বিপজ্জনক পথে হাঁটছেন পুতিন by নিনা খ্রুশ্চভা
ক্রেমলিনের গদিনশিন মানুষদের অযোগ্যতা
ভয়ংকর পর্যায়ে চলে গেছে, এতে রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষ ব্যক্তিটির অবস্থা
কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ইউক্রেনে মালয়েশীয় বিমানের ভূপাতিত হওয়ার ঘটনার
দায়ভায় রাশিয়ার ওপর পড়েছে। ফলে প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন মানুষেরা ৩১ বছর
আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের কোরিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান ০০৭ ভূপাতিত করার
ঘটনার অবতারণা করছেন, এর রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে নতুন করে আলোচনা করছেন।
সে সময় ক্রেমলিন প্রথমে একটি মিথ্যা কথা বলেছিল, কোরিয়ান এয়ারলাইনসের নিখোঁজ বিমানটি সম্বন্ধে তারা নাকি কিছু জানে না। পরে তারা দাবি করে, দক্ষিণ কোরিয়ার বিমানটি আসলে মার্কিনদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করছিল। কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত নেতৃত্বের মধ্যে একটি বড় ধরনের ওলট-পালটের সূত্রপাত হয়। এ কারণে সোভিয়েত সেনাপ্রধান মার্শাল নিকোলাই ওরগাকভের সামরিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, তিনি ছিলেন চূড়ান্ত পর্যায়ের একজন চরমপন্থী মানুষ। এই বিমান ভূপাতিত করার সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি নানা যুক্তির অবতারণা করেন, সেগুলোর মধ্যে আবার কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। ফলে পুরো ব্যাপারটি ক্রেমলিনের জন্য লজ্জাকর হয়ে দাঁড়ায়।
ওরগাকভের অযোগ্যতা ও অসততা এবং ১৯৭৯ সালের পর থেকে আফগানিস্তান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ধারাবাহিক ব্যর্থতা সোভিয়েত ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয়ের বিপদঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। লিওনিদ ব্রেজনেভের শাসনামলে যে অচলাবস্থা শুরু হয়, ১৯৮২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সেটা আরও ঘনীভূত হয়। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে কেজিবির ইউরি আন্দ্রোপোভ ও কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির
সদস্য কনস্ট্যান্টিন চেরনেনকো শুধু বয়সের ভারে ন্যুব্জই ছিলেন না, সোভিয়েত ব্যবস্থার সংস্কার করার মতো যোগ্যতাও তাঁদের ছিল না।
আফগানিস্তানে বিপুলসংখ্যক সোভিয়েত সৈন্যের প্রাণহানি ঘটায় এমনিতেই বাজারে একটি খবর চাউর হয়ে যায়—ক্রেমলিন নিজেই নিজের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। আফগানিস্তান যুদ্ধে সোভিয়েত ক্ষয়ক্ষতি মার্কিন বাহিনীর ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির সমপরিমাণ, তবে সেটা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই ঘটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বেসামরিক বিমান ভূপাতিত করার কারণে এই খবরের ভিত্তি আরও জোরালো হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে মিখাইল গর্বাচভের ক্ষমতায় আরোহণের পথ প্রশস্ত হয়, তাঁর িপরেস্ত্রাইকা ও গ্লাস্তনস্ত শীর্ষক সংস্কার কর্মসূচির প্রতিও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সমর্থন দেন।
অবশ্যই, ইতিহাস মানুষের গন্তব্য নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায় যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের আশপাশের অনেকেই ওরগাকভের ব্যর্থতা ও সোভিয়েত অভিজাততন্ত্রের ওপর এর প্রভাব নিয়ে ভাবছেন, পুতিন হয়তো এ দলভুক্ত নন। সর্বোপরি, পুতিনসহ ক্রেমলিনের নেতারা ঘটমান বাস্তবতার মধ্য দিয়েই নিজেদের জায়েজ করেন, কী ঘটতে পারে তার নিরিখে নয়।
হ্যাঁ, ব্রেজনেভের আফগানিস্তান আক্রমণের রেটরিক ও পুতিনের ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্তকরণের রেটরিকের মধ্যে দারুণ মিল রয়েছে: যে শত্রুরা দেশকে ঘিরে ফেলতে পারে তাদের একঘরে করে ফেলা। পুতিন ২০০৪ সালে আফগানিস্তান যুদ্ধ ফেরত সেনাদের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, ভূরাজনৈতিক কারণেই সোভিয়েত কেন্দ্রীয় এশীয় সীমান্ত রক্ষা করা দরকার, ঠিক যেমন গত মার্চে তিনি ইউক্রেনের ভূমি দখলের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি তুলেছিলেন।
ব্রেজনেভের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন জ্বালানি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে। তখনকার রুশ সম্প্রসারণবাদের কারণ ছিল দেশটির নবলব্ধ জ্বালানি শক্তিনির্ভর সমৃদ্ধির পথ আরও প্রশস্ত করা। পুতিনের আমলে যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন হয়, তার ভিত্তিও হচ্ছে এই জ্বালানি রপ্তানি। কিন্তু রাশিয়ার বর্তমান জ্বালানিনির্ভরতা আসলে পুতিনের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার দিকটি আড়াল করে দিয়েছে, দেশটির প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব আয় এখন এককভাবে হাইড্রো-কার্বনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
পুতিনের অদক্ষতা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী বর্বর আচরণ করছে, এদের কোনো জবাবদিহি নেই। এমনকি নানা জায়গায় তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে মিলে গিয়ে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। দেশটির বিচারব্যবস্থা সরকারনিয়ন্ত্রিত, বিচারিক ব্যবস্থা জনগণের জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারছে না। আর দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে দেশটির সামরিক স্থাপনা, সাবমেরিন, তেলক্ষেত্র, খনির যন্ত্রপাতি, হাসপাতাল ও অবসরপ্রাপ্তদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্তকরণের প্রতি জনসমর্থন কমে এলে পুতিনের ব্যর্থতার দিকগুলো দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে, এই জনসমর্থন নিশ্চিতভাবেই একসময় কমে আসবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করলে পুতিনের পক্ষে বিরোধীদের মোকাবিলা করা সহজ হবে। বিরোধীদের অভিযোগ হচ্ছে, পুতিনের সরকার ‘চোর–বাটপারে’ ভর্তি, বহু মানুষ এ অভিযোগে গলা মেলাবেন, ক্রমেই সে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
আদতে পুতিন নিজেই এখন রাষ্ট্র, তাঁর জমানা বুড়োদের শাসনে পরিণত হয়েছে—গর্বাচভের উত্থানের মধ্য দিয়ে বুড়োদের শাসনের পতন হয়েছিল। রাষ্ট্রের সব ব্যর্থতার জন্য মানুষ ক্রমেই তাঁকেই দায়ী করা শুরু করেছে। চিন্তাশীল রুশরা পুতিনের ঔদ্ধত্য ও গুরুতর ভুলের কাছে জিম্মি হয়ে থাকলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা নয়। তিনি যেভাবে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন, ব্রিকস (ব্রাজিল, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোও সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে না—সম্প্রতি ব্রাজিল সম্মেলনে যেটা দেখা গেছে। রাশিয়ার আশপাশের দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি ব্রিকসের সদস্যরা সম্মান দেখাতে চায়। ইউরোপও আর রাশিয়ার ব্যাপারে চোখে ঠুলি পড়ে থাকবে না, নিশ্চিতভাবে তারাও আরও বড় অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে।
পুতিনের বয়স মাত্র ৬১ বছর। যে নেতারা সোভিয়েত ব্যবস্থাকে খাদের কিনারে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের চেয়ে তিনি অন্তত ১০ বছরের ছোট। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী পুতিনের আরও ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ২০১৩ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এর সঙ্গে আরও অবরোধ আরোপ হলে পুতিন শুধু জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে আর পার পাবেন বলে মনে হয় না।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে অনেক বাড়াবাড়ি করেছে, কোরীয় বিমান ভূপাতিত করা নিয়ে বিশ্ববাসীর সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে। ফলে সোভিয়েত ব্যবস্থার পচন দুনিয়ার সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ে, এই পচনের কারণেই সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। রাশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলে পুতিনকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হবে, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
নিনা খ্রুশ্চভা: নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড পলিসি ইনস্টিটিউটের একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো।
No comments