ব্যাংকিং খাতের অস্থিতিশীলতা বিপজ্জনক by আলী ইদ্রিস
অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক ব্যাংকিং খাত।
রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেয় তেমনি রাজনৈতিক প্রভাবে বা
বিবেচনায় ব্যাংকিং সেক্টরকে পরিচালনা করলে স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়। সরকারি,
বেসরকারি তহবিলসহ সাধারণ জনগণের তথা সমগ্র জাতির এবং বিদেশী নাগরিক ও
সংস্থার আমানতের রক্ষক ব্যাংক। তাই ব্যাংক পরিচালনায় আইন-কানুনের যথাযথ
প্রয়োগ না হলে বা ছাড় দিলে অথবা নীতিমালা শিথিল করলে সেখানে অস্থিতিশীলতা
আক্রমণ করতে পারে। ব্যাংকের কুঋণ, খেলাপি ঋণ, অবলুপ্ত ঋণ, মওকুফকৃত সুদ,
আর্থিক কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, সব মিলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ইতিমধ্যে
দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে খেলাপি ঋণ
পুনঃতফসিল করার পর কৃত্রিমভাবে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছিল।
২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসা প্রতিষ্টানের আর্থিক ক্ষতি হযেছে এই
অজুহাত দেখিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিল করা হয় এবং নতুন, পুরাতন
খেলাপিরা দলে দলে কোন রকম ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করার আবেদন
করেন। এ সুযোগে ১৪,০০০ কোটি টাকার খেলাপি ও প্রায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা
হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ৭,৮৫৭ কোটি এবং বেসরকারি
ব্যাংকসমুহ ৬,০০০ কোটি টাকা টাকা পুনঃতফসিল করেছিল। এতে খেলাপি ঋণ পূর্বের
যে কোন সময়ের তুলনায় কমে গিয়েছিল। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৬,৭২০
কোটি টাকা থেকে ডিসেম্বরের প্রন্তিকে খেলাপি ঋণ কমে ৪০,৫৮৩ কোটি টাকায়
দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ তিন মাসে ১৬,১৩৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমে ব্যাংকের,
বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি
হয়েছিল।কিন্তু পুনঃতফসিলকৃত ঋণ খেলাপিরা ঋণ পরিশোধে অনিয়ম করাতে অবস্থা
পুনরায় খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ব্যাংকসমুহের কৃত্রিমভাবে এই পুনঃতফসিল
করার ফলে পুরাতন ঋণখেলাপিগণ সুবিধা পেয়েছেন কিন্তু নতুন ব্যবসায়ী ও
বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হয়েছেন। কুফলস্বরূপ সৎ ও নিষ্ঠাবান ঋণগ্রহণকারীদের
মধ্যে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে কুঋণ,
খেলাপি ঋণ আদায় করার তৎপরতায় ভাটা পড়েছে, কৃত্রিমভাবে আর্থিক অবস্থার
উন্নতি হওয়ায় ২০১৩ সালে মুনাফা বেড়ে গিয়েছে ও নগদে ডিভিডেন্ড চলে গিয়েছে।
আরও লক্ষণীয় যে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা ও কৃষি খাত ২০১৩ সালে রাজনৈতিক
অস্থিরতার শিকার হলেও তাদের বিবেচনায় আনা হয়নি। অন্যদিকে যে সমস্ত ঋণ অতীতে
একাধিকবার পুনঃতফসিল হয়েছে তা পুনরায় বিবেচনার অবকাশ নেই, কিন্তু সে সব
বিষয় বিশ্লেষণ-বিবেচনা না করে ডাউন পেমেন্ট ছাড়া, হ্রাসকৃত সুদে কুঋণ
পুনঃতফসিল করাতে সুবিচার করা হয়নি। নবম সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জানা যায়
৪৭টি ব্যাংকে মোট ঋণ-খেলাপির সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজার। মোট খেলাপি ঋণের
পরিমাণ ২৪,৪০৩ কোটি টাকা। আরও আছে মূলধন এবং খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন
ঘাটতি। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৯,৬৪৫ কোটি টাকা,
প্রভিশন ঘাটতি ৭,৪৯৪ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক দু’দিকেই সবচেয়ে এগিয়ে আছে।।
হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি গ্রুপের কেলেঙ্কারির পর অবস্থা খারাপ হয়েছে।
এদিকে বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতিতে স্বয়ং পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকগণ
জড়িত থাকার এবং ৪,০০০ কোটি টাকার অধিক অর্থ লোপাট হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অনেক
দিন থেকেই বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি সন্দেহ করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বা
অর্থ মন্ত্রণালয় কোন কার্য়ক্রম নেয়নি, এখন চেয়ারম্যানকে সম্মানজনকভাবে
পদত্যাগ করতে দেয়া হয়েছে। সুতরাং, যা হওয়ার তাই হয়েছে। ২০০৯ সালে ব্যাংটির
খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ১৪১.২৩ কোটি টাকা, চার বছরে সে ঋণ ৪,১৫৭ কোটি টাকায়
উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২,১৭,৯৯২ কোটি ঋণের বিপরীতে
৪,৬৮০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিপিডির
প্রতিবেদন মোতাবেক গত সাড়ে চার বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহে প্রায় ৫,০০০
কোটি টাকার সুদ মওকুফ ও ১১,০০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর আগে ৭
বছরে সুদ মওকুফ করা হয়েছিল মাত্র ৩,৬৪৫ কোটি টাকা। এসব করা হয়েছে
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ, কৃষিব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও শিল্পঋণ সংস্থায়। এ
বিশাল অংকের সুদ মওকুফ ও ঋণ অবলোপনের ফলে ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ কমে
গিয়েছে এবং মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো
২,২২৫ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছিল, তার বিপরীতে ২০১২ সালে সেগুলো লোকসান
গুনেছে। একই ভাবে রাষ্ট্রাত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ২০১১ সালে ১০.৯৬ কোটি
টাকা মুনাফা অর্জন করেছিল, ২০১২ সালে মাত্র ১৫ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন
করেছে। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করায় ২০১৩ সালে ব্যাংকের কৃত্রিমভাবে হঠাৎ
আর্থিক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকসমূহে অলস পড়ে আছে প্রায় ১০০,০০০ কোটি
টাকা (জানুয়ারিতে ছিল ৬০,০০০ কোটি টাকা) যা থেকে বোঝা যায় শিল্পপতি ও
ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এ অচলাবস্থার অবসান না হলে
জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে না, এমডিজি অর্জন করা কঠিন হবে, দেশকে মধ্য
আয়ের দেশে রূপ দেয়ার লক্ষ পিছিয়ে যাবে। সুতরাং, ব্যাংকিং খাতে আরও দক্ষ,
আরও বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একটি ব্যাংক দেউলিয়া
হলে অর্থনীতি তথা দেশের ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
No comments