৭২-এ পাওয়া আর ১৫৪-তে যাওয়া by একে এম শাহ নাওয়াজ
মনে পড়ে ক্লাস এইটে স্কুলে বাংলার শিক্ষক
‘বাহাত্তরে পাওয়া’ বাগধারাটির অর্থ বলতে বলেছিলেন। আমি পারিনি। পরে স্যার
বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এর অর্থ বুদ্ধিনাশ হওয়া। এতকাল পর বাগধারাটির তাৎপর্য এখন
হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। বিএনপির বাহাত্তরে পাওয়া দশা দেখে এখন উদাহরণসহ
বাগধারাটির ব্যাখ্যা করতে পারব। সপ্তাহে একটু-আধটু বিরতি দিয়ে দিনের পর দিন
হরতাল-অবরোধ ডেকে বিএনপি এখন গিনিস বুকে নিজ দলের নাম উঠাতে চাইছে।
নেতা-নেত্রীদের বড় অংশই আত্মগোপনে আর বাকিদের অনেকে সরকারের কৃপায় জেলখানার
চার দেয়ালের ভেতর অবসর কাটাচ্ছেন। অজ্ঞাত স্থান বা গুলশানের অফিস থেকে
জনগণের ওপর অবরোধ নামের মৃত্যুবাণ ছুড়ে মারছেন। আর তা দেশময় মানুষের কাছে
অতি যতেœ পৌঁছে দিচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। অতঃপর পরদিন তা
পল্লবিত করছে প্রিন্ট মিডিয়া। আর এসবে আতংকিত হয়ে মানুষ অবরোধের আগুনে
পুড়ছে। বিএনপি নেতারা জানেন, এসব অবরোধ সাধারণ মানুষের জীবন সংহারী আর
অর্থনীতি ধ্বংসকারী। ফলে তাদের তথাকথিত আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হবে
না। তাই অবরোধ সফল করার জন্য প্রয়োজন জনমনে আতংক সৃষ্টি করা। এ কাজে
জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসীরাই প্রধান দায়িত্ব পালন করে থাকে। পেছনের সারিতে
উপস্থিত থাকে বিএনপির অঙ্গ দলগুলোর জিহাদিরা। সম্প্রতি বিএনপি নির্দলীয়
নির্বাচনী সরকারের দাবির বাস্তবতা তামাদি হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের
তফসিল বাতিল করা বা আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে অথবা যেনতেন ইস্যু তৈরি করে
প্রায়ই ৭২ ঘণ্টাব্যাপী অবরোধ ডাকছে। এভাবে বিএনপি নেতা-নেত্রীদের ৭২-এ
পেয়ে বসল যেন। অবরোধ ডাকায় বিএনপি নেতাদের কোনো আলস্য নেই। লজ্জা, সংকোচও
নেই। পঞ্চমবারের মতো আবার অবরোধের ডাক এসেছে। মাঝখানে বড়দিন পড়ে যাওয়াতে
পুরো সপ্তাহ টানতে পারেনি। বড়দিনের জন্য এইটুকু ক্ষমা যে মানবিক নয়,
দায়সারা তা বুঝতে বেশি বিদ্যার প্রয়োজন হয় না। কারণ জামায়াত আশ্রিত বিএনপির
জন্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি মানবিক হয়ে যাওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে
যেত। না হলে তো সাধারণভাবেই বোঝা উচিত, খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব
এ ২৫ ডিসেম্বর। উৎসবের জন্য অনেক প্রস্তুতি রয়েছে। কেনাকাটা আছে। আছে
জনসংযোগের প্রয়োজন। কিন্তু দেশবাসীর সঙ্গে খ্রিস্টান সম্প্রদায়কেও বন্দি
করে রাখা হল ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ কারণে ২৫ ডিসেম্বর ছাড় দেয়াটা উপহাসেরই
নামান্তর। বিএনপি ইচ্ছা করলে এখনও পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারে অবরোধ পুরো
সপ্তাহ পর্যন্ত টেনে দিতে পারে কিনা। তবে ৭২-এ পাওয়া থেকে বাঁচতে এবার ৮৩
ঘণ্টা করতে পেরে বিএনপি নেতা-নেত্রীরা নিশ্চয়ই কিছুটা স্বস্তিতে আছেন।
আমার ভাবনা এমন, ৭২-এ পাওয়া রাজনীতিকে ভবিষ্যতের ইতিহাস লেখক কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতিকরা জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতি করেন। রাজনৈতিক দল আন্দোলন-সংগ্রামে অবরোধ এবং হরতালের মতো অস্ত্রের ব্যবহার করে যখন এসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি বিকাশের বুকে পা রেখে, মানুষ খুন করে, শিক্ষা জীবনকে বিধ্বস্ত করে, শ্রমজীবী মানুষের পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে এ ধরনের আন্দোলনে মানুষকে সম্পৃক্ত করবে কেমন করে! এ কারণে প্রায় মাসব্যাপী অবরোধ-হরতালে বিপর্যস্ত করার পরও বিএনপির আন্দোলন কোনো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। নেতারাও মাঠে থাকছেন না, আবার সাধারণ মানুষকেও মাঠে টানা যাচ্ছে না। জামায়াত-শিবির, বিএনপির দলীয় সন্ত্রাসী ও ভাড়াটে অস্ত্রবাজদের পথে নামিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়ে সরকারকে দুর্বল করে লক্ষ্যে পৌঁছা কঠিন। আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিএনপির অতীত অবস্থান এমন ছিল না যে, সাধারণ মানুষ বিএনপির ডাকে জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ২০০৬ সালের আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার সন্ত্রাসের পেছনে সাধারণ মানুষ তবুও কিছুটা যুক্তি খুঁজে পেয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগের ঘরে ফসল উঠাতে অল্প কয়টি দিনের সহিংসতা আর অরাজকতাই যথেষ্ট ছিল। এত দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের সহিংসতা থেকে ফলাফল আশা করাটা কঠিন। আমাদের ধারণা আন্দোলনের মাঠে বিএনপিকে সত্যিই ৭২-এ পেয়েছে। আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতাই শুধু দেখাচ্ছে তারা। আর জামায়াত জঙ্গিদের ব্যবহার করতে গিয়ে জনগণের সামনে কলংকিত করছে নিজ দলকে। দলীয় কর্মীদের আÍশক্তির জায়গায় বড় এক ফাটল তৈরি করেছে। গোটা বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারত। প্রায় পাঁচ বছরের শাসন দুর্বলতায় দলটি খুব সবল অবস্থানে ছিল না। কিন্তু বিএনপির সংকীর্ণ ও একগুঁয়েমি আচরণ আওয়ামী লীগের পায়ের তলার মাটি অনেকটা শক্ত করে দেয়। এ অবস্থায় দলটি নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়ার নানা রকম ছক কাটতে থাকে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ দলীয় ঐতিহ্যের কথা বিবেচনায় না এনেই ক্ষমতায় টিকে থাকার উদগ্র বাসনা থেকে নানা গলি পথ খুঁজে নেয়। ১৫ ফেব্র“য়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করে বিএনপি নেতারা নিজ দলকে যেমন রাজনৈতিক ইতিহাসে কলংক উপহার দিয়েছিলেন, তেমনি যেন কলংকের ভারসাম্য তৈরি করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রার্থীবিহীন নির্বাচনে জেতার আনন্দে আপ্লুুত হতে চাইলেন। যেহেতু বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতা-নেত্রীরা হুংকার দিচ্ছিলেন দলীয় বা সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবেন না, তাই অত ঝুট-ঝামেলায় না গিয়ে দশম জাতীয় সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ার জন্য নির্বাচনের আগেই নিজ দলের ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। সংবিধানে ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের কথা বলা থাকলেও অতি জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সামনে কেউ এলেনই না। তাই ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়াই অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগ ও তাদের বন্ধু দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে গেলেন। বলাই বাহুল্য, এতে গণতন্ত্র একটি বড় রকমের হোঁচট খেল। আওয়ামী লীগের মতো দলের এমন বিতর্কিত অবস্থান কাম্য ছিল না। কার বা কাদের পাপে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদেরই মূল্যায়ন করতে হবে। মুখে যত কথাই বলুন না কেন, এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভেতর যে অন্তঃক্ষরণ হচ্ছে না তা নয়। যে কারণে ১৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে নির্বাচনের আয়োজন করা যাবে। নির্বাচন কমিশনও সময়মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি। তাই নিয়মের ফাঁদে পড়েই জগাখিচুড়ির নির্বাচন করতে হচ্ছে ৫ জানুয়ারি। এর মধ্যে এ ধারার ছেলেখেলা আর স্থূলতার নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা বলে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এমন নির্বাচনের দিকে স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক মহলের কোনো আগ্রহ নেই। আছে সমালোচনা ও তির্যক দৃষ্টি। দেশের ভেতরেও কি কোনো মহলের আগ্রহ আছে? আমাদের ধারণা, খোদ আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও আগ্রহে ভাটা পড়েছে। যা কিছু আগ্রহ থাকার তা আছে ১৮ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। তাদের এখন দৃষ্টি সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে ভোটকেন্দ্রে ভোটার শূন্যতা সৃষ্টি করা। আমরা মনে করি এরা কষ্ট না করলেও ফলাফল এ ধরনেরই হবে।
তবে এ ধরনের জেদাজেদির রাজনীতি, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার বা ক্ষমতাসীন হওয়ার রাজনীতি ক্রমে আরও বেশি ভঙ্গুর করে ফেলছে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যদি এর মধ্যে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হয় তবে নির্বাচনী খেলার পর নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। দশম সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসবেন রওশন এরশাদ। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়া অমন সংসদ দাঁড়াতেও পারবে না। হামাগুঁড়ি দিয়েও কি চলতে পারবে? নির্বাচনী রাজনীতিতে কৌশল হিসেবে একবার আওয়ামী লীগ গোলাম আযমের অনুকম্পা নিতে গিয়েছিল। সেই ক্ষতের খোঁচা এখনও বারবার বিক্ষত করছে আওয়ামী লীগকে। আর এবার যে গ্যাংগ্রিন হতে যাচ্ছে, তার পরিণতির কথা ভেবে মুক্তিযুদ্ধাত প্রগতিশীল মানুষ ভয়ানক অস্বস্তিতে আছে।
এ ধারার রাজনীতি হয়তো সাময়িক কিছু লাভ এনে দেবে দুই ক্ষমতা প্রত্যাশী দলকেই। তবে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ভয়ানক কালো মেঘ তৈরি করে দিচ্ছে আকাশে। বেড়ে ওঠা প্রজন্ম প্রণোদনার জন্য এখন রোল মডেল খুঁজে পাবে না। গত দুদিন আগে বিষয়টি আমাকে ভয়ানকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। আমার বাসা ক্যাম্পাসে স্কুলের পাশেই। হেঁটে স্কুলের পাশের রাস্তা অতিক্রম করছিলাম। স্কুল ড্রেস পরা কয়েকজন ছেলেমেয়ের জটলার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওদের কথা কানে আসছিল। অবরোধের কারণে বারবার পরীক্ষা পেছানো থেকেই সম্ভবত ওদের আলোচনা উৎসারিত হয়েছে। এখনও রেশ কাটেনি। বোঝা গেল ওরা বেশ বিক্ষুব্ধ। পরীক্ষা শেষে দেশের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হওয়ায় একজন ভীষণ রকম আহত। এ বয়সে বেমানান হলেও রাজনৈতিক আলোচনা ভর করেছে ওদের বক্তব্যে। হয়তো কিছুটা বুঝে আর কিছুটা বড়দের মুখে শুনে। এ কোমলমতি শিশুরা একপর্যায়ে অনেকটা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমাদের দুই নেত্রী সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল, তাতে আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়লাম। এর পরিণতির কথা ভেবে আতংকিত হলাম। প্রত্যেক জাতির প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গনের মডেল প্রয়োজন। যাদের দেখে, যাদের কথা শুনে উদ্দীপ্ত হবে প্রজন্ম। এগিয়ে যাওয়ার-জয় করার প্রণোদনা পাবে। নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, সব নিপীড়িত মানুষেরই মডেল। মালয়েশিয়ার শিশুরা মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে গর্ব করে-প্রত্যয়ী হয়। আমাদের মতো বয়সীরা সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু অথবা কেউ কেউ জিয়াউর রহমানকে রোল মডেল মনে করে প্রণোদনা খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু এ শিশু-কিশোর প্রজন্ম বড় দুর্ভাগা। তাদের সামনে গর্ব করার মতো কোনো মডেল নেই। আমাদের নষ্ট রাজনীতি তেমন মডেল তৈরি হতে দেয়নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় হতাশার আর কী হতে পারে! আমাদের মহান রাজনীতিকরা যদি দেশপ্রেমের চোখে দূরদৃষ্টিতে না তাকান, তাহলে এ অবস্থা থেকে আমাদের উদ্ধার করবে কে? এভাবে ৭২-এর পাওয়া আর ১৫৪-এ বৈতরণী পাড়ি দেয়া সংকীর্ণ রাজনীতিতেই যদি আমরা আটকে যাই, তবে জাতি হিসেবে আমরা পেছাতেই থাকব।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমার ভাবনা এমন, ৭২-এ পাওয়া রাজনীতিকে ভবিষ্যতের ইতিহাস লেখক কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতিকরা জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতি করেন। রাজনৈতিক দল আন্দোলন-সংগ্রামে অবরোধ এবং হরতালের মতো অস্ত্রের ব্যবহার করে যখন এসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি বিকাশের বুকে পা রেখে, মানুষ খুন করে, শিক্ষা জীবনকে বিধ্বস্ত করে, শ্রমজীবী মানুষের পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে এ ধরনের আন্দোলনে মানুষকে সম্পৃক্ত করবে কেমন করে! এ কারণে প্রায় মাসব্যাপী অবরোধ-হরতালে বিপর্যস্ত করার পরও বিএনপির আন্দোলন কোনো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। নেতারাও মাঠে থাকছেন না, আবার সাধারণ মানুষকেও মাঠে টানা যাচ্ছে না। জামায়াত-শিবির, বিএনপির দলীয় সন্ত্রাসী ও ভাড়াটে অস্ত্রবাজদের পথে নামিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়ে সরকারকে দুর্বল করে লক্ষ্যে পৌঁছা কঠিন। আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় বিএনপির অতীত অবস্থান এমন ছিল না যে, সাধারণ মানুষ বিএনপির ডাকে জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ২০০৬ সালের আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার সন্ত্রাসের পেছনে সাধারণ মানুষ তবুও কিছুটা যুক্তি খুঁজে পেয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগের ঘরে ফসল উঠাতে অল্প কয়টি দিনের সহিংসতা আর অরাজকতাই যথেষ্ট ছিল। এত দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের সহিংসতা থেকে ফলাফল আশা করাটা কঠিন। আমাদের ধারণা আন্দোলনের মাঠে বিএনপিকে সত্যিই ৭২-এ পেয়েছে। আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতাই শুধু দেখাচ্ছে তারা। আর জামায়াত জঙ্গিদের ব্যবহার করতে গিয়ে জনগণের সামনে কলংকিত করছে নিজ দলকে। দলীয় কর্মীদের আÍশক্তির জায়গায় বড় এক ফাটল তৈরি করেছে। গোটা বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারত। প্রায় পাঁচ বছরের শাসন দুর্বলতায় দলটি খুব সবল অবস্থানে ছিল না। কিন্তু বিএনপির সংকীর্ণ ও একগুঁয়েমি আচরণ আওয়ামী লীগের পায়ের তলার মাটি অনেকটা শক্ত করে দেয়। এ অবস্থায় দলটি নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়ার নানা রকম ছক কাটতে থাকে। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ দলীয় ঐতিহ্যের কথা বিবেচনায় না এনেই ক্ষমতায় টিকে থাকার উদগ্র বাসনা থেকে নানা গলি পথ খুঁজে নেয়। ১৫ ফেব্র“য়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করে বিএনপি নেতারা নিজ দলকে যেমন রাজনৈতিক ইতিহাসে কলংক উপহার দিয়েছিলেন, তেমনি যেন কলংকের ভারসাম্য তৈরি করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রার্থীবিহীন নির্বাচনে জেতার আনন্দে আপ্লুুত হতে চাইলেন। যেহেতু বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতা-নেত্রীরা হুংকার দিচ্ছিলেন দলীয় বা সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবেন না, তাই অত ঝুট-ঝামেলায় না গিয়ে দশম জাতীয় সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ার জন্য নির্বাচনের আগেই নিজ দলের ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। সংবিধানে ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের কথা বলা থাকলেও অতি জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সামনে কেউ এলেনই না। তাই ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়াই অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগ ও তাদের বন্ধু দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে গেলেন। বলাই বাহুল্য, এতে গণতন্ত্র একটি বড় রকমের হোঁচট খেল। আওয়ামী লীগের মতো দলের এমন বিতর্কিত অবস্থান কাম্য ছিল না। কার বা কাদের পাপে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদেরই মূল্যায়ন করতে হবে। মুখে যত কথাই বলুন না কেন, এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভেতর যে অন্তঃক্ষরণ হচ্ছে না তা নয়। যে কারণে ১৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে নির্বাচনের আয়োজন করা যাবে। নির্বাচন কমিশনও সময়মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি। তাই নিয়মের ফাঁদে পড়েই জগাখিচুড়ির নির্বাচন করতে হচ্ছে ৫ জানুয়ারি। এর মধ্যে এ ধারার ছেলেখেলা আর স্থূলতার নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা বলে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এমন নির্বাচনের দিকে স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক মহলের কোনো আগ্রহ নেই। আছে সমালোচনা ও তির্যক দৃষ্টি। দেশের ভেতরেও কি কোনো মহলের আগ্রহ আছে? আমাদের ধারণা, খোদ আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও আগ্রহে ভাটা পড়েছে। যা কিছু আগ্রহ থাকার তা আছে ১৮ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। তাদের এখন দৃষ্টি সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে ভোটকেন্দ্রে ভোটার শূন্যতা সৃষ্টি করা। আমরা মনে করি এরা কষ্ট না করলেও ফলাফল এ ধরনেরই হবে।
তবে এ ধরনের জেদাজেদির রাজনীতি, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার বা ক্ষমতাসীন হওয়ার রাজনীতি ক্রমে আরও বেশি ভঙ্গুর করে ফেলছে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যদি এর মধ্যে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না হয় তবে নির্বাচনী খেলার পর নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। দশম সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসবেন রওশন এরশাদ। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ ছাড়া অমন সংসদ দাঁড়াতেও পারবে না। হামাগুঁড়ি দিয়েও কি চলতে পারবে? নির্বাচনী রাজনীতিতে কৌশল হিসেবে একবার আওয়ামী লীগ গোলাম আযমের অনুকম্পা নিতে গিয়েছিল। সেই ক্ষতের খোঁচা এখনও বারবার বিক্ষত করছে আওয়ামী লীগকে। আর এবার যে গ্যাংগ্রিন হতে যাচ্ছে, তার পরিণতির কথা ভেবে মুক্তিযুদ্ধাত প্রগতিশীল মানুষ ভয়ানক অস্বস্তিতে আছে।
এ ধারার রাজনীতি হয়তো সাময়িক কিছু লাভ এনে দেবে দুই ক্ষমতা প্রত্যাশী দলকেই। তবে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য ভয়ানক কালো মেঘ তৈরি করে দিচ্ছে আকাশে। বেড়ে ওঠা প্রজন্ম প্রণোদনার জন্য এখন রোল মডেল খুঁজে পাবে না। গত দুদিন আগে বিষয়টি আমাকে ভয়ানকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। আমার বাসা ক্যাম্পাসে স্কুলের পাশেই। হেঁটে স্কুলের পাশের রাস্তা অতিক্রম করছিলাম। স্কুল ড্রেস পরা কয়েকজন ছেলেমেয়ের জটলার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওদের কথা কানে আসছিল। অবরোধের কারণে বারবার পরীক্ষা পেছানো থেকেই সম্ভবত ওদের আলোচনা উৎসারিত হয়েছে। এখনও রেশ কাটেনি। বোঝা গেল ওরা বেশ বিক্ষুব্ধ। পরীক্ষা শেষে দেশের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হওয়ায় একজন ভীষণ রকম আহত। এ বয়সে বেমানান হলেও রাজনৈতিক আলোচনা ভর করেছে ওদের বক্তব্যে। হয়তো কিছুটা বুঝে আর কিছুটা বড়দের মুখে শুনে। এ কোমলমতি শিশুরা একপর্যায়ে অনেকটা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমাদের দুই নেত্রী সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল, তাতে আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়লাম। এর পরিণতির কথা ভেবে আতংকিত হলাম। প্রত্যেক জাতির প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গনের মডেল প্রয়োজন। যাদের দেখে, যাদের কথা শুনে উদ্দীপ্ত হবে প্রজন্ম। এগিয়ে যাওয়ার-জয় করার প্রণোদনা পাবে। নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, সব নিপীড়িত মানুষেরই মডেল। মালয়েশিয়ার শিশুরা মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে গর্ব করে-প্রত্যয়ী হয়। আমাদের মতো বয়সীরা সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু অথবা কেউ কেউ জিয়াউর রহমানকে রোল মডেল মনে করে প্রণোদনা খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু এ শিশু-কিশোর প্রজন্ম বড় দুর্ভাগা। তাদের সামনে গর্ব করার মতো কোনো মডেল নেই। আমাদের নষ্ট রাজনীতি তেমন মডেল তৈরি হতে দেয়নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় হতাশার আর কী হতে পারে! আমাদের মহান রাজনীতিকরা যদি দেশপ্রেমের চোখে দূরদৃষ্টিতে না তাকান, তাহলে এ অবস্থা থেকে আমাদের উদ্ধার করবে কে? এভাবে ৭২-এর পাওয়া আর ১৫৪-এ বৈতরণী পাড়ি দেয়া সংকীর্ণ রাজনীতিতেই যদি আমরা আটকে যাই, তবে জাতি হিসেবে আমরা পেছাতেই থাকব।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments