যত অত্যাচার তত লড়াই by সাযযাদ কাদির
উদার গণতান্ত্রিক সমাজকল্যাণ রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ- এই স্বপ্ন ছিল আমাদের। এ
স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম মওলানা ভাসানীর ‘আসসালামু আলাইকুম’ ঘোষণার
অর্থ ও তাৎপর্য সার্বিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম করার পর থেকে। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা
আন্দোলন শুরু হতেই বুঝেছিলাম সে স্বপ্ন সত্যি হতে বেশি বাকি নেই আর।
মুক্তিযুদ্ধকালে, বধ্যশিবির-উত্তর উদ্যত সঙ্গীনের নিচে ক্ষতাক্ত জীবনে ওই
স্বপ্নই ছিল একমাত্র সান্ত¡না।
কিন্তু হায়! স্বাধীনতার পর সে উদারতার চেতনা
হারিয়ে গেল দলীয়করণ আর দলবাজিতে। পরের কল্যাণের কথা বলে নিজ নিজ কল্যাণ
সাধনের নাম হলো দেশ জাতি সমাজের কল্যাণ। গণতন্ত্রের ভিত যে অবাধ, স্বচ্ছ,
জবাবদিহি নির্বাচন তার ধ্বংসপ্রক্রিয়া শুরু হলো ’৭৩-এ। গণমুখী প্রশাসন দেখা
দিলো কর্তৃত্ববাদী মূর্তিতে, সরকার হলো একব্যক্তিক। এই প্রক্রিয়া
জিয়া-এরশাদ পর্বে হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে, বছর পনেরো’র বিরতিতে জিরিয়ে নিয়ে, ৫ই
জানুয়ারির পূর্বাপর পটভূমি-প্রেক্ষাপটে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো বলা যায়।
আমাদের চোখে মুখে মনে তাই সেই স্বপ্নের কোনও অবশেষ নেই আর, আমরা এখন
দাঁড়িয়ে আছি এক কঠিন বাস্তবে। দেশ জাতি জনগণের জন্য আজ সত্য কেবল সংগ্রাম। এ
অবস্থায় বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি। সংসদে
যে বিরোধী দল তা এক ‘অস্বাভাবিক’ বিরোধী দল। বাইরে যে বিরোধী দল তা-ও কি এক
স্বাভাবিক দল? পাঁচ বছর পর নির্বাচন এলেই কেবল দেখা যায় তাঁদের তোড়জোড়।
বিপদে আপদে জনগণের পাশে দাঁড়ায় না, জনগণের পক্ষে কথা বলতে সংসদে ঠিকমতো যায়
না, কার্যকর কর্মসূচি নেয় না, সামাজিক অন্যায় অনিয়ম অব্যবস্থা কোনও কিছুর
বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখে না। সরকারে থেকেও নিজেদের অযোগ্যতাই দেখিয়েছে
সর্বক্ষেত্রে। যাহোক তাঁদের আন্দোলন ও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন নিয়ে
অনেক কথা শোনা গেছে পক্ষে ও বিপক্ষে। তবে শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনের
মাধ্যমে সরকারি মহল প্রমাণ করে দিয়েছে- তাঁদের বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিকই
ছিল। অনেকে আরও একটি কথা বলছেন, এভাবে নাকি তাঁদের দল গোছানোর কাজটিও হয়ে
গেছে অনেকখানি। আমার অবশ্য যথেষ্ট সন্দেহ আছে এতে। কারণ সরকার পক্ষের হাতে
যে ভাবে আচ্ছামতো উত্তম মধ্যম খেতে হচ্ছে নিত্যদিন তাতে ওই দল/জোটের মধ্যে
আর কোনও কোন্দল বাকি থাকার কথা ছিল না আর, যথেষ্ট শিক্ষা পাওয়ারই কথা।
কিন্তু তা আক্কেল তাঁদের কিছুই হয় নি এখনও। নির্বাচনে বিদ্র্রোহী প্রার্থীর
আধিক্য, জোটে মতানৈক্য ইত্যাদি অনেক সমস্যায় জেরবার তাঁরা। এ জন্য আরও
ঘোরতর দুর্ভোগ যে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে আছে তাতে অন্তত আমার মনে সন্দেহ
নেই কোনও। সদ্য সফর করে যাওয়া বৃটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক
প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকান ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘অস্বাভাবিক’ বললেও
‘অবৈধ’ বলতে চান নি। তাঁর অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহলের এমন ব্যাখ্যার
নিহিতার্থ অনেক। যাঁরা নির্বাচনকে ‘অবৈধ’ গণ্য করে সংসদ, সরকার সব কিছুকে
অবৈধ ঘোষণা করে বর্জনের কথা বলছেন তাঁরা এক অর্থে এই সমাসীন সরকারকেই
সমর্থন করছেন। কারণ বর্জনে তেমন কিছু আসবে যাবে না সরকারি মহলের। যে বর্জন
৫ই জানুয়ারির জন্য হয়তো সত্য ছিল তা আজকের জন্যও সত্য হবে এমন মনে করার
কোনও কারণ নেই। কারণ বিরোধীদের জন্য এখনকার সত্য সংগ্রাম। সার্বিক সংগ্রাম।
সরকারকে প্রতিটি ক্ষেত্রে মোকাবিলা করার সংগ্রাম। এ জন্য উপনির্বাচন,
উপজেলা নির্বাচন- সকল শক্তি পরীক্ষাতেই মুখোমুখি হওয়ার কথা বিরোধীদের।
অনেকে নিন্দামন্দ করছেন- কিন্তু উপনির্বাচনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী
বীরউত্তমের শামিল হওয়ার চেষ্টা, উপজেলা নির্বাচনে ১৬ দলীয় জোট ও অন্যান্য
বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সর্বোতভাবে সঠিক। মনে রাখতে হবে, সংগ্রাম কখনও আংশিক
হয় না। এটা হতে হয় সর্বস্তরীণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে মোকাবিলা করতে হয় অর্থাৎ
কোনও ক্ষেত্রেই ছাড় দেয়া চলে না। কারণ ‘যত বেশি অত্যাচার তত বেশি লড়াই।’
তবে আমাদের বিরোধী দল/ জোটের ওপর যত বেদম দমন-নির্যাতন হতে দেখিÑ এর
প্রতিক্রিয়ায় তাঁদের তত সুতীক্ষè চিত্তে সুতীব্র লড়াই করতে দেখি না।
No comments