নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা- উপসর্গ নয়, রোগের চিকিৎসা জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার
২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী
তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত সপ্তাহ তিনেক চলমান সহিংসতায় শতাধিক ব্যক্তির
প্রাণহানি ঘটেছে। অসংখ্য ব্যক্তি আহত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার
সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে বাংলাদেশে সহিংসতার ‘জিনি’ বোতল থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং পুরো জাতিকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে।
সংঘাত এড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে আগে থেকেই বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি এবং তাদের কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এমনকি সহিংসতা প্রতিরোধে ঠুনকো অজুহাতে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সহিংসতা দমনে মাঠে নামানো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবস্থার উন্নতি ঘটছে না, বরং মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ সহিংসতা দমনে সরকার সফলতা প্রদর্শন করতে পারছে না।
জ্বর হলে চিকিৎসক রোগীকে প্যারাসিটামল খেতে এবং প্রচুর পানীয় পান করতে বলেন। তাতে নিরাময় না হলে জ্বরকে উপসর্গ হিসেবে ধরে নিয়ে চিকিৎসক এর কারণ অনুসন্ধান করেন। রোগীকে বিভিন্ন ধরনের ‘টেস্ট’ দেন। তিনি নিশ্চিত হতে চান: রোগের কারণ কি টাইফয়েড? ম্যালেরিয়া? না অন্য কিছু? রোগের কারণ নির্ধারণের পরই রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দেন চিকিৎসক। একাধিক রোগের কারণে রোগী অসুস্থ হলে, প্রতিটি রোগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ দেওয়া হয়। এটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এর মাধ্যমেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটেছে।
এটি সুস্পষ্ট যে সন্ত্রাস নির্মূল করাই জাতি হিসেবে আজ আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আজ চিকিৎসকদের মতো আমাদেরও চলমান সহিংসতার পেছনের কারণ অনুসন্ধানে উদ্যোগী হতে এবং উপসর্গের পরিবর্তে রোগের চিকিৎসায় নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। তাহলেই আমরা সহিংসতার দানবকে বধ করতে পারব; তা না হলে এটিই আমাদের গ্রাস করে ফেলতে পারে এবং আমরা একটি উগ্রবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারি। কারণ, অস্থিতিশীল, সহিংস পরিবেশই উগ্রবাদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
আমরা মনে করি যে বাংলাদেশের বিরাজমান সংকট ও সহিংসতার পেছনে কারণ মূলত দুটি: ১. নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যকার চলমান বিরোধ; এবং ২. যুদ্ধাপরাধের বিচার ভন্ডুল ও বিচারে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বাঁচানোর লক্ষ্যে জামায়াত-শিবিরের মরণপণ চেষ্টা।
প্রায় পৌনে তিন বছর আগে মহাজোটের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে যে একটি বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হবে, তা আঁচ করতে পেরেছিলেন এবং এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার জন্য তাঁরা সুপারিশও করেছিলেন।
অনেকেরই স্মরণ আছে যে ২১ জুলাই ২০১০ সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি সংসদীয় ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ১২ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের এবং অন্য তিনজন মহাজোটের অন্য শরিক দলের।
২৯ মার্চ ২০১১ অনুষ্ঠিত ১৪তম বৈঠকে কমিটি নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করে এবং ‘বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখার বিষয়ে বৈঠকে ঐকমত্য হয়’ (বৈঠকের কার্যবিবরণী)। বৈঠকে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘মীমাংসিত বিষয়কে অমীমাংসিত করা ঠিক হবে না...তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেজর কোনো কিছুতে হাত দেওয়া আমাদের কোনোমতেই উচিত হবে না।’ একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেন কমিটির অন্য সদস্যরা, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ।
ওই বৈঠকে আমির হোসেন আমু আশঙ্কা প্রকাশ করেন: ‘আসলে এটা যদি আমরা পরিবর্তন করতে যাই, তাহলে অনেক জটিলতা বাড়বে, অনেক ঝামেলায় আমরা জড়িয়ে পড়ব। তার চেয়ে এটাই ভালো, যেভাবে আছে, সেভাবে থাক।’
আইনজীবী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন: ‘আমাদের হাত দিয়ে এ বিষয়টি ওপেন করা ঠিক হবে না...এটা নিয়ে গন্ডগোল হবে। যখন গন্ডগোল হবে, তখন সব দায়িত্বটি আমাদের কাঁধে এসে পড়বে।’
আবদুল মতিন খসরু সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন: ‘আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ব্যবস্থা আছে, এটিই থাকুক। এর মধ্যে আমাদের হাত দেওয়া ঠিক হবে না। এতে জটিলতা আরও বাড়বে। বিরোধী দলকে আমরা অনেকটা সুযোগ করে দেব কথা বলার জন্য; আমাদের ঘায়েল করার জন্য।’
এটি সুস্পষ্ট যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে যে জটিলতা সৃষ্টি হবে, আগে থেকেই সে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন আমাদের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদেরা। তাই, ১০ মে ২০১১ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে প্রদত্ত বিভক্ত (৪-৩), সংক্ষিপ্ত আদেশের পরও বিশেষ কমিটি সামান্য পরিবর্তনসহ এটি অব্যাহত রাখার পক্ষে ২৯ মে ২০১১ সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করে। এর পরদিন, ৩০ মে, কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে অবশ্য সিদ্ধান্তটি পাল্টে যায়। তাই এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত, যার মাশুল আজ পুরো জাতিকে গুনতে হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াত-শিবির যে মারমুখী আচরণ করবে, তা-ও সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার পক্ষে বাংলাদেশে ব্যাপক জনমত বিরাজ করছে। বস্তুত এ ব্যাপারে পুরো জাতি প্রায় এককাট্টা। তাই এককভাবে এই ইস্যুতে আন্দোলন করে স্বার্থসংশ্লিষ্টরা সফল হতো না। বরং কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে জনগণই দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নির্বাচনকালীন সরকারসংক্রান্ত রাজনৈতিক ইস্যুটি বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে তথা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করে ক্ষমতাসীন মহাজোট অর্বাচীনভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে, যদিও এটি স্থায়ী সমাধান নয়। ফলে দুটি ইস্যু—তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার ভন্ডুলের দাবি—একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। যেহেতু আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার অভিপ্রায়ের অংশ হিসেবে পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করার অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তাই বিএনপিকে ধিক্কৃত করার লক্ষ্যেই সরকার জেনেবুঝেই দুটি ইস্যুকে এক করে ফেলেছে।
তাই যখনই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে টুঁ-শব্দটিও করেছে, তখনই ক্ষমতাসীন মহাজোট ঢালাওভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর অভিযোগ তুলেছে। এতে অবশ্যই বিএনপি জামায়াতের দোসর হিসেবে চিহ্নিত ও বিতর্কিত হয়েছে। একই সঙ্গে এটা সরকারবিরোধী আন্দোলনকেও সহিংস করে তুলেছে।
প্রসঙ্গত, যুদ্ধাপরাধের বিচারসংক্রান্ত কাদের মোল্লার রায় বাস্তবায়ন মহাজোট সরকারের অন্যতম সাফল্য। এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের প্রতিবাদ এবং দেশটির সংসদে নেওয়া প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয়। আর জাতির ইতিহাসের এ কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি টানার লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গে এ বিচার সম্পন্ন করা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া আবশ্যক। তাই বিএনপির কাছ থেকেও এ ব্যাপারে আমরা সুস্পষ্ট অঙ্গীকার দাবি করি।
আমাদের ধারণা যে চলমান সহিংসতার মুখে ক্ষমতাসীনেরা আরেকটি ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে—তারা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সহিংসতা দমনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণেরও উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ম্যালেরিয়ার ওষুধ দিয়ে যেমন টাইফয়েডের নিরাময় করা যায় না, তেমনিভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানও সম্ভব নয়, যদিও সহিংসতা দমনে তা করা অপরিহার্য। অন্যভাবে বলতে গেলে, ভিন্ন রোগের জন্য ভিন্ন ওষুধ না দিয়ে সব রোগের চিকিৎসা একই ওষুধ দিয়ে করতে গেলে যেমন রোগীরই মৃত্যু ঘটতে পারে, তেমনিভাবে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার-সম্পর্কিত বিরোধ মীমাংসার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আর এ ব্যর্থতা জাতি হিসেবে আমাদের এক চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই সংলাপের মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান তথা সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments