বহুমুখী পাটপণ্য কেন্দ্র- কোনো নিয়ম মানতে দেননি লতিফ সিদ্দিকী by ইফতেখার মাহমুদ
বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির
দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা জুট ডাইভারসিফিকেশন সেন্টারে (জেডিপিসি)
নির্বাহী পরিচালকসহ ১৮ জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে নিজের
সিদ্ধান্তে নিয়োগ দিয়েছিলেন সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ
সিদ্দিকী। এ ক্ষেত্রে নিয়োগবিধি মানা হয়নি।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন এই জেডিপিসি এবং ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপ নামের দুটি সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠানই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে জানিয়ে গত বছর জেডিপিসির বার্ষিক সভায় হতাশা প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত জুনে হতাশাজনক কর্মদক্ষতার কারণে ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপ নামের প্রতিষ্ঠানটিকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে।
জেডিপিসির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান টাঙ্গাইল জেলা কৃষক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খন্দকার মোখলেসুর রহমান। এ পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য তাঁর ন্যূনতম যোগ্যতাও ছিল না। আবেদনপত্রের সঙ্গে দেওয়া জীবনবৃত্তান্তে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিশদ বর্ণনা দেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানের জবাবে গত ১২ জুন জেডিপিসির পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
নির্বাহী পরিচালক মোখলেসুর রহমানও কম যান না। তিনিও শুধু ‘মৌখিক পরীক্ষার’ ভিত্তিতে ১৪ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন সংস্থাটিতে। এর মধ্যে তাঁর ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে রংপুর কেন্দ্রের ইনচার্জ, আরেক ভাইয়ের ছেলে খন্দকার মুনতাসীর রহমানকে একটি প্রকল্পের হিসাবরক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সংস্থাটির মোট জনবল এখন ৪৬। এর মধ্যে ৪০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী লতিফ সিদ্দিকী ও মোখলেসুর রহমানের নিজ জেলা টাঙ্গাইলের বলে সংস্থাটির সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর মোখলেসুর রহমান ১৪টি দেশ সফর করেছেন। তিনি পাঁচ বছরে মোট ১৭ বার বিদেশে গেছেন। সর্বশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর তিনি তিনজন সফরসঙ্গী নিয়ে ইতালি ঘুরে এসেছেন। তাঁর সফরের তালিকায় রয়েছে কেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, চীন, ব্রাজিল, এল সালভাদর, তুরস্ক, ভারত, ওমান, কাতার, আরব আমিরাত, ফ্রান্স, শ্রীলঙ্কা ও ইতালি। দেশ-বিদেশে তাঁর সফর বাবদ এ পর্যন্ত কোটি খানেক টাকা ব্যয় হয়েছে।
জানতে চাইলে মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং কোন কোন দেশ সফর করেছি, তার বিস্তারিত তথ্য আমি ইতিমধ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা আমাদের ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা তা মেনে নেব।’ ভাই এবং ভাইয়ের ছেলেকে চাকরি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে না জানিয়ে আমার মায়ের অনুরোধে লতিফ সিদ্দিকী তাঁদের নিয়োগ দিয়েছেন। আমি মানা করা সত্ত্বেও তিনি তা শোনেননি।’
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির প্রয়োজন নেই!: জেডিপিসির নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এতে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল, পাট খাতে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা, সঙ্গে পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি অথবা ন্যূনতম স্নাতকোত্তর। দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছিল, বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ ও উদ্যোক্তা তৈরি করা।
কিন্তু পাট খাত দূরে থাক, মোখলেসুর রহমানের শিল্প খাতেই কোনো কাজের অভিজ্ঞতাই নেই। ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কয়েক বছর কাজ করেছেন তিনি। তাঁর মূল পরিচয় রাজনীতিবিদ।
মোখলেসুর রহমানের নিয়োগের বিষয়ে ওই মন্ত্রণালয়ের তখনকার মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী ২০১০-এর ৩১ মার্চ নিয়োগ কমিটিকে লেখেন—‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কোনোই প্রয়োজন নেই, খন্দকার মোখলেসুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হোক।’
জেডিপিসি গত ১২ জুন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নির্দেশে কোনো নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই সীমা বোসকে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই পদের জন্য পাট খাতে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা এবং পাট খাতের ওপরে মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রি থাকার শর্ত ছিল। নির্বাহী পরিচালকের পর প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ পরিচালক (বিপণন)।
জানতে চাইলে সীমা বোস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পাট খাতে কাজ না করলেও একটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিতে সাড়ে ছয় বছর মার্কেটিং বিভাগে কাজ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করে ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করেছি।’ পাট খাতের জন্য আলাদা অভিজ্ঞতার দরকার নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কী পণ্য বাজারজাত হবে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কীভাবে হবে। সেটি আমার জানা আছে।’
লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ: ২০০২ সালে জেডিপিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। গত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। গত বছর জেডিপিসির বার্ষিক সভায় এর কার্যক্রম নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হতাশা প্রকাশ করেছে।
জানতে চাইলে খন্দকার মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘কীভাবে নিয়োগ হলো, সেটা বড় কথা নয়, আমরা কী কাজ করছি, সেটাই বড় কথা।’ জেডিপিসি বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, সংস্থাটিকে শক্তিশালী করতে একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটি হলে জেডিপিসি আরও ভালোমতো কাজ করতে পারবে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফণীভূষণ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেডিপিসির নিয়োগে অনিয়ম ও অন্যান্য বিষয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। তবে তাদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’
No comments