মোদি-মাহাত্ম্য রক্ষায় দিল্লি দখল বড় বালাই by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এত বিপুল সমর্থন নিয়ে দেশ শাসনের দায়িত্ব
গ্রহণের পরও দিল্লি দখলে বিজেপি প্রবল দোলাচলের মধ্যে পড়েছে। এমনই যে এখন
পর্যন্ত তারা বুঝতে পারছে না, কী করলে সেটাই হবে ঠিক সিদ্ধান্ত। বলতে গেলে
দল দ্বিধাবিভক্ত। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর
‘ম্যান ফ্রাইডে’ দলীয় সভাপতি অমিত শাহর ওপরই ঝুলে রয়েছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
গ্রহণের দায়। খুব বেশি সময় নষ্ট না করেই তাঁদের দুই বিকল্পের একটি বেছে
নিতে হবে। আবার ভোট, নাকি বিকল্প সরকার?
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দিল্লি বিধানসভার ভোট যখন হলো, সেই সময়ের রাজনৈতিক চালচিত্রটা মনে আছে তো? কংগ্রেস নানা কারণে লেজেগোবরে। আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের শরিক অরবিন্দ কেজরিওয়াল গুরুকে ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিজেদের দল গড়ে তুলেছেন। নাম আম আদমি পার্টি (এএপি)। দেশের আনাচ-কানাচে তখন এএপির ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
অন্যদিকে বিজেপি তখন দেশ দখলের স্বপ্নে বিভোর। রাজ্যে রাজ্যে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কংগ্রেসের একমাত্র বিকল্প হিসেবে যা যা করণীয়, কিছুই করতে বাকি রাখছে না। এ অবস্থায় দিল্লির ভোট হলো। দেখা গেল, কংগ্রেস ধূলিসাৎ হলেও দিল্লির মানুষজনের এক বিরাট অংশ ভরসা রাখলেন কেজরিওয়ালদের ওপর। বিজেপি একক গরিষ্ঠ দল হলেও সরকার গড়তে প্রয়োজনীয় সংখ্যা তারা আদায়ে ব্যর্থ হলো। তীরে এসে তরি ডোবার মতো তাদের হাল। ৭০ আসনের বিধানসভায় তারা পেল ৩১টি, সহযোগী আকালি দল একটি। সরকার গড়তে দরকার অন্তত আরও চারটি আসন। তা পাওয়া সেই মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। বিজেপিকে রুখতে পর্যুদস্ত কংগ্রেস আটটি আসন নিয়ে সমর্থন দিল এএপিকে। ক্ষমতায় এলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এক অন্য ধরনের মুখ্যমন্ত্রী পেল দিল্লিবাসী। এক অন্য ধরনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল দেশ।
স্বপ্নভঙ্গে অবশ্য সময় বেশি লাগেনি। মাত্র ৪৯ দিন ক্ষমতায় থেকে হঠকারিতার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন রেখে কেজরিওয়াল বর্তমান থেকে সাবেক হয়ে গেলেন। এত দ্রুত উত্থান ও পতনের এমন নির্ভেজাল উদাহরণ ভারতীয় রাজনীতিতে আগে ঘটেনি। ওঁরা যে ভুল করেননি—ত্যাগেই যে মোক্ষ, ভোগে নয়—বারবার সে কথা বলে যখন তাঁদের বোধোদয় হলো, তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। লোকসভার ভোট শেষ। সাধ ও সাধ্যের পার্থক্য না বুঝে পাগলের মতো ঝুরি ঝুরি প্রার্থী দিয়ে ভোট শেষে কেজরিওয়ালেরা উপলব্ধি করলেন আবেগ ও বাস্তবের ফারাক কতখানি। সেই বোধোদয় কেজরিওয়ালদের কবুল করাল, দিল্লির মসনদ ছেড়ে দেওয়াটা ছিল গুরুতর ভুল। তাঁরা বুঝলেন, মানুষ তাঁদের কুর্সিতে বসাতে ভোট দিয়েছিল, কুর্সি ছেড়ে দেওয়ার ‘আর্ট’ শেখাতে নয়।
কংগ্রেসও হাবুডুবু খেল, কিন্তু লোকসভার ভোটে দিল্লিতে আম আদমি পার্টি একটি আসনও জিততে পারল না। সাতে সাত জিতে গেল বিজেপি। একে মোদি-হাওয়া, তায় লোকসভা ভোট। বিধানসভার ভোটের আগেই দিল্লির আনাচ-কানাচে ফুসফুস গুজগুজ ছিল এ রকম—নিচে আম আদমি পার্টি, ওপরে মোদি। মানে, দিল্লি বিধানসভায় এএপিকে ভোট, লোকসভায় মোদি। সেটাই হলো, কিন্তু ত্রিমুখী ভোটে কেজরিওয়ালদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না। মানুষ তাঁদের বুঝিয়ে দিল, দিল্লি শাসন যাঁরা করতে পারেন না, তাঁদের হাতে দেশ শাসনের ভার দেওয়া ঠিক নয়। সেই শিক্ষায় কেজরিওয়ালরা শিক্ষিত হয়েছেন কি না জানা নেই, তবে এটুকু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা অতীতের ভুল স্বীকার করেছেন এবং আগামী দিনে সাবধানী হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
রাষ্ট্রপতির শাসন শেষ হওয়ার মুখে দিল্লির রাজনীতিকে এর পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। আম আদমি পার্টির প্রতি দিল্লির সাধারণ মানুষ আশাহত হয়তো, কিন্তু তাদের বর্জন করেনি। কংগ্রেসও এই সময়ে এমন কিছু করেনি যে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষ ভরসা রাখবে। আবার মোদির এই সামান্য সময়ের দেশ শাসনেও দিল্লির আম আদমি আহামরি এমন কিছু দেখেনি, যাতে তারা সব ছেড়ে বিজেপিকেই বরণ করে নেবে।
তাহলে কী করবে তিন পার্টি? কেজরিওয়াল বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের সুপারিশ করেছিলেন। দিল্লির উপরাজ্যপাল নাজিব জঙ্গ তা গ্রাহ্য করেননি। তিনি বিধানসভা জিইয়ে রেখে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করেছেন। অর্থাৎ বিকল্প সরকারের দরজা খোলাই রয়েছে। কিন্তু সেই বিকল্পকে সাকার করতে গেলে দল ভাঙাভাঙির খেলায় নামতে হয়। দল ভাঙিয়ে সরকার গড়তে সবচেয়ে ভালো জায়গায় রয়েছে বিজেপি। আবার বিজেপিকে রুখতে একমাত্র উপায় এএপিকে কংগ্রেসের সমর্থন দেওয়া। অর্থাৎ সেই পুরোনো খেলা।
এ অবস্থায় দিল্লির রাজনৈতিক ভাগ্য পুরোটাই নির্ভর করছে বিজেপির ওপর। অথচ বিজেপিই রয়েছে সবচেয়ে বেশি দোলাচলে।
দিল্লি বিধানসভার মোট আসন ৭০। ডিসেম্বরের ভোটে বিজেপি ও তার সহযোগী আকালি দল পেয়েছিল ৩২টি। আম আদমি পার্টি পায় ২৮টি, কংগ্রেস আটটি, দুটি আসন পায় স্বতন্ত্ররা। দিন কয়েকের মধ্যেই এএপির এক বিধায়ক বিনোদ কুমার বিন্নি দল থেকে বহিষ্কৃত হন। ফলে স্বতন্ত্র বেড়ে হয় তিন, এএপি কমে হয় ২৭। লোকসভা ভোটে বিজেপির তিন বিধায়ক জেতেন। তাঁরা বিধানসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ায় সেই তিন আসন খালি হয়ে যায়। ফলে ৭০ আসনবিশিষ্ট বিধানসভা কমে হয় ৬৭, বিজেপিরও আসন কমে হয় ২৯। বিকল্প সরকার গড়তে হলে তাই বিজেপিকে আরও পাঁচজনের সমর্থন জোটাতে হবে। অন্যদিকে বিজেপিকে ঠেকাতে গেলে সেই পুরোনো অঙ্ক কষতে হবে কংগ্রেস ও এএপিকে, কেজরিওয়ালেরা যা চান না। তাঁরা চান নতুন ভোট। অর্থাৎ, বলটা পুরোপুরিই বিজেপির কোর্টে। অথচ বিজেপি কী করবে, সেটাই ঠিক করে উঠতে পারছে না।
না পারার একটা কারণ নির্বাচিত বিধায়কদের আপত্তি। মাত্র গত বছর যাঁরা ভোটে জিতলেন বিপুল পরিশ্রম ও অর্থ খরচ করে, দ্বিতীয়বার সেই ধকল তাঁরা সইতে নারাজ। তাঁরা চান কংগ্রেসের দল ভাঙিয়ে স্বতন্ত্রদের সাহায্য নিয়ে সরকার গড়তে। এই না চাওয়ার বড় কারণ অবশ্য এএপির ভয়। আবার ভোট হলে বিজেপির বিধায়কেরা যে জিতবেনই, সেই নিশ্চয়তা তাঁরা পাচ্ছেন না। এমনকি, যে হাওয়ায় ভর দিয়ে লোকসভায় বিজেপি দিল্লিতে সাতে সাত করেছিল, সেই মোদি-হাওয়ার ওপরও বিধায়কেরা ভরসা করতে পারছেন না। এই মহল তাই দলীয় নেতৃত্বকে প্রাণপণে বোঝাতে চাইছে, ফের ভোটের রাস্তায় না গিয়ে অন্য দল ভাঙিয়ে সরকার গড়া হোক। সে জন্য তলে তলে কংগ্রেসের ছয়জনের সঙ্গে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব যোগাযোগও করে। কংগ্রেস ছেড়ে ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে কংগ্রেসের ওই ছয়জন রাজিও হয়ে যান। কিন্তু কেজরিওয়ালরা শোরগোল পাকালে বিজেপি যেমন কুঁকড়ে যায়, কংগ্রেসও তেমনি ঘরে আগল তোলার সময় পেয়ে যায়। কেজরিওয়ালের দাবি, বিজেপি একেকজনকে ২০ কোটি টাকার টোপ দিয়েছে।
বিজেপির রাজ্য নেতারা এই অভিযোগের তেমন কোনো জুতসই জবাব যেমন দিতে পারেননি, তেমনি বিকল্প সরকার গড়তে গেলে অন্যদের যে দলছুট করতে হয়, সেটাও অস্বীকার করতে পারছেন না। দলের নতুন সভাপতি সতীশ উপাধ্যায়, সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ মুখী, সাবেক সভাপতি বিজয় গোয়েলদের রাজনীতি সম্পূর্ণই দিল্লিনির্ভর। দল রাখতে তাঁরা ফের ভোটের রাস্তায় হাঁটার পক্ষপাতী নন। আবার যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে বিজেপি ডিসেম্বরের ভোটে লড়েছিল, সেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন দল ভাঙিয়ে সরকার গড়ার ঘোরতর বিরোধী। তাঁরই মতো বিরোধী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও। এই মহলের অভিমত, এভাবে সরকার গড়ার প্রতিক্রিয়া বিরূপ হতে বাধ্য। বিশেষত এ বছরের শেষে যখন মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার নির্বাচন রয়েছে এবং ঝাড়খন্ডেও ভোট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
বিজেপির এই দোলাচলের মধ্য দিয়ে একটি বিষয়ই প্রকট হয়ে উঠছে এবং তা নরেন্দ্র মোদির ‘ক্যারিশমা-কেন্দ্রিক’। যাঁর নামে এই সেদিন আসমুদ্রহিমাচল চঞ্চল হয়ে উঠল, ‘আচ্ছে দিন আনেবালা হ্যায়’ স্লোগান যাঁকে করে তুলল হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা, যাঁর পেছনে বিহ্বল হয়ে ছুটল দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা, যিনি কান্ডারি হয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর পরে বিজেপিকে একক ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন করলেন, সেই নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে দিল্লি দখলে বিজেপির কেন এত কুণ্ঠা? তবে কি কোনোভাবে মোদি-বিহ্বলতা ফিকে হয়ে যাচ্ছে? মোদি-মাহাত্ম্যও কি দিল্লিবাসীকে তরাতে পারবে না বলে ভয় পাচ্ছে বিজেপি? পেঁয়াজের দাম ৩৫-৪০ রুপির নিচে নামছে না। আলুও ৩২-৩৫ রুপিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। টমেটো ৫০ রুপির নিচে নেই। বিদ্যুতের দাম ফের বাড়ল দিল্লিতে। সামাল দিতে রাষ্ট্রপতিশাসিত দিল্লির বাজেট পেশ করলেন অরুণ জেটলি, ২৭০ কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও পানীয় জলে ভর্তুকি দিয়ে। এত কিছুর পরও বিজেপি কেন বুক ঠুকে নতুন করে ভোটে যাওয়ার জন্য উপরাজ্যপালকে অনুরোধ জানাচ্ছে না? কেজরিওয়ালরা যেখানে নিত্যদিন সেই দাবি জানিয়ে আসছেন?
মোদি-মাহাত্ম্য এখানেই ধাক্কা খাচ্ছে। সারাটা দেশ দখল করে খোদ দিল্লি অধরা থাকলে মোদি-মাহাত্ম্য কোথাও একটু কলঙ্কিতই থেকে যাবে। দিল্লিতে দল ভাঙানির সরকার যে কলঙ্ক বয়ে আনবে, ভোটে দাঁড়িয়ে আম আদমি পার্টির মোকাবিলা পূর্ণভাবে করতে না পারলেও সেই কলঙ্ক লেপে যাবে মোদির ভাবমূর্তিতে। ক্ষমতা লাভের পর এত দ্রুত কালিমালিপ্ত হতে কে-ই বা চান? হয় নতুন ভোট, নয় বিকল্প সরকার, নতুবা রাষ্ট্রপতির শাসন অব্যাহত রেখে দেওয়া, দিল্লির ক্ষেত্রে তিনটি বিকল্পই এখনো খোলা রাখছে বিজেপি। কিন্তু ভোট ছাড়া হয়তো অন্য গতি তাদের নেই। সেই সিদ্ধান্তে আসার আগে বিজেপি আটঘাট বেঁধে রাখতে চাইছে। দিল্লি দখল বড় বালাই।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments