যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ কোবানি
ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে চলমান লড়াইয়ে সিরিয়ার কোবানি শহরটি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিনিয়ত আলোচনায়। তুরস্কের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত শহরটি সিরীয় কুর্দিদের প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আরবি ভাষায় কোবানি শহরের নাম আইন আল-আরব। গত ১৬ সেপ্টেম্বরের আগেও বহির্বিশ্বের কাছে ছিল এক অজানা নাম। কিন্তু সেখানেই আইএসের বিরুদ্ধে এসপার-ওসপার লড়াই চলছে বলে এমনভাবে প্রচারিত হয়েছে যে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলের পতনের ঘটনাও অনেকটা আড়াল হয়ে পড়েছে। কোবানির লড়াইয়ে স্থানীয় প্রায় ৪৫ হাজার বাসিন্দা বিপাকে পড়েছে। তাদের অধিকাংশই কৃষিজীবী। সেখানে যুদ্ধকালীন মানবিক বিপর্যয়ের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীকেই দায়ী করেছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম। শহরের শতাধিক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য প্রতিবেশী দেশ তুরস্ককেও যথেষ্ট সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কোবানি নিয়ে এই মাতামাতির কারণ শহরটির কথিত কৌশলগত গুরুত্ব। বলা হচ্ছে, এর অধিকার হাতে পেলে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণে আসবে। শহরটি দখলের চেষ্টা করা আইএস যোদ্ধাদের ওপর হামলার পাশাপাশি কোবানির কুর্দি যোদ্ধাদের রসদও সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, তুরস্ক তাদের সীমান্ত দিয়ে ইরাকি কুর্দি বাহিনীকে কোবানিতে প্রবেশের সুযোগ দিতে রাজি হয়েছে।
তবে কোবানির কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে অনেক কথাই বলা হলেও বৃহত্তর কুর্দিস্তানজুড়ে কুর্দি জাতীয় প্রেরণার শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে শহরটির অবস্থান আলোচনায় আসছে না। ইরাকি কুর্দিরা দীর্ঘদিন ধরেই তেলসমৃদ্ধ কিরকুক নগরকে নিজের করে পেতে চায়। কেউ কেউ এ জন্য একে ‘কুর্দি জেরুজালেম’ বলেন। তবে সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে কোবানির সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে কম। বাশার আল-আসাদ সরকারের নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই বরং তাদের স্বায়ত্তশাসনের লড়াইয়ের পেছনে মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিরীয়-কুর্দি বিশ্লেষক সিরওয়ান কাজো বলেন, কোবানি শহরটি কুর্দি জাতির প্রতিরোধের প্রতীক, কেবল সিরিয়ায় নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য স্থানেও। এ শহরের পতন হলে গোটা কুর্দি জাতি পরাজিত হবে। শহরটি এখন কৌশলগত কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে। এর আংশিক কারণ হলো, এটিই প্রথম শহর হিসেবে আইএসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়ার অন্যান্য শহর কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই আইএসের দখলে চলে গেছে। অটোমান যুগে ১৮৯২ সালে ছোট জনবসতি হিসেবে কোবানির পত্তন হয়। রেলস্টেশন নির্মাণের মধ্য দিয়ে ১৯১১ সালে এটি একটি শহরে রূপ নেয়। পরে ১৯১৫ সালের দিকে আর্মেনীয় উদ্বাস্তুরা তুরস্ক থেকে পালিয়ে কোবানিতে আশ্রয় নেয়।
আর্মেনীয়দের অনুসরণ করে অনেক কুর্দি আনাতোলিয়া থেকে কোবানিতে চলে আসে। কোবানির প্রতীকী তাৎপর্যের সঙ্গে অতীতের কোনো সংযোগ নেই বলেও মনে করেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোমান অ্যান্ড টার্কিশ স্টাডিজ ইনিশিয়েটিভের পরিচালক মোস্তাফা মিনওয়ায়ি বলেন, কোবানির অবস্থান এখন কুর্দি স্বপ্নের কেন্দ্রে। ইতিহাসের চেয়ে এটি বরং ভবিষ্যৎ স্বপ্নের সঙ্গেই বেশি যুক্ত। সিরিয়া ও তুরস্কের কুর্দিরা এখানে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন কায়েমে আগ্রহী।তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক সেনজিগ আকতার বলেন, তুর্কি কুর্দিরা ইরাকি কুর্দিদের চেয়ে সিরীয় কুর্দিদের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। তারা একই ভাষাভাষী। ১৯২১ সালে তাদের গ্রামগুলো কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করে দেওয়া হয়। সিরিয়ার কুর্দিরা তুরস্কের নিষিদ্ধ সংগঠন পিকেকের প্রতি সব সময়ই সহানুভূতিশীল। তবে আঙ্কারা এখন আইএসকে সমর্থন না করলেও পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ নিচ্ছে। বলা যেতে পারে, কুর্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে আইএসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে তুরস্ক অসন্তুষ্ট হবে না। সূত্র: আল-জাজিরা
No comments