে জুড়ে বসা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিয়েও একই প্রশ্ন উঠতে পারে! ফেসবুক ভালো না খারাপ। আমেরিকানরা খুব পছন্দ করে পরিসংখ্যান। সর্ববিষয়ে আমেরিকানদের জরিপ আছে। বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে প্রতিবছর আমেরিকায় মারা যায় ৪৫০ জন। তবে গাড়ি চালানোর সময় টেক্সট করার কারণে (মোবাইলে বা ধরা যাক ট্যাবে) অ্যাক্সিডেন্টে আমেরিকায় প্রতিবছর মারা যায় ছয় হাজার জন। অনেক বড় সংখ্যা। বাংলাদেশে অন্তত একজনকে জানি, যিনি রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফোনে কথা বলছিলেন, বলতে বলতে চলে গিয়েছিলেন ট্রেনলাইনের ওপরে আর ট্রেন এসে পড়ায় মারা গিয়েছিলেন।
আর এটাও খুব পুরোনো খবর যে গবেষকেরা বলছেন, ফেসবুক বেশি ব্যবহারকারীরা নাসিসিজম রোগে ভোগেন। আর যাঁরা সেলফি তোলেন, তাঁরা তো বটেই।
১৯ বছর বয়সী একজন ব্রিটিশ তরুণ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন একটা নিখুঁত সেলফি তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে। তিনি ১০ ঘণ্টা ধরে ২০০ বার চেষ্টা করলেন নিজের ছবি তোলার। যা উঠল, তা তাঁর কাছে যথেষ্ট সুন্দর বলে মনে হলো না। তিনি স্কুল ছাড়লেন। ছয় মাস নিজেকে বাড়ির মধ্যে আটকে রাখলেন। আর বের হন না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ১০টা স্ন্যাপ নেন। তাঁর ওজন কমে গেল ৩০ পাউন্ড। তবু তো একেবারে নিপাট সেলফিটা আসছে না। হতাশা থেকে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন ডানি বাউমান নামের এই তরুণ। এরপর তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসা হলো। চিকিৎসকেরা জানেন, যেকোনো মনোরোগেরই চিকিৎসা আছে।
সেলফি রোগেরও চিকিৎসা আছে। আপনি প্রথমে দিনে ১০ মিনিটের জন্য আপনার কাছ থেকে তাঁর স্মার্টফোন সরিয়ে রাখুন। আস্তে আস্তে সময়টা বাড়াতে থাকুন। দেখুন কয় ঘণ্টা লাইক চেক না করে আপনি পারেন!
আমার অবশ্য আজকের আলোচ্যটা একটু ভিন্ন। বহুদিন আগে আমেরিকায় গিয়ে আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের নানা কার্যালয়—সিএনএন থেকে শুরু করে নিউইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত ঘুরেফিরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেই প্রোগ্রামের শেষে সমাপনী আলোচনা। আমি কী বলেছিলাম, জানি না; কী বলতে চেয়েছিলাম, তা জানি। বলতে চেয়েছিলাম, কোনো দেশ বা রাষ্ট্র স্বাধীন কি না, এটার চেয়েও বড় কথা, প্রতিটা ব্যক্তি স্বাধীন কি না। সংবাদমাধ্যম স্বাধীন কি না, তার চেয়েও বড় কথা, যেকোনো নাগরিকের কথা বলার সুযোগ আছে কি না। তোমাদের বড় বড় মিডিয়া হাউস, এর বাইরে একজন নাগরিক যদি কোনো কথা বলতে চায়, সে নিশ্চয়ই সেটা বলতে পারে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট জোরে শোনা যায় কি? কারণ, বড় বড় হাউসের বড় বড় আওয়াজের নিচে ছোট কণ্ঠগুলো কি চাপা পড়ে যায় না?
আজকের পৃথিবীতে সেই বিচারে বলতে হবে গণতন্ত্রের যুগ। এখন যে কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে যেকোনো মত কিংবা খবর প্রচার করতে পারে। আগে ধরা যাক, জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখেছেন, বুদ্ধদেব বসু সেটা প্রকাশ করেছেন প্রগতি পত্রিকায়, লোকে জানতে পারল, জীবনানন্দ দাশ কবি। কিংবা ঢাকা থেকে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ কবিতা পাঠালেন কলকাতায়, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায়, ছাপা হলো, সেটার একটা মূল্য দাঁড়াল। এখন তো আমার কবিতা কোনো সম্পাদকের কাছেও পাঠাতে হয় না, ফেসবুকে পোস্ট করে দিলেই হলো। এভাবে বাংলাদেশের ৬০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রত্যেকেই কবি ও সম্পাদক, প্রত্যেকেই সাংবাদিক ও সম্পাদক, প্রত্যেকেই টক শোজীবী ও প্রযোজক। ব্যক্তিমানুষের কণ্ঠস্বরকে তা মুক্ত করেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে তা এনে দিয়েছে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা।
কিন্তু ৬০ লাখ লোক একসঙ্গে কথা বলে উঠলে মনে হয় কারোরটাই ঠিকভাবে শোনা হয়ে ওঠে না। ফলে এসবের সংবাদমূল্য, মতমূল্য, সাহিত্যমূল্য, শিল্পমূল্য প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
কিন্তু ক্ষতি করার ক্ষমতা মাঝেমধ্যে ভয়াবহই হয়ে উঠছে। ফেসবুক শান্তি আনতে পারে না, কিন্তু দাঙ্গা লাগাতে পারে। ফেসবুকে সুপ্রচার দিয়ে কারও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা যাবে কি না সন্দেহ, কিন্তু অপপ্রচার দিয়ে যেকোনো একজন মানুষকে একেবারে শেষ করে ফেলা যাবে। এ ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যা কোনো ব্যাপার নয়, তথ্য যাচাই-বাছাই করার কোনো বালাইই নেই। আপনি বললেন, মিস্টার এক্স যখন ইতালিতে ছিল, তখন সে হিটলারের সহযোগী ছিল। ব্যস, এর পরে সবাই বলতে থাকবে, মিস্টার এক্স হিটলারের সহযোগী! আর কোনো যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই। যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তার বক্তব্য নেওয়ার দরকার নেই। বলে ফেললেই হলো! ব্যাপারটা অনেকটাই কান নিয়েছে চিলের মতো!
গদ্যকার্টুন অবশ্য গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য নয়। এটা আসলে কৌতুক পরিবেশনের জন্য।
আচ্ছা, ফেসবুকে একটা কৌতুক দিয়েছিলাম। কৌতুকটা আসলে পুরোনো, কিন্তু ফেসবুকে একটা কৌতুক দিলে তার নিচে কী ধরনের মন্তব্য পড়ে, তার একটা সম্ভাব্য তালিকা প্রণয়ন করেও দিয়েছিলাম। সেটাই হয়তো বেশি অভিনিবেশ দাবি করবে।
একটা কাক গাছের ডালে চুপচাপ বসে আছে। নিচে একটা মুরগি দৌড়াদৌড়ি করছে।
মুরগি বলল, আমাকে খাবার জোগাড় করার জন্য কত পরিশ্রম করতে হয়। আর তুমি তো আরামে বসে আছো।
কাক বলল, তোমার শখ হলে তুমিও বসে থাকো।
মুরগি চুপ করে বসে রইল। একটা শেয়াল এসে মুরগিটাকে খেয়ে ফেলল।
কাক বলল, কাজ না করে চুপচাপ বসে থাকতে হলে যথেষ্ট ওপরে বসতে হয়।
এই কৌতুক শোনার পরে যেসব কমেন্টস আসবে: ১. পুরোনো কৌতুক। উদাস হয়ে গেলাম।
২. নিচেরটা মুরগি নয়। ওটা খরগোশ ছিল।
৩. এই জোকস আপনি লেখেন নাই। আপনি তো মিয়া অন্যের লেখা নিজের বলে চালাইলেন।
৪. কাক কখনো কথা বলতে পারে না। মুরগিও পারে না।
৫. অ্যাড মি অ্যাড মি অ্যাড মি...
৬. ঘরে বসে টাকা আয় করুন...
৭. মুরগি কেন বললেন, মোরগও তো বলতে পারতেন।
৮. এইটা কোনো জোকস হইল?
৯. লুল... (এল ও এল নয়। লুল)
১০. ...মুদ্রণযোগ্য নয়
১১. ...মুদ্রণযোগ্য নয়...
ফেসবুক ভালো কি খারাপ, এটা বলার আমি কে? তবে পুরোনো কথাটাই আবার বলতে পারি, যেকোনো যন্ত্রই ভালো, যদি আমি তা ভালো কাজে ব্যবহার করি। যেকোনো যন্ত্রই আবার খারাপ হতে পারে, যদি সেটার আমি ভুল ব্যবহার করি।
বার্ন ইউনিটে একজন এসেছেন, তাঁর কান পুড়ে গেছে। ডাক্তার বললেন, কীভাবে পুড়ল?
ডাক্তার সাহেব, ফোন বাজল, আমি ফোনটা তুলে কানে নিলাম, তখনই পুড়ে গেল?
ফোন কানে দিতেই কান পুড়ে গেল!
ডাক্তার সাহেব, ভুল করে গরম ইস্তিরিটাকে কানে ধরেছিলাম।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments