লতিফ সিদ্দিকীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ যত কথা ও আচরণ

বিভিন্ন ধরনের বেফাঁস মন্তব্য আর উদ্ভট ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ সব কর্মকাণ্ড করে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। গত সংসদের বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আর কখনো নির্বাচন করবেন না জানিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নেন বিতর্কিত এ ব্যক্তি। কিন্তু সেই অঙ্গীকারেও তিনি অটল থাকতে পারেননি। ক্ষমতার লোভে এবারো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনে দলের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে গত সরকারের সময় পাওয়া পাট মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় এবার তাকে সরিয়ে স্থানান্তর করা হয় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে। সব কিছুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যেন ছিল এ মন্ত্রীর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তার লাগামহীন এসব কর্মকাণ্ড শুধু বিরোধী মতেরই নয়, নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও বিব্রত করেছে বারবার।

তবে এবার শেষ রা হলো না আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর। রোববার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হজ, হজরত মুহাম্মদ সা:, জামায়াতে ইসলামী ও তাবলিগ জামাতকে নিয়ে কটূক্তির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ফেঁসে গেলেন তিনি। তার অশালীন ও চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের জন্য মন্ত্রিসভা থেকে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম থেকেও বহিষ্কার হতে পারেন প্রভাবশালী এ সদস্য।
এর আগে গত বছর ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে এক সভায় লতিফ সিদ্দিকী জামায়াতের হরতালে দলীয় নেতাকর্মীদের তৎপর না থাকায় ােভ প্রকাশ করে বলেন, আর বসে থাকার সময় নেই। আর কেউ হরতাল করলে তাদের বাড়িতে ঢুকে হত্যা করতে হবে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত হরতাল করে। আর রাস্তায় শুধু পুলিশ থাকে। আমাদের নেতাকর্মীরা নেতার হুকুমের অপোয় বসে থাকেন। তিনি বলেন, সব কিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ লাগবে কেন? যখন বাড়ি-গাড়ি করেন তখন কোথায় থাকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। আমি বলছি, এটিই আমার শেষ বক্তৃতা।
ওই মাসের শেষ সপ্তাহে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে মন্তব্য করেছেন তা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে এত দিন তাকে (ড. ইউনূস) কারাগারে থাকতে হতো।
গত ২৮ মার্চ টাঙ্গাইলে নিজ বাড়িতে পিডিবির উপসহকারী প্রকৌশলী পুনয় চন্দ্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে গাজীপুরের হাইটেক পার্কের উপসহকারী প্রকৌশলীকে পানিতে ভিজিয়ে শাস্তি দেন এ বিতর্কিত মতাধর মন্ত্রী। চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রী হাইটেক পার্কে প্রবেশের সময় ফোয়ারা অপরিষ্কার দেখেন। সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য গাজীপুর হাইটেক পার্কের সামনে ফোয়ারা তৈরি করা হলেও তা অপরিষ্কার থাকায় প্রকৌশলীকে পানিতে নামান মন্ত্রী। পরে ফোয়ারার পানিতে তাকে ভিজিয়ে শাস্তি দেন তিনি।
২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদা না দেয়ার অভিযোগ তুলে পাট নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আয়োজকদের কঠোর সমালোচনা করেন তখনকার বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে লতিফ সিদ্দিকী ােভ প্রকাশ করে বলেন, অর্থমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা। আর আমি কি উড়ে এসেছি?
এর কিছু দিন পরই খামারবাড়িতে এক অনুষ্ঠানে কুরআন ও আজানের সমালোচনা করে বিতর্কিত এ মন্ত্রী বলেন, আজানের সময় মাইক বন্ধ রাখতে হবে কেন? আর কোনো অনুষ্ঠান কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে শুরু করতে হবে কেন? কুরআন তিলাওয়াতের সাথে গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটকও পাঠ করতে হবে।
গত বছর ১১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনায় দাঁড়িয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনী রাজনীতিতে আর অংশ নেবো না। তবে দলীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনা যে নির্দেশ দেবেন, তা সম্পন্ন করার চেষ্টা করব।
২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর সংসদে দেয়া এক বক্তব্যে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদের সমালোচনা করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, স্পিকার হচ্ছেন সংসদের সেবক। তিনি প্রভু নন। আবদুল হামিদকে উদ্দেশ করে তিনি আরো বলেনÑ প্রতিভা ও প্রগল্ভতা এক নয়।
তবে গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের অনুষ্ঠানে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘চিনতে না পারলেও’ গত ১১ মার্চ ঢাকায় জয়ের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী জয়কে নিজের মাস্টার হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে জয় কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, তা পথপ্রদর্শক হবে। কারণ তিনি যার (শেখ হাসিনা) উপদেষ্টা, তার সৃষ্টি মননশীল।
গত ৩১ আগস্ট সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের বক্তব্যে উষ্মা প্রকাশ করে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছে, তা শুনলে আমি হাসি। আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তিনি পড়েছেন কি না। তিনি কিন্তু পড়েননি। কেবল নীতিমালা পড়লেই হবে না, টেলিভিশনগুলো যেসব শর্তে লাইসেন্স পেয়েছে, সেগুলোও জানা থাকতে হবে। ওরা কী কী শর্তে দস্তখত করে লাইসেন্স নিয়েছে সেই শর্তটা একবার বের করে দেখুন। ওই কাবিননামায় দস্তখত করেই কিন্তু লাইসেন্স পেয়েছে।
চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে অংশ নিয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমার স্বভাব খারাপ, এ জন্য মাঝে মধ্যে একটু লাঠিপেটা করি। সাপকে যদি মারতে হয়, তাহলে লাঠিপেটা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাংবাদিকেরা আমার বিরুদ্ধে লাগে উক্তি করে সমালোচিত এই মন্ত্রী বলেন, এ দেশের ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া, ব্যবসায়ী, কথিত সুশীলসমাজের সদস্যরা বেতনভুক ক্রীতদাস।
গত ২০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতা সংগঠনকে গতিশীল ও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। তাদের থামিয়ে দিয়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, সংগঠন-টংগঠন দিয়ে কিছু হবে না নেত্রী। আপনি (শেখ হাসিনা) বেঁচে থাকলে সব ঠিক থাকবে। দল দিয়ে কিছু হয় না। আপনিই আমাদের সব।
এ সময় তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদকে উদ্দেশ করে বলেন, তারা বিভিন্ন সময় দলের নেতাদের চ্যালেঞ্জ করে বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ান। এটি মেনে নেয়া যায় না। কারণ তারা এত দিন সাইড লাইনে ছিলেন। নেত্রী (হাসিনা) পাঁচ বছর পর আবার তাদের মূল স্রোতে নিয়ে এসে মন্ত্রী বানিয়েছেন। তাদের সেটি মনে রাখা উচিত। একই সাথে এ থেকে আমাদের অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতাদেরও শিক্ষা নিতে হবে।
এ বছরের ২৯ মে রাজধানীর শিল্পকলায় যুবলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে আমরা কী করব? নবম জাতীয় সংসদে মোট সাতটি দল ছিল। দশম সংসদেও সাতটি দল আছে। দল তো কমে নেই। ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়নি। প্রার্থীবিহীন নির্বাচন হয়েছে।
এর আগে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার ধানাইদহ ও লালপুর উপজেলার দাঁইড়পাড়া এলাকায় নাটোর-পাবনা মহাসড়কে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এক হাতে পিস্তল উঁচিয়ে ও অন্য হাতে দা নিয়ে সড়কে অবরোধকারীদের ফেলে রাখা গাছের ডালপালা কেটে গাছ সরান।

No comments

Powered by Blogger.