ব্রিকস ব্যাংক কি বিশ্বব্যাংকের প্রভাব কমাতে পারবে? by ধীরাজ কুমার নাথ

ব্রাজিল, রশিয়া, ভারত, গণচীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃবৃন্দ ১৫ জুলাই ২০১৪ এক ঐতিহাসিক সভায় মিলিত হয়েছেন ব্রাজিলের ফোর্তালেজা শহরে। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মনোরম এ শহরে অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে আলোচনা শেষে অনেক প্রত্যাশা ও শুভেচ্ছা নিয়ে হাসিমুখে হাতে হাত রেখে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ­াদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফ, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা ব্রিকস ব্যাংক গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যাপক প্রতিশ্রুতি ও অপার সম্ভাবনার আশা ব্যক্ত করে পাঁচ দেশের নেতৃবৃন্দ ব্রিকস ব্যাংকের শুভযাত্রার সূচনা করলেন। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী শোরগোল শুরু হল বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবার সত্যিই কি প্রতিযোগিতার মুখে পড়ল? তাদের একছত্র আধিপত্য এবার বোধ হয় সরাসরি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হল।

পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক ফাইল কার্টুন
সিদ্ধান্ত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো বিনির্মাণে চীনের বৃহৎ বাণিজ্য নগরী সাংহাইয়ে থাকবে এ ব্যাংকের সদর দফতর। ব্যাংকের প্রথম প্রেসিডেন্ট হবেন একজন ভারতীয়। বোর্ড অব গভর্নরের প্রথম চেয়ারপারসন আসবেন রাশিয়া থেকে এবং পরিচালনা পর্ষদের প্রথম প্রধান হবেন একজন ব্রাজিলিয়ান। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকবে এই ব্যাংকের আফ্রিকার আঞ্চলিক সদর দফতর। এই ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হবে ২০১৬ সাল থেকে। ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী গুইডো মনে করেন, ‘বিশ্বব্যাংকের কর্তৃত্ব বরাবরই ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকে। ব্রিকস ব্যাংক হবে গণতান্ত্রিক।’ সম্ভবত একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাংক তার শুভ সূচনা করল।
ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ১০ হাজার কোটি ডলার, তবে প্রাথমিক মূলধন হবে ৫ হাজার কোটি ডলার। গণচীন দিবে ৪ হাজার ১শ’ কোটি এবং ব্রাজিল, ভারত ও রাশিয়া দিবে প্রত্যেকে ১ হাজার ৮শ’ কোটি ডলার করে। দক্ষিণ আফ্রিকা দিবে ৫শ’ কোটি ডলার। তবে পরিচালনা এবং ঋণদান বিষয়ক অনেক নিয়মাবলী পর্যায়ক্রমে আলোচিত হবে এবং সেভাবে সিদ্ধান্ত হবে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদির অভিমত হচ্ছে, শুরু থেকেই ‘একটি স্থিতিশীল, শন্তিপূর্ণ এবং ভারসাম্য অবস্থা বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে এবং সবার অভিমত গ্রহণ করে ব্রিকস ব্যাংক তার কাজ পরিচালনা করবে।’ ব্যাংকের সূচনালগ্নে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফের বক্তব্য হচ্ছে- ‘ব্রিকস ব্যাংক এবং সঞ্চিত আমানতের চুক্তিতে আমরা যে স্বাক্ষর করেছি, তা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনের নতুন নকশা প্রদানে মূল্যবান অবদান রাখতে সক্ষম হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা চাই ন্যায়বিচার ও সমঅধিকার। আইএমএফকে দ্রুত ভোটাধিকার কোটা পরিবর্তন করতে হবে। উদীয়মান দেশগুলোর গুরুত্ব মূল্যায়ন করতে হবে।’
একটি গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা করা এবং সবার অভিমত গ্রহণ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ছাড়াও বিশ্বপরিমণ্ডলে নতুন অর্থনৈতিক প্রশাসনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে শতাব্দী ধরে আর্থিক বিশ্বে আধিপত্যবাদের অবসানের লক্ষ্যে ব্রিকস ব্যাংকের শুভযাত্রার মাধ্যমে উদীয়মান দেশসমূহ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অঙ্গনে একটি অর্থবহ চ্যালেঞ্চ ছুঁড়ে দিল বলে অনেকেই মনে করেন।
ব্রিকস ব্যাংকভুক্ত ৫টি দেশের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে বিশ্বের প্রায় ৪২ শতাংশ। বিশ্বের মোট পুঁজি বিনিয়োগে ১১ শতাংশ এবং বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের ২০ শতাংশ এই পাঁচটি দেশ থেকেই আসে। তাই বিশিষ্ট অর্থনৈতিক প্রজ্ঞাবান দার্শনিকদের ধারণা হচ্ছে, ব্রিকস ব্যাংকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিশাল এবং ব্যাপক। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মুন্সিয়ানা ও আধিপত্যবাদের সূর্য এবার অস্তমিত হবে। মাথানত করে প্রতিযোগিতার পরিমণ্ডলে তাদের টিকে থাকার লড়াই শুরু করতে হবে।
তবে কথা আছে। অর্থনীতির গতি প্রবাহ চলে নিজস্ব ধারায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কী হারে এ ব্যাংক ঋণ দিবে। বিশ্বব্যাংক এখন তৃতীয় বিশ্বে বিশেষত বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেয়, যার সুদের হার হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ০.৭৫% অর্থাৎ ১% শতাংশেরও কম হারে। এ ছাড়াও বড় ধরনের সুবিধা হচ্ছে প্রায় ৪০ বছর পর এ ঋণ পরিশোধের তালিকায় আসে। বিশাল এক সুযোগ উন্মুক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক। এ কারণেই বাংলাদেশের জনগণ পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকে ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিনা সুদে জাইকার অর্থ গ্রহণে উৎসাহ পদর্শন করেছে। ব্রিকস ব্যাংক অবশ্য ঘোষণা করেনি কোন দেশ কোন ধরনের ক্ষেত্রে ঋণ সুবিধার আওতায় আসবে এবং অবকাঠামো নির্মাণে কেমন শর্তাবলী আরোপিত হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ যদি ব্রিকস ব্যাংকের সদস্য হয়, তবে বিনিয়োগের হার কী হবে এবং ভোটাধিকার থাকবে কিনা, সবই ভবিষ্যৎ বলে দিবে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের পরিচালনায় বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের ভূমিকা পালন করে এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের গভর্নিং বডির সদস্য।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০০১ সালে গোল্ডম্যান স্যাকস গ্র“পের অর্থনীতিবিদ জিম ওনিল ৪টি দেশ নিয়ে ব্রিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ধারণার সূত্রপাত করেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকা এতে সংযুক্ত হতে প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করায় এশীয়, আফ্রিকা, ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার উদীয়মান দেশ হিসেবে ‘ব্রিকস ব্যাংকে’র ধারণা চূড়ান্ত করা হয়। লক্ষ্য করা যায়, ২০০৭ সালে এসব দেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০.৭ শতাংশ যা বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। তবে বর্তমানে তা হ্রাস পেয়েছে সত্য; কিন্তু ব্যবসায়িক সাফল্য এবং রফতানির গতি-প্রকৃতিকে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে দেখে পশ্চিমা দেশসমূহ আতংকিত। তার উপর এমন একটি বিশাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা দেখে বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনাবিদ এবং অর্থনীতিবিদগণ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন ।
আমরা তৃতীয় বিশ্বের আমজনতা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার এবং এসব ব্যাপারে আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ তীব্র এবং কঠোর। আমরা পরিশ্রম করে আমাদের অগ্রগতি অর্জন করব, কারও অঙ্গুলির নির্দেশনা মানতে রাজী নই।
মূলত একটি ব্যাপক প্রতিযেগিতার সূত্রপাত করেছে ব্রিকস ব্যাংক। বিশ্ববাসী অবশ্যই অথনৈতিক সম্প্রসারণবাদের অবসান দেখতে পারে এবার। উদীয়মান অর্থনীতির দেশসমূহ বিশ্ব অর্থনৈতিক অঙ্গনে অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করবে। তাই গোল্ডম্যান গ্র“পের জোহানসবার্গ শাখার প্রধান কলিন কোলম্যান মনে করেন, ‘কূটনৈতিকভাবে এবং আর্থিকভাবে আমরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উদীয়মান বাজারের অংশীদার।’
তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এ জাতীয় অর্থনৈতিক উদ্যোগকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা বুঝে ওঠা কঠিন। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে। ইউক্রেন প্রশ্নে ভারত বা গণচীন বা ব্রাজিল নীরব থাকলেও সবার ভাবনা এক নয়। মালয়েশিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে ১৭ জুলাই বিকাল ৫টায় এবং ২৯৫ জন আরোহীর সবাই নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, সে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিনতাবাদীরা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বিমানটি ভূপাতিত করেছে। এভাবে রাজনৈতিক অঙ্গন ভিন্নরূপ নিতে চলেছে। ব্রাজিলের নির্বাচন সামনে। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, এসব রাজনৈতিক ব্যতিক্রমধর্মী কর্মকাণ্ড ব্রিকস ব্যাংকের মহান উদ্যোগকে প্রভাবিত করে তার অভীষ্ট পূরণে সহায়তা করবে কি-না।
সবকিছুর মাঝে নতুন ব্যাংকের যাত্রা শুভ হোক, বিশ্ব পরিমণ্ডলে, অর্থনৈতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতা তীব্র হোক। অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের অবসান হোক, এই আমাদের প্রত্যাশা।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা,সাবেক সচিব, কলাম লেখক
dknath888@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.