কন্যাশিশু এবং কিছু অভিজ্ঞতা by আদনান সৈয়দ

আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রে। ছুটিছাঁটায় সময়-সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে চলে আসি। তবে এবার বাংলাদেশে আসার সময় আমার অনুভূতি ছিল একটু ভিন্ন। আমার স্ত্রী বাংলাদেশে, তিনি সন্তানসম্ভবা। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! আর বাবা হওয়ার আনন্দটা সত্যিই কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়?

বাংলাদেশে এসে আর ১০টা স্বামীর মতো আমিও স্ত্রীর দেখভালে লেগে গেলাম। স্ত্রীর বিভিন্নরকম শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকার রাস্তার আশপাশে নামীদামি ক্লিনিক, চিকিৎসকের চেম্বার, হাসপাতাল চষে বেড়াতে লাগলাম। এ কাজ করে আনন্দ পাচ্ছিলাম। কিন্তু এ আনন্দযজ্ঞে অংশ নিতে গিয়ে আমাকে বিভিন্ন পর্বে কিছু উটকো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ লেখার বিষয়বস্তু আমার সেই অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতাগুলোকে কেন্দ্র করেই।

ঘটনা-১
বাড়ির মা-খালা, চাচা-ফুফু থেকে শুরু করে সবার মধ্যেই একধরনের চাপা অজানা উত্তেজনা কাজ করছে। আসন্ন শিশুটির লিঙ্গ কী? মেয়ে নাকি ছেলে? সত্যি বলতে আমার মাঝেও সে রকম একটা কৌতূহল ছিল বৈকি। কারণ, শিশুটির লিঙ্গ জানা থাকলে আমার আগাম কেনাকাটা অনেক সহজ হয়। ধরা যাক কন্যাসন্তান হলে তার জন্য এক রকম রঙের জামাকাপড় আবার পুত্র হলে অন্য রকম। এসব আরকি। তবে সব মিলিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল সন্তানের লিঙ্গ যা-ই হোক না কেন, সে যেন শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকে।
যথারীতি ঢাকার এক নামকরা ক্লিনিকে স্ত্রীর আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হলো এবং নির্দিষ্ট একটি দিনে আমরা রিপোর্টও আনতে গেলাম। প্রথম দিনই হোঁচট খেলাম। চিকিৎসক রিপোর্টে আসা সন্তানের লিঙ্গ ঘোষণা দেবেন। আমি আর আমার স্ত্রী খুব কৌতূহল নিয়ে চিকিৎসকের দিকে তাকিয়ে আছি। না, চিকিৎসক সন্তানের লিঙ্গ নিয়ে প্রথমেই কোনো কথা বলতে চাইলেন না। বরং তিনি আমার স্ত্রীকে একধরনের মানসিক সান্ত্বনা দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। তাঁর বক্তব্যটা ছিল অনেকটা এই রকম ‘একদম মন খারাপ করবেন না। সন্তান মেয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। দেখবেন, সে-ও ঠিক একটা ছেলের মতোই এই জগৎ সংসারে তার জায়গা তৈরি করে নেবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।’
আমি একজন উচ্চশিক্ষিত নামীদামি প্রসূতিবিশেষজ্ঞের মুখে এ ধরনের কথায় সত্যি ভড়কে গেলাম। চিকিৎসক বলেন কী? বারবার কানে তাঁর কথাটা ধাক্কা খাচ্ছিল, ‘মেয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে?’ ততক্ষণে আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের দেশে একটি শিশু জন্ম হতে না হতেই কীভাবে ‘লিঙ্গবৈষম্যের’ শিকার হয়ে যায়। অবশ্য পরে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে এটি নাকি আমাদের দেশে খুব সাধারণ একটি চিত্র। আমাদের সমাজবাস্তবতার কথা ভেবে অনেক চিকিৎসকই মনে করেন, কন্যাশিশু হলে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সবাই খুব একটা খুশি হতে পারেন না। তাই তাঁরা সন্তানের মা-বাবাদের এ ধরনের ‘অগ্রিম পরামর্শ’ দিয়ে থাকেন।

ঘটনা-২
১০ মার্চ রাত ১১টা। জগতের সব আনন্দ আর ভালোবাসাকে সঙ্গী করে এই পৃথিবীতে চলে এল আমাদের শিশুকন্যাটি। ঝটপট তার একটা নাম দিয়ে দিলাম। ‘চারুলতা’। চিকিৎসক আমাকে নিশ্চিত করলেন চারুলতা শারীরিকভাবে বেশ সুস্থ আছে। সন্তান শারীরিকভাবে সুস্থ আছে কথাটা শুনে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ‘শুকরিয়া’ আদায় করলাম। ঢাকার স্বনামধন্য একটি ক্লিনিকে চারুলতা আর তার মায়ের আশ্রয় হলো। যথারীতি আত্মীস্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই চারুলতা আর তার মাকে দেখতে আসতে শুরু করলেন।
এবার হোঁচট খেলাম দ্বিতীয় পর্বে। আত্মীয়স্বজন কেউ কেউ বলেই ফেললেন, ‘প্রথম বাচ্চা মেয়ে হয়েছে দোষের কিছু না। পরেরটা ছেলে হলেই চলবে। আর বংশের প্রদীপ তো রক্ষা করে ছেলেরাই, নাকি?’ বলে কী? এ ধরনের কথা শুনে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যায় আরকি! এবার সত্যি সত্যি আরও ভীত হয়ে পড়লাম। বিষয়টা যেন এমন যে সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে, তা বুঝি বাবা-মায়ের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে। আর তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কন্যাশিশু তো আর বংশের প্রদীপ জ্বালতে পারবে না? মনে পড়ল বিখ্যাত ফরাসি নারীবাদী লেখক সিমন দ্য বোভোয়ার কথা। ‘নারী হয়ে জন্ম নিলেই নারী হওয়া যায় না, তাকে ধীরে ধীরে নারী হতে হয়।’
এসব কথা ভাবছিলাম কয়েক দিন ধরে। ২০০ বছর আগে আমাদের বঙ্গীয় নারীদের অবস্থা তাহলে কেমন ছিল? সন্দেহ নেই চিন্তায়, মননে, শিক্ষায়, পোশাকে, সামাজিকতায় আমাদের বাঙালি নারীরা আজ অনেক পথ হেঁটে এসেছে। তার পরও প্রশ্ন জাগে। এই যুগে এসে নারীরা সত্যি কি সমাজের কুটিল থাবা থেকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের মু্ক্ত করতে পেরেছে? আমার সদ্য আগত কন্যাশিশু চারুলতা যেন সে কথাটিই আমার কানের কাছে বারবার ফিসফিস করে বলতে চাইছে।
adnansyed1@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.