কত কী দেখলাম!
প্রথম চীনা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। ১৯৭৭-৭৮ সালের কথা। তখন আমি পড়ি ক্লাস সেভেন কি এইটে। খুব শুকনা-পটকা ছিলাম। কিন্তু মাথাটা ছিল বড়। এ জন্য অনেকেই আমাকে ডাকত কাতলা মাছ বলে। নরকঙ্কালের মতো শরীরটা থাকার ফলে একটা কাজ পাওয়া গেল। আমার বড় ভাই পড়তেন মেডিকেল কলেজে। তিনি আমাকে খালি গায়ে দাঁড় করিয়ে রেখে আমার বুকের হাড্ডিগুলোতে পেনসিল দিয়ে দাগ দিতেন আর পড়া মুখস্থ করতেন। শর্ত হলো, পরীক্ষা শেষে তিনি আমাকে চায়নিজ খাওয়াবেন। তখন রংপুরে সবে একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্ট হয়েছে। বলাকা হোটেলের নিচে। তো চায়নিজ খেতে দুই ভাইয়ের কেউই কখনো যাইনি। ভাই মেনুটা পড়ে একটা খাবারের অর্ডার দিলেন। সেটা ছিল সবজি। আমাদের সামনে একটা বাটিতে ভাতের মাড় দেওয়া কতগুলো পেঁপে সেদ্ধ এল। আমরা দুই ভাই কাঁটা চামচ ব্যবহার করে সেই জিনিস খেলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম, চায়নিজ অত্যন্ত বিস্বাদ।প্রথম কোমল পানীয় খাওয়ার গল্পটা বলি। ক্লাস নাইনে পড়ি। রংপুর জিলা স্কুলের নাইনের ছাত্ররা ঠিক করলাম পিকনিকে যাব। তিস্তা নদীর ধারে। আমাদের বড়লোক বন্ধু রাজদের ট্রাক আছে, সেটায় চড়ে আমরা তিস্তা নদীর ধারে বাঁধের ওপরে একটা শিমুলগাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু খাবারের মেনুতে আছে সেভেনআপ। আমি আর আমার তখনকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্বপনের মধ্যে কথা হচ্ছে:
‘দোস্ত, এইটা তো কোনো দিন খাই নাই? কেমন লাগে খাইতে?’
‘আমিও তো খাই নাই। কেমনে যে খাইতে হয়, জানিও না তো!’
‘কী করবি?’
‘অরা তো মনে হয় আগে খাইছে। অরা খাক। ওদের দেখে দেখে খাব।’ ওরা সেভেনআপের বোতল খুলে পাইপ দিয়ে খাওয়া শুরু করল। আমরাও দুজনে ভয়ে ভয়ে দুটো সেভেনআপের বোতল হাতে নিলাম। দুপুরের রোদে বোতল গরম হয়ে আছে। সেই জিনিস মুখে দিতেই ঝাঁজ... তারপর উদ্গার... রংপুর শহরে লিফট এসেছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। লিফট কী, দেখতে যাব। বন্ধুরা মিলে সাইকেল চালিয়ে একদিন গেলাম লিফট দেখতে। রংপুর শহরে টেলিভিশন এসেছে। সেটা দেখতে কার বাসায় গিয়েছিলাম মনে নেই। তবে মোহাম্মদ আলী ক্লের শেষ লড়াইটা দেখতে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো আর আমরা আমাদের বন্ধু ভিকটোর রাধাবল্লভের বাড়ি গেলাম। কারণ, তার বাসায় টেলিভিশন আছে। পরের দিন মোস্তাফিজুর স্যার বললেন, ‘এহ, একেবারে গো-হারা হারছে!’ ঢাকা শহরে মোবাইল ফোন এল। প্রথমে তো বড় বড় সেট, শুধু অতি বড়লোকেরা ব্যবহার করেন। ফোন করলে তাঁরাও বিল ওঠার ভয়ে কেটে দেন। তারপরে এল গ্রামীণফোন। আমিও একটা কিনে ফেললাম। কারণ, বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল না। ইয়া বড় সেট। সেটা নিয়ে রাস্তায় নামলে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা যেত। কারণ, লোকে ভাবত ওয়াকিটকি হাতে পুলিশের লোক। আমার মনে আছে, আমাদের বন্ধু লেখক-সাংবাদিক প্রভাষ আমিন আর আমি এক রিকশায় যাচ্ছি, সম্ভবত আমিনুর রশীদও ছিলেন। প্রভাষ চূড়ায় বসে বললেন, আপনার মোবাইল ফোনটা দেন তো, ভাব নিই। তিনি কানে মোবাইলটা ধরে অকারণে কথা বলার ভান করতে লাগলেন। কিছুদিন পরে হানিফ সংকেত ইত্যাদিতে দেখালেন, মুরগিওয়ালা মোবাইল ফোনে কথা বলছে। দেখে আমাদের হাসি আর থামে না। এখন? মুরগিওয়ালার বাড়িতে অন্তত তিনটা মোবাইল ফোন আছে। ঢাকা শহরে কারও কারও বাড়িতে কম্পিউটার রাখা শুরু হলো। তখন আমরা কাজ করি ভোরের কাগজ-এ। তার মানে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি। পত্রিকা অফিসে কম্পিউটার আগেই এসে গেছে। কিন্তু বাড়িতে লোকে কম্পিউটার রাখে কী কাজে?
‘দোস্ত, এইটা তো কোনো দিন খাই নাই? কেমন লাগে খাইতে?’
‘আমিও তো খাই নাই। কেমনে যে খাইতে হয়, জানিও না তো!’
‘কী করবি?’
‘অরা তো মনে হয় আগে খাইছে। অরা খাক। ওদের দেখে দেখে খাব।’ ওরা সেভেনআপের বোতল খুলে পাইপ দিয়ে খাওয়া শুরু করল। আমরাও দুজনে ভয়ে ভয়ে দুটো সেভেনআপের বোতল হাতে নিলাম। দুপুরের রোদে বোতল গরম হয়ে আছে। সেই জিনিস মুখে দিতেই ঝাঁজ... তারপর উদ্গার... রংপুর শহরে লিফট এসেছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। লিফট কী, দেখতে যাব। বন্ধুরা মিলে সাইকেল চালিয়ে একদিন গেলাম লিফট দেখতে। রংপুর শহরে টেলিভিশন এসেছে। সেটা দেখতে কার বাসায় গিয়েছিলাম মনে নেই। তবে মোহাম্মদ আলী ক্লের শেষ লড়াইটা দেখতে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো আর আমরা আমাদের বন্ধু ভিকটোর রাধাবল্লভের বাড়ি গেলাম। কারণ, তার বাসায় টেলিভিশন আছে। পরের দিন মোস্তাফিজুর স্যার বললেন, ‘এহ, একেবারে গো-হারা হারছে!’ ঢাকা শহরে মোবাইল ফোন এল। প্রথমে তো বড় বড় সেট, শুধু অতি বড়লোকেরা ব্যবহার করেন। ফোন করলে তাঁরাও বিল ওঠার ভয়ে কেটে দেন। তারপরে এল গ্রামীণফোন। আমিও একটা কিনে ফেললাম। কারণ, বাসায় ল্যান্ডফোন ছিল না। ইয়া বড় সেট। সেটা নিয়ে রাস্তায় নামলে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা যেত। কারণ, লোকে ভাবত ওয়াকিটকি হাতে পুলিশের লোক। আমার মনে আছে, আমাদের বন্ধু লেখক-সাংবাদিক প্রভাষ আমিন আর আমি এক রিকশায় যাচ্ছি, সম্ভবত আমিনুর রশীদও ছিলেন। প্রভাষ চূড়ায় বসে বললেন, আপনার মোবাইল ফোনটা দেন তো, ভাব নিই। তিনি কানে মোবাইলটা ধরে অকারণে কথা বলার ভান করতে লাগলেন। কিছুদিন পরে হানিফ সংকেত ইত্যাদিতে দেখালেন, মুরগিওয়ালা মোবাইল ফোনে কথা বলছে। দেখে আমাদের হাসি আর থামে না। এখন? মুরগিওয়ালার বাড়িতে অন্তত তিনটা মোবাইল ফোন আছে। ঢাকা শহরে কারও কারও বাড়িতে কম্পিউটার রাখা শুরু হলো। তখন আমরা কাজ করি ভোরের কাগজ-এ। তার মানে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি। পত্রিকা অফিসে কম্পিউটার আগেই এসে গেছে। কিন্তু বাড়িতে লোকে কম্পিউটার রাখে কী কাজে?
এটা নতুন ট্রেন্ড। আমাদের পরিচিতদের মধ্যে আসফিয়া আজিমের বাসায় পিসি আছে। আমি বললাম, এটা নিয়ে একটা ফিচার লিখতে হবে। বাসায় পিসি রেখে লোকে কী করে? আগে বের হতো ক্যাসেট। গানের অ্যালবামের ক্যাসেট। এখন বের হয় সিডি। ভোরের কাগজ-এর বেনজীর আহমেদ আমাদের বললেন, সিডির নিউজ দিতে হবে। সিডির নিউজ দেওয়া শুরু হলো। তারপর একদিন খবর এল, দেশের প্রথম ডিভিডি বের হয়েছে কুমার বিশ্বজিতের। আমেরিকায়। আমাদের দুশ্চিন্তা, ডিভিডি প্লেয়ার তো কারও নেই। কুমার বিশ্বজিতের ডিভিডি চালানো হবে কোন যন্ত্রে। তারও আগে সত্তরের দশকের শেষে আর আশির দশকের চল ছিল ভিসিআরের। ভিসিআরে লোকে হিন্দি ছবি দেখত। হাওয়া হাওয়া গানটা বা আই এম এ ডিস্কো ড্যান্সার লোকের মুখে মুখে ফিরত। বিয়ের অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হতো আর সেটার ক্যাসেট সংরক্ষণ করা হতো। মাঝেমধ্যে ভিসিআরে সেটা চালিয়ে দেখা হতো। ভিসিআর সস্তা হয়ে এল ভিসিডি। এখন তিন হাজার টাকায় ডিভিডি প্লেয়ার পাওয়া যায়। পিসি, ল্যাপটপ, ট্যাব, স্মার্ট ফোন। লোকে কৌতুক করে, পাত্র স্মার্ট, এটা কোনো যোগ্যতা হলো? আমার ফোনই তো স্মার্ট। শেষে আরেকটা সত্য ঘটনা বলি। হংকংয়ে গৃহপরিচারিকার চাকরি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এক বন্ধু তার পরিচারিকাকে দিয়ে আবেদন করাল। আবেদন গৃহীত হলো। মেয়েটি চাকরি নিয়ে এখন হংকংয়ে। হংকং থেকে সে ফোন করেছে আমাদের বন্ধুটিকে, খালাম্মা, আপনার ফোনে ভাইবার নেন। ভাইবার নিলে ফোনে কথা বলতে পয়সা লাগে না! বাংলাদেশ যে কত দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। তথ্যাভিজ্ঞ মহল বলছে, বাংলাদেশের মানুষ মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও এগিয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা এই প্রযুক্তিকে ভালো কাজে, ইতিবাচক কাজে, নিজের ও দেশের উন্নতির জন্য ব্যবহার করব কি না!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments