নদী ও পানি আগ্রাসন by ড. মাহফুজ পারভেজ
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেলে এ অঞ্চলের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ব্যবহার নিয়ে আঞ্চলিক সঙ্কট দেখা দেয়। তখন বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচিতে ভারত ও পাকিস্তানের সরকার প্রধানরা সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলোর পানি ব্যবহার নিয়ে ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী পাঞ্জাবের রাভি, সাটলেজ ও বিয়াস নদীর পুরো প্রবাহ ভারতকে এবং সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পুরো প্রবাহ পাকিস্তানকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ সম্পাদনের পর ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের সময়ও তারা কিন্তু পানি-চুক্তি ভঙ্গ করেনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারতের সঙ্গে অভিন্ন রূপে চিহ্নিত হয়। ভারত ষাটের দশকে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কার ওপর যে ব্যারেজ নির্মাণ শুরু করে, তা কিন্তু পাকিস্তান আমলে চালু করতে পারেনি; চালু করেছে বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৫ সালে। ভারত তখন একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ৪০,০০০ কিউসেক পানি হুগলি নদীতে প্রত্যাহার করতে শুরু করে। এর ফলে হঠাৎ করে বাংলাদেশ অংশে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায় এবং গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাশে প্রথমবারের মতো গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তিতে যে কোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি দেওয়ার গ্যারান্টি ছিল। পাঁচ বছর মেয়াদি ওই চুক্তির সময় উত্তীর্ণ হলে ভারত ইচ্ছামাফিক পানি আটকাতে থাকে। এর ফলে একসময় গঙ্গার পানিপ্রবাহ বাংলাদেশ অংশে ১০,০০০ কিউসেকে নেমে আসে। পরে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ন্যূনতম ২৭,৬৩৩ কিউসেক পানি দেয়ার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে কোন গ্যারান্টি নেই।
এদিকে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত থেকে আসা গঙ্গা, তিস্তাসহ ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর নায্য প্রবাহ অব্যাহত রাখার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ, ফসল ও অর্থনীতি এবং জীব ও জনজীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করেছে চীন। সেই সঙ্গে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রকৃতি বহুবিধভাবে বিপর্যয় ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদী প্রসঙ্গে এ অঞ্চলের উজানের দেশগুলোর কর্মকাণ্ড ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য বিরাট বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ নতুন নয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করেছিলেন। রংপুরে তিস্তা নদী অভিমুখেও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক লংমার্চ হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব জায়গার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন নদীর মরণদশা দেখে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। শুধু গঙ্গা, তিস্তা বা টিপাইমুখ নয়, আগে-পরের আরও অনেক পানি আগ্রাসী ঘটনা এই ক্ষোভের বিস্তার ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি ফেসবুকে এক তরুণের সংক্ষুব্ধ ভাষ্য এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে: ‘ভারত উজানে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরের কোদলা নদীর ওপর বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর চাকমাঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর ওপর বাঁধ, গোমতি নদীর ওপর মহারানী বাঁধ এবং মুহুরি নদীর ওপর কলস বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে বছরের পর বছর। এছাড়াও আরও কমপক্ষে ১৫টি সীমান্ত নদীর ওপর অস্থায়ী ভিত্তিতে কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষায় অস্থায়ী বাঁধ কেটে দেয়া হয়। ভারতের এরকম পানি আগ্রাসী নীতির কবলে পড়ে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের প্রায় সব নদ-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। আর বর্ষায় বাংলাদেশকে ভাসানো হয় বন্যার পানি দিয়ে। এছাড়াও সীমান্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভারত পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে বাংলাদেশ অংশে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি করছে। ভারতের এমন নীতির কবলে পড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশের শ’ শ’ কোটি টাকার সম্পদ, ফসল নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে।’
এমনই আগ্রাসী পরিস্থিতিতে ভারত বা ভারতের তৎপরতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব কেমন হতে পারে- তা আঁচ করা কঠিন নয়। অতএব, রামপাল প্রকল্প, সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিট নিয়ে গোপন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তাসহ যথাযথভাবে নদী চুক্তি নিয়ে টালবাহানা, অসম বাণিজ্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সামনে কার্যকরী প্রতিবাদ ছাড়া অন্য কোন পথ ও পন্থা খোলা নেই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারতের সঙ্গে অভিন্ন রূপে চিহ্নিত হয়। ভারত ষাটের দশকে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কার ওপর যে ব্যারেজ নির্মাণ শুরু করে, তা কিন্তু পাকিস্তান আমলে চালু করতে পারেনি; চালু করেছে বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৫ সালে। ভারত তখন একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ৪০,০০০ কিউসেক পানি হুগলি নদীতে প্রত্যাহার করতে শুরু করে। এর ফলে হঠাৎ করে বাংলাদেশ অংশে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায় এবং গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাশে প্রথমবারের মতো গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তিতে যে কোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি দেওয়ার গ্যারান্টি ছিল। পাঁচ বছর মেয়াদি ওই চুক্তির সময় উত্তীর্ণ হলে ভারত ইচ্ছামাফিক পানি আটকাতে থাকে। এর ফলে একসময় গঙ্গার পানিপ্রবাহ বাংলাদেশ অংশে ১০,০০০ কিউসেকে নেমে আসে। পরে ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ন্যূনতম ২৭,৬৩৩ কিউসেক পানি দেয়ার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে কোন গ্যারান্টি নেই।
এদিকে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত থেকে আসা গঙ্গা, তিস্তাসহ ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর নায্য প্রবাহ অব্যাহত রাখার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ, ফসল ও অর্থনীতি এবং জীব ও জনজীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করেছে চীন। সেই সঙ্গে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রকৃতি বহুবিধভাবে বিপর্যয় ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদী প্রসঙ্গে এ অঞ্চলের উজানের দেশগুলোর কর্মকাণ্ড ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য বিরাট বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ নতুন নয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করেছিলেন। রংপুরে তিস্তা নদী অভিমুখেও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক লংমার্চ হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব জায়গার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন নদীর মরণদশা দেখে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। শুধু গঙ্গা, তিস্তা বা টিপাইমুখ নয়, আগে-পরের আরও অনেক পানি আগ্রাসী ঘটনা এই ক্ষোভের বিস্তার ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি ফেসবুকে এক তরুণের সংক্ষুব্ধ ভাষ্য এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে: ‘ভারত উজানে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরের কোদলা নদীর ওপর বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর চাকমাঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর ওপর বাঁধ, গোমতি নদীর ওপর মহারানী বাঁধ এবং মুহুরি নদীর ওপর কলস বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে বছরের পর বছর। এছাড়াও আরও কমপক্ষে ১৫টি সীমান্ত নদীর ওপর অস্থায়ী ভিত্তিতে কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্ষায় অস্থায়ী বাঁধ কেটে দেয়া হয়। ভারতের এরকম পানি আগ্রাসী নীতির কবলে পড়ে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের প্রায় সব নদ-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। আর বর্ষায় বাংলাদেশকে ভাসানো হয় বন্যার পানি দিয়ে। এছাড়াও সীমান্ত নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভারত পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে বাংলাদেশ অংশে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি করছে। ভারতের এমন নীতির কবলে পড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশের শ’ শ’ কোটি টাকার সম্পদ, ফসল নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে।’
এমনই আগ্রাসী পরিস্থিতিতে ভারত বা ভারতের তৎপরতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব কেমন হতে পারে- তা আঁচ করা কঠিন নয়। অতএব, রামপাল প্রকল্প, সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিট নিয়ে গোপন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তাসহ যথাযথভাবে নদী চুক্তি নিয়ে টালবাহানা, অসম বাণিজ্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের মানুষের সামনে কার্যকরী প্রতিবাদ ছাড়া অন্য কোন পথ ও পন্থা খোলা নেই।
No comments