তাঁবুর শহর মিনায় হজযাত্রীরা by ফেরদৌস ফয়সাল
ভিড় এড়ানোর জন্য মোয়ালেম গাড়িতে করে
গতকাল বুধবার আমাদের মিনায় নিয়ে এসেছেন। অন্য সময় গাড়িতে মিনায়
পৌঁছাতে ২০ মিনিট লাগে। গতকাল লাগল দুই ঘণ্টা। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। তবে
হজযাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। এখানে সবাই সার্বক্ষণিক
ইবাদত-বন্দিগির মধ্যে থাকেন। বাসের হজযাত্রীদের মুখেও ছিল তালবিয়া
‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক,
ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল্মুল্ক্ লা শারিকা লাকা।’ কেউ কেউ
দোয়ার বই পড়ছিলেন। আর যাঁরা অপেক্ষা করতে চাননি, তাঁরা হেঁটেই রওনা
হচ্ছেন। কাঁধে ছোট ঝোলা। অনেক বৃদ্ধকে হুইল চেয়ারে যেতে দেখা গেল।
মিনা এখন যেন তাঁবুর শহর। যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। পবিত্র হজের অংশ হিসেবে হজযাত্রীরা মিনায় এসে পৌঁছেছেন। চৌচালা ঘরের মতো এসব তাঁবুতে থাকবেন তাঁরা। এ সময় মিনায় আগুন জ্বালানো নিষেধ। কারণ, এতে তাঁবুতে আগুন লেগে যেতে পারে। ফলে এত লোকের খাবারও বাইরে থেকে রান্না করে নিয়ে আসতে হয়।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এসব তাঁবুতে বাতি আছে। আছে বাথরুম। কিছুদূর পর পর আছে খাবারের দোকান। এই দোকানগুলো বছরে পাঁচ দিনের জন্য খোলা থাকে। মোয়ালেমের কাছ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা দোকান নেন। অল্প সময়ের দোকান বলে জিনিসপত্রের দামও কয়েক গুণ বেশি। বেশির ভাগ দোকানদার ভারতীয় ও পাকিস্তানি। ইয়েমেনি কিছু লোক আছেন, তাঁদের দেখতে অনেকটা বাংলাদেশিদের মতো।
সৌদি আরবে এক বাংলাদেশি আরেকজন বাংলাদেশিকে দেখলে দেশি বলে সম্বোধন করেন। আমি এমনি একজনকে দেশি বলাতে তিনি জবাবে বললেন ইয়েমেনি।
মিনায় মোট সাতটি জোন রয়েছে। ২, ৫, ৬ নম্বর জোনে বাংলাদেশিদের তাঁবু। আমাদের তাঁবু ২ নম্বর জোনে, তাঁবু নম্বর ৬ থেকে ৫৬। নওগাঁর মিঠু প্রামাণিক জানালেন, এখানে কোনো গাড়ি চলে না, শুধু পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স চলে।
হজের এই পাঁচ দিন ছাড়া মিনার পুরো এলাকা খালি পড়ে থাকে। চারপাশের প্রবেশদ্বারও তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক সংযোগ, পানির লাইন, টেলিফোন সংযোগ। হজের দুই দিন আগে মিনা এলাকার ফটক খোলা হয়। হজের দুই দিন পর আবার সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন দিন-রাত হেলিকপ্টারে টহল দেওয়া হয়, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না আল্লাহর মেহমানদের।
তাঁবুগুলো দেখতে একই রকম হওয়ায় অনেক হাজির পক্ষে পথঘাট ঠিক রেখে নিজের তাঁবুতে যাতায়াত কঠিন হয়। এর জন্য এখানে আছে স্কাউট, হজগাইড। বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের পক্ষ থেকে হজযাত্রীদের সহায়ক আরাফাত, মিনার তাঁবু নম্বর-সংবলিত মানচিত্র বিতরণ করা হয়েছে।
মিনায় অবস্থান করা হজের অংশ। হজযাত্রীরা মিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখছেন।
মিনার কাছেই সৌদি বাদশাহর বাড়ি, রাজকীয় অতিথি ভবন। হজযাত্রীরা মোয়াচ্ছাসা (হজের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ) কার্যালয়, নতুন চালু হওয়া রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখছেন।
ঢাকার নয়াটোলার মধুবাগ থেকে হজ করতে এসেছেন নুরুল হুদা ও শিউলি পারভিন দম্পতি। জানালেন, ‘মিনার একমাত্র মসজিদ মসজিদে খায়েফের সামনে গিয়ে বেশ ভালো লাগল। কারণ সেখানে বাংলায় লেখা মসজিদে খায়েফ। আরও কয়েকটি ভাষায়ও মসজিদের নাম লেখা আছে।’
মসজিদে খায়েফ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন হজযাত্রী সিরাজুল ইসলাম। বললেন, ‘স্ত্রীকে ছেড়ে ঈদ করব, একটু খারাপ লাগছে। তবে পবিত্র হজ পালন করতে এসেছি, এটাই সুখের কথা।’
মিনায় আরও একটা মসজিদ আছে, নাম কুয়েতি মসজিদ। মসজিদের কাছে কথা হলো ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীর আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘হজে এসেছি, এটাই বড় শান্তি। কষ্ট মনে করলে কষ্ট না মনে করলে কিছু না।’
প্রথমবার হজে আসা শফিকুল ইসলাম বললেন, ‘হজে আসতে পেরেছি, এর জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাই।’
সামান্য এই ঘোরাফেরার বাইরে হাজিরা সারা দিন নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ ইবাদত-বন্দিগি করছেন।
১০ জিলহজ হাজিরা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারবেন, কোরবানি দেবেন, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফ, সায়ি শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করবেন। সেখানে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন তাঁরা। প্রত্যেক শয়তানকে সাতটি করে পাথর মারতে হয়।
মসজিদে খায়েফ থেকে মক্কার দিকে আসার সময় প্রথমে জামারায় সগির বা ছোট শয়তান, তারপর জামারায় ওস্তা বা মেজ শয়তান, এরপর জামারায় আকাবা বা বড় শয়তান।
জনশ্রুতি আছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সন্তান ইসমাইলকে (আ.)কে কোরবানি করার জন্য মিনায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। জামারায় পৌঁছালে শয়তান তাঁকে ধোঁকা দেয়। তখন শয়তানকে লক্ষ্য করে তিনি পাথর নিক্ষেপ করেন।
তিন শয়তানকে তাকবিরসহ পাথর নিক্ষেপ করা হজের অপরিহার্য অংশ। শয়তানের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
হাজিরা যাতে নির্বিঘ্নে শয়তানকে পাথর মারতে পারেন, সে জন্য কয়েক বছর ধরে ওই জায়গা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সৌদি গ্রাম ও পৌরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হাবিব জয়নাল আবেদিন জানান, জামারাকে পর্যায়ক্রমে ১২ তলা করা হবে। প্রতি তলার দৈর্ঘ্য হবে ৯৫০ মিটার আর প্রস্থ ৮০ মিটার। এবার এখানে প্রতি ঘণ্টায় তিন লাখ হাজি পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন বলে জানান মন্ত্রী।
জামারা কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, এখানে তাপমাত্রা থাকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য জামারার ভেতরে একাধিক ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা আছে। রয়েছে পর্যাপ্ত টয়লেট, খাবারের দোকান ও সেলুন। জরুরি প্রয়োজনে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য রয়েছে হেলিপ্যাডও।
পাথর নিক্ষেপের সুবিধার্থে মিনার পূর্ব দিক থেকে আসা হাজিরা আসবেন নিচতলা ও দোতলায়, মক্কা থেকে আসা হাজিরা তৃতীয় তলায়, উত্তর দিক ও মোয়াইসিম থেকে আসা হাজিরা চতুর্থ তলায় এবং আজিজিয়া থেকে আসা হাজিরা পঞ্চম তলায় উঠে পাথর নিক্ষেপ করবেন। ১২টি করে ঢোকার ও বের হওয়ার পথ আছে এখানে।
সৌদি কর্তৃপক্ষের দাবি, মিনায় পুরো কমপ্লেক্স চালু হলে একসঙ্গে ৫০ লাখ হাজি পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন। এখন হাজিদের পাথর মারার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া আছে। মোয়ালেম নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পাথর মারতে হয়।
সৌদি মোয়াচ্ছাসা ১০ জিলহজ সকাল ছয়টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এবং ১১ থেকে ১৩ জিলহজ সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত পাথর মারতে না যেতে হাজিদের অনুরোধ করেছেন।
No comments